বিজ্ঞান বিষয়ক ছড়ার বই “আয় দেখি ফুটোস্কোপ দিয়ে” - রোমেন রায়হান

“আয় দেখি ফুটোস্কোপ দিয়ে” - রোমেন রায়হান

বাংলাদেশের পশ্চাৎপদ অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগীয় সমাজে বিজ্ঞানচর্চাকে আনন্দময় করে তোলার জন্য যারা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে রোমেন রায়হান একজন। তার আন্তরিকতা ও পরিশ্রমের ছাপ রয়েছে "আয় দেখি ফুটোস্কোপ দিয়ে" বইয়ের পাতায় পাতায়। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান নিয়ে এই ধরনের মজার বই দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না।

বিজ্ঞানকে বাংলাদেশের সমাজে যেভাবে উপস্থাপিত করা হয়, তাতে শিক্ষার্থীদের মনে এক ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়। বোঝা যায় যে, শিক্ষার্থীদের পাঠের জন্য যারা বিজ্ঞানের বই লেখেন তারা নিজেরাই নিজেদের পঠিত বিষয়কে ভালবাসেন না বা তারা কেউ বিজ্ঞানমনস্ক নন। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত নিজেদের বিষয়টিকে যে তারা ভালবাসেন না তা নায়, তারা এতটাই আত্মকেন্দ্রিক বা আত্মপ্রেমী যে তাদের লেখা বই যারা পড়বে সেই অল্পবয়সী শিক্ষার্থীদেরকেও তারা ভালবাসেন না। সেকথা লেখক তার বইয়ের 'লেখকের কথা' অংশে চিহ্নিত করে দিয়েছেন।

সঠিক বিজ্ঞানশিক্ষা এবং বিজ্ঞানচর্চা ছাড়া একটি জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। এই উপলব্ধি থাকার পরও বিজ্ঞান বিষয়টিকে সহজহ করে তোলার ব্যাপারে আমাদের অনীহা চোখে পড়ার মতো। ছোটবেলা থেকেই শিশু মনে বিজ্ঞান বিষয়ে একটি আতংক ঢুকিয়ে দেয়া হয়। এই আতংক বাড়িয়ে তোলার পেছনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন আমাদের পাঠ্যপুস্তক প্রণেতারা।

লেখক দেশপ্রেমিক। তাই সমাজের উন্নয়নের সম্ভাব্য সকল দিক নিয়ে চিন্তা করেন। সে ভাবনা থেকে তিনি 'লেখকের কথা' অংশে বলেনঃ-

শিশু-কিশোরদের বিজ্ঞানশিক্ষার সাথে আনন্দ যোগ করাটাই এই সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।


প্রায় একই ধরনের কথা বইয়ের প্রথম প্রচ্ছদের ভিতরের ফ্ল্যাপে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধারণত এটা প্রকাশক বলে থাকেন। সেখানে আছে-

সভ্যতার এগিয়ে যাওয়া যার হাত ধরে, সেই বিজ্ঞানকে যদি জটিল, দুর্বোধ্য বা আনন্দহীন মনে হয়, তাহলে জানবেন সেটি আপনার সমস্যা নয়। দায়ী হচ্ছেন লেকক, যিনি সহজ এবং আনন্দময় করে বিজ্ঞানকে আপনার সামনে তুলে ধরতে পারেননি।

“আয় দেখি ফুটোস্কোপ দিয়ে” - রোমেন রায়হান - মশা'র অলংকরণ
মশা
আলোচ্য বইটি যে চিন্তা থেকে লেখা হয়েছে সে ভাবনাটি যুগোপযোগী এবং সমর্থনযোগ্য। লেখক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়কে ছড়ার আকারে ছন্দোবদ্ধ করে উপস্থাপন করেছেন। সহজভাবে বললে বলতে হয়, বিজ্ঞানের নানা উপাদানকে নিয়ে তিনি ছড়া লিখেছেন। বিষয়টি অভিনব ও তাই আকর্ষনীয়। কারণ প্রথমত বিজ্ঞানের বিষয়গুলি নিয়ে যে ছড়া লেখা যেতে পারে সেটাই হয়ত কেউ ভাবেন নি। আর দ্বিতীয়ত তিনি শুধু ভেবেই ক্ষান্ত হন নি; রীতিমত তেত্রিশটি ছড়া লিখে প্রমাণ করেছেন। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক ছড়া নিয়ে সম্ভবত এটাই প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র বই।

রোমেন রায়হান কর্মজীবনে ডাক্তার। এদেশের বেশিরভাগ ডাক্তার বিজ্ঞানমনস্ক নন। তারা নিজেরা যেমন, অন্যকেও তেমন ভাবেন; সেজন্য বিজ্ঞানচেতনা ছড়িয়ে দিতেও আগ্রহী বা উৎসাহী নন। কিন্তু এই বইয়ের লেখক অন্যরকমের মানুষ। নিজে ডাক্তার হবার কারণে বেসিক বিজ্ঞানের অনেককিছু তার জানা। আর নিজের জ্ঞান অন্যদের মধ্যে বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তিনি খুব ভালবাসেন। নিজের সন্ধিৎসু মনের কর্মকাণ্ডকে সবার সাথে ভাগ করে নিতে চান। শিশুদের প্রতি তার আন্তরিক ভালবাসার পরিচয় পাওয়া যায় ছড়াগুলোর ছত্রে ছত্রে। বিজ্ঞান নিয়ে ছড়া লেখা সহজ কাজ নয়। বিজ্ঞানের মূল সূত্রগুলো ঠিক রাখতে হবে, আবার সেই ছড়াটিও আবৃত্তি উপযোগী ছন্দময় হতে হবে। রোমেন রায়হান দুটো বিষয়কেই ঠিকঠাক রাখতে পেরেছেন।

যেহেতু ছড়ার বই, অতএব তিনি কেমন ছড়া লিখেছেন তা বোঝার জন্য দু একটা ছড়া উপস্থাপন করা যেতেই পারে।

শূন্য কবিতার কয়েকটি লাইন পাঠ করা যেতে পারেঃ

শূন্য প্রতীক সাদাসিধে
ভারতীয় গণিতবিদে
প্রতীকটাকে সংখ্যা করে ছিল সবার আগে।
জায়গামতো শূন্য বসা
সহজ হলো অংক কষা
স্থানে স্থানে দশগুণনে শূন্য কাজে লাগে। পৃষ্ঠা- ২৬

পুষ্টি কবিতাটার ছন্দ বেশ সহজবোধ্য ও আনন্দদায়ক। নমুনা হিসেবে কয়েক লাইন পড়া যেতে পারে।

পুষ্টি আছে বাড়ির কাছেই
পুঁই ও পালংশাকে
পুষ্টি আছে কাঁচা পেঁপেয়,
কিংবা যখন পাকে।
পুষ্টি আছে ছোট মাছে,
পুষ্টি আছে ফলে
রঙিন যত শাকসবজি
পুষ্টিকরের দলে। পৃষ্ঠা- ৬৬

কি মজার, তাই না? অল্পবয়সী ছন্দপ্রেমী প্রত্যেক শিশু-কিশোর ছড়াগুলো পছন্দ করবে একথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়।

দীর্ঘ সূচিপত্র তুলে দেয়া কঠিন বলে সেখান থেকে কয়েকটি ছড়ার নাম উল্লেখ করি। তাহলে এই বইতে কী ধরনের ছড়া আছে, তা বোঝা সহজ হবে। বিজ্ঞানের যে বিষয়গুলো নিয়ে ছড়া লেখা হয়েছে, তা বোঝা যায় ছড়ার নামকরণে। তাই কয়েকটি ছড়ার নাম উল্লেখ করা যেতেই পারে।

  • সূর্য পরিবার
  • ভালোবাসা রসায়ন
  • মশা
  • রক্ত
  • শূন্য
  • চুল
  • হাঁচি
  • হজম
  • চাঁদ
  • ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর
  • সালোকসংশ্লেষণ
  • ওজন
  • এনাটমি
  • ব্যাকটেরিয়া……… ইত্যাদি

বর্তমানে সারা পৃথিবীর মানুষ করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত। এই ভাইরাস মানুষের সমাজে প্রায় ৫ থেকে ১০ হাজার বৎসর ধরে আছে। অনেক ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করেছে। কীভাবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে নিজেকে নিরাপদ রাখা যায়, সে বিষয়েও লেখক সবাইকে সতর্ক করতে চেয়েছেন তার একটি ছড়ায়। 'অসুখ-বিসুখ' নামক একটি ছড়ায় তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক  সচেতন থাকার পদ্ধতি বলে দিয়েছেন। দীর্ঘ কবিতাটির শেষের দিকের কয়েকটি লাইন এই সুযোগে পড়ে নেয়া যেতে পারে।

রোগ ঠেকাতে তা তা করি
যা যা আসে মাথায়
সাবান মেখে হাত-মুখ ধুই,
হাঁচি শার্টের হাতায়।

রুমালে নাক ঢেকে হাঁটি,
খাই না কারো থালায়
ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে আছি
সত্যি ভীষণ জ্বালায়।

মুখের উপর দিচ্ছ হাঁচি!
এ কী আজব স্বভাব!
রোগ ছড়াতে করছ এসব?
দিচ্ছ না তো জবাব!
আসলে কি শত্রুতা, না
জ্ঞান-বুদ্ধির অভাব? পৃষ্ঠা- ৭৬

জ্ঞান-বুদ্ধির অভাব আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষেরই। মানুষের আচরণ দেখে কে শিক্ষিত কে অশিক্ষিত তা বোঝা কঠিন। যেন এদেশের শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলের মধ্যেই অভাব রয়েছে জ্ঞান-বুদ্ধির।

বইয়ের নামকরণটি আকর্ষণীয় হয়েছে। কিন্তু এই নামকরণটি কী তার নিজের দেয়া, নাকি অন্য কোন কবিতা বা ছড়া থেকে তুলে নেয়া লাইন, তা তিনি কোথাও উল্লেখ করেন নি। এর ফলে "ফুটোস্কোপ" শব্দটি দিয়ে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন, তা অস্পষ্ট থেকে গেছে। যারা বিভিন্ন বই পড়ে অভ্যস্ত তারা কিন্তু 'ফুটোস্কোপ' শব্দটি সুকুমার রায় না কার আবিষ্কার তা জানে। প্রচ্ছদশিল্পীও জানেন, আর তার নিজের সেই জানা জ্ঞান থেকেই ফুটোস্কোপকেন্দ্রিক প্রচ্ছদের ভাবনা ভেবেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হল যে ফুটোস্কোপ বা টেলিস্কোপ বা মাইক্রোস্কোপ নিয়ে কোন কবিতা বইয়ের কোথাও নেই। সুকুমার রায়ের লেখা 'বিজ্ঞান শিক্ষা' ছড়ার প্রথম লাইন থেকে শব্দটি তিনি কেন বা কী উদ্দেশ্যে নিয়েছেন তা কোথাও একটি বাক্য খরচ করে জানান নি। কেন জানান নি তার কোন ব্যাখ্যাও বইয়ের ভূমিকা বা 'লেখকের কথা' বা প্রথম বা শেষ প্রচ্ছদের ফ্ল্যাপ কোথাও লেখা নেই। দ্যু এর মত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কাছে এরকম ভুল আশা করা যায় না। নিশ্চয় পরবর্তী সংখ্যায় লেখক এবং প্রকাশক দুজনই এ বিষয়টি বিশেষ মনোযোগের সাথে খেয়াল করবেন।

চাঁদের পিঠে মানুষ। “আয় দেখি ফুটোস্কোপ দিয়ে” - রোমেন রায়হান
চাঁদের পিঠে মানুষ
লেখকের পরিচিতি পর্বে দেখা যায় তিনি ১৯৮৬ সাল থেকে ছড়া লেখা শুরু করেছেন। অর্থাৎ ৩৪ বৎসর হয়ে গেল ছড়ার সাথে মিতালী তার। এরপরও বেশ কিছু ছড়ায় ছন্দের অস্বাভাবিক পতন পড়ার গতিকে বাধাগ্রস্থ করে। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩০টিরও বেশি। তিনি শিশুসাহিত্য পুরস্কারসহ বেশ কয়েকটি জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কারও পেয়েছেন। তারপরও কোনও কোনও ছড়ার ছন্দ নির্মাণে তার দুর্বলতার কারণ বোধগম্য হল না।

বইটি বোর্ড বাঁধাই। এর মানে মলাটটি হার্ডবোর্ড জাতীয় শক্ত কাগজ দিয়ে তৈরি। ছাপার মান ভাল। লেখকের পাশাপাশি এজন্য প্রকাশককে ধন্যবাদ দিতেই হয়। বইয়ের আকর্ষণীয় প্রচ্ছদটি এঁকেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। বইয়ের ভিতরের প্রত্যেকটি পৃষ্ঠায় দুইরঙে ছাপা অলংকরণ রয়েছে। খয়েরি ও কাল রঙের শৈল্পিক মিশ্রণে আঁকা ছবিগুলো দেখতে ভাল লাগে। পড়তে গিয়ে একঘেয়ে লাগে না। অল্পবয়সী পাঠকদের উপযোগী এই মনোহর ছবিগুলো এঁকেছেন অমিত রোহান। তাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ।

এই ধরনের বই বাংলা ভাষায় আরও প্রকাশিত হোক এই প্রত্যাশা করি।

_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_#_

আয় দেখি ফুটোস্কোপ দিয়ে
রোমেন রায়হান

প্রচ্ছদঃ মোস্তাফিজ কারিগর
অলংকরণঃ অমিত রোহান
প্রকাশকঃ দ্যু প্রকাশন
প্রকাশকালঃ ২০২০
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৮০
মূল্যঃ ১৫০ টাকা
ISBN: 978-984-8015-32-2

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ