সাহিত্য কাকে বলে, সাহিত্যের মধ্যে কী আছে, সাহিত্য থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই, সাহিত্য কীভাবে শেখায়, পাঠকের মনে সাহিত্যের প্রভাব কেমন – সাহিত্যের ইতিহাসে এই প্রশ্নগুলো প্রথম গ্রিসের পণ্ডিতগণ ভেবেছিলেন। এই জিজ্ঞাসাগুলোর বহিঃপ্রকাশ পাই প্লেটো, অ্যারিস্টটল প্রমুখের লেখায়। ছাত্র হিসেবে শিক্ষক প্লেটোর কাছে যা শিখেছেন, সে সম্পর্কে অ্যারিস্টটলের কিছু নিজস্ব মতামত ছিল। নিজের সেই অনুধাবনগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন 'পোয়েটিক্স' নামক বইতে। বাংলা ভাষায় পোয়েটিকস বইয়ের একটি তথ্যবহুল অনুবাদ সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়কৃত "কাব্যনির্মাণকলা"। এই বইতে অ্যারিস্টটলের কবিতা ও নাটক সম্পর্কিত মনোভঙ্গীর বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়।
গ্রিক সমালোচকদের সাহিত্যভাবনার প্রথম সুসংবদ্ধ প্রয়াস এই বই। এখানে পূর্ববর্তী চিন্তাবিদদের আলোচনার নির্যাস এবং তার সাথে অ্যারিস্টটলের নিজস্ব বিশ্লেষণ – দুটিরই প্রতিফলন রয়েছে। সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়ের বইয়ের প্রকাশকাল ১৯৭৬ সাল। এর পূর্বেই বাংলা ভাষায় অ্যারিস্টটলের 'পোয়েটিক্স' এর একাধিক অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো হল ড. সাধনকুমার ভট্টাচার্য 'এরিস্টটলের পোয়েটিক্স ও সাহিত্যতত্ত্ব' (১৩৬৩), অধ্যাপক শীতল ঘোষ 'এরিস্টটলের পোয়েটিক্স' (১৩৭৯) এবং ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী 'এ্যারিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব' (১৩৮২)।
সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়ের বইটি দুই ভাগে বিভক্ত। 'প্রসঙ্গ কথা' ও 'কাব্যনির্মাণকলা: আরিস্টটল'। অনুবাদক 'প্রসঙ্গকথা'য় নিজের অবস্থান থেকে কাব্যনির্মাণকলা সম্পর্কিত ইতিহাস, তথ্য, বিশ্লেষণ, ভাবনা উপস্থাপন করেছেন। পরের অংশে রয়েছে অ্যারিস্টটলের মূল সাহিত্যভাবনা। সাথে রয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা বা টীকা-টিপ্পনি। সূচিপত্র দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
সূচিপত্র
- প্রসঙ্গকথা
- আরিস্টট্ল-পূর্ববর্তী গ্রিস: সাংস্কৃতিক বাতাবরণ
- আরিস্টট্ল: জীবনী ও সারস্বত -সাধনা
- পাশ্চাত্য সাহিত্য-সমালোচনার বিকাশধারা ও আরিস্টটল
- আরিস্টট্লের 'কাব্যনির্মাণকলা': বিষয় -বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন
- ‘কাব্যনির্মাণকলা' গ্রন্থের পূর্বসূত্র
- ‘কাব্যনির্মাণকলা' গ্রন্থের প্রভাব
- বাংলাভাষায় আরিস্টট্লচর্চা: ‘কাব্যনির্মাণকলা’-সম্পর্কিত
- আরিস্টট্লের 'কাব্যনির্মাণকলা' ও সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র
- উপসংহার: অনুবাদ-কর্ম সম্পর্কে কয়েকটি বক্তব্য
- কাব্যনির্মাণকলা: আরিস্টট্ল
- সূচনা: কাব্য: একটি অনুকরণ প্রক্রিয়া
- প্রথম পরিচ্ছেদ: কাব্যিক অনুকরণের বিভিন্ন মাধ্যম
- দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: কাব্যিক অনুকরণের বিষয়
- তৃতীয় পরিচ্ছেদ: কাব্যিক অনুকরণের রীতি
- চতুর্থ পরিচ্ছেদ: কমেডির উদ্ভব॥ ট্র্যাজেডির সঙ্গে তুলনায় মহাকাব্য
- ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ: ট্র্যাজেডির স্বরূপ
- সপ্তম পরিচ্ছেদ: বৃত্তের পরিধি
- অষ্টম পরিচ্ছেদ: বৃত্তের ঐক্য
- নবম পরিচ্ছেদ: কাব্য-সত্য ও ঐতিহাসিক সত্য
- দশক পরিচ্ছেদ: সরল ও জটিল বৃত্ত
- একাদশ পরিচ্ছেদ: পরিস্থিতি-বিপর্যাস, প্রত্যাভিজ্ঞান ও বিপদ্পাত
- দ্বাদশ পরিচ্ছেদ: ট্র্যাজেডির মুখ্য সন্ধিসমূহ
- ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ: ট্র্যাজিক সংঘটন
- চতুর্দশ পরিচ্ছেদ: ভয় এবং করুণা
- পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ: ট্র্যাজেডির চরিত্র
- ষোড়শ পরিচ্ছেদ: বিভিন্ন শ্রেণির প্রত্যাভিজ্ঞান
- সপ্তদশ পরিচ্ছেদ: ট্র্যাজিক কবির অনুসৃতব্য কতিপয় নিয়ম
- অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ: ট্র্যাজিক কবির অনুসৃতব্য কতিপয় নিয়ম (পূর্বানুবৃত্তি)
- ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ: চিন্তন ও বাচন
- বিংশ পরিচ্ছেদ: কতিপয় ভাষাতাত্ত্বিক সংজ্ঞা
- একবিংশ পরিচ্ছেদ: কাব্যিক বচন: ব্যবহৃত শব্দের প্রয়োগ-বৈচিত্র্য অনুষঙ্গে
- দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ: কাব্যিক বচন ও রচনাশৈলী
- ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ: মহাকাব্য
- চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ: মহাকাব্য (পূর্বানুবৃত্তি)
- পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ: সমালোচনামূলক জিজ্ঞাসা ও তার উত্তর
- ষড়বিংশতি পরিচ্ছেদ: মহাকাব্য ও ট্র্যাজেডির তুলনা
- পরিশিষ্ট
- গ্রন্থপঞ্জি
বইয়ের প্রসঙ্গকথা অংশটি বেশ সমৃদ্ধ। আলোচনাগুলোর শিরোনাম পড়লে আলোচিত প্রসঙ্গের ব্যাপকতা অনুধাবন করা যায়। শিরোনামগুলোতে কোন অস্পষ্টতা নেই। নামেই উপস্থাপিত প্রসঙ্গের পরিচয় স্পষ্ট। অ্যারিস্টটল কাব্য সম্পর্কে তৎকালীন সময়ে যে সব তথ্য পেয়েছেন, যে ইতিহাস জেনেছেন, যে ভাবনা ভেবেছেন, চিন্তাগত বিষয়গুলো যেভাবে বুঝেছেন, তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ উদাহরণসহ রয়েছে বইয়ের দ্বিতীয় অংশে। বইয়ের এই অংশই মূল অংশ। এই মূল অংশকে বুঝতে অনুবাদকের ভাষ্য 'প্রসঙ্গকথা' অংশ বেশ সাহায্য করবে। অনুবাদক তথ্য, ইতিহাস ও বিশ্লেষণকে সাবলীল ও সহজবোধ্য ভাষায় বর্ণনা করেছেন। কোথাও পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের অহংকার নেই।
বই রিভিউয়ের অজুহাতে প্রসঙ্গকথা'র একটি অধ্যায় সংক্ষেপে আলোচনা করা যায়। “আরিস্টট্লের 'কাব্যনির্মাণকলা' ও সংস্কৃত অলংকারশাস্ত্র” অংশে ভারতীয় অলংকারশাস্ত্রে অ্যারিস্টটলের প্রভাব কিরূপ তাই মূল্যায়ন করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে ভারতীয় অলংকারশাস্ত্রের প্রথম প্রবক্তা ভরতমুনির আবির্ভাবকাল খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতাব্দী; আর অ্যারিস্টটলের সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী। অর্থাৎ প্রায় আটশত বৎসর আগের হলেও ভারতীয় পণ্ডিতগণ আ্যারিস্টটলের চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হন নি। তাঁরা নিজস্ব দার্শনিক বোধ দ্বারা সাহিত্যবোধকে বিশ্লেষণ করেছেন। খ্রিস্টিয় দশম-একাদশ শতাব্দীতে পোয়েটিক্স এর আরবীয় অনুবাদ ব্যাপক প্রচার লাভ করে। ভারতবর্ষের বাইরের জগৎ অ্যারিস্টটলের সাহিত্যচিন্তাকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে নেয়। অথচ ভারতীয় চিন্তাবিদরা নিজস্ব স্বতন্ত্র সাহিত্যভাবনাকে আরও বেশি পরিশীলিত করে তুলেছেন। নিজেদের চিন্তাকে গ্রিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হতে দেন নি। এই প্রসঙ্গে অনুবাদক জানান --
সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্র প্রথম থেকে নিজস্ব পথ ধরেই অগ্রসর হয়েছে। এমন অবস্থায় দুইয়ের পারস্পরিক প্রভাবের আলোচনা অবান্তর বলেই মনে হবে। পৃষ্ঠা- ৪৮
বইয়ের মূল অংশে অ্যারিস্টটলের বক্তব্যের পর যোগ করেছেন বিভিন্ন ব্যাখ্যা, টীকা-টিপ্পনি এবং তথ্যসূত্র। ফলে মূল বক্তব্য বুঝতে অনুসন্ধিৎসু বিশ্লেষণীবোধসমৃদ্ধ পাঠকের কোন সমস্যা হয় না। অন্যদের অনুবাদের চাইতে এই বইয়ের স্বকীয়তা এখানেই। উদাহরণস্বরূপ অষ্টম পরিচ্ছেদের টীকা প্রসঙ্গ দেখা যেতে পারে। এখানে 'বৃত্তের ঐক্য' বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অ্যারিস্টটল 'হিরাক্লিস', 'হিরাক্লিড', ‘থেসিয়াড', ‘হোমার', 'অডিসি', ‘অডিসিউস' প্রমুখের পরিচয় টীকা অংশে উল্লেখ করেছেন। কারণ এই নামগুলো যেভাবে মূল অংশে উপস্থাপিত হয়েছে, তা সাধারণ পাঠকের নিকট দুর্বোধ্য মনে হতে পারে।
বইয়ের শেষে পরিশিষ্ট অংশে অনুবাদে ব্যবহৃত পারিভাষিক শব্দের একটি তালিকা যোগ করা হয়েছে। এই অংশটুকু পাঠকের অনেক প্রশ্নের উত্তর দেবে। পরিশিষ্ট শেষে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থপঞ্জি। এরিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব বা পোয়েটিকস বুঝতে এবং বাংলা ভাষায় রূপান্তর করতে গিয়ে যেসব বইয়ের সাহায্য অনুবাদক গ্রহণ করেছেন সেগুলোর একটি তালিকা এখানে রয়েছে। গ্রন্থপঞ্জিটি পুনঃপ্রকাশযোগ্য। গ্রন্থগত ওয়েবসাইটে এই গ্রন্থপঞ্জি কোন এক সময় প্রকাশ করা যেতে পারে।
বইটি বোর্ড বাঁধাই, সাদা কাগজে ছাপানো। বেশ মজবুত মানের বাঁধাই কার্য বইয়ের আয়ু বহুদিন বাড়িয়ে দেবে একথা নিঃসংশয়ে বলা যেতে পারে। ১৯৭৬ সালের প্রথম প্রকাশিত বইটি ২০১৫ সালে প্রকাশ করেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। বেশ কিছু তথ্য বইয়ের কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলনা। প্রথম প্রকাশকাল প্রিন্টার্স লাইনে উল্লেখ করা দরকার ছিল। বইয়ের কোন একটি ফ্লাপে লেখকের পরিচয়, বইটি অনুবাদকের কাছ থেকে দ্বিতীয় প্রকাশের জন্য অনুমতি নেয়া কী না, এই সংস্করণ সম্পর্কে অনুবাদকের বক্তব্য বা প্রকাশকের কোন বক্তব্য ইত্যাদি বিষয় বইয়ের যে কোন জায়গায় থাকতে পারতো। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশিত বইয়ে এসব তথ্য থাকবে না এটা কাঙ্ক্ষিত নয়। বর্তমান সংস্করণের উৎসর্গটি কার লেখা? অ্যারিস্টটলের, অনুবাদকের নাকি প্রকাশকের – তা বোঝা গেল না। ধ্রুব এষ অঙ্কিত প্রচ্ছদের বিশেষত্ব কী সেটা বোঝা গেল না। মন্দিরের পিলারের উর্ধাংশের কারুকাজ দিয়ে নন্দনতত্ত্ব বোঝানো যেতে পারে, কিন্তু কাব্যতত্ত্বের কোন দিক উন্মোচিত হল সে বিষয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি থেকে গেল। মনে হয় শিল্পীকে গ্রিস সম্পর্কিত যে কোন একটা প্রচ্ছদ তৈরির জন্য বলা হয়েছিল।
যা হোক, সাহিত্য কাকে বলে, সাহিত্যের মধ্যে কী আছে, সাহিত্য থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই, সাহিত্য কীভাবে শেখায়, পাঠকের মনে সাহিত্যের প্রভাব কেমন – এই প্রশ্নগুলো যে পাঠককে আলোড়িত করে, তাকে এই বই পড়তেই হবে। সাহিত্যতত্ত্বের অন্যান্য বইয়ের পাশাপাশি সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায় অনূদিত "কাব্যনির্মাণকলা" বইয়ের পাঠ তার চিন্তাকাঠামোতে যথাযথ স্তর যোগ করে দেবে। মনের গভীরে জেগে ওঠা সাহিত্য সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর তৃপ্ত হবে। গত দুই হাজারেরও বেশি বৎসর ধরে যে বই সাহিত্য সমালোচকদের অর্থাৎ যারা সাহিত্য বুঝতে চায়, সাহিত্য সমালোচনা করতে চায়, সাহিত্যতত্ত্ব অনুধাবন করতে চায় তাদের পাশে থেকেছে, সেই বই সমকাল ও আগামী দিনের অনুসন্ধিৎসু পাঠককে সঙ্গ দেবে সে কথা বলাই বাহুল্য।
উল্লেখ্য: অনুবাদক Aristotle শব্দের বাংলা উচ্চারণ এই বইয়ে 'আরিস্টটল' লিখেছেন।
~0~0~0~0~
কাব্যনির্মাণকলা: আরিস্টট্ল
অনুবাদ: সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশকাল: ২০১৫
প্রকাশক: বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা।
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১৬০/=
মূল্য: ২২৫.০০ টাকা
ISBN: 984-18-0386-X
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম