২৮শে মে তারিখ যে বিজ্ঞানের জন্মদিন তা আমরা অনেকেই জানিনা। কিন্তু সেই দিনটিকে বিজ্ঞানের জন্মদিন হিসেবে মনে করা হয় কেন, তার মনোজ্ঞ ব্যাখ্যা দিয়ে শুরু দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখিত "আবিষ্কারের অভিযান" বইটি। আসলে শুরুর আগেও আর একটা শুরু থাকে।
বইটি গল্পের মত করে উপস্থাপিত। পাঁচু ডাক্তারের মাথায় গোবর ভরা তাই লেখককে সভাপতি হতে হবে এরকম একটি ঘটনা দিয়ে বইয়ের শুরু। সভাপতি হবার অনুষ্ঠানটা ছিল বিজ্ঞানের জন্মদিন পালনের। ২৮শে মে তারিখে "বিজ্ঞান-জয়ন্তী সভা" তারা কুলপি বরফ খেয়ে শুরু করেছিল। আর পিছনের ঘটনা বলতে গিয়ে কাহিনী এগিয়ে চলে পাতার পর পাতায়।
বিজ্ঞান কাকে বলে? বিজ্ঞানের সংজ্ঞা কী? প্রকৃতির সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক কী? বিজ্ঞান কী চায়? এরকম সহজ কিছু প্রশ্ন এক এক করে সামনে এসে হাজির হয়।
বিজ্ঞানের জন্মের কাহিনী বলতে গিয়ে আসে অগ্রযাত্রায় বাধা পাবার কথা। গ্রিক চিন্তাবিদ হেকাটিউস- এর লেখা বইপত্তর পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা চলে আসে। প্রসঙ্গক্রমে আসে প্রাচীন ভারতীয় ভিন্নমতাবলম্বী দার্শনিক চার্বাকদের কথা। লেখক মনে করেনঃ-
চার্বাকদের বিরুদ্ধে যে পাল্টা অভিযান তা আসলে বিজ্ঞানের বিরুদ্ধেই অভিযান। পৃষ্ঠা- ২০
লেখক "নতুন সংস্করণের মুখবন্ধ" লিখেছেন ১৯৯২ সালে। মূল সংস্করণ কত সালে প্রকাশিত তা বইয়ের কোথাও লেখা নেই। প্রকাশক তার প্রিন্টার্স লাইনেও প্রথম প্রকাশের তারিখটি লিখে দিতে পারতেন। বরং লেখকের ভাষ্য থেকে এই বই প্রথম প্রকাশের সময়কালের ভাবনা এবং বর্তমান বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির যুগে তার ভাষ্যগুলো কতটা বিজ্ঞানসম্মত যৌক্তিক বা সমকালীন বা প্রাসঙ্গিক রয়েছে সে ভাবনারও উত্তর মেলে। তিনি লেখেনঃ-
অন্তত পঞ্চাশ বছর হতে চলল এই বইটি আমি প্রথম লিখি। পঞ্চাশ বছর বড়ো কম সময় নয়। এর মধ্যে বিজ্ঞানের সমাজ পরিবর্তনের কৌশল নিয়ে এবং সর্বোপরি লেখকের ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে অনেক, অনেক অদল বদল ঘটে গেছে। তাই একবার মনে হয়েছিল, বইটি হয়ত আগাগোড়া নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। কিন্তু ভালো করে পড়েও মনে হলো তার দরকার খুব একটা বেশি নয়।
আসলে বিজ্ঞানের মূল বিষয়গুলো নিয়ে এই বইয়ের যাবতীয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। আর মূল ভিত্তি ঠিক রেখেই তো পরবর্তীতে অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ডালপালা বেড়ে ওঠে। মাত্র ৭২ পৃষ্ঠার ছোট এই বইয়ের আকারও ছোট। ৭"×৪.৮" আকারের বইটি সহজে হাতে এটে যায়। তাই যাত্রাপথে গাড়ীতে বসে দু'এক ঘন্টায় অনায়াসে বইটিকে পড়ে ফেলা যাবে। ওজন কম হওয়ায় দীর্ঘক্ষণ হাতে ধরে থাকলে হাতে ব্যথা করবে না।
বিজ্ঞান না চাওয়া মানুষ কারা ছিল?
প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন আসে। মিশর, ব্যবিলন প্রভৃতি প্রাচীনতম সভ্যতা থাকা সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত নবীন সভ্যতা গ্রিসের মিলেটাস কেন বিজ্ঞানের জন্মস্থান হল সেটাও তো এক জটিল প্রশ্ন। বিজ্ঞান না চাওয়া মানুষ কারা ছিল? কেন তারা বিজ্ঞানকে চায় না, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ তৈরিতে উৎসাহ দেয় না। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় বারবার বাধা দেয়? লেখক বিষয়টির ব্যাখ্যা দেন এক লাইনেই।যুগে যুগে তাই দেখা যায় পুরানো সংস্কারের বাধা বিজ্ঞানের সামনে। সেই বাধা ভেঙে ভেঙে আবিষ্কারের অভিযান। পৃষ্ঠা - ২৭
জন্ম নিয়েও বিজ্ঞানের মৃত্যু ঘটে। গ্রিসের মিলেটাস শহরে বিজ্ঞান জন্ম নেয়, কিন্তু গ্রিসের সমাজ ব্যবস্থায় এমন এক পরিবর্তন ঘটে যার ফলে মৃত্যু ঘটে বিজ্ঞানের। যার প্রভাবে বিজ্ঞানী এরিস্টটলও ভুল করেছিলেন। লেখক এর কারণ খুব সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করেন। বলেনঃ-
তাহলে দেখতেই পাচ্ছ, একজন পণ্ডিতের নিজের প্রতিভা যতোখানিই হোক না কেন, সমাজের ব্যবস্থায় যদি গলদ থাকে তাহলে সে প্রতিভাও ভেস্তে যাবার ভয়। তার মানে আসল সঙ্কটটা সমাজের। সে সঙ্কটের দরুনই আবিষ্কারের অভিযানেও সঙ্কট দেখা দেয়। পৃষ্ঠা - ৩৩
ভারতবর্ষেও ঘটেছিল একই অবস্থা। এখানে কারিগররা অচ্ছুত হবার ফলে জ্ঞানচর্চার প্রায়োগিক দিকটিও পণ্ডিতদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বলছেন, একেই তো দেশের একটা ঝোঁক ছিল কল্পনাবিলাসের প্রতি, সূক্ষ্ম দার্শনিক সমস্যা নিয়ে চুলচেরা বিচার করবার দিকে। তার এইভাবে কারিগরদের অচ্ছুৎ করে রাখবার ফলে জ্ঞানচর্চার জীবনটা থেকে যখন কৌতূহল মরে যেতে লাগল তখন দেশটা যেন পরীক্ষামূলক আর অভিজ্ঞতামূলক বিজ্ঞানের কাছ থেকে বিদায় নিল। পৃষ্ঠা- ৪০
প্রকৃতির সাথে মানুষের যে সমস্যা, যে বৈরিতা বিজ্ঞান সেসব অনেকাংশে দূর করতে পেরেছে। মানুষ প্রাকৃতিক বিপদ আপদে হয়েছে নির্ভয়, নিঃসংশয়। বিজ্ঞানের প্রশ্রয়ে মানুষের যত দুঃখ কষ্ট, যন্ত্রণা, বেদনা তার বেশিরভাগের উপশম হয়েছে। লেখক ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করেন এভাবেঃ-
বিজ্ঞান বলতে মানুষ এতদিন পর্যন্ত মনে করেছে শুধুমাত্র পৃথিবীর নিয়মকানুনগুলিকে জানা এবং ওই জ্ঞানের ভিত্তিতে সেগুলিকে জয় করা। সেই ধারণা নিয়ে এগিয়ে মানুষ আজ সত্যিই সত্যিই প্রকৃতিকে জয় করেছে অনেক অনেকখানি--- দুর্বার হয়ে উঠছে মানুষের শক্তি, দেখা দিয়েছে এমন সম্ভাবনা যে কোনো মানুষেরই দুঃখ, কষ্ট, অভাব-অভিযোগ বলে সত্যিই আজ আর কিছু থাকবার কথা নয়। পৃষ্ঠা- ৬৬
বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে প্রকৃতিকে বশ করা গিয়েছে, জয় করা গিয়েছে। কিন্তু মানুষের সব সমস্যাতো মিটে যায় নি। বিশেষ করে সামাজিক সমস্যাগুলো মানুষকে এখনও কুড়ে কুড়ে ক্ষয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞানে এত উৎকর্ষ থাকা সত্ত্বেও মানুষের যাবতীয় সমস্যার মূলে যে কারণ তার সন্ধান লেখক লুকিয়ে রাখেন না। গল্পের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেন সমাজের কোন কারণে একজন বিজ্ঞানী রোগের টীকা আবিষ্কার করেন আর সমাজের কোন প্রভাবে একজন বিজ্ঞানী নতুন শক্তির অস্ত্র আবিষ্কার করেন। প্রয়োজনটা মূলত কার তা লেখকের ভাষ্যে পাঠকের নিকট অজানা থাকে না। আর এর সমাধানের চাবিটাও যে মানবিক মানুষের হাতে সে কথা দরদী পাঠক নিজেই বুঝে ফেলেন।
বইয়ের ছাপার মান ভাল। প্রথম সংস্করণ থেকে বেশ কিছু ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে সেকথা কোথাও বলা হয় নি। ৪৮ পৃষ্ঠায় লেখা আছে "১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দে ভেসালিয়াস মানবদেহের গড়ন প্রসঙ্গে তার সুদীর্ঘ বই প্রকাশ করেন।" তারিখটি একেবারে ভুল। এর কোন সংশোধনী বইয়ের কোথাও লেখা নেই। এই বিষয়গুলো প্রকাশক পরবর্তী সংস্করণে সংশোধন করে নিবেন বলে আশা করি।
বিজ্ঞানপ্রিয় পাঠকের কাছে এই বই কতটা জনপ্রিয় হবে সেকথা আলাদাভাবে উল্লেখ করার দরকার আছে বলে মনে করি না।
@@@@@@@@@@
আবিষ্কারের অভিযান
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশকালঃ ২০১৮
প্রচ্ছদঃ মিতা মেহেদী
প্রকাশকঃ প্রগতি প্রকাশন, ঢাকা।
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৭২
মূল্যঃ ৭৫টাকা
ISBN: 978-984-93201-1-1
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম