সম্ভবত গত বছর মার্চ মাসে যখন খুলনা যাই ভাগ্নির বিয়ে উপলক্ষে, ফেরার সময় আব্বার পুরনো বইয়ের আলমারিটা থেকে অল্প কয়টি বই সাথে করে নিয়ে আসি। অজস্র স্মৃতি-সুধার স্পর্শ মাখা আলমারিটা এখন আমার বড় বোনের বাসায় আছে। এই আলমারির কথা আমার কিছু লেখায় উল্লেখ করেছি। ভবিষ্যতেও করবো। মনে হয়, একটা উপন্যাসিকা না হলেও বড় একটা গল্প লেখা যেতে পারে আলমারিটা নিয়ে।
আমার বড় হয়ে উঠবার কালে আমার সারা জীবনের মানস আর মনন এর শক্ত গঠন দাঁড় করে দিয়েছে কাঠের আলমারিটার চারটি তাক আর দুটি ড্রয়ার। এগুলোতে থরে থরে অল্প-বিস্তরে সাজানো, ভাঁজে ভাঁজে গোজানো বইগুলি ছিল আমার শৈশব-কৈশোর আর তারুণ্যের অপরিহার্য সঙ্গী। ব্যক্তিজীবনে আক্ষরিক অর্থে কারো সাথে আমার তেমন ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব না হবার কারণ যতটা না আমার চারিত্রিক অন্তর্মুখী বৈশিষ্ট্য, তার চেয়ে বেশি বোধ করি ঘরের মধ্যেই বিশ্বস্ত বন্ধু খুঁজে পাওয়া। সংক্ষেপে বলতে পারি, ওই বইয়ের আলমারিটা, আলমারিটার ভেতরে থাকা বইগুলি আমার অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই যতদিন সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকবো, এদের কথা আমি বলতেই থাকবো।
সেবার খুলনা থেকে ফিরে আসার সময় হাতে গোনা যে কয়টি বই বাক্সে ভরে নিয়ে এসেছিলাম, সেগুলোর মধ্যে ছিল বিংশ শতাব্দীর বাংলাসাহিত্যের অন্যতম লেখক শ্রদ্ধেয় ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকীর বিখ্যাত ভ্রমণগাঁথা ‘প্যারিস সুন্দরী’। বইটি আমার স্মৃতির মেমব্রেনে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে প্যারিস সম্পর্কে যেকোন উচ্চারণ আমাকে তৎক্ষণাৎ এই বইটির কথা মনে করিয়ে দেয়। এরকম ভ্রমণ সাহিত্যের ওপর আমার প্রিয় আরো বেশ কিছু বই আছে যেগুলোর নাম শোনা মাত্র আমার পাখি-মন নিমেষে ওই বিশেষ দেশ বা জায়গায় উড়ে গিয়ে হাজির হয়। যেমন, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন এর তৎকালীন যুগোশ্লাভিয়া ভ্রমণের ওপর লেখা অসাধারণ বই ‘হলদে পরীর দেশে’ ইত্যাদি।
বই পড়ার অভ্যাসটি যখন নিজের মধ্যে ধীরে ধীরে শিকড় ছড়াতে শুরু করেছে, তখনই এই বইগুলি পড়া। এ কারণেই এগুলো পড়ার সেই নির্মল আনন্দ পরবর্তী সময়েও একই মাত্রায় অনুভূত হয়। কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি তীব্র। কারণ, পরিণত বয়সে যোগ হয় এই আশ্চর্য আনন্দ আবিষ্কারের বিস্ময়। অথচ, অল্প বয়সে কেবল পড়ার আনন্দেই পড়েছি। এর মধ্যে জীবনের অর্থ, দর্শন বা তাৎপর্য অনুসন্ধানের গভীরতা বা নিমগ্নতা প্রবেশ করেনি। বরং, ভ্রমণ কাহিনী পড়তে গিয়ে লেখকের সাথে যে মানুষগুলির বিভিন্ন স্থানে নানা উপলক্ষে দেখা-সাক্ষাৎ ঘটেছে, আমার বাড়ন্ত মন কল্পনা করতে ভালোবাসতো বড় হয়ে ওদের সাথে আমি একদিন দেখা করবো এরকম অদ্ভুত ভাবনা। বারবার হিসাব করতাম লেখকের সাথে তাদের দেখা হবার সময়কার বয়সআর আমি যখন বড় হয়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো সে সময়ের বয়স। এটা মনে মনে আমার এক ধরনের খেলা ছিল।
বইটি আমার স্মৃতির মেমব্রেনে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে প্যারিস সম্পর্কে যেকোন উচ্চারণ আমাকে তৎক্ষণাৎ এই বইটির কথা মনে করিয়ে দেয়।
রডমিলা নামে যে মেয়েটির সাথে বেলগ্রেডে কবি জসীম উদ্দীন এর পরিচয় হয়েছিল, একটা দীর্ঘ সময় আমি এই রডমিলা নামের প্রেমে অভিভূত হয়েছিলাম। এখনও এই নামের আচ্ছন্ন করা প্রভাব থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি। পারবো বলেও মনে হয়না। রডমিলা থেকে লুদমিলা, রাশান আর সারবিয়ান মেয়েদের এই নাম শুনলে অবধারিতভাবে আমার ‘হলদে পরীর দেশে’ বইটির কথা মনে পড়বে। আড়াই বছর আগে কলম্বোতে থাকার সময় বাংলাদেশ থেকে একটি যুবদল গিয়েছিল শ্রীলঙ্কায় শিক্ষা সফরে। ওরা যখন বাংলাদেশ হাই কমিশনে এলো সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য, ওদের মধ্যে একজনের নাম লুদমিলা জানতে পেরে আমি মনেমনে যেন গুনগুনিয়ে উঠেছিলাম, “জলভর সুন্দরী কন্যা জলে দিছাও ঢেউ, হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই তোর কেউ”। জসীম উদ্দীন এর ওই বইয়ে এরকম কিছু লোকসঙ্গীতের উল্লেখ ছিল। আমার মগজে তা আটকে গেছে সেই সময় থেকেই।আলমারিটায় অনেক বইয়ের ভেতর থেকে ‘প্যারিস সুন্দরী’ বইটি যখন আমি আলাদা করলাম, এর সাথে ‘পারি’ নামের আরেকটি অনুবাদগ্রন্থ খুঁজছিলাম। জীবনে কোনদিন প্যারিসে যাবার সৌভাগ্য হবে ছোটবেলায় সেই স্বপ্ন দেখবার দুঃসাহসও করতে পারিনি। কিন্তু ততদিনে জেনে গেছি, পারি বলতে প্যারিসকেই বোঝায়। মোটা বইটি নেড়েচেড়ে ধরতে গিয়ে এর ভূমিকা থেকে হয়তো অতটুকু জ্ঞান লাভ হয়েছিল। ভেতরে পাতা উল্টাতে গিয়ে বুঝেছিলাম, এটা বড়দের বই। আমার বোঝার মতো বয়স হয়নি। বড় হলে নিশ্চয় পড়ে ফেলবো। বড় হয়ে খানিকটা ফরাসি ভাষা শিখে নিশ্চিত হয়েছি, প্যারিসকে ওই ভাষার উচ্চারণে পারি বলা হয়। এর আগে অবশ্য সৈয়দ মুজতবা আলী অর্ধেক পড়েও কিছুটা মাদমোয়াজেল, ফিয়ানসে এসব শব্দ জেনে গেছি।
আর আশরাফ সিদ্দিকীর ‘প্যারিস সুন্দরী’ বইটি হাতে নেবার আগে থেকেই আমি এই বইয়ের লেখককে বিটিভি সূত্রে চিনে ফেলেছি। আমাদের শৈশবকাল বিটিভির স্বর্ণালী যুগ। জীবনের অর্ধেক ভালো কিছু বিটিভি থেকেই শিখেছি। ভালো সিনেমা, নাটক দেখার রুচি তৈরি হবার পাশাপাশি দেশ-বিদেশ সম্পর্কিত নানা তথ্য, বিখ্যাত মানুষদের পরিচয় এসব বিটিভি দেখার বদৌলতেই জানা। হারিয়ে ফেলা সেই সময়টার জন্য বুকের ভেতর একটা তীব্র হাহাকার অনুভব করি সবসময়। আবার মানুষ হিসেবে স্মৃতি রোমন্থনের সুযোগ আছে বলে ওই হাহাকারটুকুকে মাঝেমাঝে স্মৃতির জারক রসে ভিজিয়ে নিয়ে এক অমৃৎসুধা পান করতে পারি। তার স্বাদও মন্দ নয়।
তখন টিভিতে ‘হীরামন’ আর ‘মনিহার’ শিরোনামে দুটি ধারাবাহিক পাক্ষিক নাটকের অনুষ্ঠান হতো। ‘হীরামন’এ বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোককাহিনী ভিত্তিক গল্পগুলোকে নাটকের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হতো। কিশোর মনে ওই গল্পগুলোর আবেদন ছিল অভূতপূর্ব। ঠিক নিজেদের যাপন করা জীবনের মতো নয়। বইয়ের পাতা থেকেউঠে আসা অনেক দূরের এক অপরিচিত দুনিয়ার গল্প, কিন্তু জীবনের মতো বাস্তব। মহুয়া সুন্দরী, কাজললতা, চাঁদ সদাগর, বেহুলা লক্ষিন্দর নামের নাটকগুলো দেখবার জন্য সারা সপ্তাহ ধরে উন্মুক্ত হয়ে থাকতাম। এই ‘হীরামন’ নামের ধারাবাহিক পাক্ষিক নাটকের একেক পর্বের শুরুতে অধ্যাপক ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী ওই দিনের কাহিনী সম্পর্কে সূচনা বক্তব্য রাখতেন। তাঁর কথা শেষ হলেই কেবল নাটক শুরু হবে বলে কখনো কখনো তাঁর বক্তব্য দীর্ঘ একঘেয়ে মনে হতো। আমাদের মতো অল্পবয়সী উদগ্রীব দর্শকের কাছে। বিষয়টি আসলে মোটেও তা ছিলনা এখন মনে করে হাসি পায়। তিনি তাঁর জন্য নির্ধারিত সময়টুকুই কথা বলতেন। একইরকম প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখতেন অধ্যাপক আলাউদ্দিন আল আজাদ ‘মনিহার’ নামের নাট্যানুষ্ঠানের পূর্বে। এই অনুষ্ঠানে সম্ভবত সমকালীন গল্পের ওপর ভিত্তি করে নাটক দেখানো হতো।
আমি বা আমার বয়সী অনেকে ওই সময় ‘মনিহার’ এর চেয়ে ‘হীরামন’ দেখতে বেশি পছন্দ করতাম। একটা কারণ হতে পারে এর নাটকগুলিতে সুন্দর গান বা নাচ থাকতো যা স্বাভাবিকভাবে আমাদের শিশু বা কিশোর মনের ওপর দারুণ প্রভাব ফেলতো। নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ, শামীম আরা নীপাদের এসব নাটক দেখেই অভিনেত্রী হিসেবে চিনেছি। নাটকের কাহিনীতে তাদের সুখে-দুখে হেসে-কেঁদে উঠেছি। এর বেশি আর তেমন কিছু মনে নেই। তবে আরো যা মনে আছে, ডক্টর আশরাফ সিদ্দিকী ডানদিকে ঘাড়টা সামান্য কাত করে কথা বলতেন। একদিন জানলাম, রাজশাহী কলেজে তিনি আব্বার বাংলার শিক্ষক ছিলেন।
আরো কিছু সময় পরে যখন সেই আলমারির বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে শুরু করেছি, বই পড়ার অভ্যাস যখন সন্তর্পণে আমার মননের মধ্যে স্থান করে নিচ্ছে, তখন একদিন পরম বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম যে টিভিতে দেখা আব্বার শিক্ষক আশরাফ সিদ্দিকীর লেখা ‘প্যারিস সুন্দরী’ নামের একটি বইও আমাদের বাসায় আছে। ঠিক কোন সময়টায় বইটি একটানে পড়ে শেষ করেছিলাম এখন আর স্মরণে নেই। তবে যা স্পষ্ট মনে করতে পারি তা হলো এই বইয়ের অদ্ভুত চরিত্র এক ফরাসিনীর কথা। প্লেনের ভেতরে মহিলার মেকাপবিহীন বয়স্ক চেহারা দেখে লেখক আঁতকে উঠেছিলেন কয়েক ঘন্টা আগে দেখা তার ঘন মেকাপের আড়ালে ঢাকা ঝকঝকে রূপ মনে করে। আর কিছু না। কেবল লেখক, বইটার নাম আর বইটার একেবারে শেষ দিকে লেখকের অমন পিলে চমকে যাওয়ার বিবরণটুকুই আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে চিরদিনের জন্য। ওই বইটি থেকে প্যারিস সুন্দরী হিসেবে শুধু সেই মহিলার কথাই বইপড়া সংক্রান্ত আমার অজস্র স্মৃতিমঞ্জুরীর এক মূল্যবান উপাদান হিসেবে সংগ্রহে আছে।
সেবার বইটি খুলনা থেকে এনে রেখেছিলাম আবার পড়বো বলে। এর মধ্যে খুলনার ভৈরব-রূপসা নদী আর প্যারিসের স্যন নদীতে অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। বিটিভিতে ‘হীরামন’ দেখা ছোট্ট আমি পাখা মেলে উড়তে উড়তে প্যারিস শহরটাও ঘুরে এসেছি। বিদেশের মাটিতে আমারও হয়েছে নানারকম পিলে চমকানো অভিজ্ঞতা। অনেক বছর পরে তাই যখন ‘প্যারিস সুন্দরী’বইটি আবার খুলে বসলাম এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে, একসাথে অনেক স্মৃতির মুখোমুখি হয়ে পড়লাম। দারুণ বিস্ময় আর আনন্দ নিয়ে বইটি আবার পড়তে শুরু করেই মনে হলো, এমন চমৎকার একটি বইয়ের কথা এই প্রজন্মের পাঠকরা জানে তো? বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে, ‘মরহুম সৈয়দ মুজতবা আলী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত-এ পথের পথিকৃৎ’।
কেবল লেখক, বইটার নাম আর বইটার একেবারে শেষ দিকে লেখকের অমন পিলে চমকে যাওয়ার বিবরণটুকুই আমার মনের মধ্যে গেঁথে গেছে চিরদিনের জন্য।
এর মধ্যে একদিন বইমেলার নির্দিষ্ট স্টলে গিয়ে ‘সৈয়দ মুজতবা আলী-প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ’ নামের বইটি না পেয়ে মনক্ষুণ্ণ হয়ে ফিরে এসেছি। আমি সাধারণত বইয়ের তালিকা করেই বই কিনতে যাই। কদিন আগে একটি পত্রিকায় বইটির ওপর একটি সুন্দর সংক্ষিপ্ত আলোচনাও পড়েই এটি কেনার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু বইমেলায় গিয়ে না পেয়ে মেজাজ কিছুটা খারাপ হলো প্রকাশনীর বালখিল্য ব্যবহারে। যা হোক, এই ঘটনার কাছাকাছি সময় ‘প্যারিস সুন্দরী’ বইটি খুলে উৎসর্গ পাতায় আমার সবসময়ের প্রিয় লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর নামটি দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেলো।না বললেই নয়, সেই আলমারিতে সৈয়দ সাহেবের প্রায় সবগুলি বিখ্যাত বই এক সারিতে পরপর সাজিয়ে রাখা ছিল। একসময় বুঝে নিয়েছিলাম, আব্বা তাঁর লেখার যাকে বলে পাঁড় ভক্ত পাঠক। তুলনামূলকভাবে কম বয়সে আমিও দ্রুতই মুজতবা আলীর লেখার অনুরাগী পাঠক হয়ে উঠি। বিশেষ করে তাঁর লেখায় স্বতঃস্ফূর্ত হাস্যরস আর করুণ রসের অপরিমিত যোগান আমার কিশোর বা তরুণ মনে ভীষণ রকম প্রভাব ফেলে যায়। আর মুজতবা আলী পড়তে পড়তেই আমার প্রথম ফরাসি ভাষা আর জাতির সাথে সাক্ষাৎ ঘটে।
দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে যখন আশরাফ সিদ্দিকীর ‘প্যারিস সুন্দরী’ বইটির সূচিপত্রে আবার চোখ রাখলাম, শিরোনামের লেখাটি ছাড়া বাকি আর আটটি লেখার কোনটির কথাই মনে করতে পারলামনা। ভাবলাম, যাক ভালোই হলো। মনে থাকলে নতুন করে পড়ার আনন্দ লাভে কিছুটা হলেও ব্যাঘাত ঘটতে পারতো। সেরকম কিছুই হলো না। বরং, দ্বিগুণ বিস্ময় আর বিশুদ্ধ সাহিত্য পাঠের প্রগাঢ় আনন্দ বোধ হলো এই উপলব্ধি থেকে যে, গত শতাব্দীর ষাট আর সত্তর দশকের প্রথমার্ধে লেখা রচনাগুলি ধারণ করে আছে এক অপূর্ব নির্মেদ ভাষাশৈলী আর ঝরঝরে প্রাণবন্ত রূপ।
ভূমিকা থেকে জানলাম, বইটির অধিকাংশ রচনা তৎকালীন ‘দৈনিক সংবাদ’, ‘চিত্রালী’, ‘সমকাল’, ‘মাহে নও’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ‘প্যারিসের শিল্পী’ শীর্ষক লেখাটি ১৯৭৪ সালে কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশের পর
বেশ কিছুদিন আলোচনার ঝড় উঠে-সুদূর বোম্বে থেকে-শান্তিনিকেতন-ঢাকা পর্যন্ত।
ইতিপূর্বে পত্রিকা থেকেই ‘মাদার জেমস্’ রচনাটি টেকস্ট-বুক বোর্ড কিছুটা সংক্ষিপ্তাকারে ১৯৬৩ থেকে নবম ও দশম শ্রেণীর বাংলা ‘গল্প-সঞ্চয়নের’ জন্য নির্বাচিত
করেন। ১৯৭৩ সালে লেখক অত্যন্ত সঙ্কোচের সঙ্গে বইটির পাণ্ডুলিপি সৈয়দ মুজতবা আলীকে দেখালে
তিনি ‘অনতিবিলম্বে’ প্রকাশের আদেশ জারী করেন।
এসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে জানতে এবং লেখাগুলির রস আস্বাদন করতে করতে বারবারই মনে হয়েছে, বইটি এখনকার পাঠকদের অবশ্যই পড়া উচিৎ। সেই কতকাল আগের লেখকের আমেরিকা-ফ্রান্স-লন্ডন ভ্রমণের কাহিনী, অথচ নিখুঁত বর্ণনার মুন্সিয়ানায় তা যেন বর্তমান সময়েও দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক। লেখকের সাথে যে চরিত্রগুলির পরিচয় ঘটে, যাদের কথা তিনি বলেন অকপট সোজা সাপ্টা সরলতায় তাদের দোষ-গুণ, ভালো-মন্দ সহ, চিত্রায়নের কারিশমায় তারা যেন আমাদের চোখের সামনে একেবারে জীবন্ত হয়ে ওঠে। মনে হয় এরকম চরিত্রের সাথে আমাদেরও তো কখনো কখনো দেখা হয়েছে বিদেশ বিভূঁইয়ে।
বইটি পড়া শেষ করে অনেকটা সময় নিয়ে লেখকের কথা ভাবছিলাম। অনেকদিন তাঁর সম্পর্কে কোন খবর জানিনা। টিভি দেখা হয়না বলে কোন অনুষ্ঠানে তিনি আসেন কিনা তাও জানতে পারিনা। শ্রদ্ধেয় লেখক আশরাফ সিদ্দিকী অনেক বছর পরে যখন আমার মনে ভীষণভাবে উপস্থিত, যখন আমি তাঁর বর্তমান অবস্থা জানবার জন্য মনেমনে তৈরি হচ্ছি, ঠিক তখনই তাঁর চিরবিদায়ের সংবাদ শুনে ভেতরে কতটা মুষড়ে পড়েছি ভাষায় তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। লেখার শুরুতে জীবনের যে রহস্যপূর্ণ আশ্চর্যময়তার কথা বলেছি, এতোদিন বাদে এভাবে আশরাফ সিদ্দিকী স্যারের সাথে আমার এই যোগাযোগের কথাই বোঝাতে চেয়েছি। ‘প্যারিস সুন্দরী’ বইটি দীর্ঘদিন বাদে আবার পড়ে আমার অতীত-বর্তমান পাঠ-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমি কিছু লিখতে চেয়েছিলাম। সেই লেখা যে স্যারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হয়ে উঠবে ভাবতে পারিনি। বর্তমান প্রজন্মের পাঠকের কাছে বাংলার মৌখিক লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তাঁর অসামান্য অবদানসহ বাংলা সাহিত্যে প্রগাঢ় পান্ডিত্বের পরিচায়ক তাঁর অসাধারণ সাহিত্যসৃষ্টিগুলো তুলে ধরতে পারলেই স্যারের প্রতি আমাদের যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদনসম্পূর্ণ হবে।
************
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম