কবি সাজ্জাদ সাঈফের "বহুদিন ব্যাকফুটে এসে" কাব্য সম্পর্কে তাসকিন আমিনুল হক

কবি সাজ্জাদ সাঈফের "ব্যাকফুটে এসে দেখা" কাব্য সম্পর্কে তাসকিন আমিনুল হক
কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা-মায়ার মলাট-ভাষার সি-বিচে শিরোনামে তিনটি পাঠকপ্রিয় কাব্যের পর কবি সাজ্জাদ সাঈফ এনেছেন 'বহুদিন ব্যাকফুটে এসে' কাব্যটিকে, একুশে বইমেলা, ২০২০-এ।

এই তরুণ কবির শব্দযোজনার দক্ষতা সম্পর্কে তার পাঠকমাত্রই ওয়াকিবহাল। এবার কবিকে পাওয়া গেলো ছন্দের কাজে, বিশেষত অক্ষরবৃত্তে অন্ত্যমিলযোগে। সার্বিকভাবে কবির লেখনী সময়কে রিপ্রেজেন্ট করে এবং উৎরে যাবার তাগাদা নিয়ে হিলহিলিয়ে যান ক্রমে মৃত্যুচেতনায়-
'যাবার কথা হিলহিলিয়ে, যেনো শনপাপড়ির বাকশো ভর্তি লাল- যাত্রাপথে মুখ ঘুরিয়ে অশ্রু লুকাবে কেউ?
গাল বেয়ে নামে রোদ, ফিরে যায় বাগানে আবার-
কোথাকার জল আমি কোথায় নেমে, গড়িয়ে গিয়েছি ভেসে!'
সামাজিক কাঠামোর চলমান বাস্তবতাকে আঘাত করেছেন স্বীয় ইমেজারি দক্ষতায়-
'সুনীতির শাঁস খেয়ে গেছে চালাক বাদুড়ে, তবু দেখি তুমি
পৃথিবীকে ডাকো আনন্দ-নার্সারি'

'মনে হয় গলা কেটে মরি, তোমাদের রাজার ভিটায়'
সর্বান্তকরণে এই কবির সেরা পুঁজি হলো ইতিহাস-মিথ-স্মৃতি সমন্বিত আবহাওয়া আর নিজস্ব ফরম্যাটে বাক্য বিন্যাস। এখানে প্রেম-পরিণয়-নস্টালজিয়া-রাজনীতি-অসাম্প্রদায়িকতা-আত্মজৈবনিকতা-নিরাশা-দ্রোহ কিছুই প্রেডিক্টেবল নয়, সাজ্জাদ সাঈফের লেখার ধারাবাহিকতা খেয়াল করলে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে তিনি সিকোয়েন্স ধরে ধরে এক এক বইয়ের কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। নিজস্ব বাচনভঙ্গি আর প্রাকৃতিক চড়াই উৎরাই সহযোগে এই কবি নিঃসন্দেহে একজন সাধক। ব্যক্তিজীবন-পেশাজীবনের কোথাও কিছু বাদ যায়নি কবিতায় অনায়াসে শিল্পিত হয়ে লিপিবদ্ধ হতে। কন্টেন্ট বিচারে আমরা এই কবির যাত্রাপথকে রাশান কবি পুশকিনের কাতারে রাখতে পারি দ্বিধাহীন ভাবে।
'কেনো তবে বলো আধাআধি বাঁচা? করুণাগাত্রে হাত?'

'সমস্ত গানের ভিতর এক এক করে ঢুকে যাচ্ছে রাস্তার হর্ন'

'আমাদের গেরস্থ-ফুল ফুটে আছে কুপির আলোয়'
বইটি কবির চতুর্থ কাব্য। চিত্রকল্পের প্রয়োজনে দৃশ্যের অনালোকিত স্পেসগুলিকে নিবিড় দৃষ্টিতে ভিড়িয়ে আনেন কবিতায় যা অনেকাংশেই সাজ্জাদ সাঈফের নিজস্ব বাচনভঙ্গিকে স্পষ্ট করে ক্রমে, মালার্মের প্রতীকি মেজাজপূর্ণ কবিতার ধারণাকেও অনেকাংশে উতরে যেতে দেখা যায় কবিকে-
'রাত শেষে তা দেয়া ডিম রেখে, উড়ে যাচ্ছে কোকিল
উড়ালে গুটানো পায়ের নিচে দেখে নেয় হাট-বার;'

'বিভীষিকা তবে এক জ্বর
হাম-নিঃশ্বাস ফুলে ফুলে ওঠে শিশুদের ফুসফুসে'

'এখন উনিশ সাল, মৃত্যুরহস্যের মতো ভারী একটা হৃদয়ে
রোপিত হলো আত্মসংবরণ!'
প্রকৃতি ও জীবনকে ঘনিষ্ঠ হয়ে নিরীক্ষণ করেন এই কবি। খুব সূক্ষ্ম বস্তুও চারপাশে পড়ে থেকে উঠে আসে কবিতায়, আর সেইসাথে সাঈফীয় চিত্রকল্প বিবৃত হয় অনায়াসে, স্বরূপে। প্রেমকে দেখি সত্যের মতো স্বস্তি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় পঙক্তি হতে পর্বে, ও পয়ারে...
'ছায়াযোগ হলে মানুষের একা মন
স্মৃতি-ঘাই-দিশা টের পায়, গায় নাকি?
ডাল-ভাঙ্গা ঝড়ে, রাত্রি করাল-মুখর
ঘাস-ফুলেদের দেখা পাবে জোনাকী?'

মনে ঝরে আজকে যেমন ইয়াসিন-সুরা-ভোর
আয়াতের মাঝে চুপচাপ এসে শান্ত হচ্ছে রুকু
মা'কে ডাকে এক হারমোনিকায়, নিরালা ভাঙার শোর
বাতাস জানে না, বাতাস পাবে না পাতা-স্নান-ঝিরিটুকু?'
আমরা শিল্পীদের বাস্তবতা বাহির হতে আর কতোটা বুঝি? কাজের ভিতরেই শিল্পীর আত্মপরিচয়। এই কবি তাই বহিরঙ্গ দেখে তাকে একটা চেনা ছকে ফেলার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বিদ্রুপ করতেও দেখিয়েছেন মুন্সিয়ানা-
'লোকে ঘাড় তেড়া করে দ্যাখে, টিপ্পনী কাটে-
আমার চাহনী থেকে আন্দাজ করে নিতে চায়, রক্তের সকল ব্যামো;
এর হয়েছেটা কি!'

‘সহকর্মীর ঠাট্টা ও পরিহাস মেশানো হাসি, মেনে নিবো আর ক'টা দিন!'


ফিরে গিয়েছে্ন নিজের ভিতরে হাত উঁচিয়ে ডাকা শামুকের আহ্বানে, উপেক্ষাকে ত্রাস ভাবেন না তিনি
এক সময়কার আবেগ মথিত ব্যক্তিসত্তা সমাজ সংসার আর বিশ্বায়ন বিচারে নিজেকে প্রবোধ দিতেও স্যাটায়ারকে আশ্রয় করে নিমেষেই। সাজ্জাদ সাঈফ দশক বিচারে বাংলাদেশের ১ম দশকীভূত হয়েও স্বেচ্ছায় সাধন-পর্বকে কিছু নিবিড় সময় দিতে চেয়ে ২য় দশকে এসে বসে গেছেন আসন গেড়ে। শুধুমাত্র নিরালা সাধনাকে টার্গেট করে পিতৃনিবাস ছেড়ে যাপনের উপযোগী আকারে স্থান দিয়েছেন মফঃস্বলকে, যাপন নির্বিশেষে এইটা এই কবির আত্মনির্বাসন, এতে মেধার লগ্নিতে পুঁজিপতি হবার সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়ে সচেতনভাবেই রাজধানীকে (ঢাকাকেন্দ্রীক সাহিত্যের দল-উপদল খেলা) ওভারলুক করে ফিরে গিয়েছে্ন নিজের ভিতরে হাত উঁচিয়ে ডাকা শামুকের আহ্বানে, উপেক্ষাকে ত্রাস ভাবেন না তিনি, আর এই মতাদর্শকেন্দ্রিক কবিত্বকে এক প্রকার শিল্প-জেদ হিসেবে তাড়িত হতে দেখা যায় কবির আদি অন্তে, কামুর আউটসাইডার যেনো কবি নিজের ভিতর পুষে যাচ্ছেন দিনকে দিন-
'এই যে ফাঁপর, নামছে বুকে; থামছে সিঁড়ির ধাপ-
প্রসঙ্গ ফুল, কাঠের পুতুল, হাওয়ার মনস্তাপ;'

'কি আসে যায়, অবিন্যাসে, উপেক্ষা-ত্রাসে'

'তিথি জুড়ে নকশাকাটা তারা
যেনো আকাশ, তাম্রলিপির খাতা;

'লিখে দিলাম গোলাপবর্ণ গান-'
বিচিত্র না? শুধু বিচিত্র নয়, নতুনও, যেনো বইটা চিত্রনাট্যের এমন সব বিচিত্র জারক পঙক্তির বক্তব্যে আগাগোড়া নতুন প্রায় আশিভাগেই। সমকালীন কবি অগাস্টিন গোমেজ, মাসুদ খান, জুয়েল মাজহার, জহরসেন, জয় গোস্বামীদের, মজনু শাহ, সাখাওয়াত টিপু, শামীম রেজা, শামীম কবীরদের অভূতপূর্ব উত্তরসুরি কবি সাজ্জাদ সাঈফ। একই সাথে বিজ্ঞান আর সচিত্র লেখনীকে এই কবির তুরুপের তাসই বলা যায়। নিজেকে সামান্য মিস্ত্রী ভাবেন ভাষার। বাংলা কবিতার এই অনাবাদীপ্রায় (হাতে গোনা গুটিকয় বাদে যখন প্রায় সবাই ট্র্যাশ) মৌসুমে গড়পড়তা লেখার জঙ্গল হতে সুদূর মফঃস্বলে থেকে গিয়ে এই প্রিয় কবি একের পর এক ক্লাসিক ঘরানার মুখে এনে আলো ফেলছেন কবিতার।

'তোমাকে ভাষার মিস্ত্রী ভেবে সেই সকাল থেকে খুঁজছে স্বরবর্ণ;
ঠান্ডায় সিটকা লেগে আছে দন্ত্য ধ্বনিরা!'
-ভাষার সি-বিচে(১৫)

ব্যক্তিজীবনে একদমই সাদামাটা ও পেশাজীবনে সংবেদী মানসিকতার এই কবির সাথে যোগাযোগ ক্ষীণ হলেও তাঁর কবিতা এক প্রকার হিপনোটিজমের মতো গ্রাস করে সমস্ত অপরিচয়কে, ম্যাসেঞ্জার মারফত কথা বিনিময়ের সুবাদে কবিকে পাঠোত্তর দেখি যেনো আত্মার ছায়ায় সুনিবিড় কানেক্ট করে যায় তাঁর কবিতা। যে কোনো উপায়ে পাঠক অব্দি পৌঁছাক কবি-কৃতি ‘বহুদিন ব্যাকফুটে এসে’, এতেই বাংলা কবিতার নতুন এই স্বর খুঁজে পাবে কবিতাপ্রেমে ঋদ্ধতম পাঠক-হৃদয়কে।

*
লেখক
তাসকিন আমিনুল হক
প্রভাষক, বাংলা বিভাগ
আইডিয়াল ল্যাবোরেটরি কলেজ, ঢাকা।

============
বহুদিন ব্যাকফুটে এসে
সাজ্জাদ সাঈফ

প্রকাশক- বুকিশ পাবলিকেশন্স
প্রচ্ছদ- নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
পৃষ্ঠাসংখ্যা- ৩২
মূল্য-৭৫টাকা
ISBN: 978-984-34-8927-2

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ