নতুন বই প্রকাশের অনুভূতি এবং বর্তমান সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে সাখাওয়াত টিপু কথা বলেছেন গ্রন্থগত ডট কম এর সঙ্গে।
====================
❑ সম্প্রতি আপনার বই প্রকাশিত হলো৷ আপনার অনুভূতি জানতে চাই৷
সাখাওয়াত টিপু : আমি সর্বদা লেখার ভেতরে থাকি। ফলে বই প্রকাশটা আমার জন্য বিশেষ কিছু নয়! আমার মনে হয়, বই প্রকাশ অনুভূতির ব্যাপার নয়, এটা বুদ্ধিবৃত্তিক ইভেন্টের ব্যাপার। যে কোনো লেখা প্রকাশের পর তা লেখকের হাত ছাড়া হয়ে যায়। এক অর্থে, লেখার যেখানে শেষ, সেখানেই ব্যক্তি লেখকের মৃত্যু ঘটে! লেখকের দিক থেকে যে কোনো বই প্রকাশের পর লেখকের নির্দিষ্ট সময়ের চিন্তা কিংবা শিল্পের সমাপ্তি ঘটায়। কিন্তু অন্য পদে চলমান। কেননা বই নানা হাতে নানা চিন্তায় নানা পাঠকের দুয়ারে ঘুরতে থাকে সর্বদাই। আর আর্থিক দিক থেকে উৎপাদন আর উদযাপনের বিষয় এটা! ছাপার পর সেটা প্রকাশক আর পাঠকের বিষয়ে পরিণত হয়। পাঠক কিভাবে পড়ছে কিংবা বিশ্লেষণ করছে বা কি প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে সেটাই হয়তো অবসরে দেখার বিষয়! তাই একজন আপাদমস্তক লেখকের জন্য বই নতুন কিংবা আলাদা ব্যাপার নয়! বই নিয়ে অনুভূতি আপাতত শান্ত আর আনন্দময়!
❑ বই প্রকাশের সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন কীভাবে?
সাখাওয়াত টিপু : আমি ৮ বছর বাংলা কবিতার বই প্রকাশ করিনি। ফলে অনেক লেখা সিন্দুকে জমা আছে। আসলে আমি বাংলা ভাষার ভেতরে আর বাইরে সাহিত্যের নতুন জগত খুঁজছিলাম। তাই বই প্রকাশ করতে দেরি হলো! আমাদের দেশে বই প্রকাশের পদ্ধতি হলো, সারা বছর যা লিখেন তা এক মলাটে রেখে কোনো প্রকারে একটা নাম দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বই প্রকাশ করা। এসব বইয়ের বেশির ভাগ মেলার শেষে নিখোঁজ হয়ে যায়। অ-সম্পাদনার কারণে আবর্জনার স্তুপে পরিণত হয়! কারণ বইগুলোর নামের সঙ্গে অবজেক্টের কোনো সম্পর্ক থাকে না। শিল্পমান থাকে না। আমি অবশ্য তা থেকে মুক্ত! তাই অনেক বছর পর বই প্রকাশ করলাম। ধীরে সুস্থে, রয়ে সয়ে, ভেবে চিন্তে! যাতে সাহিত্যে একটা চিহ্ন রাখা যায়। আমার দুটো বই প্রকাশিত হলো এবার। বাতিঘরের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কবিতাভবন প্রকাশ করেছে ‘রাজার কঙ্কাল’ আর আদর্শ প্রকাশনী করেছে আমার আলোচিত কাব্যগ্রন্থ ‘এলা হি বরষা’। ২০ বছরের মাথায় বইটির তৃতীয় সংস্করণ হলো। বইটির নতুন দিক হলো বিখ্যাত ফরাসি শিল্পী লুক-ফ্রাঁসোয়া গ্রানিয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ! দুজনের যৌথ শিল্প যাপন বলা চলে!
❑ বইটি প্রকাশ করতে প্রকাশক নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয়েছিলো কি?
সাখাওয়াত টিপু : আমি কখনো প্রকাশক জটিলতায় পড়িনি। দেশে-বিদেশে আমার প্রকাশকের অভাব হয়নি! তবে অন্য এক ঝামেলা হয়েছিল একবার! সেবার বই প্রকাশের পর ঝামেলা হয়েছিল বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার ও লেখক নাসির আলী মামুন ভাইয়ের সঙ্গে আমার যৌথ একটা বই আছে। বইটি প্রকাশের পর বাংলা একাডেমি গ্রহণ করছিল না। আগামী প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী ওসমান গনী ভাই বললেন, আমার মেয়ে আপনার বই বাংলা একাডেমিতে জমা দিতে গেল, তারা তো বই গ্রহণ করছে না। ব্যাপারটা ছিলো খুবই দুঃখজনক! বাদ-প্রতিবাদের পর ওরা তিনদিন পর বইটি গ্রহণ করেছিল। সম্ভবত তৎকালীন সচিব ও কবি কামাল চৌধুরী হস্তক্ষেপে এটার সমাধান হয়। বাংলা একাডেমির এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, বইটি কোন ক্যাটাগরিতে রাখবে, সেটার নাকি নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই গ্রহণ করেনি! সেটা ছিল খুবই অপদার্থ আর হাস্যকর যুক্তি! আমার সম্পাদিত আলোচিত এই বইটির নাম ‘চাড়ালনামা’!
❑ নিজের লেখার প্রতি আত্মবিশ্বাস কতটুকু?
যে কোনো মহৎ শিল্পে সব উপাদানই সুষম হতে হয়
সাখাওয়াত টিপু : আত্মবিশ্বাস নিয়ে অতো ভাবি না। ভাবলে সময়ের অপচয় হয়। তারচে নতুন আইডিয়া বা শিল্পের নতুন অর্গল খোলা নিয়ে চিন্তা করা ভালো। কারণ একজন প্রকৃত লেখকের আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন হয় না! পুষ্প তার আপন গুণে ফোটে! জোর করে ফোটানোর ব্যাপার নাই। যে কোনো মহৎ শিল্পে সব উপাদানই সুষম হতে হয়। সুষম না হলে বিস্বাদ হয়! কোনো একটি উপাদান কম হলে সেই শিল্প মহৎ হতে পারে না কখনো। সবচে বড় কথা, একজন শিল্পীকে প্রথমত সৎ, দ্বিতীয়ত সৎ, তৃতীয়ত সৎ হতে হবে। অসৎ পথে আপোষ করে কখনো বড় শিল্পী হওয়া যায় না। আর সাময়িক ক্ষমতার বুদবুদ দিয়ে শিল্পে টিকে থাকা কঠিন।❑ কবিতাই কেন লিখলেন? ভাব প্রকাশের জন্য শিল্পের আরও তো মাধ্যম আছে।
সাখাওয়াত টিপু : আমি রাজনীতি করি না, তাই কবিতা লিখি। রাজনীতিবিদ হলে কবিতা লিখতাম না। তবে প্রথাগত রাজনীতিতে আমার আস্থা নাই, সেটাও বড় কারণ। দর্শনের জগত বলে, মানুষ মূলত ভাষার দাস। জগত পাল্টাবার ভাষা সৃষ্টি হয় সাহিত্য থেকে। এমন কি রাজনীতির ভাষাও! কবিতা তার একটা মাধ্যম মাত্র! কবি কিংবা সাহিত্যিকরাই তার রূপকার। তবে আমার মনে হয়, কবিতা না লিখলে রক্ত দূষিত হয়ে যেত! আর কবিতা রচনায় ভাষা কিংবা চিন্তার অপচয় কিংবা অবচয় কম হয়! ফলে কবিতা লেখা আরামদায়ক। অধরাকে ধরতে কবিতার জুড়ি মেলা ভার। অল্পকথায় কালেক্টিভ কনসাসনেসকে ধরা যায়! ঠিক তেমনি শিল্পের দরকারে ব্যক্তির সকল আনকনসাস জায়মান থাকে ভাষার প্রতীকে!
❑ অনেকে বলেন লেখার ক্ষেত্রে প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে আপনারা প্রস্তুতির কথা জানতে চাই।
সাখাওয়াত টিপু : স্বল্প পরিসরে বলে শেষ করা যাবে না। আমি এতোকিছুর ভেতর দিয়ে গেছি, তার কোনো সরল পথ ছিল না। কেউ সহসা এসে আমাকে এক বিন্দু জায়গা ছেড়ে দেয়নি। দেশে-বিদেশে সেটা আমাকে অর্জন করতে হয়েছে নতুন বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা দিয়ে, নতুন কবিতার উন্মেষ ঘটিয়ে। বস্তুত মানুষ কবির সৌন্দর্যটা দেখেন। একজন কবির ভেতরের রক্তক্ষরণ আর কষ্ট অনুধাবণ করা সাধারণ পাঠকের পক্ষে সম্ভব নয়! সহজ ভাবে বললে, পৃথিবীর তিন ভাগ জল। নানা সময়ে এই জল আমাকে ডিঙাতে হয়েছে! তারপর একটা স্থল পেয়েছি হয়তো। এখন আমি সহজ পথে আছি। সহজ মানুষের পথে! তবে মাঝে মাঝে মনে হয় আমি জন্মগতভাবেই একজন কবি ও দার্শনিক! দুটো জিনিসই আমার ভেতরে অচেতনে ধরা দেয়! তার বাইরে আপাতত ভাবনা নাই। কবিতা না লিখলে কি করতাম আমি জানি না। এখন তো মনে হয়, ক্ষুদ্র আমি পৃথিবীর মানুষের একজন, যার কোনো সীমানা নাই।
❑ পাণ্ডুলিপি গোছানোর ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন?
সাখাওয়াত টিপু : আমাদের দেশে বইয়ের সম্পাদনার মান গড়পরতা। মানে প্রকাশনার জগতে আমাদের ভালো সম্পাদক খুবই কম। লেখকরা সম্পাদনার ক্ষেত্রে নিজের চয়েসের বাইরে যেতে চান না। প্রকাশকরা সম্পাদনার জন্য যথাযথ বিনিয়োগ করতে চান না। প্রকাশক আর লেখকের দিক থেকে এটা বড় সীমাবদ্ধতা! এই সংকট কাটিয়ে না উঠলে বাংলা সাহিত্য আগাতে পারবে না। আমি নিজেও জাতীয় সাহিত্য ও নতুনধারা সম্পাদনা করেছি। এখন দূর থেকে সে সব সম্পাদনার দুর্বল দিকগুলো দেখতে পাই। আমার নিজেরও হাসি পায়! বিদেশি পত্র-পত্রিকায় লেখাপত্র ছাপা না হলে হয়তো আমাদের দেশের গৎবাঁধা সম্পাদনা নিয়েই তুষ্টি থেকে যেত আমার! ‘রাজার কঙ্কাল’ আর ‘এলা হি বরষা’ নতুন সম্পাদনার কিছুটা ছাপ আছে। আসলেই সম্পাদনার ব্যাপারটাই ভালো রন্ধন শিল্পের মতো। কোনো একটা উপাদান কম হলে সেটা বিস্বাদ হয়ে যায়!
❑ শিল্প না কি পাঠক, আপনার দায়বদ্ধতা কার কাছে?
এগুলো হচ্ছে শিল্প হয়ে ওঠার প্রধান শর্ত!
সাখাওয়াত টিপু : শিল্প ও পাঠক পরস্পর বিরোধী নয়! পাঠক হচ্ছে যে কোনো বইয়ের জন্য বাতাস। যিনি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওল্টান। পাঠকহীন শিল্প বলে জগতে কিছুই নেই। প্রথম দায়বদ্ধতা নিজের চিন্তা কাছে, ভাষার কাছে, বাক-স্বাধীনতার কাছে, নিজের দর্শনের কাছে, নিজের ভাবের কাছে, নিজের সময়ের কাছে! এগুলো হচ্ছে শিল্প হয়ে ওঠার প্রধান শর্ত! পরের স্তরে শিল্পের দায়টা পাঠকের কাছে। ফলে সমকাল মাড়িয়ে ভবিষ্যতের দিকে শিল্প ও পাঠক পরস্পর হাত ধরাধরি হাঁটে। শিল্পের কাজ নয় পাঠকের সন্ধান করা। পাঠকের সম্বন্ধ স্থাপনের কাজটা প্রকাশকরাই করেন। পাঠক একটা বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যাপার! পাঠক তার প্রয়োজনেই শিল্পের সন্ধান করে নেবে! শিল্পও পাঠকের কাছে ধরা দেবে। তবে আমি আমার পাঠকদের ভালোবাসি!❑ একজন পাঠক হিসেবে যখন বইটি দেখছেন/পড়ছেন, তখন বইটিকে কেমন মনে হচ্ছে?
সাখাওয়াত টিপু : আমি নিজের প্রকাশিত বই পড়ি না আর। লেখার সময় যে মুগ্ধতা বা ঘোর প্রতিক্রিয়া করে, প্রকাশের পর সেটা আর থাকে না। কদাচিত কোনো লেখা ভালো লাগে। তবে এমন দিনও গেছে, একটা ভালো লেখা পয়দা হওয়ার পর তিনদিন চিন্তা কাজ করে না আর। আবার একটা ভালো লেখার হয়ে ওঠার পর সবকিছুতে অবশানন্দ হয়! নিজের লেখা নিয়ে যদি নিজেই মুগ্ধ থাকি, তাহলে নতুন কিছু লেখা বা নিজের লেখা পুনঃসম্পাদনা সম্ভব নয়! মানে আমি নিজের লেখাকে খুব ক্রিটিক্যালি দেখি!
❑ অধিকাংশ লেখক বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশ করে, বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
সাখাওয়াত টিপু : বই তো শুধু মেলার ব্যাপার নয়! ভবিষ্যত সময়ের ব্যাপার। আমাদের দেশে উৎসবকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশটা একটা প্রথা হয়ে গেছে। এটা কম অগ্রসরমান সমাজের চেহারা। প্রকাশনা যদি পূর্ণ শিল্প-প্রকল্প হিসেবে দাঁড়ায় তবে এটার দ্রুত পরিবর্তন ঘটবে। এটা ঠিক, মানুষকে টিকে থাকলে হলে জ্ঞানের কাছে ফিরে আসতে হবে। কারণ না জানলে, চিন্তা না করলে, বই না পড়লে আধুনিক অবক্ষয়ী, জটিল পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকে থাকা সম্ভব নয়!
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম