বিরুন-আল-রশিদের উপন্যাস 'হলনা আকাশ ছোঁয়া': বৃন্তচ্যুৎ এক ফুলের গল্পঃ সৌমেন দেবনাথ

বিরুন-আল-রশিদের উপন্যাস 'হলনা আকাশ ছোঁয়া
ছন্দে ছন্দে লাভ ডিবেট দিয়ে উপন্যাসের যাত্রা শুরু। যেখানে মেয়ে পক্ষের নেতৃত্বে থাকে প্রেম বিশেষজ্ঞা নীলা আর ছেলে পক্ষের নেতৃত্বে থাকে সেরা ছাত্র বিষাদ যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ। এক পর্যায়ে মেয়ে পক্ষের ওরাই বিষাদকে নিয়ে নীলাকে জড়িয়ে মশকরা করে। নীলা রাগ করে চলে যায়। পরে বিষাদ নীলাকে বুঝিয়ে বলে শান্ত করে। নীলারা শিক্ষিত পরিবার, অঢেল সম্পত্তির মালিক, রাজনৈতিক  পরিবার, ভিলেজ পলিটিক্স করে, হাই সোসাইটির সাথে চলাফেরা। নীলা বান্ধবীদের সাথে করে বিষাদের কাছে এসে বলে ইংরেজি প্রাইভেট পড়বে। ইংরেজিতে পাশ না করার কারণে বিষাদ নীলার কথাতে রাজী হয় না। পরে বাধ্য হয়েই রাজী হয়। কলেজ আঙিনায় বিভিন্ন স্থানে নীলা বিষাদের কাছ থেকে জ্ঞান নিতে থাকে। হাই সোসাইটিতে জন্ম নিলেও নীলার আছে সহজ সরল সুন্দর মন, আর তাই সুন্দর মনের খোঁজ করতে করতে বিষাদকে পেয়ে অতি সহজেই তার মনে নিজের মনকে হারিয়ে ফেলে।

বিষাদ যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ, কলেজ এলাকাতে বাড়ি বিধায় বর্তমানে কলেজ প্রাঙ্গণেই সময় কাটায়। নীলার সাথে প্রেম করে, সে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। কলেজের ছাদে বসেই তারা বেশি সময় কাটায়। বিষাদ বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হবে। নীলাও বিষাদকে সাহায্য করবে, তার জন্য অপেক্ষা করবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।

কলেজের অধ্যক্ষ স্যারের সাথে কথা বললে স্যার তাকে কলেজে জয়েন করতে বলেন। খুশিতে বিষাদ নীলাদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলো। নীলার পরিবার ততক্ষণে ওদের সম্পর্কের কথা জেনে গেছে। নীলার বড় ভাই তাজুল ছুরি নিয়ে বিষাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় মল্লযুদ্ধ। এক পর্যায়ে ছুরিটি তাজুলের পেটে বিঁধে যায়। এটেম্পট টু মার্ডার মামলায় বিষাদের সাত বছরের জেল হয়ে যায়। ধ্বংস হয় শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন। শেষ হয়ে যায় নীলাকে পাওয়ার স্বপ্নও। নীলার বিয়ে হয়ে যায় বড় লোকের ছেলের সাথে যে কিনা পঙ্গু হাসপাতালের ডাক্তার। জেল থেকে যেদিন ছাড়া পায় বিষাদ ওদিনই নীলার স্বামীর গাড়ির নিচে চাপা পড়ে বিষাদ। নীলার স্বামী তাকে ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সিতে ভর্তি করে। অবস্থার অবনতি হলে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নেয়। সেদিন গাড়িতে নীলা থাকলেও বিষাদ রক্তাক্ত হবার কারণে চিনতে পারেনি। এজন্য ডাক্তার স্বামী বাড়ি এলেই রোগীর খোঁজ খবর নেয় নীলা। স্বামী বলে লোকটি আর কোনদিন কথাও বলতে পারবে না। নীলা তাকে দেখার জন্য উদগ্রীব হলে পরদিন তার স্বামী হাসপাতালে তাকে নিয়ে যায়। বিষাদকে দেখে চোখের জলের বাঁধন  ছেড়ে দেয় নীলা। নীলার স্বামী তার কিছুই বুঝতে পারে না বা বোঝার চেষ্টাও করে না। বিষাদকে সুস্থ করার জন্য স্বামীকে বলে বিষাদকে যেন নিজের বাসায় আনে। বাসাতে ওদের তিন বছরের ছেলে অয়ন আছে।

নীলা বাসাতে বিষাদকে ঘিরে অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকে। তাদের প্রেম কাননে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বড় ভাই তাজুল। তাজুলকে বিষাদ কিছু বলতো না  সম্মানার্থে। কারণ সে নীলার বড় ভাই। ছেলে অয়নের ডাকে নীলা সম্বিত ফিরে বাস্তবে আসে।

নীলার স্বামী নীলাকে ফোন করে জানায় বিষাদের একটা পা বাঁচানো গেলো না। শুনে নীলা আরো স্তব্ধ হয়ে যায়। পা হারা, বাকশক্তিহীন বিষাদ অবশেষে ঠাঁই পেলো নীলাদের বাড়ির  সিঁড়ির পাশের রুমে। নীলার চোখে ঘুম কেড়ে নিয়েছে নিদ্রাদেবী। জানালায় দাঁড়িয়ে বিষাদের কথা ভাবতে থাকে। বিষাদের জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেলো ভেবে কাদতে থাকে। নীলার স্বামী তাকে এসে ঘরে নিয়ে যায়। ভেতরের খবর সে জানেও না। সে জানে বিষাদের বাড়ি নীলাদের বাড়ির দিকে। সে জানে নিজেদের গাড়ির নিচে চাপা পড়ে বিষাদের এই দশা তাই অপরাধবোধ থেকে নীলার এত উদ্বিগ্নতা।

বিষাদের কাছে নীলার অনেক কিছু জানার আছে। কেন সে তার ভাইকে ছুরি দিয়ে মারতে চেয়েছিলো। কিন্তু বিষাদ তো বাকশক্তিহীন হয়ে গেছে, উত্তর দেবে কি করে। এই কারণে নীলা একজন মনোবিজ্ঞানীর কাছে গেলো। মনোবিজ্ঞানী বললেন, মানসিক চাপে মানুষ বাকশক্তিহীন হতে পারে। চিকিৎসায় সুস্থ করা সম্ভব। স্বামীকে না বলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কারণে নীলার স্বামীর নীলার প্রতি সন্দেহ জাগতে থাকে।

বিষাদের প্রতি নীলার আন্তরিকতা বা যত্ন নেয়ার বাড়াবাড়ি দেখে নীলার স্বামীর মনে প্রবল সন্দেহ যখন দানা বাঁধে তখনই দ্রুত বাড়ি ফিরে আসে। এসে দেখে নীলা বিষাদকে প্রশ্ন করে জর্জরিত করছে। কেন সে তার ভাই তাজুলকে মারতে চেয়েছিলো, কেন সে তার নির্মল প্রেমকে গলা টিপে মেরেছে। এক পর্যায়ে এই দৃশ্যাদি দেখে নীলার স্বামী নীলাকে সতর্ক করে দিয়ে বলে, হয় তুমি থাকবে, নতুবা আমি থাকবো। এসব অন্তর্দ্বন্দ্ব সব শোনে বিষাদ এবং এটাও বুঝতে পারে তার কারণে নীলার সুন্দর সংসার ধ্বংসোন্মুখ। ওদিনই নীলার বড় ভাই তাজুল নীলাকে দেখতে আসে। নীলা ভাইকে কৌশলে আর দিব্যি দিয়ে জেনে নেয় যে বিষাদ তার ভাইকে খুন করতে আসেনি৷ সব ছিলো তাজুল আর তার বাবার কুটচাল যাতে নীলা বিষাদকে ভুল বোঝে। ভাই বোনের কথা শুনতে পেয়ে বিষাদ শিউর হলো যে বিষাদের প্রতি নীলার মনে আর কোন ক্ষোভ নেই। বিষাদ ঘরের ছাদে চলে যায়, ক্র্যাচ ফেলে মাটিতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে নীলার সংসারে শান্তি ফিরিয়ে দেয়।

'হলনা আকাশ ছোঁয়া'
উপন্যাসের মূল কাহিনি হলো:- ধনীর দুলালী নীলা আর গরীবের ছেলে বিষাদের মধ্যের প্রেম ও নিয়তির পাঁকে পড়ে বিষাদের মৃত্যু উপন্যাসের মূল উপজীব্য। নীলা আর বিষাদের প্রেম নীলার বাবা ও বড় ভাই তাজুল মেনে নিতে পারে না। কিভাবে কি করা যায় যাতে বিষাদকে নীলা ভুল বুঝবে, এই মর্মে নীলার বড় ভাই ছুরি হাতে বিষাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং নিজের ছুরি নিজের দেহে প্রবেশ করিয়ে এটেম্পট টু মার্ডার মামলায় ফেলে বিষাদকে সাত বছরের জেলে পাঠায়। ভাইকে খুন করতে আসে জেনে নীলাও বিষাদকে ঘৃণা করতে থাকে এবং  এক পর্যায়ে বাবা মায়ের পছন্দে ডাক্তারকে বিয়ে করে। যেদিন বিষাদ জেল থেকে ছাড়া পায় ওদিনই নীলাদের গাড়ির তলেই পড়ে বিষাদ পা ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে। নিজেদের গাড়ির তলে পড়েই মরার উপক্রম বলে নীলার স্বামী বিষাদকে উন্নত চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করে। বিষাদকে দেখে নীলার মনে এক সাথে প্রেম জাগে, সাথে সাথে প্রবল ঘৃণাও জাগে কেন সে তার ভাইকে মারতে চাইবে। বিষাদের প্রতি অতি যত্নশীলা দেখে নীলার স্বামী নীলাকে ভুল বোঝে এবং বাক-বিতণ্ডা করে বের হয়ে যায়। ওদিন নীলার ভাই এলে নীলার প্রশ্নে তাজুল সব সত্য কথা নীলাকে বলে। নীলা সত্য জেনেছে যে বিষাদ তার ভাইকে খুন করতে যায়নি। বিষাদও জানতে পেরে একটা মিথ্যা অপবাদ থেকে সে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু নীলার স্বামী ভুল বুঝে কোথায় যেন চলে গেলো। বিষাদ ভাবে তার কারণে এত সুন্দর পরিবারে সংকট দেখা দেছে। নিজেকে বিসর্জন দিয়ে নীলার সংসারে হঠাৎ জ্বলে উঠা আগুনে জল ঢেলে দেয় বিষাদ। মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েও যে প্রিয়ার সংসারে সুখ আনয়ন করা যায় এ এক অনন্ত নিদর্শন। প্রিয়তমার প্রতি প্রিয় মানুষের এই হলো শেষ উপহার। সব দিক বিবেচনা করে বলা চলে উপন্যাসটি একটি সফল ট্রাজেডি।

===============
হলনা আকাশ ছোঁয়া
বিরুন-আল-রশিদের উপন্যাস

প্রকাশক: রাহিমা আক্তার
প্রকাশনা: চৈতী প্রকাশন
প্রকাশ : ২১শে জুন, ১৯৯৮
প্রচ্ছদ: কাজী মনিরুল ইসলাম
মূল্য: ৬০টাকা
লেখক: বিরুন-আল-রশিদ
পেশা: শিক্ষকতা, সহকারী অধ্যাপক, সরকারি মুড়াপাড়া কলেজ, মুড়াপাড়া, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ