অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার অদম্য ইচ্ছা মানুষকে পথ দেখিয়েছে মানবসভ্যতার জন্মলগ্ন থেকেই। কৌতুহল তাকে নিয়ে গেছে সাগরের অতল গভীরে, হিমালয়ের চূড়ায় কিংবা মহাকাশের সুদূর প্রান্তে। একটা সময় ছিল, যখন মানুষের মহাবিশ্ব ছিল চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ আর তারকা খচিত ছাদের নিচে আবদ্ধ। ঠিক ততটাই, যতটা সে খালি চোখে দেখতে পেত। এখন প্রযুক্তির কল্যাণে দিগন্ত গেছে সরে, বেড়েছে জানার পরিধি। কিন্তু মানুষ বসে থাকেনি। করেছে নতুন প্রশ্ন, নতুন জ্ঞান নিয়ে নতুন অজানার পেছনে ছুটেছে সে। এ যেন মরীচিকার পেছনে ছোটা। কিন্তু সত্যি কি তাই? জ্ঞান কি মরীচিকা? মোটেই নয়। জ্ঞান এক অন্তহীন ভাণ্ডার যে চলে উলটো নিয়মে। মানুষ যতই নেয় জ্ঞানের ভাণ্ডার ততই বাড়ে। কৌতূহলী মানুষ আরও জানতে চায়, নতুন করে শুরু হয় তার অন্বেষণ। জানা অজানা আর কৌতূহলের এই অবিরাম লুকোচুরি খেলার ফলে মহাবিশ্বের অনেক রহস্যই আজ উন্মোচিত। যেটুকু জানা সেটা জানানোর, যেটা অজানা তাকে জানার ইচ্ছা জাগানোর এক ক্ষুদ্র প্রয়াস এই গল্পে গল্পে মহাবিশ্ব ভ্রমণ। পৃষ্ঠা- ১৪
বইয়ের নামটাই তার চরিত্র বর্ণনায় যথেষ্ঠ। আমরা অ্যাস্ট্রোনমি চিনি, অ্যাস্ট্রোলজিকেও জানি; কিন্তু কসমোলজি কী সে সম্পর্কে আমাদের ধারণায় কিছু কমতি আছে। লেখক কসমোলজির গবেষক, তিনি আমাদের এই অজ্ঞতার বিষয়টি বোঝেন, আর সেজন্য সহজভাবে জানাতে চেয়েছেন কসমোলজি বিষয়টির ব্যাপ্তি। কসমোলজি বিজ্ঞানেরই একটি বিশেষ শাখা যেখানে মহাবিশ্বের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করা হয়। কসমোলজির আলোচ্য বিষয়গুলোর কথা জানান ১৫ পৃষ্ঠার শুরুতেই।
- মহাবিশ্বের উৎপত্তি
- মহাবিশ্বের গঠন
- স্পেস-টাইম বা স্থান-কালের পারস্পরিক সম্পর্ক
- মহাবিশ্বের বিবর্তন
- মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি
অর্থাৎ কসমোলজি হল বিজ্ঞানের এমন একটা দিক বা তত্ত্ব যা মহাকাশ গঠন করার জন্য যে প্রাকৃতিক নিয়মকানুন ও বিশিষ্টতা রয়েছে, সেসব নিয়ে আলোচনা করে।
মহাবিশ্বের গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রপুঞ্জের বিন্যাস। ছবি: উইকিপিডিয়া |
লেখক শুরু করেন মানুষ কবে থেকে মহাকাশ নিয়ে আগ্রহী হল তার ইতিহাস দিয়ে। তারপর একে একে বিভিন্ন সভ্যতা, দর্শনে, কল্পনায় কীভাবে মহাকাশের উপাদানগুলোকে বর্ণনা করা হয়েছে তার পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থাপন করেন। সূচিপত্র দেখলে লেখকের প্রচেষ্টা হৃদয়ঙ্গম হবে।
- পূর্বকথা
- শুরুর আগে, শুরুর পরে
- কসমোলজি কী?
- অ্যানসিয়েন্ট বা প্রাচীন কসমোলজি এবং মাইথোলজি
- নিওলিথিক কসমোলজি
- ইজিপসিয়ান বা মিশরীয় কসমোলজি
- মেসোপটেমিয়ান কসমোলজি
- প্রাচীন হিব্রু বিশ্বব্রহ্মাণ্ড
- বাইবেল বর্ণিত সৃষ্টি রহস্য
- মধ্যযুগের ইসলামীয় কসমোলজি
- বৌদ্ধ কসমোলজি
- জৈন কসমোলজি
- হিন্দু কসমোলজি
- ফিজিক্যাল বা ভৌত কসমোলজি
- ভারতীয় কসমোলজি
- বৈজ্ঞানিক কসমোলজি
- মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ত্বরণ
- সুপারনোভা
- মহাবিশ্বের আকার
- বিগ-ব্যাং বিস্ফোরণ নাকি অন্য কিছু
- কেমন ছিল মহাবিশ্ব বিগ-ব্যাং এর আগে?
- মহাবিশ্বের কেন্দ্র
- মহাকাশের বাসিন্দারা
- নক্ষত্র
- নক্ষত্রপুঞ্জ
- নীহারিকা
- গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ
- মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা
- সৌরজগৎ
- সূর্য
- বুধ
- শুক্র
- মঙ্গল
- বৃহস্পতি
- শনি
- ইউরেনাস
- নেপচুন
- প্লুটো
- ধুমকেতু
- চাঁদ
- পৃথিবী
- ব্ল্যাক হোল
- পোকার গর্ত
- ডার্ক এনার্জির রাজ্যে
- ডার্ক এনার্জি মডেল
- কসমোলজিক্যাল মডেল
- টেলিস্কোপের ইতিহাস
- রেডিও টেলিস্কোপ
- ইনফ্রারেড টেলিস্কোপ
- আলট্রা-ভায়লেট টেলিস্কোপ
- এক্স-রে টেলিস্কোপ
- গামা-রে টেলিস্কোপ
- আমি কীভাবে এখানে এলাম
- গ্রন্থসূত্র
সূচিপত্র দেখে বোঝা যাচ্ছে মহাকাশবিজ্ঞানের ব্যাপ্তি কীরকম। তবে লেখকের ইচ্ছা ছিল সহজে এবং সংক্ষেপে আলোচনা করা। তাই খুব বেশি বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্তের উপস্থাপন ছাড়াই তিনি ১৫২ পৃষ্ঠার মধ্যে মহাকাশ বিষয়টাকে ধরে রাখতে পেরেছেন।
মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ইতিহাস। ছবি: উইকিপিডিয়া |
বইয়ের ভাষাভঙ্গি সহজ। ছোট ছোট বাক্যে বিষয়কে যতটা সম্ভব সরল করে উপস্থাপন করা হয়েছে। লেখক নিজে কৈশোর থেকে মহাকাশকে ভালবেসেছেন। বর্তমানে মহাকাশ গবেষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তাই যতটা সম্ভব নতুন তথ্য পাঠককে দিয়েছেন। একজন বিষয় সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীর কাছ থেকে তার পঠিত বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা বেশ উপভোগ্য। একথা 'কসমোলজির সেকাল- একাল' বইটি একনজর দেখলে ভালভাবে বোঝা যায়। বইয়ের ভিতরে পাতায় পাতায় অনেক ছবি দেয়া আছে। মহাকাশের বিভিন্ন উপাদান, মিথোলজির কল্পনা, তত্ত্বের রূপায়ন, ছক, সমীকরণ ইত্যাদির চিত্র দেয়ায় পাঠকের কৌতূহল অনেকাংশে তৃপ্ত হবে। বইয়ের শেষে সংযুক্ত গ্রন্থপঞ্জি উৎসাহী পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণাকে আরও উস্কে দেবে। তবে রহস্যময় প্রচ্ছদটির পরিকল্পনা কে করেছেন তা প্রিন্টার্স লাইন, বা সামনে-পিছনের ফ্ল্যাপ কোথাও ইংরেজি বা বাংলা কোন ভাষায় লেখা না থাকায় একটু খটকা লাগল। কেন তার নাম লেখা হল না, তার ব্যাখ্যা কোনখানে দেয়া নেই।
বইয়ের আকার বেশ ছোট। পেপারব্যাক মলাটের বইটি ৬.৮ ইঞ্চি×৪.৬ ইঞ্চি হওয়ায় সহজে ব্যবহারযোগ্য। পৃষ্ঠাসংখ্যাও খুব বেশি নয়। ফলে পড়া শুরু করতে দ্বিধা হবার কথা নয়। বইটি প্রকাশ করার সময় প্রকাশক যে একটু বেশি যত্ন নিয়েছেন, তা বেশ বোঝা যায়। এজন্য প্রকাশক বিশেষ ধন্যবাদ পেতেই পারেন। আর, বাংলাদেশের সমাজের বর্তমান যে অবস্থা, তাতে মহাকাশ তো দূরের -কথা, যে কোন কিছু সম্পর্কে কৌতূহল বা প্রশ্ন করার প্রবণতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। আসলে অনুৎসাহিত করা হচ্ছে। এরকম উদ্ভট সমকালে এই জাতীয় একটি বইয়ের সাথে সংযুক্ত থেকে লেখক এবং প্রকাশক বেশ সাহসী কাজ করেছেন। তাদের এই উদ্যোগ দেশের কৌতূহলী নতুন প্রজন্মের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাতে সহায়ক হবে। এই ধরণের তথ্যমূলক বিজ্ঞানভিত্তিক বই আরও প্রকাশিত হোক সেই প্রত্যাশা করি। এই বই নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানপ্রেমী পাঠকদের কাছে সাদরে গৃহীত হবে।
~~#~~#~~#~~#~~
আপডেট: এই বইয়ের গ্রন্থপঞ্জী প্রকাশ করা হল।
পড়ুন 'বিজন সাহা' রচিত 'আকাশ ভরা সূর্য তারা' বইয়ের গ্রন্থপঞ্জী
~~#~~#~~#~~#~~
আকাশ ভরা সূর্য তারা - কসমোলজির সেকাল একাল
বিজন সাহা
প্রকাশকালঃ ২০১৯
প্রকাশকঃ দ্যু প্রকাশন, ঢাকা।
পৃষ্ঠাঃ ১৫২
মূল্যঃ ২০০ টাকা
ISBN: 978-984-8015-75-9
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম