বইটি উপস্থাপিত হয়েছে একটি কথোপকথন শুরু করার মধ্য দিয়ে। দেবীপ্রসাদের রচনার এটাই স্টাইল। তিনি কোন দুইজনের মধ্যে প্রশ্ন এবং তার উত্তরের মাধ্যমে শুরু করেন। উত্তর বা ব্যাখ্যা বা আলোচনাটিই মূল বইয়ে রূপান্তরিত হয়। আলোচনা পাতার পর পাতায় ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে চলে। পাঠক পড়তে পড়তে বুঝে যান মূল প্রশ্নের উত্তর। জেনে যান সমস্যার গভীরে থাকা সহজ সমাধানকে। বইটি শুরুর দিকের কয়েকটি বাক্য উপস্থাপন করলে বিষয়টির অনুধাবন সহজ হবে।
ছাদের টবে টুকটুকে লাল ফুল ফুটেছে।
কী করে জানলাম? বারে, স্বচক্ষে দেখলাম যে!
পাশের বাড়ির নেড়ী তারস্বরে গলা সাধছে।
কী করে জানলাম? বারে, কান একেবারে ঝালাপালা হয়ে গেলো যে! পৃষ্ঠা- ৫
মোট উনিশটি প্রসঙ্গ দিয়ে এই বইয়ের ছোট অবয়বটি তৈরি। সূচিপত্র উপস্থাপন করার লোভ সামলানো গেল না।
সূচিপত্র
- খবর পাবার খবর
- পাঁচ-পাঁচটি খবর-দার
- পণ্ডিতী নাম ইন্দ্রিয়
- দেখলাম ধুঁয়ো জানলাম আগুন
- অনুমানের গোড়ার কথা
- দুনিয়ার নানান বিভাগ
- নিষ্ঠা নিয়ে দেখা
- দেখতে পাবার সীমানা বাড়ানো
- ল্যাবরেটারি কেন?
- প্রকৃতির নিয়মকানুন মানে কী?
- জানা থেকে অজানায় ঝাঁপ
- প্রত্যেক ঘটনারই কারণ আছে
- কারণ মানে কী?
- কারণ আবিষ্কারের কায়দা
- বিজ্ঞান মানে কী?
- কথাটা যে সত্যি তা বুঝবো কেমন করে?
- জ্ঞান বড়ো না কর্ম বড়ো
- হাত আর মগজ
- প্রকৃতিকে জয় করা আর প্রকৃতিকে জানা
বেশ আকর্ষণীয় সূচিপত্র, তাই না? যে পাঠক কৌতুহলী প্রশ্নপ্রবণ, সে তো মনে হয় এক বসাতেই সম্পূর্ণ বইটা পড়ে ফেলতে চাইবে। হ্যাঁ, সেটা সম্ভব। কারণ বইটি মাত্র ৫৬ পৃষ্ঠার। ৭.২ ইঞ্চি × ৪.৬ ইঞ্চি আকারের এই বই পৃষ্ঠাসংখ্যার বিচারেও বেশ হালকা। ফলে হাতব্যাগে রেখে দিয়ে যাত্রাপথে এক বসাতেই পড়ে ফেলা যাবে।
অনুবীক্ষণ ও টেলিস্কোপ |
নির্ভুল অনুমান করতে হলে এই রকমের কোন-না-কোনো নির্ভুল কথা থেকে শুরু করতে হবে।… আমার অনুমানটা নির্ভুল হয়েছিলো। কেননা, আমি এমন একটি জ্ঞান থেকে শুরু করেছিলাম যে জ্ঞানের দুটো লক্ষণ ছিলো:
এক।। জ্ঞানটা সব-দৃষ্টান্তর বেলায় সত্যি – শুধুমাত্র কোনো-কোনো দৃষ্টান্তটুকুর বেলাতেই যে সত্যি তা নয়।
দুই।। জ্ঞানটার মধ্যে একটা বাধ্য-বাধকতার ভাব আছে – কথাটা শুধুমাত্র সম্ভব নয়, সুনিশ্চিত। পৃষ্ঠা -১৬
বিজ্ঞান কী সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার অভিযানে লেখক এভাবেই এক এক করে এগিয়ে যান। প্রশ্ন, এর উত্তর পাওয়ার উপায়, লব্ধ জ্ঞান, তার বিশ্লেষণ, পূর্ব অভিজ্ঞতার সাথে তুলনা করে এভাবে এক পর্যায়ে গিয়ে বলেনঃ-
বিজ্ঞান কী? এ-প্রশ্নের একটা একমেটে জবাব হিসেবে আমরা বললাম, বিজ্ঞান হলো এমন কিছু যার সাহায্যে আমরা দুনিয়ার জ্ঞান পাই – সে-জ্ঞান সবক্ষেত্রে সত্যি এবং সত্যি হতে বাধ্য। এই কথাটাকে আর একটু ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমরা বললাম, সব-বিজ্ঞানই দুনিয়ার সবকিছু একসঙ্গে জানবার চেষ্টা করে না। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা দুনিয়ার বিভিন্ন বিভাগের জ্ঞান পাবার চেষ্টা করে। পৃষ্ঠা- ১৯
লেখক বিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের বিভিন্নরকম আগ্রহকে এভাবে পূর্ণ করার চেষ্টা করেন। তিনি আমাদের তথা সাধারণ মানুষের জ্ঞানের মাত্রা এবং অভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানেন। তাই সহজভাবে বলেনঃ-
আমাদের সাধারণ দেখাটা প্রায়ই অযত্নের দেখা, হেলাফেলা করে দেখা, এলোমেলো ভাবে দেখা। বৈজ্ঞানিকেরা দেখতে চান অনেক বেশি যত্ন নিয়ে, অনেক ভালো করে, গুছিয়ে, খতিয়ে। পৃষ্ঠা- ২১
বইয়ের মাঝামাঝি এসে লেখক কথাপ্রসঙ্গের আড়ালেই যেন বলেছেন এমন ভঙ্গিতে জানিয়ে দেন বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য। “ল্যাবরেটারি কেন?” অধ্যায়ের শেষে লেখক জানিয়ে দেনঃ-
… ল্যাবরেটারির ভিতরকার ঘটনাগুলি যদি সত্যিই প্রাকৃতিক ঘটনা না হতো তাহলে সেগুলিকে দেখে বৈজ্ঞানিকদের পক্ষে প্রকৃতিকে জানা, – প্রকৃতিকে চেনা, – সম্ভবই হতো না। তার মানে, ল্যাবরেটারি তৈরি করতে গিয়ে বৈজ্ঞানিকদের আসল উদ্দেশ্যটাই যেতো ভেস্তে। বৈজ্ঞানিকদের আসল উদ্দেশ্যে কী? প্রকৃতিকে জানা। প্রকৃতির জ্ঞান পাওয়া। পৃষ্ঠা- ৩০
ঠিক সেটাই। প্রকৃতির জ্ঞান শুধু ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর করলে খুব বেশি পাওয়া যাবে না। আবার অনুমানের উপর নির্ভর করলে সবক্ষেত্রে একই ফলাফল নাও হতে পারে। তাই দরকার ল্যাবরেটরি বা পরীক্ষাগার। এখানে বিজ্ঞানীগণ প্রকৃতির পরিবেশ বা বিভিন্ন শর্ত ঠিক রেখে ইন্দ্রিয় থেকে পাওয়া জ্ঞানের সাথে অনুমান থেকে নেয়া সিদ্ধান্ত পরীক্ষা করতে পারেন। নিজের নেয়া সিদ্ধান্তের পুনর্বিবেচনা করতে পারেন। নিপুণ গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য পাওয়ার পর সে সিদ্ধান্ত হবে বিজ্ঞানসম্মত বা সকল বিজ্ঞানীর নিকট গ্রহণযোগ্য।
বিজ্ঞান বিষয়ে এই ধরণের বই বাংলা ভাষায় খুব একটা নেই। যেসব বই বাজারে প্রচলিত তার বেশিরভাগ প্রযুক্তির খবরনির্ভর। বিজ্ঞানের বিষয় নিয়েও কিছু বই আছে, কিন্তু সেগুলোর পিছনে যতটা না বিজ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্য থাকে, তার চেয়ে বেশি থাকে যেন ব্যবসার উদ্দেশ্য। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে যারা চেনেন, তাঁর নাম যারা শুনেছেন, তারা বুঝবেন বিজ্ঞানচর্চাকে তিনি আড্ডাবাজির বিষয় মনে করতেন না। বিজ্ঞানচর্চা ছিল তাঁর কাছে জীবনচর্চার সমান।
গবেষণা চলছে |
এরকম একটি আকর্ষণীয় অমূল্য বই প্রকাশ করে প্রকাশক মহোদয় বেশ প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। কিন্তু কিছু ত্রুটি একেবারে দৃষ্টিকটু লেগেছে। বইটির প্রথম প্রকাশ কবে সে তথ্য কোথাও লেখা নেই। লেখক কোন মুখবন্ধ বা ভূমিকা নামের কোন কিছু লিখেছেন কি না, তাও বইয়ে দেয়া নেই। দেবীপ্রসাদ চট্টোাপাধ্যায় একজন বিখ্যাত লেখক। তাঁর বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস ও সমাজ সম্পর্কে বইগুলো অনেক জনপ্রিয়। তিনি মারা গেছেন ১৯৯৩ সালে। আর এই বই প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালে। প্রিন্টার্স লাইন বা শেষ প্রচ্ছদ কোথাও বইটির প্রথম প্রকাশের সাল লেখা নেই। প্রকাশনীর নাম দেখে মনে হয় 'প্রগতি প্রকাশন' প্রগতিশীল মানসিকতার। কিন্তু এসব তথ্য না দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার কাজ তারা কেন করলেন সেটা বোঝা গেল না। এই ধরণের কাজ তো সাধারণত বটতলার পুঁথি বা পাইরেট বইয়ের প্রকাশকরা করে থাকে। তাদের মত একই কাজ প্রগতি নামাঙ্কিত প্রকাশন কেন করবে?
বইয়ের প্রচ্ছদটি মিতা মেহেদীর করা। আমরা এর আগে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের "আবিষ্কারের অভিযান" বইয়ের রিভিউ প্রকাশ করেছি। সেই বইয়ের প্রচ্ছদের সাথে এই বইয়ের প্রচ্ছদের বেশ কিছু মিল আছে। এটা প্রচ্ছদশিল্পী মিতা মেহেদী করেছেন নাকি দেবীপ্রসাদ নিজে করেছেন, তার কোন উল্লেখ বইয়ের কোথাও নেই। বইয়ের ভিতরে বেশ কয়েকটি কৌতুককর অলংকরণ রয়েছে। সেগুলো কার আঁকা সে কথাও বইয়ের কোথাও উল্লেখ নেই। তবে মনে হয় প্রথম সংখ্যা থেকে নেয়া হয়েছে। যাহোক, অল্পবয়সী পাঠকেরা বইটি পছন্দ করবে একথা নিশ্চিত করে বলে দেয়া যায়। প্রত্যাশা করি প্রকৃতির রহস্যসন্ধানী নতুন প্রজন্ম এই বইকে আগ্রহের সাথে হাতে তুলে নিবে।
--০--০--০--০--০--
বিজ্ঞান কি ও কেন?
দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
প্রচ্ছদঃ মিতা মেহেদী
প্রকাশকঃ প্রগতি প্রকাশন, ঢাকা।
প্রকাশকালঃ ২০১৮
পৃষ্ঠাঃ ৫৬
মূল্যঃ ৭৫
ISBN: 978-984-93201-2-8
2 মন্তব্যসমূহ
রিভিউটা দেবী প্রসাদের মতো সহজ ও প্রাঞ্জল।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনমার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম