অরুণ সেনের কাব্যগ্রন্থ 'অনেক ভুলের প্রতিবেশী': ব্যক্তিবীক্ষণ ও সমাজ প্রত্যক্ষণের তীর্যক বচনঃ সৌমেন দেবনাথ


অরুণ সেনের 'অনেক ভুলের প্রতিবেশী' কাব্যগ্রন্থে আড়াল কথার আধিক্য বেশি স্বচ্ছ কথার আধিক্যের চেয়ে। কবিতার গভীরে লুকিয়ে আছে নিত্যচিত্তক্ষোভের দ্যুতি। দক্ষ ডুবুরী না হয়ে কাব্যসমুদ্রে ডুব দিলে কবিতা থেকে মণিমাণিক্য সংগ্রহ করা দূরুহ হবে, ডুবসাঁতার দিয়ে কবির কবিতা থেকে কাব্যরস আস্বাদন সম্ভব নয়। কবির কবিতাজুড়ে যে আড়ালতা তা উদ্ধার করতে পারলে মোহময়তা সৃষ্টি হবে কবিতার প্রতি।

কবিতার শরীর খুলে গ্রন্থির ভাজ ভেঙে নিবিষ্ট চিত্তে কবিতা পাঠ করলে কবিতার অন্তরের গূঢ় রহস্য উদঘাটিত হয় এবং তাতে তন্দ্রাচ্ছন্নতা কাটে। অধিকাংশ পাঠকের পাঠপ্রস্তুতি নেই, পাঠাভ্যাস নেই; কাব্যমনস্ক পাঠক না হলে অরুণ সেনের কবিতার ভাব ও বিষয় আবিষ্কার অসম্ভব হবে। কবিতার অনালোকিত দিক আবিষ্কার করতে পারলে বোধে যে দ্যোতনা সৃষ্টি হবে তা পরম প্রাপ্তি হবে বোধ করি। অস্থির মনস্ক হলে অরুণ সেনের কবিতা ভাবনা দুর্বোধ্যতায় আক্রান্ত বোধ হবে। অস্থির পাঠক অনন্তকালই চোরাবালির আবর্তে ঘোরে, কবিতার অন্তর্লোকের সৌন্দর্য উদ্ধার করে অজানা সুখানুভব তারা পাবে না।

অরুণ সেনের পঙক্তিমঞ্চ জুড়ে বিপন্ন মানুষের জীবনালেখ্য চিত্রিত। মানুষের জীবনবোধ, সংগ্রাম, ব্যর্থতা, আস্ফালন, দৈনন্দিন জীবনে বিভেদ, বৈষম্য, সমাজপতিদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ, সাথে সাথে মানবতার জয়রথে উত্তরীয় উড়াবার অভিপ্রায় বাঙময় কাব্যব্যঞ্জনায়। মানুষ ও সমাজের প্রতি অঙ্গিকারাবদ্ধ কবি অরুণ সেন বহুমাত্রিকতার দ্যুতি ছড়িয়েছেন কবিতার ছত্রে ছত্রে। পাঠক গভীর চিন্তার আবর্তে পড়ে যায় কবিতা পড়ে, একনিষ্ঠ পাঠ ও পাঠমনস্কতায় কাচ ও কাঞ্চনের পার্থক্য করতে পারে। কবিতার ভাব উদ্ধার ও ভাবের সাথে একাত্ম প্রকাশ করছি। তাঁর 'অনেক ভুলের প্রতিবেশী' কাব্যগ্রন্থে মোট ৩০টি কবিতা রয়েছে। পাঠ শেষে আমার অনুভূতি তুলে ধরলাম।

আমি, আমার, আমাদের নিয়ে চিরকাল চলে যায়, স্বার্থকেন্দ্রিক চিন্তা কমে না। আমিত্ব নির্ভর জীবন। কিন্তু এই আমি কে? নির্মম সত্য মৃত্যুর কথা কেনো ভাবি না? পথ মতের ভিন্নতায় জীবনের সঠিক পথ কেনো খুঁজি না? কবি প্রশ্ন করেন,

"এ-বাড়ি আমার, ও-বাড়ি কার!
দু'বাড়ির মাঝে উঠোনের মতো
যে-পথ রয়েছে সেই পথ দিয়ে
জীবন কোথায় যায়?" (পথ-খরচা)

 

জীবন পথ পাড়ি দিতে আলোর পিছনে আমাদের ধাবমানতা। পথ ফুরায় না, জীবনের আশা ফুরায় না, জীবনের পথ ফুরিয়ে আসে। পথ-কেলিতে পথিকের দুরন্তপনা আর জলকেলিতে বোয়াল মাছের উত্থান-পতন সব দেখেও অনর্থক ছুটতে থাকি ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে। কবি লেখেন,

"এ-মাছ জানে কি, চাঁদের দূরত্ব থেকে জন্ম নেয়া
হাজার হাজার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে বহু
পুরুষ আকাঙ্ক্ষা হারিয়েছে পুরুষত্বের পথে।
অনেক অনেক নারী-বাসনারও গর্ভ-ধারণের
বিশুদ্ধ ক্ষমতা আহা ঝরে গেছে এমন ধারায়" (বিদ্যুচ্ছটা)

 

সেই দিন নেই, এখন যে দিন দুর্দিন৷ দুর্গন্ধে থাকা লোক সুগন্ধে এলে সুগন্ধকেও দুর্গন্ধ ভাবে। দুর্গন্ধের অসুর সুগন্ধের সুরকে গিলে ফেলছে। মানুষের মাঝে মিশে গেছে দৈত্যরূপী অমানুষ। মানুষের জীবন হয়ে গেছে দূর্বিষহ। কবি লেখেন,

"বাহারি শরীরধারী কলুষ চিত্তের প্রলোভন
সহজে বোঝে না সত্যি সরল মৌমাছি
সবুজের ছদ্মবেশী সকল গাছের মধ্যে লুকিয়েছে গভীর পিপাসা
তৃপ্তিতে ঢেকুর তোলা সব মানুষের মধ্যে লুকিয়েছে আগ্রাসী পিয়াস" (রাত্রিতে ঘুমিয়ে যাওয়া সেই দিন)

 

সময়কে হাতের মুঠোয় ধরতে ধরতে সময় মিলিয়ে যায়। অদেখা পকেটে জমে না কড়ি, স্মৃতি ভারে কম্পমান কাদতে থাকি। পাওয়ার আশায়, না পাওয়ার বেদনায় জীবনের ফুরিয়ে যায় অমূল্য সময়। কবি লেখেন,

"মায়ার প্রতিটি রেখাও তো চায় কপোলের ছোঁয়া
দিশেহারা এই দিনের উপর দিয়ে
পকেটেই গলে যায় অমূল্য সময় 
অনেক সুন্দর তবু হয় না দেখা, না-বোঝার যাতনায় ভরা
অনেক আনন্দ তবু ছোঁয় মন, বিরহের মাটি দিয়ে গড়া" (অদৃশ্য রোদন)

 

যন্ত্রণা, আতঙ্ক মাড়িয়ে মানুষ এগিয়ে চলে শিরোপা আর সাফল্যের পথে। সাফল্য পেলে শত্রুও বাড়ে। স্বাধীন হাওয়ায় খুশী উড়ার আগেই চেনা পথ অচেনা হয়ে যায় কীটপতঙ্গের আক্রমণে। কবি লেখেন,

"কথার ভাঁজেই কথা লুকিয়েছে, সন্দেহ ওড়ায়
মেঘের আড়ালে ঘুড়ি
রক্তের সাগরে ভাসা হৃদয়-ভেলায়
কে চালায় অর্জনের নিরীহ গলায় ছুরি" (অর্জনের নিরীহ গলায়)

 

তন্দ্রাচ্ছন্ন মানুষকে ধাক্কা মেরে জাগানোতে যে যুবক বলীয়ান সে বিপ্লবের ঋত্বিক। রক্ত কণিকায় তেজ জাগলে সকল দুর্দিন কাটবে। একজন মানুষের ততদিন ঠিকমত জন্ম হয় না যতদিন না পর্যন্ত তার মেরুদণ্ড পুষ্ট হয় সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কবি লেখেন,

"কার বেগে কে খোলে প্রথম কার ভাবের দুয়ার?
সুপ্তিতে আঘাত লেগে এদিনেই জন্ম নেয়
সেদিনের ঢেউ" (জন্মদিন)

 

মানবরূপী দৈত্য দানবের অযাচিত কীর্তিকলাপে সুশীল দেবতাদের নিঃশ্বাস নেয়া দায়। দানবেরা বিশুদ্ধ বাতাসে প্রবেশ করে বিষাক্ত করে ফেলছে পরিবেশ। বৈরি হাওয়ায় গা ভাসিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। মালিন্যের মই দিয়ে ক্ষেত চাষ করলে ক্ষেতে জন্মাবে আগাছা। কবি বলেন,

"সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকা আলোরূপী কালিমার রোগা ক্ষুধা
জন্ম দেয় কতগুলো নখ আর জেদি জেদি দাঁত
বড় বড় নখ আর ভয়ঙ্কর দাঁতগুলো ব্রহ্মতালু ফুঁড়ে
ধ্বংস করে কৃষকের চিন্তন-ক্ষমতা
কালের কলঙ্ক থেকে জন্ম নেয়া দানবের আক্রমণ
কে আর ঠেকায়" (দৈত্য-দানবের গল্প)

 

কবি দীর্ঘকাল পরে শহর থেকে জন্মগাঁয়ে এসে দেখেন কবিতার মতো গাঁয়ে জনশূন্যতা, ধূসরতা। গাছপালা কেটে বিরান করে ফেলেছে। কবি তাই লেখেন,

"কীভাবে আমার অতীতের প্রিয় অঙ্গগুলোকে এখনও সমানে খুঁজে
ব্যর্থ হবার পর মুহূর্তে স্মৃতির ছায়ায় বসে কাঁদি আর
দৃঢ়তার সাথে বলতে শুনেছি এক
শাপিত কবিতা আমার গলায় ঝুলন্ত দড়ি হয়ে
আপন খেয়ালে আমাকেই তো ফাঁসায়" (এক শাপিত কবিতার কাণ্ড)

 

আমাদের প্রতিবেশটা বিষাক্ত মানুষে ভরে গেছে। কেউ ভালো তো তার ঘাড়ে ডাকাতের শ্বাস। ''কার হাতে ছাতা কারা পায় ছায়া" থেকে বোঝা যায় ভার একের কাঁধে ফল লুটছে অন্যে। আশা ভরসার ধড়গুলো জোয়ার ভাটায় ভাসে, সত্যি দুঃখজনক। "শবের উপর অনেক শকুন বসে" থেকে বুঝি নিষ্পেষিতের কাঁধে ভর করে আছে দৈত্য দানব। শিরদাঁড়াহীন মানুষের যে উৎপাত তা সহ্যাতীত, সত্যের ঢাকে কাঠি পড়ে না, মন গুমড়ে কাদে। "আড়ালে এগোয় পতঙ্গ দলে দলে" তবুও "প্রমাণের জালে পড়ে না সহজে ধরা"। চারিদিকে এতো উন্নয়ন তবুও ক্ষুধার্ততা কমে না, কমে না দুঃখীর দুঃখ। " মাঠে শস্যের নরম বাতাস তবু/ কেন কেঁদেছিল খিদে"। এ থেকে বোঝা যায় যা শুনছি ভুল, যা দেখছি তাও ভুল, অন্তর্লোক শূন্য। আজ দুর্বৃত্তদের রাজত্ব। কবি ক্ষোভে আরো লেখেন,

"হিংসার নখ ক্ষুধায় জ্বলতে গিয়ে
প্রসাধন মাখে ত্বকে
হিংসুকেরাই প্রতিহিংসাকে দেখে
প্রতিবাদে নামে মাঠে" (অনেক ভুলের প্রতিবেশী)

 

কবি সব কিছুতেই কবিতা খুঁজে পান। কারণ সব কিছুই সুন্দর। অনুভবে প্রবেশ করে ভাবনার সাগরে ভাসায়। সব কিছুতেই আনন্দ শিখা দেখেন, অতৃপ্তি তাতে বাড়ে। এমনকি কবিতার পরিহাসকেও কবি ভালোবাসেন, কেননা কবিতার পরিহাস থেকেও আলো ঝরে। কবি লেখেন,

"অনুভবে ঢুকে রস রূপ আর গন্ধ ঢালার পরে
ভাবার সাগরে ভাসানো তোমার কাজ
আনন্দ-শিখা জ্বলে
উপভোগিগণ যতবার নেয় স্বাদ
অতৃপ্তি তত তাড়িয়ে বেড়ায় ক্রোধে" (পরিহাস থেকে আলো)

 

মনের রং সাতরঙা রংধনুকেও হার মানায়। প্রিয় মানুষকে সবুজ সংকেত দেয়, হিংসার মনে জন্মে কালো রং৷ শত্রুর বিষে নীল হয় মন, হলুদ খবর বিলিয়ে বেড়ায় যে আত্মা সে আত্মা শাদা ভালোবাসা বোঝে না, বোঝে লাল রক্ত ঝরাতে। কবি লেখেন,

"শাদা চোখে ভালোবাসা, কাঁধে তার ভুল কিলবিলিয়ে
অবাধে ছড়াচ্ছে পরিতাপ
হলুদ মুহূর্ত এসে জানিয়েছে সবে
স্নেহপ্রবণ সবুজে কেন
বাস্তবের অনাস্থা প্রকট" (আত্ম-বর্ণালি)

 

মানুষের অন্তর বাহির ক্ষুধায় জর্জর, ক্ষুধা ভীষণ সর্বক্ষণ। অন্তরের পিপাসার ধার বাড়েই, তৃষিত আত্মা থামে না, মরুঝড়ে তাদের ভেতর বিবেক জাগে না। তারা কি কখনো কালো আঁধারের মুখে বারুদের ঘষা দিতে পারবে? কিন্তু দূষিত বাতাসের মধ্যে থেকেও কবি উড়াতে চান শান্তির নিশান। কবি লেখেন,

"শূন্যতার বুক থেকে মাঝে মাঝে অদৃশ্য পূর্ণতা
অলৌকিক শক্তিবলে দিয়ে যাচ্ছে মাথায় চক্কর " (মাথায় চক্কর)

 

জীবনে বসন্ত ক্ষণস্থায়ী। জীর্ণতা শীর্ণতা গ্রাস করে। আর তাই ক্ষণিকের বসন্তে ছলাকলার সম্ভারে কলাবতী হয়ে যৌবন বিকানোর কিছু নেই। মহাকাল সব কেড়ে নিয়ে হাতশূন্য করে দেবে। কবি লেখেন,

"মহাকালের চোখের প্রতিটি পলক
নিয়ত ছিঁড়েই দিচ্ছে মায়া আর মোহের বন্ধন
ঘূর্ণমান ক্ষণিকের কম্পিত বসন্ত
ফুল ফোটা সাঙ্গ হলো
এইবার বলো কতক্ষণ লাগে আর খালি হতে হতে" (ঘূর্ণমান ক্ষণিকের কম্পিত বসন্ত)

 

কবি গুরুকে নিবেদিত পাঁচ লাইনের কবিতা ''কবি গুরুর প্রতি" তুলে দিলাম-

গুরুদেব, তুমি এত অজানায় ভরা
ছায়াটা তোমার কোথায় হয়েছে শেষ
এতো বলে গেলে ছায়াময় কথা, তবু
না-বলা কথাই মনের ভেতর ঢুকে
কী যেন কী যেন আত্মীয়-কথা কয়"

 

প্রিয় মানুষ রেবাকে নিবেদিত পঙক্তিতে পঙক্তিতে ভালোবাসার নান্দনিক প্রকাশ। যার লজ্জারাঙা দৃষ্টিতে কবির পরাণ চাপা পড়ে। যার চোখের হাসি প্ররোচনা করে, চিত্তে ঢেউ তোলে। কবি লেখেন,

"প্ররোচনা দেয় চোখের হাসিটি
ঝুলন্ত কথা নেড়ে
চিত্ততলের স্থির জলাশয়ে
ঢেউ তোলে মন কাড়ে" (রেবার পঙক্তি)

 

শীতের অপশাসনকে বিনাশ করে ফাগুনের শাসন আনে ঘরের রমণী৷ লজ্জা এমন মিষ্টি মধুর তাকে দেখেই জানা। তার চোখে অঝোর ধারায় বৃষ্টি এলে কবি দেখেন বেহুঁশ নয়ন ঘোরে। কবি লেখেন,

"বোবা হয়ে ভাষা
বলার অধিক বলতে বলতে আবার দেখায়
ভাবের বাঁধটা ভাঙা" (ভাবের বাঁধটা ভাঙা)

 

ক্ষুধার শেষ নেই, ভোগাসক্তিতে কবিও আসক্ত। বাঘের ক্ষুধার মতো মানুষের ক্ষুধা। মানুষের ক্ষুধার শেষের হদিস নেই।

"দ্রুততায় গিলে ফেলা আহার্য জিনিস
উদরে না গিয়ে হচ্ছে হিংসার ফুয়েল"
মানুষ মানুষও খেয়ে দিব্যি সাধুরূপে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কবির বুকটা ফেঁটে যায়। কবি আরো লেখেন,
"অশুদ্ধ আহারে বাড়ে ক্ষুধার মত্ততা
আর ক্ষুধা অন্ধ হলে পরিণতি চোখেই পড়ে না'' (ভোজনের অন্য এক রূপ)

১২ চরণের কবিতা "তরী খোঁজে অমর অভয়" - এ দেখতে পাই- পৃথিবীতে প্রথম এসে আকাশ পানে চেয়ে প্রথম অবাক হওয়া। ঐ আকাশে সুন্দরের অপূর্ব ইশারা থেকে মনোযোগী হয়ে আগ্রহ বাড়তে থাকে। এই পৃথিবীর ডিঙিতে সদ্য উঠা যাত্রী আমি, দেখার দুয়ার খুলে অজানা দেখা শুরু। প্রিয় জীবনের আসল ফুয়েল হলো আশা, সেই জীবনে আলো আঁধারের দোলায়িত দৃশ্যের কত খেলা। তারপর যত নিষিদ্ধ কাজে মনোযোগ। ভাবিও না এর ফল কত হবে খারাপ। কবি লেখেন,

"ফাগুনের গন্ধ লেগে তলায় তলায় শুরু নিষিদ্ধ কথার চলাচল
ক্ষুধার অসুখে তপ্ত কম্পিত ইন্দ্রিয়সূত্র ভাবেই না অন্ধকারে ফল"

 

এরপর কাঁধের থলিতে ভরে অভিজ্ঞতা, পথের ধুলোয় হাটি হাটি পা পা করে অজ্ঞতার শক্তিশালী ছায়াও সঞ্চয় করে হয়ে উঠি উদ্ধত। পরিপাটি পরিচ্ছদে সমাদৃত বীভৎস ইচ্ছেরা কুকাজের বীজ রোপণ করে বিশ্বাসের মাটিতে ব্যর্থতার দৃশ্য ফলাই। কবি লেখেন,

"না বেয়ে সময় যায় কার কি ভুলায়ে খায় সবকিছু ভুলেভালে গোল
রক্তে করে নাচানাচি ছ'রকম আঁধারের ছ'কিসিম মুদ্রা আর বোল"

 

বয়স বাড়ার সাথে সাথে আলোর ঝলকানি জীবনে আসে, লাজুক ফোয়ারা, অদম্য পিয়াসা পেয়ে বসে, দেহমনে গভীর চাঞ্চল্য আসলেই মন পঁচে যায় কারো কারো, হয়ে উঠে দাঁতাল জন্তুর চেয়ে নখদন্তহীন জানোয়ার। জানতে বুঝতে পারাটা পক্ত হলেই বোঝা যায় জানাটার চেয়ে অজানাই বেশি। কবি লেখেন,

"কালের সাগরে ভাসতে থাকা ডিঙিটা আমার চলাকেই শুধু ভালোবাসে
কান্নাকে ঘুমন্ত রেখে সময় কোথায় যায় প্রশ্ন শুনে শূন্যস্থান হাসে"

 

তারপর মানুষ অপূর্ব স্বপন দেখে, এই মিথ্যে জানা থেকে বাঁচার মূর্খতা জন্মে। অন্ধ প্রীতির আলো নিয়ে বয়সের শিকড়ে জল ঢেলে মনোরম সাধের আলয় গড়ি। আমরা মিথ্যে বন্ধন ব্যথায় নরকের দ্বারে পৌঁছে গেলেও বুঝি না দিনে দিনে ফুরাচ্ছে দম। ভুলের ভূগোলে না চড়ে, ঘূর্ণাবর্তে ঘুরে ঘুরে শূন্য না হয়ে রুচির লাগাম টেনে পিপাসু মনকে স্থির করি না। কবি লেখেন,

"বাতাস উড়িয়ে নেয় কুরুচির গাছ থেকে ঝরে পড়া রুচির সনদ
দৃষ্টির নাগালে তাতে বহু পিপাসু প্রশ্নকে হতে হয় নির্বিচারে বধ"

 

চিন্তার দেয়ালটা ভেঙে দেখলে বোধ হবে অদৃশ্য কার্বন চেতনার শিরায় প্রবেশ করে বিস্মৃতির অতল তলে ফেলে দেচ্ছে। উগ্র প্রসাধনী মেখে মর্মবীজে অজ্ঞতা পুষে সজ্জার সাগরে বুদ থাকি ভুলকে আশ্রয় করে। নিখাদ স্বাপ্নিক হই কিন্তু মুক্তির জন্য ব্যর্থ প্রয়াসটুকুও করি না। কবি লেখেন,

"যে-ঠিকানা স্থায়ী নয়, সে তুলেছে চুপিচুপি বুকের ভেতর এত ঢেউ
যে-কথাটা কথা নয়, চোখ নিজে বয়ে নেয়, সে-কথাটা বুঝেছে কি কেউ"

 

টাকা হলে টাকা মানুষের পাখা গজিয়ে দেয়, আকণ্ঠ লোভে রাজত্ব করে, অবিরত অশান্তির ঢিল ছোঁড়ে সে সমাজে। কিন্তু এক সময় সময় আর হাতে থাকে না, জীবনসূর্য ক্লান্তির রং মাখে, আত্মীয়দের সাথে করতে চায় শেষ আলিঙ্গন। জীবনে বেজে উঠে বেদনার সুর, স্মৃতিগুলো সব শব হয়ে উঠে, যেদিকেই তাকানো হয় সেদিকেই বুক ভরা বিচ্ছেদের মধুর রোদন। স্রষ্টার সৃষ্টি মেলা থেকে বিদায় ঘণ্টা বেজে যায়, মৃত্যুর পরে কোনস্থানে যাবে অচেনার ভয় পেয়ে বসে, পালাবার পথ নেই। এরি মাঝে কেউ হয় অমর, তাদের অমৃত ফুল ফুঁটে থাকে পথে। কবি লেখেন,

"চিত্রটির ভাষা বলে, ভুলের প্রশ্রয় থেকে বেঁধে যাওয়া এতো সব গোল
দেখার বাহিরে এসে কীভাবে কে পেয়ে যায় পরমের শান্তিভেজা কোল" (তরী খোঁজে অমর অভয়)

 

চার চরণে লেখা ১২টি কাব্যকণিকা রয়েছে ১২ ভাবনার "কাব্যকণিকা"য়। সাত নং কাব্যকণিকাটি হলো-

"ভালোবাসার ধুলো ওড়াও
দিতে তাতে প্রাণ
ধূসর রঙের খেলায় ডুবে
তৃপ্তিতে নিই ঘ্রাণ"
 
আট নং কাব্যকণিকায় আছে-

"রূপের ঝড়ে দৃষ্টি লুটায়
শরম যাচ্ছে টুটে
ঈষদুষ্ণ হাওয়ায় মুখে
ইচ্ছে উঠলো ফুটে"

 

স্রষ্টা সবখানে, যেখানে যাই, যেদিকে তাকাই, সবখানে তিনি। বিশ্বাসে তিনি, প্রাণের মাঝে প্রাণ হয়ে আছেন তিনি, তাঁর সমীপেই যত প্রার্থনা, জীবন দাঁড় বাইতেও তিনি সহায়, তাঁর আলোতে আলোকিত, তাঁর মায়ায় ছায়া৷ কবি লেখেন,

"চোখের তিনি বুকের তিনি
কোথায় তিনি না
রসের হাতে পড়ছে ধরা
বিস্ময়েরই হাঁ"। (সর্বভূতে তিনি)

 

স্রষ্টা সবচেয়ে বড় রচয়িতা, রচনা করেন সৃষ্টি, সৃজনমূখর তিনি। তাঁর নির্মাণ হাতে নির্মিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অপার বিস্ময়ের। তিনি মৃত্যু দেন, মৃত্যু তাড়ান, তিনি নিষ্ঠুর, তিনি দয়াবানও। তিনি শিল্পী, তাঁর শিল্পের ক্ষমতা আর মমতা সবার অজানা। কবি লেখেন,

" স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির এই
মহামিলনের মাঠ
চিন্তক সদা নিয়েই যাচ্ছে
পর্দা-সরানো পাঠ" (স্রষ্টা)

 

কেউ ভুল করে না, ভুল হয়ে যায়। দেখতে ভুল হয়, করতে ভুল হয়। অন্ধ ভুল নাও করতে পারে, সচেতন থাকলে ভুল হয় না। কারো দিঘি চোখের মদির নেশায় পা পিছলে ডুবলে নিজেকেই খেসারত দিতে হবে। কিছু ভুলের ক্ষমা নেই, কিছু ভুলের সীমানা নেই, কিছু ভুল বুমেরাং হয়ে নিজ সংসারকে জ্বালিয়ে দেয়। কবি লেখেন,

"সেই ভুলটা কি আসলে জানত
তার মাথাতেই ঠিক বিঁধে যাবে
হাজার ভুলের ভার" (হাজার ভুলের ভার)

 

"শ্রাবণের জলজ উনুন"  কবিতা থেকে-

"আগুনে নুন্নুড়ি বাজলো, না শোনা শোনালো
জলজ পিপাসা ডুবলো, না দেখা দেখালো
ফললো কি ফললো না সৃষ্টি
ভিজলো কি ভিজলো না চিবি
দেখলো অন্ধ শুধু বীজই হাসলো
দুই ক্ষুধা দু'পারের ক্ষুধাই শুধালো"

 

পাপ করার পর পাপোপলব্ধি জাগলে অন্তর্দাহ হবেই। যাদের অন্তর্দাহ জাগে না তাদের দিকে যে কেউ অবজ্ঞার হাসি হাসবে। কবি লেখেন,

"আশেপাশে সবুজ গাছের ডালে বসা
গুটিকয় পাখি নির্বাক শূন্যের ঘাড়ে
ভেঙে দিয়ে সঙ্গীতের হাঁড়ি
আনন্দে উস্কায়
গোপন পাপের অন্তহীন অন্তর্দাহ" (অন্তর্দাহ)

 

মানুষের লোভ, লালায়িত জিভ, লকলকে দোলায়িত জিহ্বার তাড়নাগুলো জ্যোৎস্নার সৌন্দর্যকে পুড়িয়ে দেয়। কবি লেখেন,

"যাবার সময় বিবেকের বুকে বিঁধে দেয়া হুল
মুহূর্তেই চেতনায় ছড়িয়েছে নীল নীল জ্বালা
নাক থেকে নাকে আর গ্রাম থেকে গ্রামে যাচ্ছে দ্রুত
জ্যোৎস্না-পোড়া ধোঁয়া থেকে পাক খেয়ে ওঠা প্রেমী গন্ধ" (জ্যোৎস্না-পোড়া ধোঁয়া)

 

"মানসাঙ্ক" কবিতা থেকে-

"কে যে কার পণ্যে ধন্য প্রশ্নে উভয়ের
ভেসে এলো অরণ্যের হাল-মানসাঙ্ক
সেদিনের বলা ছিলো শব্দ খেয়ে থাকা
শব্দগুলো ছেঁটে ছুটে প্রাপ্তি দিয়ে ঢাকা"

 

শহরের মানুষ বাঁধ ভাঙা বিলাসে ভাসে, হিংস্র স্বেচ্ছাচার তারা। বিবেক বিকৃত করে, চিন্তার ভাণ্ডটা ভেঙে কুকর্ম করে। তাদের বড়াই বেশি, গাঁ সুন্দর, গাঁ ভর্তি নিখাদ সারল্য সৌন্দর্য। কবি লেখেন,

"পূত হে গাঁ, ও পরম পূণ্যভূমি মায়ের আঁচল
তোমার ছায়ায় পুড়ে পাপ হয় নিষ্পাপ সকাল
নিশ্চুপ বৃক্ষরা দ্যাখো ঠিক তোমারই বোনের মতো
প্রাণের ফুয়েল দিয়ে টেনে করে সবুজ আদর" (পূত হে গাঁ)

 

প্রশান্তি ছিলো, সুখ ছিলো, মিল-মহব্বত ছিলো, ছবির মতো স্বপ্ন স্বদেশ ছিলো। অভয়, স্বর্গবাস ছিলো, আত্মীয়তায় বাঁধা জীবন ছিলো, হাসা-কাঁদার জীবন ছিলো; ছেলেবেলার আনন্দের খেলা ছিলো, আমকুড়ানো সকাল ছিলো। সব হারানোতে আজ শুধু স্মৃতিটুকুন আছে। কবি লেখেন,

"খুব সুরতীর হাসির ঠোঁটে বাঁকা চাঁদটা এঁকে
রাখতো দুখের বর্ষানামা মেঘগুলোকে ঢেকে
ঘুম তাড়ানো ভোর জাগানো পাখির ডাকাডাকি
অনেক কিছু হারিয়েছি স্মৃতিটুকুই বাকি
শান্তি ছিল শান্ত যেমন অশরীরী কন্যা
কেউ দেখেনি তাকে তেমন হতো ভাবের বন্যা" (শান্তি ছিল শান্ত যেমন)

 

বাংলার মানুষ, বাংলা ভাষা, বাংলায় ভাব প্রকাশ, বাংলার নদী, বাংলার সবুজ গাঁ, মাটি, বাংলার গান, বাংলার ফুল, শ্রমিক, মজুর, মেহনতি জেলেদের স্তুতি আছে কবির "বাংলা মায়ের কান্তি" কবিতায়। কবি লেখেন,

"বাংলাতে মা-র আদর মাখানো তিরস্কারের ধ্বনি
যেখানেই যাই, শোনা যায় তার মধুময় রনরনি
ষড়ঋতুদের বিচিত্র রঙ এই বাংলার বুকে
আকাশে বাতাসে ছন্দকথায় পরাণ দোলায় সুখে
সকলেই খাও, সকলেই বাঁচো, সকলেই পাও শান্তি
এভাবেই বলে, জনম-জনম বাংলা মায়ের কান্তি" (বাংলা মায়ের কান্তি)

 

ভাষা আন্দোলন, ভাষা শহীদ, ভাষার প্রতি ভালোবাসা, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা বিষয়কে উপজীব্য করে লেখা "নিয়ত একুশ" কবিতা থেকে-

"সালাম রফিক জব্বার কয়, ভাষা মাটি আর জাতি
জগৎ-সভায় এদের বিভায় আহা কী যে মাতামাতি
বরকত এসে বলে গেল ভোরে,'ঘাসের ডগায় শিশির
তার ভেতরেই হাসি-হাসি মুখে মিষ্টি রঙিন মিহির'
শানাবাঁধা ঘাটে বায়ান্ন এলো পূর্ণিমারাতে আজ
জলের মুকুরে গাছেদের সারি দেখছে খুশির সাজ"

 

পাঠান্তে, অরুণ সেনের কবিতায় সমাজ ও বাস্তবতার চিত্র রযেছে, মানুষের দ্বিমুখী আচরণ ও বৃহন্নলাবৃত্তির প্রতিচ্ছবি রয়েছে। সমাজপতিদের প্রতি তীক্ষ্ণ উচ্চারণ আছে, স্বাধিকারপ্রমত্ত মানুষের সংগ্রামও রয়েছে। সমাজ, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে কবি কবিতা লেখেন, সমাজ প্রত্যক্ষণপূর্বক তাঁর যে সোচ্চার উচ্চারণ রক্তে জাগরণ সৃষ্টি করে। কবির কাব্যগ্রন্থটি পড়ে যে নতুন চিন্তার উদয় হলো তা জীবন চলার পথে পাথেয় হবে। তাঁর "অনেক ভুলের প্রতিবেশী" কাব্যগ্রন্থটি পাঠকপ্রিয়তা পাক এই কামনা থাকলো।


অনেক ভুলের প্রতিবেশী
অরুণ সেন
স্বত্ব-চামেলী সেনগুপ্তা
প্রকাশনি-জবান
প্রকাশক-আবদুল ওয়াহেদ
প্রচ্ছদ-খালিদ আহসান
প্রথম প্রকাশ-ফেব্রুয়ারি, ২০১০
পৃষ্ঠা-৩২
মূল্য-২৫ টাকা
ISBN-978-984-33-0990-7

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ