বাংলা ভাষায় লেখা শিশুতোষ সাহিত্যের বিভিন্ন দিকে লেখকের আগ্রহ। বাংলা ভাষায় শিশুদের মনভোলাতে কবি-লেখকগণ যেসব রচনাকার্য করেছেন সেসবের উপর মনযোগ তার। বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যে শিশু কত বিচিত্ররূপেই না উপস্থিত হয়েছে? ব্যাপক বর্ণিল সে উপস্থিতির একাংশ আলোচনা করেছেন জনাব আতোয়ার রহমান তাঁর "শিশু শিক্ষা ও শিশুতোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ” বইয়ে। বাংলা একাডেমীর মত প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত বইয়ে থাকা তথ্যের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। লেখক নিজেও বাংলা ভাষায় শিশু সাহিত্য বিষয়ে পণ্ডিত। বইয়ের ৩য় প্রচ্ছদে থাকা ফ্লাপে লেখা হয়েছে:
তাঁর প্রায় চল্লিশটি শিশুতোষ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।… শিশুসাহিত্যের গবেষণায় বাংলাদেশে তিনি বিশিষ্ট কর্মী।
এক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য লেখক 'বাংলাদেশের শিশুপত্রিকা' সহ বাংলা একাডেমী, শিশু একাডেমী ইত্যাদি সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন। শিশুসাহিত্য বিষয়ে এত ব্যাপক কর্মযজ্ঞ যার, তার লেখা বই অপেক্ষাকৃত তৃপ্তিদায়ক হবে সে কথা বলাই বাহুল্য।
এই বইতে যেভাবে তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে একে গবেষণাগ্রন্থ বলা যেতে পারে। কোন গবেষণাকার্যের অংশ হিসেবে বইাটি রচনা করা হয়েছে কী না, তা কোথাও লেখা নেই । অতি সংক্ষিপ্ত 'ভূমিকা' তে শুধুমাত্র বইয়ের রচনাকাল ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার নিয়ে লেখার সূত্র জানিয়ে দেন। সরাসরি সূচিপত্রের মাধ্যমে প্রবেশ করেন বইয়ের মূল অংশে।
মাত্র সাতটি প্রসঙ্গ দিয়ে সূচিপত্রটি সাজানো। এক ঝলকে দেখে নেয়া গেলেও বোঝা যায় এক বসাতে পড়ে ফেলার মত বই এটা নয়। মাত্র ১২৬টি পৃষ্ঠা হলেও তাড়াতাড়ি এই বই পড়া কঠিন। এই প্রসঙ্গে সূচিপত্রটি একবার দেখে নেয়া যাক।
- কলকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি
- মদনমোহন তর্কালঙ্কার
- হরিনাথ মজুমদারের শিশুসাহিত্য
- ছেলে ভুলানো ছড়ায় শ্রেণীচিত্র
- কলকণ্ঠ
- ছোটদের লেখক দাদাভাই
নিবিষ্ট পাঠক বিষয়গুলোর ঐশ্বর্য বুঝতে পারবেন। খুশি হয়ে উঠবেন এই বই হাতে নিয়ে। সূচিপত্র দেখে বিষয়ের পরিব্যাপ্তি অনুধাবন করতে পারবেন।
সাতটি প্রসঙ্গ বিস্তারিতভাবে একাধিক উদাহরণসহ উপস্থাপনের যে পদ্ধতি এই বইতে অনুসৃত হয়েছে তা বেশ তথ্যবহুল। বিষয় নির্বাচনেও রয়েছে মননের পরিচয়।
প্রথম প্রবন্ধ "কলকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি" একটি ঐতিহাসিক তথ্যের আকর রচনা। ভারত বর্ষে ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর পরই বাংলা ভাষা শেখার একটি প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। যার ফলশ্রুতিতে জন্ম হয় “কলকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি” এর। ১৮১৭ সালে এর প্রতিষ্ঠাকালে উদ্দেশ্য ছিল বাংলাভাষাকে সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করার। শিশুদের মানসিকতা সহজ সরল। শিশুদের জন্য যে বই রচনা করা হয় তাতে শব্দব্যবহার এবং ভাষারীতিতে সকল প্রকারের জটিলতা পরিহার করা হয়। তাই "কলকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি" শিশুদের বই প্রকাশ করার মাধ্যমে নিজেদের যাত্রা শুরু করেছিল। ১৯১২ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই লক্ষ্য থেকে তারা বিরত থাকে নি।
"কলকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি" যে সব বই প্রকাশ করেছে সেগুলোর অর্থনৈতিক উৎস, ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, প্রকাশিত বইসমূহের ভাষারীতি প্রভৃতি বিষয়ে লেখক ঐতিহাসিক ধারাবাহিক ক্রমে তথ্য উপাত্ত প্রদান করেছেন। বাইশ পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ আলোচনায় সেকালের শিশু সাহিত্য প্রকাশে এবং শিশুসাহিত্যের লেখকদের উৎসাহ প্রদানে "কলকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি"র যে লম্বা ভূমিকা তার তথ্যসমৃদ্ধ বিবরণ রয়েছে।
সেকালের বাংলা বইগুলোতে ভূমিকা লেখার প্রচলন ছিল না। রামকমল সেন সম্পাদিত 'হিতোপদেশ' প্রকাশকালে বাংলা ভাষার প্রথম ভূমিকা প্রকাশ করা হয়। গ্রন্থপ্রণেতা লেখেন:
মনুষ্যের মধ্যে স্বাভাবিক কর্তৃক ব্যবহার ও দোষ আছে; সে কাল বিশেষ ও দেশ বিশেষ ও জাতি বিশেষ কৃত নয়, কিন্তু সর্ব্বসাধারণ, এই সর্ব্বসাধারণ দোষ কিম্বা ব্যবহারানুসারে যে হিতোপদেশ কথা যায়, সে হিতোপদেশ তাজা থাকে; সে হিতোপদেশ রচনা করিবার হাজার হাজার বৎসর পরেও তাহা বোধগম্য হয়। পৃষ্ঠা- ১১
"কলকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি" এক সময় 'পশ্বাবলী' নামে একটি বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশ করেছিল। এছাড়া দিগদর্শন, জ্ঞানোদয় প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশের কথা জানা যায়। বাংলা শিশু সাহিত্যের প্রথম গবেষক ও ইতিহাসকার খগেন্দ্রনাথ মিত্র বলেন:
প্রকৃতপক্ষে কলিকাতা স্কুল-বুক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বাংলার বর্তমান শিশু-সাহিত্যের আরম্ভ এবং এখন থেকে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যুগারম্ভের (১৮৪৭ সাল-প্রবন্ধকার) পূর্ব পর্যন্ত এই সাহিত্যের উন্নতিবিধান করে প্রধানতঃ এই প্রতিষ্ঠান। পৃষ্ঠা - ১৭
বাংলা ভাষায় একটিমাত্র কবিতা রচনা করে অমরত্ব পেয়েছেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার নামক প্রবন্ধের আলোচ্য ব্যক্তিটি। তাঁর সেই বিশেষ কবিতাটি শিশুতোষ।
পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল।
কাননে কুসুম কলি, সকলি ফুটিল।।
রাখাল গরুল পাল, লয়ে যায় মাঠে।
শিশুগণ দেয় মন, নিজ নিজ পাঠে।।
…
শীতল বাতাস বয়, জুড়ায় শরীর।
পাতায় পাতায় পড়ে, নিশির শিশির।। - পৃষ্ঠা - ২৩
এই কবিতাটা রচনার পর থেকে প্রত্যেক বাঙালি শিশু তার শিক্ষার প্রথম বছরে এই কবিতাটা পাঠ করে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে কবিতাটির আবেদন থাকছে অক্ষুন্ন। ১৮৪৯ সালে কবিতাটি প্রকাশ পায় মদনমোহন তর্কালঙ্কার রচিত “শিশুশিক্ষা” বইতে।
এই কবিতার বিভিন্ন দিক আলোচ্য প্রবন্ধের অন্যতম অংশ। প্রবন্ধের শরীর জুড়ে আছে মদনমোহন তর্কালঙ্কার শীর্ষক কবিতার ছন্দরীতি, বিষয় নির্বাচন, সংস্কৃতি ব্যাখ্যা এবং কবিতা প্রকাশকালীন বিভিন্ন ঘটনা ইত্যাদি। কালের পরিক্রমায় এই পত্রিকা সম্পাদনার ভার আসে ঈশ্বরচন্দ্রের হাতে। সম্পাদনা কার্যে গৃহিত পদক্ষেপ ও তার ব্যাখ্যা বিদ্যাসাগরের ভাষ্যে এরকম:
অল্পবয়স্ক বালক-বালিকাদিগের বোধসৌকর্য্য সম্পাদনের নিমিত্ত কোনও কোনও অংশ পরিবর্ত্তিত, কোনও কোনও অংশ পরিবর্তিত, কোনও কোনও অংশ পরিত্যক্ত হইয়াছে। পৃষ্ঠা- ২৮
এই প্রবন্ধে আরও আছে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের কর্মজীবন, সংসার জীবন ইত্যাদি।
কুষ্টিয়ার বিখ্যাত হরিনাথ মজুমদারও বাংলা শিশুসাহিত্যের অংশ হয়ে আছেন। শিশুদের শিক্ষাদানের প্রয়োজনে শিশুতোষ ছড়া বা গল্প প্রকাশের সাথে সাথে তিনি বাংলা শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে নিজের স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখে দেন।
“ছেলে ভুলানো ছড়ায় শ্রেণীচিত্র" প্রবন্ধে আলোচক বিভিন্ন ছড়ায় ধনী-দরিদ্র প্রসঙ্গ কোন কোন উপমা অলংকারের আড়ালে প্রকাশিত হয়েছে, তা অন্বেষণ করেছেন। কোন কবিতায় যেমনভাবে সমাজের উঁচু তলার মানুষ ও নীচু তলার মানুষের জীবনচিত্র অংকিত হয়েছে তার বেশ বিচিত্র। কখনও এসেছে সরাসরিভাবে কখনও অবজ্ঞ, অপমানের শব্দ ধারণ করে, কখনও সম্পদ, ঐশ্বর্য, অর্থ, অভিজাত, অফিসার, উচ্চ বংশ ইত্যাদি শব্দের উপর ভর করে গর্ব, আস্ফালন অহংকার এর রূপ প্রকাশ পেয়েছে। শিশুরাও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে।
যে ধরণের বই পাঠ শেষে নিজের জানাশোনার পরিধিকে একটু বিস্তৃত মনে হবে আতোয়ার রহমান রচিত শিশু শিক্ষা ও শিশুতোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ বইটি তেমন একটি বই। বাংলা ভাষায় শিশু সাহিত্য প্রসঙ্গে বিস্তারিত তথ্য এই বই থেকে পাওয়া যেতে পারে। আগ্রহী ও কৌতুহলী পাঠকের নানা রকম প্রশ্নের উত্তর দিতে এই বই সক্ষম। তবে নামকরণটি যথাযথ হয়নি বলেই আমি মনে করি। 'শিশুতোষ প্রবন্ধ' বলতে যে ধরণে প্রবন্ধ বোঝানো হয় সেই ধরণের কোন রচনা বইতে ছাপানো হয় নি। শিশুতোষ প্রবন্ধের ইতিহাস আছে, কিন্তু শিশুদের মন ভোলাতে মজাদার কোন ঘটনা সম্বলিত রচনা ছাপানো এই বইয়ের উদ্দেশ্যও নয়। সেদিক থেকে নামটি একটু ভিন্নরকম হওয়া প্রয়োজন ছিল বলে মনে করি। অর্থবহ কারুকার্যখচিত প্রচ্ছদটি এঁকেছেন আবদুর রোউফ সরকার। রঙের পরিমিত ব্যবহারে প্রচ্ছদটির নান্দিক বৈশিষ্ট্য এতটাই আকর্ষণীয় হয়েছে যে এর দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
বাংলা একাডেমীর নিজস্ব ছাপাখানায় ছাপানো বইয়ের ছাপানোর মান, কাগজ কালির ব্যবহার সবকিছুই উন্নতমানের। বোর্ড বাঁধাই, শক্ত মলাট থাকায় স্থায়ীত্ব বাড়বে। তবে আঠার মান হয়তো ততোটা ভাল না। কারণ এই আলোচনা প্রস্তুতকালীন সময়ে ২০০৩ সালে ছাপানো বইয়ের মলাটের আঠা খুলে গিয়েছে। সেলাই ঠিক ছিল বলে পাতাগুলো এলোমেলো হয় নি। কিন্তু আঠা দিয়ে লাগানো অংশগুলো আলাদা হয়ে মলাট থেকে বইয়ের মূল অংশটি আলাদা হয়ে গিয়েছে। এখন বইটিতে আইকা বা এই জাতীয় শক্ত আঠা না লাগালে পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়ে যেতে পারে।
বাংলাভাষায় রচিত শিশুসাহিত্যের ইতিহাস এবং শিশুসাহিত্যিকদের কয়েকজনকে চিনতে এই বই বেশ সহায়ক হবে। প্রয়োজনীয় অনেক অজানা তথ্য খুঁজে পাওয়া যাবে। তথ্যসন্ধিৎসু পাঠক নিরাশ হবেন না এ কথা বেশ জোর দিয়ে বলা যায়।
###################
শিশু শিক্ষা ও শিশুতোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ
আতোয়ার রহমান
প্রচ্ছদ: আবদুর রোউফ সরকার
প্রথম প্রকাশ: মে. ২০০৩
প্রকাশনী: বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১২৬
মূল্য: ৯০/= টাকা
ISBN: 984-07-4246-5
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম