নদীবিধৌত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ১ হাজারের বেশি নদী বয়ে গেছে। এই নদ-নদীগুলোর উৎস হিমালয় এবং অন্যান্য পাহাড় পর্বত। নদীবাহিত পলিমাটি বাংলাদেশের ভূখণ্ড সৃষ্টির প্রধান উপাদান। উর্বর মাটির কারণেই বাংলাদেশ অঞ্চলে প্রচুর ফসল ফলে, বসতি গড়ে ওঠে মানুষের।
রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিবর্তনের কারণে নদীগুলোর বর্তমান অবস্থা ভিন্নরকম। দেশের নদীকেন্দ্রিক জনপদ বন্যা-চরাঞ্চল নিয়ে জীবন কাটাচ্ছিল। নদী থেকে উদ্ভূত দুঃখ কথা শোনার কেউ ছিল না। সম্প্রতি বিদেশী অর্থপুষ্ট কিছু এনজিও বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নদীবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করার কাজ করছে। ফলে নদীবর্তী মানুষ যে সমস্যা ও সমাধান নিয়ে ৪০/৫০ বৎসর আগে থেকে চিন্তা করত; সেসব আজ চিন্তা করছে শিক্ষিত সুশীল শহরবাসী। পাদপ্রদীপের আলোয় এরা প্রফুল্ল হয়ে ওঠেন। এসব হৈহল্লার বাইরে নিভৃতে একান্তে নদীর জন্য যারা ভালবাসা নিয়ে কাজ করেন, তাদের মধ্যে মাহবুব সিদ্দিকী একজন অগ্রগণ্য। তিনি নিজের মনের টানে দেশের নদীগুলোর কাছাকাছি যান। ভ্রমণ করেন নদীঘেঁষা গ্রাম, বন্দর, ঘাট, জনপদগুলোতে। তুলে আনেন ঢেকে থাকা ইতিহাস। তার 'নারদ নদ' নিয়ে অনুসন্ধানী তথ্যসমৃদ্ধ বই আলোচনা এর আগে 'গ্রন্থগত' সাইটে প্রকাশ করা হয়েছিল।
"আমাদের নদ-নদী” বইটি নামেই তার পরিচয় দিয়েছে। প্রচ্ছদে সে চিত্র তুলে ধরতে অনীহা নেই। ফ্লাপের ভাষ্য অনুযায়ী এই বই-
নদী-শাসন ও নদী-কেন্দ্রিক নানাবিধ সমস্যা ও সম্ভাবনা এবং পটভূমি নিয়ে এই গ্রন্থ বর্তমান বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থাকে ফুটিয়ে তুলেছে।
বাংলাদেশের নদীগুলো বৈচিত্র্যময়। প্রত্যেকটা নদীর নিজস্ব কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। এদের কথা লেখক সংক্ষেপে ভূমিকাতে জানান। তিনি বলেন-
বাংলাদেশের নদীগুলোর বিশেষ কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এদেশের অধিকাংশ নদীই ভাঙনপ্রবণ। এগুলো বিভিন্ন সময়ে কম-বেশি এদের গতিপথ পরিবর্তন করেছে। এর ফলে এদেশে এমন অসংখ্য নদীর সৃষ্টি হয়েছে যেগুলো অঞ্চল বিশেষে মরাগাঙ নামে পরিচিতি পেয়েছে। যেমন বুড়ী তিস্তা-মধ্য তিস্তা- পুরনো তিস্তা, পুরনো ব্রহ্মপুত্র। করতোয়া, আত্রাই, ভৈরব এসব অতিপরিচিত নদী বিভিন্ন স্থানে মরাগাঙ নামে পরিচিতি পেয়েছে। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে পুরনো খাতগুলো কোল কিম্বা বাওড়ে রূপান্তরিত হয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভৈরব, কপোতাক্ষ, মধুমতি এসকল নদ-নদীর পুরনো অসংখ্য খাতগুলো বাওড়ে পরিণত হয়েছে। গঙ্গা- পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা, তিস্তা এসকল বৃহৎ নদ-নদীতে অসংখ্য কোল বা গভীর পানির হ্রদ সদৃশ জলাভূমি রয়েছে। এগুলো নদীর খাত পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট। পৃষ্ঠা- ৮
নদীতীরবর্তী অঞ্চল প্রাচীন কাল থেকেই বন্যার শিকার হত। ২০-৩০ দিন জলাবদ্ধতার মধ্যে কাটাতে হত। বন্যা নেমে গেলে চারপাশের মাটিতে পড়ত পলিমাটির স্তর। এই পলিমাটি খুব উর্বর। যে কোন ফসলের ভাল ফলন হত। মানুষ নদীতীরে বসতি গড়ে তুলেছে। শহরবাসী শিক্ষিত মানুষ নদী প্রসঙ্গে সচেতন নয়। গ্রাম থেকে উঠে আসা উন্নাসিক শিক্ষিত জনগণ নদী চেনেনা। ফলে তাদের মধ্যে নদীর প্রতি আগ্রহ কম। সে বিষয়ে লেখক সচেতন। তিনি জনগণের মাঝে নদীবিষয়ক জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে চান। তিনি ভূমিকার একাংশে জানান-
নদী বিষয়ক জ্ঞান ও সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মাঝে। বিশেষ করে আগামী দিনের শিশু, কিশোর ও তরুণ নাগরিকদের মাঝে নদী সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য অতি শীঘ্রই পৌঁছে দিতে হবে। পৃষ্ঠা- ৮
বইয়ের সূচিপত্রটি বেশ লোভনীয়। সূচীপত্র পড়লে বইটি আর হাত থেকে নামাতে ইচ্ছে করবে না। বিরাট-দীর্ঘ এই সূচীপত্র সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারলে ভাল লাগত। কিন্তু তা সম্ভব হল না।
- প্রথম অধ্যায়# নদ ও নদীর ব্যাখ্যা: নদী বিষয়ক সংজ্ঞা
- দ্বিতীয় অধ্যায়# উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদী
- তৃতীয় অধ্যায়# দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদী
- চতুর্থ অধ্যায়# উত্তর কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদ-নদী
- পঞ্চম অধ্যায়# উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদ-নদী
- ষষ্ট অধ্যায়# দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নদ-নদী
- সপ্তম অধ্যায়# পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চল
- অষ্টম অধ্যায়# বিশ্বের কয়েকটি বৃহৎ নদ-নদী
বইটি শুরু করেছেন নদী ও নদীর সংজ্ঞায়ন দিয়ে। কাজটি ভাল হয়েছে। ইংরেজি River শব্দটির বাংলা দুইটি। একটি নদ ও অন্যটি নদী। কিন্তু কোনটা কি তা আমরা অনেকেই জানি না। কোন জলপ্রবাহ নদ এবং কোনটা নদী সে প্রসঙ্গ আসলে বিব্রত বোধ করি। এই বিভ্রান্তি দূরীকরণের কাজটি তিনি প্রথমেই সেরে নিয়েছেন। তিনি তাঁর শিক্ষকের কাছে ১৯৬১ সালে মুন্সীগঞ্জ হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় যা শিখেছিলেন, তা পাঠককেও শেখাচ্ছেন। তাঁর শিক্ষক প্রাচীন ঋষিদের দেয়া একটি সুত্র দিয়ে জলপ্রবাহকে নদ বা নদী হিসেবে নামাঙ্কিত করা শিখিয়েছিলেন। সূত্রটি হল-
যে প্রবাহগুলোর নামের শেষে আ- কার, এ- কার, ও- কার, ঔ- কার, হ্রস্ব-ই, দীর্ঘ-ই ইত্যাদি নেই সেগুলো নদ। পৃষ্ঠা- ১৪
সেই সূত্র ১০০ ভাগ অকাট্য কীনা তা লেখক জানেন না, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সূত্রটি মিলে যায়।
দেশীয় নদীর চিত্র |
প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করেন নদীর শ্রেণী বিভাগ, নদী ও জলাশয় বিষয়ক সংজ্ঞা, স্বাধীন নদী, নদী অববাহিকা, বিল, বাওড়, ব্যারাজ, হাওর, বদ্বীপ, আন্তঃসীমান্তনদী ইত্যাদি বিষয়ে। অন্যান্য অধ্যায়ের নাম দেখে সেখানে আলোচ্য প্রসঙ্গ বোঝা যাচ্ছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে ৯টি, তৃতীয় অধ্যায়ে ১৩টি নদী, চতুর্থ অধ্যায়ে ১৪টি, পঞ্চম অধ্যায়ে ১৭টি নদী, আবার ষষ্ঠ অধ্যায়ে ৫টি, সপ্তম অধ্যায়ে ৬টি নদীর তথ্যবহুল পরিচয় দিয়েছে। অষ্টম অধ্যায়ে বিশ্বের নদ-নদী হিসেবে নির্বাচন করেছেন ৯টি বিখ্যাত জলপ্রবাহকে।
বিভিন্ন নদী সম্পর্কে জানতে আগ্রহীরা এই বই পেলে খুশি হবে। এতগুলো নদীর পরিচিতি ও বিবরণ এক বইয়ে পাওয়া গুপ্তধন পাবার মত। নদী ভালবাসে, নদীকেন্দ্রিক জীবন কাটায় এমন প্রত্যেকের কাছে এই বইয়ে উপস্থাপিত প্রবন্ধগুলো আকর্ষনীয় লাগবে। প্রতিটি রচনা তথ্যবহুল। প্রতিটি নদীর পরিচিতিতে প্রাচীন নাম, উৎসমুখ, তীরবর্তী শহর, জনপদ, বাজার প্রভৃতির বর্ণনা, নদীতীরে বাসরত/ জন্মগ্রহণ করা প্রখ্যাত ব্যক্তির পরিচয়, বিশেষ প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনা সবকিছু উল্লেখ করতে চেয়েছেন। সম্ভাব্য ও প্রাপ্ত কোন তথ্য বাদ দিতে চান নি। ফলে বইটি তথ্যসন্ধানী গবেষকদের কাজেও সুবিধা দেবে। প্রয়োজনীয় বিবেচনায় ৬৪টি ছবি আছে। সবগুলো সাদাকালো রঙের। তবে তাতে প্রাসঙ্গিক দৃশ্যপট অস্পষ্ট হয়ে যায় নি।
বিদেশী নদীর চিত্র |
বোর্ড বাঁধাই হওয়ায় স্থায়ীত্বলাভ করবে। সাদা পাতায় গাঢ় কালিতে ছাপানো লেখাও ছবিগুলো স্পষ্টতর। বর্ণের আকার যথাযথ। পড়তে কষ্ট হয় না।
সার্বিকভাবে বলা যায় বইটি প্রস্তুত করতে গিয়ে লেখককে অনেকদিকে মনোযোগ দিতে হয়েছে। এজন্য লেখক বিশেষ করে ধন্যবাদ পেতে পারেন। প্রচ্ছদশিল্পী আনওয়ার ফারুক তার নান্দনিক বোধের পরিচয় সমুন্নত রাখতে পেরেছেন। নদীবহুল দেশের মানুষ নদীর মর্ম বুঝুক লেখকের প্রত্যাশা বোঝা যায়। মাহবুব সিদ্দিকী লিখিত "বাংলাদেশের নদ-নদী" বই নদীপ্রবণ মানুষদের নিকট কাম্য হোক এই প্রত্যাশা করি। বইয়ের শেষে একটি লোভনীয় গ্রন্থপঞ্জী আছে।
বাংলাদেশের নদ-নদী প্রসঙ্গ হিসেবে এসেছে এমন বই ও ম্যাগাজিন এই তালিকায় আছে। সময় ও সুযোগ পেলে এই তালিকা প্রকাশ করা যেতে পারে।
==#==#==#==
আমাদের নদ-নদী
মাহবুব সিদ্দিকী
প্রচ্ছদ: আনওয়ার ফারুক
প্রকাশনী: আগামী প্রকাশনী, ঢাকা।
প্রকাশকাল: ২০১৭
পৃষ্ঠা: ২০৪
মূল্য: ৪০০
ISBN: 978-984-04-1920-3
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম