কবি শরীফ সোহাগের বুকের গহীনে যে অস্বাভাবিক বেদনা রয়েছে যার কারণে তার বিচ্ছিন্ন ভাবনা জুড়ে যে উদগীরণ তা তাঁর 'বিমূর্ত সন্ন্যাস' কাব্যগ্রন্থে মূর্ত রূপ পেয়েছে। স্বাভাবিক যে জীবন আমরা দেখি কবি তার বিপরীত পিঠটাও দেখে দেখে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন যা দেখছি তা আপাতত সুন্দর, এর অন্তরালে রয়েছে অন্য বীভৎসতা। আদর্শের ছাঁচে আমরা যা মাপছি কবি তাতে দেখেন উল্টো কিছু, উল্টোস্রোতে ভেসে চলেছে সবাই। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে চোখে তা দৃশ্যত হয় না। খোলামেলা আলখেল্লা ভাব দিয়ে তা উপলব্ধি করা যায় না। সুপ্ত নিরীক্ষাপ্রবণতা না থাকলে কবিতার অন্তর্লোকে প্রবেশ হয় না। উদঘাটিত হয় না মর্মার্থ। কবির কবিতায় বিষয়ের সাথে বৈচিত্র্যের দারুন যে মিল লক্ষিত হয়েছে তা অনন্য, শুধু প্রেম এবং আপাতত দৃশ্যের প্রেমের আড়ালে বৈদগ্ধতার যে চিত্রণ পাঠে তা মুগ্ধতা আনে। তাঁর রচিত 'বিমূর্ত সন্ন্যাস' কাব্যগ্রন্থটিতে মোট ৪১ টি কবিতা আছে। কবিতাগুলি পড়ে আমার যে উপলব্ধি তা তুলে ধরলাম।
প্রেয়সী যেন সব সময় কবির ভাবধারায় থাকে, তাকে ঘিরেই স্বপনে সঙ্গীত করে। কেননা কবি তাকে খুব ভালোবেসে লেখেন,'আমার সমস্ত মুগ্ধতা দিয়ে তোমার মৌনতা জুড়াই
দৃষ্টি দিয়ে প্রচ্ছদ আঁকি ভালোবাসার ক্যানভাসে'।(সূচিমুখ)
সময় আসে, যায়। অনাগত সময়ও অতীত হয়। সময়ের পতন হয়, প্রেমের গাঢ়ত্ব বাড়ে, বাঁচার আকুতি বাড়ে। বাঁচার পিপাসা জাগলেও মৃত্যু সন্নিকটে আসে। কবি লেখেন,
তবে কী সব জন্মই মৃত্যুর জন্য। (নিশিজাগা নৃত্যের অনুচক্র)
মহাকাল থেমে নেই। কবি তাকে নোঙর করতে বলেন। নশ্বর জীবনে হৃদি দিয়ে হৃদবন্ধন অবিনশ্বর হয়। কবি লেখেন,
বাঁধি সংসার আমৃত্যুর তাগিদে। (অবিনশ্বরতার গান)
শ্রাবণ কোন এক মহিয়সী, সৌন্দর্যের সারথি, দ্যুলোকের অতিথি। যাকে ঘিরে কবির স্বপ্ন বাসর, যে নিঃসঙ্গতায় সঙ্গ, যার লাজুকতায় বিহঙ্গ পঞ্চস্বরে ডাকে। কবি লেখেন,
কোন সে গ্রহ হতে এসেছিলে পৃথিবীর দ্বারে;
অমানিশার বিস্তীর্ণ ব্যাপ্তি তোমার পদতলে চুম্বন করে- (শ্রাবণের পথ ধরে)
প্রেয়সীর পোতাশ্রয়ে নোঙর ফেলে কবি নির্লজ্জ চাহনি দিয়ে ঘায়েল করেছেন প্রেয়সীকে। মন মানসীর বৃত্তের ভেতর থেকে কবি আদিখ্যেতা দেখান। কবি লেখেন,
নর্তকীর বেশ তোমাতে ধরায়নি,
ওরা সুন্দর; কিন্তু সুন্দরের প্রাচুর্যতা অসুন্দরের প্রকাশ (পর্ব:প্রেম ও পুরাণ)
কবি মাকে উদ্দেশ্য করে বলেন সামাজিকীকরণ রক্ষা করতে যেয়ে সে সর্বনেশে কীট হয়েছে। অপযশ কুড়াচ্ছে, হত্যা করছে, অনাসৃষ্টি করছে। যেমন কবি লেখেন,
পতিতার সাথে সংসার বাঁধি
সতীত্বের চাদর ছিঁড়ে আস্ফালন করি (উদাহরণ)
কবি সৌন্দর্যের পূজারি, সৌন্দর্যের মাঝে ছিলেন। কোন এক কারণে সভ্যতার কীটে পরিণত হয়েছেন। তাই কবি লেখেন,
এখন-
সব উপেক্ষা করে খুঁজি
যেদিন ছিটকে পড়েছিলাম তোমা হতে
আমার সংস্কৃতির বীজ যেখানে বপন হয়েছিল। (অন্তর্যাত্রা: অতঃপর পিছন ফিরে)
আলোয় আলোকিত ছিলো কবির জীবন। আলো দিয়ে যত অন্ধকার ঢেকে দিতেন। হঠাৎ সাম্রাজ্যবাদ এসে কবির মনকে ঊষর করে তুলেছে। কবি লেখেন,
ঊষর মনে নিয়ত পরাগায়ন ঘটছে সাম্রাজ্যবাদের
ভেতরের আমি বিষবৃক্ষের বীজ বোনে (ইতিহাস নৈঃবদ্য)
অসুস্থ কবি সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের মানে খুঁজে পান না। মেডিকেলের দুই নম্বর ওয়ার্ডে অবচেতন মনে কবি তাঁর আপুর সাথে কথা বলেন। তাঁর আপু তাঁর গাঁ, গাঁয়ের রূপ বর্ণনা করেন। কবি অনুচ্চারিত থাকেন। কবি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অথচ কবির ভাষায়,
আপু ডুকরে ডুকরে কাঁদে।
কী অসম সৃষ্টি!
আমি স্থির অথচ আমার শরীরে কীট কী স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায় (নীলকথন)
আকাশ ডাকে, শরতের সাদা কাশফুল ঝরে পড়ে দমকা বাতাসে। সৌন্দর্য নষ্ট হয়। কবির মন খারাপ হয়। কবি লেখেন,
মোমের স্নিগ্ধতা গ্রাস করে মন মুমূর্ষতা ;
পূর্ণিমার নির্জীব যৈবতী চাঁদ-
ঠিক আমার মতন'। (সঙিন)
অদ্ভূত মগ্নতায় কবি ও কবির সঙ্গিনী দিন-রাত-ভোর ভুলে গিয়েছিলেন। তারপর কি হলো? কবি লেখেন,
-হঠাৎ ছিটকে পড়লাম একগ্রহে
এখানে সমস্ত শুভ্রতা গ্রাস করেও ক্ষুধার্ত
শূন্যতা। অন্তহীন শূন্যতা... (শূন্যতার চাহনি)
শালিক পাখিরা এখন পথে ঘাটে নোংরামি করে না, পাঁচতলায় ড্রয়িংরুমে কুকুরামি করে। অপ্রত্যাশিতভাবে টবে আসে নতুন ফুল-ফল। আর সে শোকে কত কচি পাতাও ঝরে পড়ে। কবি লেখেন,
প্রত্যাশার বুক ফেঁড়ে অসংখ্য সন্তান জন্মায় বৃক্ষশাখা;
না-পাওয়ার শোকে কচিপাতারাও ঝরে পড়ে
-বেড়ায় পথ থেকে পথে
এখানে-
পাখিগুলো স্বপ্নকন্যার মতন
পাতাগুলো আমার মতন। (বৃক্ষ নির্জনতাঃ পাখি ও পাতা)
আমরা যাকে চাই, তাকে পাই না। তবে তার সাক্ষাৎ সম্মুখে না হলেও কল্পনাতে হয় বৈকি। কবি লেখেন,
শেষমেষ তোমার দেখা মিলল-অদেখাতেই... (সাক্ষাত)
ভালোবাসার অনুভূতিতে সমতা না থাকার কারণ অশুদ্ধতা। দুটি মানুষ দুটি গ্রহের হলে মিল কখনো হয় না। কবি লেখেন,
ভালোবাসাটা
অসুস্থ হয়ে শুকনো ন্যাড়া গাছের ছায়া সাজায়
চৈত্রের দুপুরের। (অশুদ্ধতা)
নিষ্ঠুর মানুষও ভালোবাসা পেলে পাথর হৃদয় থেকে বের হয়ে আসে, অন্ধকার থেকে ফেরে। আজন্ম ভুলেও ফুল হয়ে ফোঁটে। কবি লেখেন,
নিজেকে না জানিয়ে/ যেতে যেতে চলে যাই-
পায়চারি করি হ্যাঁ-না বৃত্তের বাতুলতার সংসারে। (পাথর ও অন্ধকারের গল্প)
নশ্বর জীবনে কিছু পাবো পাবো করে কল্পনাপ্রবণ মানসে জীবনের সবটা চলে যায়। তবু পেলে হত, শূন্য থেকে যায় বুকের খাঁচা। কবি লেখেন,
তোমাকে বাজানোর উন্মাদনায় জেঁকে বসবে অন্যরা
গালে টোল ফেলে আলিঙ্গন হবে-
সবচেয়ে কম আদর।
আমার উপর কটি ঘাসের অবিচলতা
তোমাকে না পাবারচিহ্ন। (নশ্বরতা)
কবির জীবন উপন্যাসে দুঃখ, বিরহ, কষ্ট, অমলিনতা, অসাম্যই বেশি। যে প্রেমটুকু ছিলো প্রচণ্ড ক্ষুধায় গিলে ফেলেছেন তা। কবির কথাতে,
মাঘী পূর্ণিমার যৌবনের মত
আমিও স্পর্শ পেতে চেয়েছিলাম প্রেমের।
ভাটির কথা ভাবতে ভাবতে-
কখন যে চলে এসেছি বিপরীতে; ভুলে গেছি। জ্যোৎস্নার মতো উন্মুক্ততা এখন
চারদিকের কালিমা: (ক্রমায়ত করার প্রমিতি)
কাউকে কুসন্তান বলতে নেই। যারা কাউকে কুসন্তান বলে কবি তাদের বোধের পরনে অশ্লীলতার উন্মুক্ত বস্ত্র আছে বলেছেন। কখনো কারো উজানে যেতে নেই, ভাটির গান গেতে হয়, কারণ কবি লেখেন,
বোধ; তুমি ভাটির গান গাও
বুলেটের ক্ষতে আঁক মায়ের মূর্তি-
উজানে না যাই। উজানে বিলুপ্তের সংসার।(অসময়)
কবির জন্ম হয়ত অন্ধকার গর্ভে। কিন্তু যে সুন্দর তার অবয়বে ক্ষত থাকলে বেমানান মনে করেন। কবি তাদের ভালো মনে করেন যারা অশুদ্ধকে গিলে ফেলে। কবি লেখেন,
আমাকে লুকিয়ে কীভাবে যেন শোষণ করছে। তোমার স্বাদ। দু-চারটির ভীড়ে বহুরা বেসামাল
অশুদ্ধতাই শুদ্ধ। শুদ্ধতা বৈরী। তোমার নতুবা আমার। (অকালের কথা)
কবিকে নেশা করেছে, জয়ের জন্য। কিন্তু একবারও জিততে পারেন না। অথচ কবির মন মানসী পূর্ণা যে নিজে হেরে কবিকে জিতিয়ে দেন। কবির ভাষায়,
কতবার আমি যুদ্ধে গেছি নিজের সাথে;
জিতিনি একবারও-
অথচ জয়ী হওয়ার নেশায় ধরেছে বারবার
আর তুমি!
আমাকে জিতিয়ে হারলেই যেন জয়ী। (পরাজিত পারিজাত)
কবির প্রেম অপ্রকাশিত রয়ে গেলো। মনের দীনতা বাড়ে। কষ্টগুলো সুখের জন্য ব্যস্ত হলেও কষ্ট কমে না। কেন? কবির কথায়,
দুর্বোধ্য আর অকল্পনীয়; সব লাইন
নীল হয়ে জেঁকে বসে আছে
বিমুখ- বিধাতার মতন। (কষ্টবর্ণ)
ঐশ্বরিক শক্তির প্রতি আমাদের খুব মায়া। প্রথম বর্ণ শেখার মতো তিনি অপরিচিত হলেও খুব পরিচিত, খুব কাছের। কেননা আমার সব তাঁর হাতেই। কবির কথায়,
এখন সন্ন্যাসীরও ঘরে ফেরার সময়
আমার সব তোমার কাছে
কল্পনার অতি প্রাচীন ঘুড়ি উড়ায়ে
লাটাই রেখেছো হাতে। (ছায়ালোকের মায়া)
ক্ষুদ্র এ জীবনে চাওয়া অপরিসীম। লয়ে ক্ষয় হয়, কখনো বা গুপ্তধনের মহারাজ্য পাই। গুপ্তধন পেলেই বা কী? কালের স্রোতে সব চলে যাবে। কবির কথাতে,
শূন্যভূবনে মহা সে প্রলয়ে
ভিক্ষারীর ধন কেড়ে নিল। (অতঃপর কী)
আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষিত ছেলের সাথে কোন এক জনের কথোপকথনে 'ব্যুৎপত্তি' কবিতাটি গড়িয়েছে। যেখানে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা লোকটি পান্তা খেতে পারে, বাচ্চার মতো কাঁদতে পারে, সত্য কথা বলতে পারে। কোন এক পর্যায়ে কবির কলমে,
কী! বেশি কতা কই-
চাঁদ মুকখানা হামলায়া আমারে কষ্ট দেও ক্যাঁ?
কী কও তুমি?
আমি মূর্খ?
শিক্ষিত ছাওয়াল বইল্যা কী আমি আমার কতা বুইল্যা গেছি? (ব্যুৎপত্তি)
একখানি দৃষ্টি যেন কবিকে ডুবিয়ে রাখে আমৃত্যু। কবি তাই কল্পনা করেন। কিন্তু দৃষ্টি সাহারার শিশিরে জমে গেলেও সেই দৃষ্টি মেলে না। কবির কথনে,
ভেতর থেকে বাতাস বয়;
শ্মশানের -
ফল না মেলার ফল শূন্য।
দৃষ্টি -
সাহারায় শিশির জমিয়ে বসে থাকে। (দৃষ্টি-বিলাস)
প্রিয় বদলে যায় না। বাসি হয় না যেন তাই প্রিয়া তাকে সাজায়। তাকে রাখতে চান অবিকল তেমনি। কারণ সেই তার আমিত্ব। কবির কলমে,
শূন্যতায় যখন শূন্য
তখন-ভালোবাসার মানুষ 'রাত্রির ছায়া'য় তোমায় ফেলি
আমিই দেখবো বলে। (আমিত্ব অনুসন্ধান)
কবিকে নিয়ে তাঁর পড়ার সাথী নিপুদের বাগানে হারিয়ে যায়। হাসানদের হিজলতলা থেকে ফুল কুঁড়িয়ে কবি মালা পরান, মেলায় যেয়ে লালফিতা, চুড়ি কেনেন। কবিকে করিমদের বাগানবাড়িতে কালো জাম খাওয়াতো। কবি কিছুই বুঝতেন না। কবি এখন বোঝেন, তাই লেখেন,
তারপর স্যারের মাইরের কথা আসলেই বলতিস্-
''রাগ করো না লক্ষীটি, স্যার কিছু বোঝে- দেখনা দেখে
পড়ায়-সে রাতুলই পারে''
তারপর দেখছিলাম তোর চোখেও পানি
আর ভাবছিলাম
তুই ক্যান কানছিল
-আজ বুঝি (নতুন আঁধার ও পুরাতন রাত্রির শ্লোক)
সেই অধরা যারা অধরা নয়, টাকা দিলেই যাদের মুখ থেকে পা পর্যন্ত পাওয়া যায়। তাদের হৃদয় কারো একার না, বহুদের স্পর্শে থাকে। বাঁচার জন্য স্বপ্ন বেচে, ক্রেতার অভাব নেই, ক্রেতারা সব সাধু, দোষী শুধু সে। কবির কলমে,
আজ অমাবস্যা।
সময় তার স্বপ্নবেচার।
বেচা-কেনা যেন বালখেল্য না হয়-
চাইলে পূর্ণিমাকে নির্বাসন দেই
বিশ্বাস করো-কেউ জানবে না এই উপাখ্যান।
তার ঘর আজ বহুদের আবাস। (অধরা অপ্সরা)
নিজের সাথে নিজে পেরে না উঠলে নিজেকে নিজেরাই একাকিত্বে বন্দি করে নিই। সজ্ঞানে নিজের হাতই শিকলে বাঁধি। কাছের মানুষ শত্রু হলে নিজেকে আর বন্দিত্ব থেকে বের করতে ইচ্ছা হয় না। কবি বলেন,
আনন্দের অশ্রু শুকায় না দুপুর।
বৈশাখের পর্দা ছিঁড়ে ঊষা বের করতে ইচ্ছে করে; ইচ্ছেও অলৌকিক ।(দ্বন্দ্ব সমীকরণ)
সুদিন আর নেই, ফুরিয়ে গেছে ভালোবাসা। কবির কলমে,
-চেনা সুর
কিভাবে যেন অসুর হয়ে বাজে; মনের মধ্যখানে। (সেই দিন গ্যাছে কবে)
কবি নিজেকে উজাড় করে অন্যকে ভরিয়ে দেন। নিজের বসন্ত দিয়ে অন্যের চৈত্রে সঙ্গী হন। নিজের বিষণ্নতা ভুলে অন্যের আনন্দ দেন। নিজে বুড়িয়ে গেলেও সরলতায় শিশুদের ভরিয়ে দেন। কবি লেখেন,
ভূস্বামী হয়েও উদ্বাস্তুর মতো চলি ধীর (ঐশ্বর্যের ঘরে দুঃখ বন্দি)
'সঙ্গম' কবিতার কয়েকটি চয়ন,
আমাকে তোমার দৃষ্টি দিয়ে নগ্ন করো
কামনার মোহে চিবুকে রাখি হাত;
অস্থির করি তোমাকে; মাতাল আমি
খেলি পাক্কা খেলুড়ের মতন।
'কথা ও কবিতা' কবিতার চারটি চয়ন। চারটি চয়নই তুলে ধরার মতো,
প্রকৃতির অনাবৃত আলিঙ্গন
কতকাল চলবে নিদ্রাহীন
বেহায়াপনা চরিত্রের মাদকতায়
কে হয় তোমার মতো সংযত।
'প্রাগৈ' কবিতায় কবি অতীতকে ভালোবেসে লেখেন,
যে অতীত আমাকে চিনিয়েছে পথ
অকৃত্রিম মমতায় দেখায় তার সব
তার ক্ষয় হওয়া দেহের যৌবনের বিদ্রূপ
নেহায়েত ঠাট্টার মতো...
'কয়েকটি সরল প্রস্তাবনা: পদাবলী'তে আছে তিনটি পদাবলী। তিনটি পদাবলীই (প্রতিভাষণ, নাইটশেড এবং নাবিক ও নারীর গল্প) তুলে দিলাম:
আমি বর্তমান
তবু বারবার -অনস্তিত্বের কথা ভাবি
আমি কেন্দ্রে থেকে দর্শনের বৃত্ত পরিভ্রমণ করি বহুবার
ভেতরটা পুরোই শূন্যতায় পূর্ণ। (প্রতিভাষণ)
নিজের তৈরি
বেপরোয়া ট্রামে চড়েছি নিজেই
সৃষ্টির প্রলয়োল্লাসে নির্জন মুখরিত
সজ্ঞানে দেখছি
শেষ যাত্রার বিমুগ্ধ স্বচ্ছতা
ধ্বংসের আনন্দ: দুর্ভিক্ষের সমার্থক। (নাইটশেড)
আন্ধারের মতন কুয়াশার ভিতর সিন্ধু ঠেলে যদি
তোমার ঘাটে নোঙর ফেলি-
দিবা কী 'শ্রয়? নাকি ভাসাইয়া দিবা-নষ্টা জননীর
বাচ্চার নেহাল-
দিলে দ্যাও- (নাবিক ও নারীর গল্প)
নারীর প্রতি হিংস্রতা, পাশবিকতা আর দমনের অপচেষ্টায় কথা 'পুরুষবাদীর ডায়েরী' কবিতাটিতে আছে। যেমন,
অনিচ্ছায় যদি না বাঁধ অনাদিকালের ঘর-
পৌরুষের বহ্নিতে যদি না হও ছাই
অযথা; নাম ভাঙিও না। (পুরুষবাদীর ডায়েরী)
মানুষ স্বপ্নে বাঁচে, প্রণয়াত উপলব্ধিতে বাঁচে, অমাবস্যা পেরিয়ে পূর্ণিমার প্রাচুর্য খোঁজে। কিন্তু এক সময় প্রশান্তের তলে হারিয়ে যেতে হয়। বেঁচে থাকতে আমরা তবুও অন্ধ থাকি। কবি লেখেন,
স্বপ্ন-সময়-স্রোতের অনাবৃত ভালোবাসায়
মাদকের গন্ধে ছিলাম আমি।
এখন
প্রশান্তের তল থেকে
উজান বাতাসে
বালি পড়ে... (অলোকিক অন্তর্যাত্রা)
পৃথিবী গন্তব্যে শিশু হিসেবে এসে উচ্ছলতা, যৌবন দীপ্ত তরঙ্গে তরঙ্গে এক সময় বুড়ো হয়ে পড়ি। বুড়ো হলে অতীত স্মৃতি মনে পড়ে, গাঁয়ের কথা মনে পড়ে, আমন ক্ষেত, বটগাছ, কৃষকের হাতের বাঁশি সব মনে পড়ে।
লাঙল কাঁধে কেউ যায়, তার বৌ শ্বশুরালয়ে গেছে, গরুর পাল নিয়ে ঘরে ফেরে, এসব ভাবনা গ্রাস করে। এমনি চিত্রণ আছে 'কিছুটা দুঃস্বপ্ন: একটি প্রত্যাবর্তনের গল্প' কবিতায়।
প্রিয় মানুষকে নিয়ে লেখার সময় নেই, মানুষ এখন খুব ব্যস্ত বিশ্বায়নের যাতাকলে পড়ে। কর্তৃত্ববাদীদের দৌরাত্ম্য, কর্পোরেটের হই-হুল্লোড় বাণিজ্য জীবনকে কংক্রিট করে তুলছে। তারা আমাকে তোমাকে নিয়ে ভাববে না। কবির কলমে,
তাদের সৃষ্টির বাণিজ্য এখন আকাশ ছোঁয়া
তোমাকে ভাবার সময় মেলে-সময় নিয়েই। (প্রতিস্থাবক : সমকালীন তোমাকে)
সভ্যতা এগিয়ে চলেছে, তার শুভ্রতা, সবুজতা হারিয়েছে। কবি আর ভবিষ্যতে হাটতে চান না। কবি লেখেন,
আমি হাঁটবো আদিমতার দিকে
আমি আবারও পৃথিবীর বয়স বাড়াবো;
নিউইয়র্ক কিংবা লন্ডনের গায়ে
এঁকে দেবো সভ্যতার সেই পুরানো ঢঙ- (সমাপ্তির সূচনা)
স্বাধীনকে লেখা কবির একখান চিঠি, যাতে কবি স্বাধীনের মাকে বর্ণনা করেছেন৷ স্বাধীনের মা মানে দেশকে বোঝানো হয়েছে। যেখানে বলা হচ্ছে দেশ স্বাধীন হলো অর্থাৎ একটি দেশের সূচনা হলো অথচ সেই মায়ের দেহে কেনো বীভৎস ক্ষত, চেহারাটা অসুরের মতো কেনো হয়ে যাচ্ছে, সে মায়ের সতীত্ব কেনো প্রশ্নের মুখে, সে মায়ের ক্যান্সার হলো না তো! চিঠিটি থেকে কটি লাইন -
আজকাল তোর মার সাথে শত্রুতা শুরু করেছে কর্পোরেটের বিজ্ঞাপন ; তা নাহলে তোর মার ফটোগ্রাফ পত্রিকায় আসে না কেন? আমি এদেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর হাতে আঁকিয়েছি তোর মাকে। ঝুলিয়েছি জানালার সম্মুখে। (সূচনার পর)
পাঠান্তে বলবো, শরীফ সোহাগের 'বিমূর্ত সন্ন্যাস' বিমূর্ত ও বিচ্ছিন্ন ভাবনার ফসল যা মূলত ২০০৩-২০০৯ সালের মধ্যে লিখিত। কবিতার অন্তর্লোকে প্রবেশে বাঁধা পেলে পড়ে উপলব্ধি জাগ্রত হয় না। প্রচ্ছন্নতার আড়ালে কবি যে ভাবের প্রকাশ করেছেন তা ধরতে পারলে যে ব্যঞ্জনা মনে জাগে তা মনকে তুমুলভাবে নাড়া দেয়। কবির কলমে যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা জেগেছে একদিন তা বিলীন হবে, তখন কবির কলমে হয়ত উঠে আসবে শান্তির বাণী। কবির কাব্যগ্রন্থটির ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা কামনা করছি এবং কবির কাছ থেকে আরো নতুন কিছু প্রত্যাশা করছি।
~~~~~~~~~~0~~~~~~~~~~
বিমূর্ত সন্ন্যাস
শরীফ সোহাগ
প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা-উদয় মাসুদ পারভেজ
প্রকাশক- মোস্তাফিজুর রহমান লিটন
প্রকাশনী- তৃতীয় নয়ন
প্রকাশ- বইমেলা,২০০৯
পৃষ্ঠা- ৪৮
মূল্য- ৬৯ টাকা
ISBN- 4864680046
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম