সম্প্রতি প্রকাশিত বই প্রসঙ্গে সাজ্জাদ সাঈফ এর সাক্ষাতকার

সম্প্রতি প্রকাশিত বই এবং নিজের সাহিত্যজীবন প্রসঙ্গে সাজ্জাদ সাঈফর সাক্ষাতকার
২০২০ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলাতে প্রকাশিত হয়েছে সাজ্জাদ সাঈফ'র কাব্যগ্রন্থ "বহুদিন ব্যাকফুটে এসে", প্রকাশ করেছে বুকিশ৷, এর আকর্ষণীয় প্রচ্ছদটির পরিকল্পনা করেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। বইটির মূল্য মাত্র ১৩৪ টাকা। পাওয়া যাচ্ছে বইমেলার ৬০৭ নম্বর স্টলে।

নতুন বই প্রকাশের অনুভূতি, নিজের সাহিত্যজীবন এবং বর্তমান সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে সাজ্জাদ সাঈফ কথা বলেছেন গ্রন্থগত ডট কম এর সঙ্গে।
====================

❑ সম্প্রতি আপনার বই প্রকাশিত হলো৷ আপনার অনুভূতি জানতে চাই৷

:: সম্প্রতি বললে প্রকাশিত ও অতি সম্প্রতি প্রকাশিতব্য দুটি বইয়ের কথা প্রসঙ্গক্রমে আসতেছে। এক) ভাষার সি-বিচে আর দুই) বহুদিন ব্যাকফুটে এসে। পশ্চিমবঙ্গে কবি ও দীর্ঘদিনের সুহৃদ জুবিন ঘোষ তাঁঁর গিলগামেশ হতে মাস দুয়েক আগে প্রকাশ করেছেন, বইটি কলকাতা সফর শেষে দুয়েকদিনের ভিতর ঢাকা বইমেলাতেও আসতেছে, এর সুবাদে মিশ্র অনুভূতি যেমন এখানেই প্রথম আমি ছন্দে কিছু কাজ করেছি, এখানেই নিজেকে পরিচয় করিয়েছি বাংলা ভাষার একজন অতি সাধারণ শ্রমিক যে কিনা বাংলা ভাষার সাহিত্যে যে কোনো কাজই ঘাম ঝরানো শ্রম লগ্নি করে করে। আর দু চারদিনের মধ্যে আসতে যাওয়া 'বহুদিন ব্যাকফুটে এসে'তে আত্মজিজ্ঞাসা, গ্লানির উপাসনা, জাতীয় জীবনের বিপর্যয় নিয়ে কর্তাব্যক্তিদের কামখেয়ালি পশুত্ব উন্মোচনের চ্যালেঞ্জ থেকে গেছে একে একে।

❑ বই প্রকাশের সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন কীভাবে?

:: এর উত্তরে প্রাসঙ্গিকভাবেই অনেক বিষয় আলোচনার দাবী রাখে। তবে বই করার সিদ্ধান্ত মূলত সবসময় নিয়ম করে হয় না, সিচুয়েশন ডিমান্ড একটা ইস্যু অবশ্যই।

❑ বইটি প্রকাশ করতে প্রকাশক নিয়ে জটিলতায় পড়তে হয়েছিলো কি?

:: না, তবে ২য় কাব্য 'মায়ার মলাট'' যদিও প্রকাশক সৌজন্য করে বিনে পয়সায় করে দিয়েছিলেন কিন্তু ১ম সংস্করণ হিসেবে একদমই অল্প সংখ্যক বই তিনি বাজারে এনেছিলেন যারপরনাই উদ্বেগ উৎকণ্ঠার ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে আমাকে দীর্ঘ একটা সময়। তা বাদে ১ম-৩য়-৪র্থ বই করতে প্রকাশকদের পেশাদারিত্ব আর আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধই করেছে বলতে পারেন।

❑ নিজের লেখার প্রতি আত্মবিশ্বাস কতটুকু?

:: নিজের লেখালিখি নিয়ে আমি বরাবরই খুঁতখুঁতে, বলতে পারেন অবসেসিভ, তবে কোনো ভাবেই নার্সিসিজম নাই লেখার বিষয়ে আমার। বই করার আগে সারাবছরে লিখিত সব লেখা যতটা সম্ভব রি-ওপেন করে ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড এগোতে হয় আমাকে, এটা শুরু হতেই অভ্যাস আসলে। তবে আমার কাজ নিয়ে আমি বরাবরই আত্মবিশ্বাসী।

❑ কবিতাই কেন লিখলেন? ভাব প্রকাশের জন্য শিল্পের আরও তো মাধ্যম আছে।

সে সব অনেক আগের কথা, বার্নাড শ আর শেকসপিয়ার দ্বারা খুব বেশিই প্রভাবিত হয়েছিলাম কিশোরকালে, সত্যজিৎ তো ছিলেনই
:: এর উত্তর বহুবিধ হতে পারে তবে আমি একটা সময় পর্যন্ত ছবি এঁকেছি যা মেডিকেল কলেজ জীবনেও অন্যদের প্রতিক্রিয়ায় উদ্বেল হতো। পরে আঁকা ছেড়ে দিই তবে একদম সেপারেশন নয় কেননা আমার ঘরে কন্যা সবচেয়ে ভালো যে কাজটা পারে তা হলো আঁকা, এছাড়াও খুব ছোট বয়সে প্রায় পিঠাপিঠি সহোদর-কাজিনদের নিয়ে প্রায়ই মঞ্চ নাটক প্র্যাক্টিস করার রেওয়াজ ছিলো এবং যথারীতি নির্দেশনাটা আমার জন্যই বরাদ্দ থাকতো যার সুবাদে মেডিকেল কলেজে ১ম বর্ষেও ব্যাচ প্রোগ্রামে অভিনয় করেছিলাম নাটকের মূল চরিত্রেও। সে সব অনেক আগের কথা, বার্নাড শ আর শেকসপিয়ার দ্বারা খুব বেশিই প্রভাবিত হয়েছিলাম কিশোরকালে, সত্যজিৎ তো ছিলেনই। তবে কবিতাকেই লাস্টলি সাথে নিয়ে একটা পাগলের জীবন যাপন করে আসাটা আমার নিজের জন্য যতোটা না তার অনেকগুণ বেশি ভূমিকা আমার প্রফেশনের যেহেতু অন্য মাধ্যমগুলি অপেক্ষা আমি কবিতাতেই স্বচ্ছন্দ ছিলাম অধিক। ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলতেন 'কবিতা আর সব শিল্প-মাধ্যম হইতে উত্তম দার্শনিক শিল্প''। রোমানরা তো আরেক কাঠি সরেস আছিলো- কবিকে বলতেন নবী (ভাটেস); অর্থাৎ তিনি স্বর্গীয়, তিনি ভবিষ্যৎবক্তা এবং তিনি প্রেরিত পুরুষ। যা-হোক ভাষার মূল জায়াগাটা হইলো এর মাধুর্য, আর কবিতাতেই একটি ভাষার মাধুর্য সর্বাপেক্ষা আদর্শ মনে করি আমি।

❑ অনেকে বলেন লেখার ক্ষেত্রে প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে আপনার প্রস্তুতির কথা জানতে চাই।

:: হ্যাঁ নিশ্চয়ই, লেখার জন্য প্রস্তুতি বা স্কুলিং আবশ্যক। সেই প্রস্তুতি কখনো যাপনে, কখনো পর্যবেক্ষণে, কখনো অধ্যায়নে সম্পন্ন হয়। আমি আগেই সারেন্ডার করেছি এই বলে যে- আমি বাংলা ভাষার একজন সামান্য মিস্ত্রীমাত্র। আমার প্রস্তুতির পর্ব চলমান, সম্পন্ন হয় নাই এখনো। এলাকায় তৎসময়ে হায়েস্ট জিপিএ পেয়ে শেষে যখন পাহাড়-সমান প্রতিযোগিতায় মেডিকেল কলেজে লিস্টেড হলাম তখনো ঢাকা থেকে চার লাইনের একটা কবিতা পকেটে নিয়া আসছিলাম বগুড়ায় ওরিয়েন্টেশনের দিন। প্রথম পরিচয় হইলো যে ব্যাচম্যাটের সাথে সে নিজেও বগুড়ার ইতিহাসে অন্যতম সেরা ছাত্র এবং একজন কবি ডাঃ তানভীর হোসেন। 'নতুনদের ভিতর (যেহেতু নবীণ বরণ) একজন কেউ মঞ্চে আসো'- বলে যখন সে সময় আমাদের এনাটমির জাঁদরেল সহকারি অধ্যাপক ডাঃ শাহজাহান সরকার স্যার (বর্তমান অধ্যক্ষ এবং অধ্যাপক-এনাটমি, টিএমসি) ডাকলেন তখন সদ্য পরিচিত তানভীর এক প্রকার ঠেলে আমাকেই মঞ্চে পাঠিয়ে দিলো। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর কবিতাটিও পড়ে ফেললাম আর তুমুল করতালি, তানভীর নিয়ে গেলো লেখক চক্রের আড্ডায়, শুরু হলো উদ্দাম পড়াশুনা (লিটারারি), পত্র-পত্রিকা, লিটলম্যাগের প্রতিষ্ঠান-বিরোধ চর্চা... দিনের পর দিন ক্লাসিক লিটারেচারে ডুবে থাকা, মেডিকেলের পড়াশুনা গেলো উচ্ছন্নে, পরিবারে উদ্বেগ। মা চট করে একদিনের জন্য এসে নিয়ে গেলো দুই বস্তা পরিমান ক্লাসিকস, ছফা থেকে শুরু করে ফুকো, ইলিয়াস থেকে মণীন্দ্র গুপ্ত, মাহমুদ থেকে মির্জা গালিব। এতে অবশ্য জোঁকটা নামেনি রক্ত হতে, কবিতায় আসক্ত জোঁক, কত যে ম্যাডনেস, বিয়ে-কন্যা-স্টাডি সব লেজে গোবরে হয়ে মগজ আঁকড়ে থাকলো শুধু কবিতা। ফারুক সিদ্দিকী, কিংবদন্তী সম্পাদক, বিপ্রতীক করেন, তাঁর ছিলো সোরিয়াসিস, আর ছিলো রাজ্যের যতো তামসিক নিসর্গের কথামালা। অমিত রেজা চৌধুরী ভাই, আরিফ রেহমান ভাই, সুপান্থ মল্লিক ভাই, এমরান কবির ভাই, অনন্ত সুজন ভাই, তালাশ তালুকদার, সরফরাজ স্বয়ম, ফখরুল আহসান, ড্যারিন পারভেজ ভাই, মাহমুদ পিন্টু ভাই, সুলতান স্যান্নাল, উত্তম মণ্ডল, আমিনুর আকাশ, অচিন্ত্য চয়ন, প্রান্তিক অরণ্য ছাড়াও তখনো একাত্ম ইসলাম রফিক ভাই, শিবলী মোক্তাদির ভাই, হাসান সিরাজ ভাই... প্রেসে পত্রিকায় বুঁদ এক একটা দুপুর-রাত, বালিশের পাশে ভুতুমভগবান-নদীকূলে করি বাস-খোয়াবনামা-হিমু, বিকালে প্রতিদিনকার রণজিৎ দাশ-মৃদুল দাশুগুপ্ত-সিকদার-উৎপল নিয়া অমিত ভাইয়ের ছন্দ আর ইমেজ-শাসন, আর এডভোকেট কাম কবি ফখরুল আহসান মানেই বুলেটের মতো মুখস্থ অনুবাদে লোরকা, মার্কেজের নির্জনতা, আউটসাইডার... পরে ২০০৭ এ একবার 'ঈক্ষণ' সম্পাদনার সুযোগ করে দেন ভ্রাতৃপ্রতীম প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক সুপান্থ ভাই, এরপরে বেশ কিছুকাল প্রতিহিংসার কবলে মানসিক বিপর্যস্ততা এবং একসময় সবকিছু গুটিয়ে আবার একাডেমিক মনোনিবেশ এবং কহতব্য সৌন্দর্য-শোভিত এমবিবিএস রেজাল্ট... প্রস্তুতি খুব সুখের ছিলো না আবার পরবর্তী বিবিধ পারিবারিক-পেশাগত ছকে নিজেকে আটকে রেখে একলা হয়ে বই প্রকাশের দিকে ধাবিত হওয়া...এই আর কি!

❑ পাণ্ডুলিপি গোছানোর ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন?

:: পান্ডুলিপি বিষয়টা আমার কাছে লোমহর্ষক; কেননা আমার পেশা আর প্যাশান দুই মেরুর দুই মহাযজ্ঞ, দুইকে এক করে প্রতিটি দিনই কিছু পড়া কিছু লেখা আবার সেই লেখাকে ফেলে রেখে দিনের পর দিন চুপচাপ নিজের সাথে বোঝাপড়া, এক পর্যায়ে কোনো এক সেন্ট্রাল পয়েন্টে (হতে পারে প্রাগৈতিহাসিক কোনো শিলালিপির টাচ অনুভূত হওয়ামাত্র ইতিহাস ঘাটাঘাটি, হতে পারে সিম্পল জনরোষ, হতে পারে একটি মাত্র কাঁটার আঘাত সয়ে গোলাপ থেকে সরিয়ে নেয়া হাত আর সেই হাতে কাস্তে-কোদাল, মেয়ের স্কুল ফিস বাঁকি পড়া, মায়ের সারারাত ছলছল চোখ, ববিতাকে হাশিখুশি/অথবা কোনো অসুখে আক্রান্ত দেখতে পাওয়া বা ইয়েমেন) ইমাজিনারিতে ছকবদ্ধ করতে পারার যথার্থ ইঙ্গিত পেলে তবেই আমি বইয়ের পান্ডুলিপি গোছাতে শুরু করি। তাঁর আগেও না তাঁর পড়েও না কেননা হতেই তো পারে এই নিঃশ্বাস আমার শেষ নিঃশ্বাস মানুষের পৃথিবীতে।

❑ শিল্প না কি পাঠক, আপনার দায়বদ্ধতা কার কাছে?

:: শিল্পকে তো বটেই কবির জন্য যাপিত মননে যুক্ত রাখতে হয় অভিজ্ঞতার মিশেল, আর কে না জানে একজন অধ্যাবসায়ী কবির অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ হতে শুরু করে একজন পাঠক হিসেবেই, মানে স্কুলিং ফর পোয়েসি শিল্প এবং পাঠক দুয়ের কাছেই, এবং আমিও কবিতা সেটাই সাধন করতে চাই বারবার

❑ একজন পাঠক হিসেবে যখন বইটি দেখছেন/পড়ছেন, তখন বইটিকে কেমন মনে হচ্ছে?

:: একজন পাঠক হিসেবে বইটি দেখে আমি প্রথমেই এর ব্যাতিক্রম সংযোজনের খোঁজ করবো। পেলে সে অনুযায়ী কবির দৃষ্টিভঙ্গীর কাব্যিক প্রকৌশল ধরে ধরে খোঁজ করবো কবির অন্তঃকরণকে। একজন প্রকৃত কবির  অন্তঃকরণ হতে উৎসারিত।

❑ অধিকাংশ লেখক বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশ করে, বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

:: বইমেলাকে আমি বই বিপণনকেন্দ্র হিসেবেই দেখি, আরে কোনো বিপণনের আশে পাশে ফুচকা, ফাস্ট ফুড আর জাঙ্ক মাছির উৎপাত তো থাকবেই। তবে পজিটিভলি দেখলে এ এক অনবদ্য মিলনমেলা হবার দাবীদার সমস্ত সুস্থ প্রগতিবোধকে একাত্মবোধে অভ্যস্ত করে। কিন্তু একুশের মেলায় আদৌ কি তা হয়?

===============
বহুদিন ব্যাকফুটে এসে
সাজ্জাদ সাঈফ
প্রকাশক: বুকিশ৷
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ