বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক ভিলহেলম নিৎশে (Friedrich Wilhelm Nietzsche) ছিলেন নতুন চিন্তার মানুষ। মধ্যযুগে বিকশিত রেনেশাঁস ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকে মানবিক ও সহনশীল সমাজ তৈরিতে উৎসাহ দিয়েছিল। শিল্পবিপ্লব সেই উদারনৈতিক মনবিকতাতে সংহত হতে পারত। কিন্তু মানুষের সমাজ সবসময় সরলপথে বিকশিত হয় নি। শিল্পবিপ্লবের চোরাপথে মানবসমাজে প্রবেশ করে নানাবিধ বঞ্চনা, হতাশা ও যন্ত্রণা। মানবমনন এমন সব জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি হয় যা সভ্যতার ইতিহাসে আগে কখনও দেখা যায় নি। এমন একটি সময়ে দৃশ্যপটে আবির্ভুত হন দার্শনিক নিৎশে। তিনি মানুষকে, তার চিন্তাকে, তার সমাজকে ব্যাখ্যা করেছেন একেবারে একান্ত অবস্থান থেকে। তিনি ছিলেন একাধারে ভাষাতাত্ত্বিক ও কবি। মনোবিজ্ঞান, মূল্যবোধ, দর্শনের ইতিহাস, নীতিশাস্ত্র, সৌন্দর্যবিদ্যা ছিল তার আগ্রহের বিষয়। দস্তয়েভস্কি, কান্ট, শোপেনহাওয়ার, লা রোশফুকো, প্যাস্কাল, ডারউইন, স্পিনোজা প্রমুখের চিন্তা নিৎসেকে আলোড়িত করেছে। বিশেষ করে শোপেন হাওয়ারের বিমূর্ত বিষন্নতা তাকে বহুদিন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। লা রোশফুকোকে তিনি মনে করতেন মনোবিশ্লেষণের গুরু। জীবদ্দশায় তিনি লিখেছেন ১৬টি বই। এর মধ্যে “On the Genealogy of Morals” অন্যতম। বাংলা ভাষায় এর সাবলীল অনুবাদ করেছেন বিপাশা মন্ডল।
সার্বিকভাবে দেশে দর্শনচর্চার জায়গা একাডেমি ছাড়া কোথাও নেই।
বাংলা ভাষায় দর্শনবিষয়ক বইয়ের সংখ্যা কম। এটা বাংলাদেশী জনগণের দর্শনচর্চার অভাব বা দর্শনবোধের অভাব যে কোন কারণেই হতে পারে। তবে সার্বিকভাবে দেশে দর্শনচর্চার জায়গা একাডেমি ছাড়া কোথাও নেই। এমন দর্শনচেতনাবোধহীন পাঠক যে সমাজের প্রধান চালিকা সেখানে বিপাশা মন্ডল ফ্রেডরিক নিৎসে'র বইটির অনুবাদ করে অতিসাহসের কাজ করেছেন। এ যেন অনেকটা অন্ধের দেশে চশমা বিক্রির মত। তারপরও তিনি যার রচনা অনুবাদ করেছেন, তাকে নিয়ে বাংলাভাষী সমাজে রয়েছে নানাবিধ বিভ্রান্তি ও অপপ্রচারণা। তার এই উদ্যোগ বাংলাভাষাভাষী পাঠককে নিৎসে সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে নিজে পাঠের সুযোগ দেবে। পরের মুখে ঝাল বা মিষ্টি কোনটাই খেতে হবে না।প্রসঙ্গক্রমে বইয়ের সূচিপত্র একবার দেখা দরকার।
- বাংলা অনুবাদকের ভূমিকা
- ইংরেজি অনুবাদকের ভূমিকা
- জার্মান থেকে ইংরেজি অনুবাদক ডগলাস স্মিথের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য
- ফ্রেডরিক নিৎশের জীবন ও সাহিত্যের ঘটনাপঞ্জি
- মুখবন্ধ
- ‘ভালো এবং অসৎ', ‘ভালো এবং মন্দ'
- ‘পাপ', ‘মন্দনীতি', এবং এসব সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়
- নৈষ্ঠিক আদর্শের মানেটা কী?
“অন দ্যা জিনোলজি অব মব়্যালস” বইয়ের মুখবন্ধে নীৎশের জীবনব্যাপী দর্শন ভাবনার কিছুটা আভাষ পাওয়া যায়। তিনি বলেন -
আমার চিন্তাক্ষেত্র হচ্ছে আমাদের নৈতিক পূর্বসংস্কারের উৎস খোঁজ করা। পৃষ্ঠা-৫৩
এ ধরণের অন্বেষণ কোন কোন উপলব্ধির উপর ভর করে তাঁকে প্রেরণা দেয়, সে প্রসঙ্গটিও তিনি প্রকাশ করেন। তার সময়কালের পরিপার্শ্ব ও প্রচলিত সমাজ নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে দ্বিধা করত না। এ সুযোগে নীৎশের ভাবনার সাথে আমাদের পরিচিতি সাবলীল হয়। তিনি জানান-
ইতিহাস ও ভাষাতত্ত্বের কিছু ক্লাস, যুগ্মভাবে স্বাভাবিকতার সঙ্গে বৈষম্যের অনুভূতিকে মনস্তত্ব বিষয়ে সম্মানের সঙ্গে প্রশ্ন করে খুব দ্রুত আমার সমস্যা অন্য একটি সমস্যায় নতুন আকারে বদলে গেছে : কোন শর্তাধীনে মানুষ ভালো ও মন্দের মূল্য যাচাই আবিষ্কার করেছে? এবং কোনও নৈতিক মূল্য তারা নিজেরা অধিকার করে আছে? এগুলো কী মানবতার উন্নয়ন দেরি করতে সহায়তা করেছে? এগুলো কী গ্রাম্যতার প্রতীক? দারিদ্র্যের প্রতীক, জীবনের অধঃপতনের প্রতীক? অথবা তারা বরং প্রকাশ করেছে প্রাচুর্য, শক্তি, জীবনের ইচ্ছাসমগ্র এর অভিশাপ, আত্মবিশ্বাস এবং ভবিষ্যৎ?- এই প্রশ্নে আমি বিভিন্ন প্রগলভতাপূর্ণ উত্তর পেয়েছি। পৃষ্ঠা-৫৩
নীৎশের দর্শন আলোচনা বক্ষমান রচনার উদ্দেশ্য নয়। তাই বিশদ বিবরণে যাওয়ার সুযোগ কম। সংক্ষেপে শুধু একথা বলা যায় যে নীৎশের দার্শনিক চিন্তা আমাদের প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত নীতিগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে; নতুন দিক থেকে বিশ্লেষণ করতে উৎসাহিত করে। নীৎশের সময়কালে এই বিষয়টি ছিল স্বাভাবিক। বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক বাস্তবতায় কেউ আর জ্ঞানচর্চা তথা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে আগ্রহী নয়, শিক্ষিত জনেরা পরিপার্শ্বের তুলনায় নিজেদের আলাদা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, আত্মচিন্তার অহংকারে তারা বেশিরভাগই নুইয়ে পড়েছেন। এমন উদ্ভট বাস্তবতায় নীৎশের দর্শন আলোচনা করা বিব্রতকর।
অনুবাদকের চিন্তাসামর্থ ও সাহসের প্রশংসা না করে পারছি না। তার পরিশ্রম করার মানসিকতা বইয়ের পাতাতে পাতাতে স্পষ্ট। দর্শনের জটিল চিন্তাপ্রবাহকে বাংলা ভাষায় প্রকাশের মত দূরূহ কাজটি তিনি সহজাতভাবেই করতে পেরেছেন। অল্প কিছু ক্ষেত্র ছাড়া তার বাক্য বেশিরভাগ সময় সাবলীল ও সহজবোধ্য হয়েছে। কখনও কখনও অনুবাদ যে পড়ছি, সে কথা মাথাতেই ছিল না। এটার জন্য বিপাশা মন্ডল ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
বইয়ের কাগজ ও ছাপানোর মান ভাল। প্রত্যেক পৃষ্ঠার নিচে ফুটনোট থাকায় উপস্থাপিত তথ্যের বিচার করা সহজসাধ্য হয়েছে। প্রচ্ছদশিল্পী আল নোমান প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় চিন্তাপ্রবাহকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন। বিষয়টি ভাল লেগেছে। এই বই প্রকাশের জন্য সিলেটের ঐতিহ্যপ্রেমী নাগরী প্রকাশনী ও সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানাই।
__________~__________
অন দ্যা জিনোলজি অব মব়্যালস
ফ্রেডরিক নিৎশে
অনুবাদঃ বিপাশা মন্ডল
প্রচ্ছদ: আল নোমান
প্রকাশকাল: ২০১৮
প্রকাশক: নাগরী, সিলেট।
পৃষ্ঠা: ২২৪
মূল্য: ৩৯০ টাকা
ISBN: 978-984-93038-8-6
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম