খান আলাউদ্দীন
মেঘ ও মেশিন ভবিষ্যতের গল্প । ২০৩৫ সালের । পটভূমি ঢাকা ।
সৈয়দ শামসুল হক বেঁচে থাকলে ২০৩৫ সালে শতবর্ষ পূর্ণ করতেন। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা সাহিত্যে গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক... সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে অনুপম মেধার পরিচয় রেখেছেন তিনি। লিখেছেন চিত্রনাট্যও।
তার জন্মশতবর্ষ ধুমধাম করে উদযাপিত হতো সারাদেশে। মেঘ ও মেশিনে আমরা মুখোমুখি হই এক ভিন্ন সমাজ বাস্তবতার। ২০৩৫ সালে বাংলাদেশে শিল্প সাহিত্য বলে কিছু নেই। দুই পরাশক্তির কাছে বাংলাদেশসহ আরও ৭০ টি দেশ বহুজাতিক কোম্পানি হিসেবে পরিচালিত হয়। তাঁর জন্মশতবর্ষ উদযাপনতো দূরের কথা কাগজে একটা খবর পর্যন্ত বেরুয় না। সৌভাগ্য তাঁর, তাঁর সাহিত্যকর্মের অবমূল্যায়ন এবং মাতৃভূমির দূর্দশা তাকে বেঁচে থেকে দেখতে হয়না। মেঘ ও মেশিন ১৯৯০ সালে লেখা। তখনই তিনি কল্পনা করেছিলেন ২০৩৫ সাল পর্যন্ত তার জীবনধারণ না করার কথা। তিঁনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন ১০০ বছর বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ তারও ছিলো ১১৬ বছর বেঁচে থাকার সাধ।
‘হল ভর্তি মানুষ দেখে কবি ও সব্যসাচী সৈয়দ হক আপ্লুত গলায় বলে উঠলেন , আমার মাথায় এখনো কত কাজ । এখনো কত কত নতুন নতুন সব পরিকল্পনা । আমি লালনের মতো একশ ষোল বছর বেঁচে থাকতে চাই। নইলে সব কাজ শেষ হবে না।’ — বাসিত জীবন ,আনোয়ারা সৈয়দ হক।
১৯৯৬ সালে ARPANET গবেষণা প্রকল্পের আওতায় ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে চারটি মেইনফ্রেম কম্পিউটারের মধ্যে সংযোগের মাধ্যমে ইন্টারনেটের যাত্রারম্ভ হয়েছিল। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, স্মার্টফোন, গৃহস্থালি আসবাব, গৃহ ... সবকিছুই ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত হয়ে পড়েছে।
অথচ ‘মেঘ ও মেশিনে’ বর্ণিত ভাবনা লিখন যন্ত্র যা কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এবং যার কল্পনা করা হয়েছে ২০৩৫ সালের প্রেক্ষাপটে, তা বিশ্ব সংবাদ গ্রাহক যন্ত্রের সাথে যুক্ত করার কথা বলেছেন লেখক— অত্যন্ত যুক্তিবহির্ভূত এবং দৃষ্টিকটু চিন্তা। ভাবনা লিখন যন্ত্র তো নিজেই ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হয়ে সংবাদ সংগ্রহে সক্ষম হবে। বিষয়টা নিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের অদূরদর্শিতা এই আইওটি (IOT) শিল্পযুগের সময় মেনে নিতে পারছিনা।
মেঘ ও মেশিনের চরিত্রাবলি :
দ্বিতীয় সৈয়দ হক: গুঁড়ো দুধ ফ্যাক্টরির মালিক।
অপরা: দ্বিতীয় সৈয়দ হকের ব্যক্তিগত সচিব। উচ্চ স্মৃতিশক্তির অধিকারি । বুদ্ধিমতি।
জামাল: অপরার সহপাঠী।
কৌরব: কৌরব ছদ্মনাম। তৃতীয় সৈয়দ হক। (তৃতীয় সৈয়দ হককে বিপ্লবী চরিত্ররুপে উপস্থাপন করেছেন লেখক। পরাশক্তির দুই দেশ দ্বিতীয় সৈয়দ হকের ফ্যাক্টরির সরবরাহ করা দুধে মিশিয়ে দিচ্ছে রাসায়নিক ধীর বিষ। সেই দুধ শিশুদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা দেয়। মি. রেম্যান সরবরাহ করেন রক্ত পরীক্ষার সুঁই সিরিঞ্জ। সেসব সুঁই সিরিঞ্জে থাকা এক ধরণের ওষুধ মানুষের চিত্তবৃত্তিকে ভোঁতা করে দেয়। এসব জেনেই কৌরব নামের ছদ্মবেশী তৃতীয় সৈয়দ হক মি. রেম্যান ও দ্বিতীয় সৈয়দ হকের ফ্যাক্টরী বোমা মেরে উড়িয়ে দেবার চিন্তা করে। উপন্যাসের একেবারে ক্লাইম্যাক্সে গিয়ে সবকিছু জানতে পারে দ্বিতীয় সৈয়দ হক।)
ভাবনা লিখন যন্ত্র: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সম্পন্ন যন্ত্র। মানুষের সাথে আলাপ আলোচনা, চিন্তা ও তথ্য প্রক্রিয়া জাত করতে সক্ষম। মানুষের পর্যায়ের চেতনাসম্পন্ন না হলেও সচেতন বলা যায়। ফলে ভাবনা লিখন যন্ত্রকেও আমি মেঘ ও মেশিনের চরিত্র বলবো। অন্যতম চরিত্র।
দ্বিতীয় সৈয়দ হকের হাত ঘড়ির ভেতরে একটি ছোট যন্ত্র লাগানো থাকে কেউ তার দশ মিটারের মধ্যে মিথ্যা কথা বললে সেই যন্ত্রে তা ধরা পড়ে । হাত ঘড়ির গোয়েন্দা ফয়েল লাল বাতি জ্বলে উঠে। তার মানে যন্ত্রটি লাই ডিটেক্টরের ক্ষুদ্র সংস্করণ(লাই ডিটেক্টর শব্দটি এই উপন্যাসে উচ্চারিত হয়নি।) সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রে লাই ডিটেক্টরের বা পলিগ্রাফের উপস্থিতি নতুন নয়। কিন্তু সৈয়দ হক ঘড়ির ভিতর পুড়ে দিতে পাড়া মিথ্যা নির্ণায়ক ক্ষুদ্র যন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছেন এবং আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। সেজন্য তাকে কৃতিত্ব দেওয়াই যায়। আমরা ক্রমশ ন্যানো ওয়ার্ল্ডে পদার্পণ করছি। আবিষ্কৃত হচ্ছে ন্যানো মেডিসিন ,ন্যানো জেনারেটর, ন্যানো কার্বন টিউব,ন্যানো বট, মেটাল্যান্স । ২০৩৫ সাল আসতে আসতে হয়ত লাই ডিটেক্টরের ক্ষুদ্র সংস্করণ বাজারে চলে আসবে। ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির আর যেসব বিষয় উপন্যাসটির সফটওয়্যার গঠনে ভূমিকা রেখেছে — ত্রিমাত্রিক ছবি, স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, ক্যাপসুল লিফট, টিভিফোন ইতোমধ্যে আমাদের পরিচিত।
মেঘ ও মেশিন। নামের মধ্যেই উপন্যাসটির বিষয় আশয় বেশ স্পষ্ট ।
মেঘ
উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়েই বোমা ফাটিয়ে আকাশ থেকে মেঘ সরিয়ে দেয়ার কথা আছে। আমরা স্মরণ করতে পারি, ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকের অনুষ্ঠান বৃষ্টিমুক্ত করার জন্য আকাশে প্রচুর সিলভার আয়োডাইড ভর্তি রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ভবিষ্যতে বোমা ফাটিয়ে মেঘ সৃষ্টির উল্লেখ ও করেছেন লেখক। কৃত্রিম উপায়ে এরুপ বৃষ্টি উৎপাদন cloud seeding নামে পরিচিত। মেঘ ও মেশিনে তৃতীয় সৈয়দ হক মেঘ ডেকে আনবার বিশেষ বোমার বদলে ফ্যাক্টরী বিধ্বংসী বোমা ফাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। পাঠক যখন পড়বেন, বোমা ফাটানোকে নীতিগতভাবে বিরোধী মনে হবেনা।
মেশিন
আমরা প্রায়ই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীগুলোতে ইউনিভার্সাল ট্রান্সলেটরকে দেখি। যা মানুষের চিন্তার রুপ-রেখা পড়তে পারে। বস্তুত, এমআরআই স্ক্যান, ইইজি ওয়েভ ব্যবহার করে মানুষের ভাবনা চিন্তা পাঠ করার ইচ্ছা বহু পুরাতন। মেঘ ও মেশিনে রয়েছে তেমনি ভাবনা লিখন যন্ত্রের আখ্যান। আমরা যেভাবে অভিজ্ঞতা, স্মৃতি, ভুলের মাধ্যমে শিখি যন্ত্রের শিক্ষণ পদ্ধতি সেরকম নয়। ফলে মেঘ ও মেশিনের প্রধান নারী চরিত্র অপরাকে ভাবনা লিখন যন্ত্রের প্রশ্ন, ‘ভালোবাসা কি? প্রেম কি? ’
মেঘ ও মেশিনে রয়েছে সৈয়দ শামসুল হক ,দ্বিতীয় সৈয়দ হক , তৃতীয় সৈয়দ হক — এই তিন পুরুষের বাস্তব কল্পিত অবয়ব, সাহিত্য সংগীত ও সংস্কৃতির সাথে তাদের প্রেম এবং প্রেম নারীর সাথে। তৃতীয় সৈয়দ হক, ছদ্মনাম কৌরব, টেকনোক্রাট বা দেশ পরিচালনার বিশাল সুযোগ, ক্যারিয়ার, বিসর্জন দিয়ে দেশের সাহিত্য সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিতে সংগ্রামের পথ বেছে নেয়। অপরা, দ্বিতীয়র ব্যক্তিগত সচিব, একদিকে তৃতীয়র প্রতি অকুন্ঠ প্রেমের বেড়াজালে বন্দি, অন্যদিকে দ্বিতীয়র প্রতি প্রভুসুলভ শ্রদ্ধা ও দায়িত্ব জ্ঞাপনে অপার নিষ্ঠা। পাশাপাশি সৈয়দ শামসুল হকের নিজস্ব লিখন শৈলী, স্বর, পাঠ ও চিন্তার গভীরতা মেঘ ও মেশিন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী পাঠকের বোধ ও কল্পনা নাড়া দিয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
==========
বইয়ের নাম : সায়েন্স ফিকশন সমগ্র
লেখকের নাম : সৈয়দ শামসুল হক
প্রচ্ছদ : ধ্রুবএষ
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারী ২০১৭
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ১৪৪
দাম : ২৫০ টাকা
বি.দ্র. বইটিতে ' মহাশূন্যে পরাণ মাস্টার ' ও 'মেঘ ও মেশিন' নামে দু'টি কল্পকাহিনী সন্নিবেশিত হয়েছে। এখানে শুধু 'মেঘ ও মেশিন ' সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম