এই উপন্যাসে দুটিই প্রধান চরিত্র। বুড়ি আর ধান। মাঝের আর সব কিছুই উপাখ্যানের মতো ঘুরপাক খায়। যেন ধানকে জাগানোর মন্ত্র ছাড়া তাদের উপস্থিতির কোনো মূল্য নেই।
বুড়ি বলে চলে ফুল না আসা শিমুল গাছের কষ্টের গল্প। পাশের পলাশগাছটা ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। আর শিমুলের শরীরে কোনো উচ্ছ্বাসের চিহ্ন নেই। শেষে ফুল ফোটানোর মন্ত্র জপে পলাশ ফুল। সেই মন্ত্রে ভালোবাসার আবেদন ছিল বলে সাড়া দেয় শিমুল। ফুলে ফুলে ঢেকে যায় তার সমস্ত শরীর।
চিনুয়া আচেবের ‘থিংস ফল এপার্ট’ উপন্যাস যেমন ফেবলস বা উপকথার ঢঙে বর্ণিত হয়েছে, এই উপন্যাসেও সেই নির্মাণশৈলী লক্ষ করা যায়। আসুন উপন্যাসের ভেতরের একটি দৃশ্যে ঢোকা যাক -
যেখানে সে মাটি খুঁড়েছে, মাটিতে তার রক্ত ঝরেছে, সে জায়গাটা খুঁজে পেতে প্রায় দুদিন সময় লাগে। সে চক্রাকারে ঘুরছিল। কিছুটা পেছনের দিকে হেঁটে আগে-পিছে গিয়ে অনেক কষ্টে গর্তটা খুঁজে পেয়েছে।
কতবার ছাইয়ের ঢিবিতে হোঁচট খেয়েছে, কতবার মাথা ঘুরে পড়েছে তার কোনো হিসাব নেই। ক্ষতবিক্ষত সারা গা, ছাইয়ে মাখামাখি। কিছু জায়গায় ছাই ভিজে গিয়ে রস বেরিয়েছে। ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে।...
সে মাটিতে হাত বোলায়। বলে, তুই আমার রক্তে, ঘামে মাখা। আমাকে বাঁচাবি, আমার মান রাখবি।
এভাবে সেই আদি মাতা নিজের রক্তে, ঘামে মাটিকে উর্বর করে তুলতে থাকে। আর অপেক্ষায় থাকে কখন ধানবীজ থেকে প্রাণের অঙ্কুর বেরিয়ে আসবে।
এই উপন্যাসে দেখা মেলে রক্তকরবী নাটকের রঞ্জনের মতো জোবায়ের নামের এক তরুণের। যে বুড়ির স্বপ্নে বারবার হানা দেয়। তাকে কবিতার মন্ত্রে জাগিয়ে তুলতে চায়। জোবায়ের এখানে বিপ্লবী তারুণ্যের প্রতীক। যারা দেশে দেশে প্রতি সভ্যতায় নতুন মানবিকতার পতাকা উড়িয়েছে। ধ্বংস ও যুদ্ধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা জোবেয়রকে এক নতুন মেসিহাই মনে হবে পাঠকের কাছে। সে বলে
ও পারমাণবিক বোমাজোবায়ের ছাড়াও আছে বুড়ির নাতনি মরিয়ম। যার স্মৃতি সুতো ছড়িয়ে আছে পাতায় পাতায়। জোবায়ের যদি স্পর্ধা হয়, তবে মরিয়ম অবশ্যই আশাবাদ। এই দুটো জিনিসের বাইরে আরও এক অনুঘটক প্রয়োজন ধানের গজিয়ে ওঠার জন্য, আর তা হলো প্রেম। অর্থাৎ স্পর্ধা, আশাবাদ আর প্রেম এই তিনেই নিহিত আছে নতুন প্রাণের সঞ্চারের রহস্য। আর সে কারণেই উপন্যাসে প্রেমের উপলক্ষও আছে। তার নাম কবিরাজ। বুড়ির স্বামী। যাকে আদর করে বুড়ি ডাকে কবিগাছ বলে।
খেলা আছে তোমার সাথে,
বরফের গোলা বানিয়ে
ছড়াব তোমায় এন্টার্কটিকায়।
আর কী কত কত চাই?
দরকার নেই তোমার
অহংকার, সংঘাত!
চলে যাও; পরমাণু
ছাড়াই হোক কিছুটা
মাতামাতি, হাতাহাতি।
স্পর্ধা, আশাবাদ আর প্রেম এই তিনেই নিহিত আছে নতুন প্রাণের সঞ্চারের রহস্য।
এই উপন্যাসে ক্লান্ত বিধ্বস্ত বুড়িকেও এক সময় গল্প বলে জাগিয়ে রাখতে চায় ধানবীজ। কারণ বুড়ির বেঁচে ওঠার মধ্যে যে তারও ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে।
ধানশি একটা রাগের নাম। শেষ রাতে গভীর-গোপনে সেই রাগের সুর ঝংকারে পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার হয়। উপন্যাসের শেষ দিকে কবিরাজ বুড়ির স্বপ্নে হাজির হয় সেই রাগিনীর সুরেই।
কবিরাজ তাকে জড়িয়ে ধরে। তার চোখ ছোঁয়, ঠোঁট ছোঁয়, আর সব ছোঁয়। ওর ছোঁয়ায় তার শরীর গলে গলে মাটির মতো হয়ে যায়। সেই মাটিতে কবিরাজ রোপণ করে একটি ধান।
সব মিলিয়ে ধানশি উপন্যাস এক দীর্ঘ কবিতার প্রবাহের মতোই যেন বয়ে যায় পাঠাকের মননজুড়ে। ১১৭ পৃষ্ঠার এই উপন্যাস চট্টগ্রামের কোনো লেখক লিখেছেন ভাবতেই গর্ব হয়। অনায়াসেই লেখক জাহেদ মোতালেবের বই আলহো কার্পেন্তিয়ার বা হুয়ান রুলফোর বইয়ের পাশেই স্থান দেওয়া যায়। তাদের সৃষ্টির পাশে এই আখ্যানও পৃথিবীর জন্য নুতন এক আলোর ইশারা। বাংলা ভাষায় এমন উপন্যাস খুব বেশি লেখা হয়নি। এই বইয়ের অনন্য আরেক দিক সব্যসাচী মিস্ত্রীর অসাধারণ প্রচ্ছদ। এমন বই প্রকাশের জন্য বাতিঘরকে প্রাণঢালা অভিনন্দন।
পড়ুনঃ ধানশি উপন্যাস নিয়ে লেখকের এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার
===============
ধানশি
জাহেদ মোতালেব
প্রচ্ছদ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
প্রকাশক: বাতিঘর
দাম: ২৪০ টাকা
পৃষ্ঠা: ১১৭
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম