আজ আমরা বিজ্ঞান বিষয়ে হরেকরকম প্রশ্ন দিয়ে সাজানো একটি বইয়ের সাথে পরিচিত হব। নাম "কী কেন কীভাবে"। লিখেছেন 'সামিহা সুলতানা অনন্যা'। তার ব্যক্তিগত পরিচিতি কোথাও দেয়া নেই, তাই তার সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। তবে তিনি যে বিজ্ঞানমনস্ক চেতনা ধারন করেন, তার পরিচয় বইয়ের ভূমিকা থেকে পাওয়া যায়। তার কথা থেকে বিজ্ঞান যে শুধু পড়ার জিনিস নয়, বাস্তব জীবনে প্রয়োগের বিষয় তা আমরা বুঝতে পারি।
কেন এই বই লিখেছেন? বা এ ধরনের প্রশ্ন দিয়ে ভর্তি বই লেখার উদ্দেশ্য কী, তার ব্যাখ্যা কিছুটা পাওয়া যায় বইয়ের ভূমিকাতে। সেখানে প্রথমেই লেখক লেখেনঃ-
কোনো ঘটনার বিজ্ঞানসম্মত কারণ জানতে পারলে সেই ঘটনার রহস্য সমাধান করা সম্ভব। প্রশ্ন করা এবং তার উত্তর খোঁজা ও জানার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানমনস্ক প্রজন্ম গড়ে ওঠে। বিজ্ঞানমনস্কতা আমাদের চারপাশের জগতকে নতুনভাবে দেখতে, যুক্তি দিয়ে বুঝতে সাহায্য করে। ফলে আমাদের জগতের নানা সমস্যার বিজ্ঞানসম্মত সমাধান বের করা সহজ হয়।
সমাজের অসঙ্গতি দূর করার জন্য শিক্ষিত মানুষদের বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারার প্রভাবই যথেষ্ট।
লেখকের চিন্তা সমর্থনযোগ্য। কোন সমাজের উন্নয়ন দৃশ্যমান হয় সে সমাজে বসবাসরত মানুষের শিক্ষার মান দেখে। যে সমাজের শিক্ষিত মানুষেরা বিজ্ঞানমনস্ক, সেই সমাজের জীবনযাত্রা মানসম্মত, দূর্নীতি বা অব্যবস্থাপনা সেখানে থাকে না। সেই সমাজে মানুষের কষ্ট, বেদনায় কোনরকম অজুহাত দেখিয়ে, কারও ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। আসলে যুক্তিপ্রবণ সমাজ হলে অপযুক্তি জায়গা পায় না। সমাজের অসঙ্গতি দূর করার জন্য শিক্ষিত মানুষদের বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারার প্রভাবই যথেষ্ট। আর যে সমাজে সমস্যা সমাধানের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি শিক্ষিত মানুষরা জানেন না, সেখানে মানুষের দুর্দশার কারণ ব্যাখ্যার জন্য নানারকম অজুহাত, পাশ কাটানো, অযৌক্তিক চিন্তাধারার সমাবেশ ঘটানো হয়। লেখক এই বিষয়ে বেশ সতর্ক। তাই কোনরকম রাখঢাক না রেখে সরাসরি বলেনঃ-বিজ্ঞানকে পড়ার বিষয় মনে না করে জানার বিষয়, বোঝার বিষয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর বিষয় মনে করতে হবে। পরীক্ষার জন্য না পড়ে বাস্তবজীবনে কাজে লাগানোর জন্য জানতে হবে। তবেই জীবনের সব প্রতিকূলতা সহজ হয়ে যাবে। নিজ থেকে জানার প্রবণতা, নতুন জ্ঞানকে জীবনে কাজে লাগানোর ইচ্ছা জীবনকে আরো আলোকিত করবে। সাফল্যের মুখোমুখি দাঁড় করাবে। নতুন নতুন বিষয় জানার আগ্রহকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যেই আমার এই বই।
মোট চল্লিশটি প্রশ্নের উত্তর রয়েছে এই বইতে। প্রধান চারটি প্রসঙ্গকে সামনে রেখে মাথায় কত প্রশ্ন আসে জাতীয় সমস্যাগুলোকে উপস্থাপন করা হয়েছে প্রশ্ন আকারে। আর সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে এই বইয়ের অবতারনা।
যে প্রধান চারটি বিষয় এই বইয়ের ভিত্তি, সেগুলো হল
- (ক) মানবদেহ
- (খ) জীবজগৎ
- (গ) প্রকৃতি-বিশ্বজগৎ
- (ঘ) প্রযুক্তি
বিষয়গুলো ব্যাপক হলেও যে আকর্ষণীয় সেকথা বলাই বাহুল্য। প্রতিটি প্রসঙ্গে আমাদের অনেকের মনে অনেক রকমের চিন্তা আসে, প্রশ্ন আসে। সেইসব প্রশ্নের সহজ সরল ব্যাখ্যা ও আলোচনা পাওয়া যাবে এই বইটিতে। প্রতিটি বিষয় থেকে সমান সংখ্যক প্রশ্ন নেয়া হয় নি। সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করা হয়েছে মানবদেহ সম্পর্কে, বাইশটি; জীবজগৎ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে ছয়টি, প্রকৃতি-বিশ্বজগৎ থেকে প্রশ্ন এসেছে সাতটি আর প্রযুক্তির উপরে করা হয়েছে পাঁচটি প্রশ্ন।
প্রশ্নগুলো কীরকম? তার উত্তর জানতে কয়েকটা প্রশ্ন নমুনা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
- আমাদের বয়স বাড়ে কেন?
- হিঁচকি বা হিক্কা ওঠে কেন?
- হাত পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে কেন?
- চোখের পাতা ফেলি কেন?
- আমরা চুলকাই কেন?
- নাকের শ্লেষ্মার কাজ কী?
- টিভি দেখা কি ক্ষতিকর?
- চুল-নখ কাটলে ব্যথা পাই না কেন?
- মাছ কি ঘুমায়?
- দিনের বেলা মশারা কোথায় যায়?
- সব তারা দেখতে একরকম নয় কেন?
- আলোর কি ভর আছে?
- মিথ্যার সত্য-মিথ্যা
- সেলফির বিজ্ঞান নিজের ছবি কেন নিজের কাছে অপছন্দ হয়?
কি অদ্ভূত আর রোমাঞ্চকর এই প্রশ্নগুলো, তাই না? আসলে সব প্রশ্নগুলোই মজার, রোমাঞ্চকর ও আকর্ষণীয়। কিন্তু সভ্যতাবিনাশী মতবাদের কারণে আমরা শৈশব থেকে প্রশ্ন করতে ভুলে যাই। ধমক, রাগ, হুমকী, প্রতারণা ইত্যাদির কারণে আমাদের প্রশ্ন করার আগ্রহ শৈশবেই নষ্ট করে দেয়া হয়। আমরা পরিণত হই প্রশ্নবিহীন রোবোটিক, একরৈখিক মানবে। লেখকের আগ্রহ এই শিশু-কিশোররা। তাই তার প্রশ্নগুলো যেমন মজার, তেমনি উত্তরগুলোও সহজ ভাষায় অল্প কথায়, তথ্যভারাক্রান্ত না করে অল্প আয়াসে একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মত করে উপস্থাপিত। আবার প্রশ্নভরা বই বলেই পরীক্ষার গাইড বইয়ের মত যে নয়- বইটি পড়তে গিয়ে সেকথাও একটু মাথায় রাখা দরকার।
বইটির আকার বেশ ছোট। পেপারব্যাক মলাটের ৭ ইঞ্চি×৪.৫ ইঞ্চি আকারের এই বই ছোট হাতব্যাগে সহজে নেয়া যাবে। যাত্রাপথে বা শুয়ে শুয়ে অল্প সময়ে চট করে পড়ার মত বই এটা। বইটির আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ এঁকেছেন মিতা মেহেদী। প্রচ্ছদপটে অনেকগুলো প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে তিনি মাথাভর্তি প্রশ্নগুলোকে হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন। বইয়ের ভিতরের পাতায় পাতায় অনেক হাতে আঁকা ছবি আছে। প্রশ্ন এবং তার উত্তরগুলোকে বোঝার জন্য ছবিগুলো বেশ কাজের। একটিমাত্র নীল রঙে ছাপানো আকর্ষণীয় ছবিগুলো একেছেন হেলাল সম্রাট। তার পরিশ্রমের কারণে বইটি একনাগাড়ে পড়তে গিয়ে অল্পবয়সী পাঠকদের নিকট একঘেয়ে লাগবে না। এরকম প্রশ্নকেন্দ্রিক বই ছাপিয়ে দ্যু প্রকাশন বেশ প্রশংসনীয় কাজ করেছে। বিজ্ঞান বিষয়ে তারা আরও বই বের করুক। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম বিজ্ঞান-আগ্রহী প্রশ্নপ্রেমী প্রজন্ম হিসেবে বেড়ে উঠুক, তাহলে যদি আমরা দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আশা করতে পারি। প্রত্যেক প্রশ্নতাড়িত নবীন প্রজন্মের হাতে এই বই থাকা উচিত।
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
কী কেন কীভাবে
সামিহা সুলতানা অনন্যা
প্রচ্ছদঃ মিতা মেহেদী
প্রকাশকঃ দ্যু প্রকাশন, ঢাকা।
প্রথম প্রকাশঃ ২০১৮
পৃষ্ঠাঃ ১১২
মূল্যঃ ১৫০ টাকা
ISBN: 978-984-8015-99-5
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম