বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর বই “বার্নাডের তারা” - ‘স্বপন কুমার গায়েন’

বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর বই “বার্নাডের তারা” - ‘স্বপন কুমার গায়েন’


বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞান সাহিত্য যাদের হাত ধরে পথ চলা শুরু করেছে তাদের মধ্যে স্বপন কুমার গায়েন অন্যতম। আজ আমরা পরিচিত হব তাঁর বিখ্যাত ‘বার্নাডের তারা’ বইয়ের সাথে। এই বইয়ের প্রথম প্রকাশ ১৯৭৯ সালে, দ্বিতীয় প্রকাশ ১৯৮৪ সাল। বর্তমানে লেখক নিস্ক্রিয় থাকলেও এক সময়ের বাংলা বিজ্ঞান গল্প জগতে ছিল তাঁর দৃপ্ত পদচারণা।

বর্তমানের বিজ্ঞান কল্পকাহিনী বলতে আমরা যেমন এলিয়েনদের সাথে মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটি, ভয়ানক মারণাস্ত্র নিয়ে রোবটদের সাথে বিধ্বংসী সংঘাত ইত্যাদি বুঝি, স্বপন কুমার গায়েনের গল্পগুলো এমন নয়।

‘বার্নাডের তারা’ বইয়ে গল্প রয়েছে মাত্র পাঁচটি। প্রত্যেক গল্পে বিজ্ঞানের উৎকর্ষের সাথে মানবিকতা গভীরভাবে মিশে আছে। লেখক সহৃদয়তার সাথে মানুষের সাথে বিজ্ঞানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বর্ণনা করেছেন। তাঁর গল্পে বিজ্ঞান ও মানবীয় বোধ একাকার হয়ে গেছে। এই বইয়ে যে গল্পগুলো আছে সেগুলো নিম্নরূপ:

  • সূচীপত্র
  • অলীক
  • অসাধারণ ছেলে
  • কালবীক্ষণ
  • জঙ্গলবাড়ি
  • বার্নাডের তারা


প্রত্যেকটা গল্পই সুখপাঠ্য, রোমাঞ্চকর, উদ্দীপনাময়। যে কোন কিশোর-কিশোরী গল্পগুলোর পাঠ শুরু করলে শেষ না করে থামতে পারবে না – এতটাই আকর্ষণীয়। প্রথম গল্প ‘অলীক’ এবং শেষের গল্প 'বার্নাডের তারা' এই দুটিতে কিছুটা ভয়াবহতা আছে। কিন্তু অন্য গল্পগুলো উৎসাহবোধক।

‘অলীক’ গল্পে দেখা যায় বিজ্ঞানী 'চ্যাং ফু' পৃথিবীর ঘুর্ণনগতিকে বাড়িয়ে দেবার মত এক অবাক করা  শক্তিশালী যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। যুদ্ধবাজ শাসকদের শাস্তি দেবার জন্য যন্ত্র চালু করলে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। বিজ্ঞানী চ্যাং ফু বিষণ্ণ ভাঙা গলায় বলেন-

মস্ত ভুল হয়ে গেছে সানি। সামান্য একটা বিয়োগ করতে ভুল হওয়ায় সব ভেস্তে গেছে। যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি আমি। - পৃষ্ঠা ১৭

দ্বিতীয় গল্প ‘অসাধারণ ছেলে’। ছোট্ট ছেলে মিশা অসাধারণ বুদ্ধিমান। চার বৎসর বয়সে মায়ের কাছে এক থেকে নয় পর্যন্ত শিখে নিয়ে নিজেই একশত পর্যন্ত বুঝে ফেলেছে। তার পিতা মস্ত বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানী। প্রকাণ্ড টেলিস্কোপে চোখ রেখে মহাশূন্যে নতুন কিছু খোঁজেন। তার ছেলে মিশা। অল্প বয়সে বিজ্ঞানের জটিল পথে চলাফেরা তার। নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের আইডিয়া চিন্তা করে। নিয়মিত স্কুলে যেতে, ক্লাশ করতে ভাল লাগে না। জানালা দিয়ে তার মন এক অন্য জগতে হারিয়ে যায়।

বাবা মার অনুরোধে মিশাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্কুলে যেতে হয়। একটুও ভাল লাগে না ওর। ক্লাসে যা পড়ান হয়, তা ওর অনেক আগেই পড়া হয়ে গেছে। নতুন কিছু শেখার আনন্দ ক্লাসে ও পায় না। ক্লাসের সময়টা ওর তাই বড় দীর্ঘ মনে হয়। স্কুলের বাঁধাধরা নিয়ম ও সহ্য করতে পারে না। - পৃষ্ঠা ২৪


‘কালবীক্ষণ’ এক মজার জিনিস আবিষ্কারের গল্প। রাখী নামের এক সাধারণ মেয়ে। ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। বিজ্ঞানে তার খুব আগ্রহ। তার মেজ'পা ক্লাশ নাইনে বিজ্ঞান গ্রুপ নিয়েছে। তার কাছে বিজ্ঞানের কাহিনী জানতে খুব আগ্রহী। গল্পে গল্পে হঠাৎ করে সে ভেবে বসে এক অদ্ভূতুরে যন্ত্রের কথা। তার নাম ‘কালবীক্ষণ’। দূরবীক্ষণ হতে পারে, অণুবীক্ষণ হতে পারে, তাহলে ‘কালবীক্ষণ’ নয় কেন? কালের ঘটনাবলী যে যন্ত্রের মাধ্যমে দেখা যায় তার নাম কালবীক্ষণ হওয়াই তো মানায়। কিশোরী রাখী'র ভাষ্যে যন্ত্রের বিবরণ এরকম-

সময় দেখা বলতে কি আর আমি সত্যি সত্যি সময় দেখতে পাওয়ার কথা বলেছি। দূরবীক্ষণে কি দূরত্ব দেখা যায়। তেমনি কালবীক্ষণেও দূরসময়ের মানে অতীতের ঘটনাকে বর্তমানে দেখা যাবে। - পৃষ্ঠা ৩৭


‘জঙ্গলবাড়ি’ গল্পে একটা রহস্যগল্পের স্বাদ আছে। লেখক বিজ্ঞানকে মিশিয়ে নিয়ে এক গা ছমছম উত্তেজনাকর গোয়েন্দাগিরির গল্প শুনিয়েছেন। গাছপালা ঘেরা আলো আঁধারীর আড়ালে থাকা বাড়ি, সেখানে ভয়ংকর হিংস্র মাংসাশী গাছপালা নিয়ে গোপন গবেষণা, দু'চারটে বিকট আকারের ডালপালা রাস্তার পাশে পড়ে থাকা, গল্পকথক ইরা'র অস্ট্রেলিয়ান মুরগীকে প্রাণীভূক গাছের খেয়ে ফেলা; আতংকিত ক্ষতবিক্ষত হাতের পরিচারিকা, নির্যাতিত উদ্ভিতবিজ্ঞানী, গুণ্ডাদের মত বিকটদর্শন দুই রাগী দারোয়ান – সব মিলিয়ে এক রোমাঞ্চকর গল্প ‘জঙ্গলবাড়ি’। তরুণ পাঠক এই গল্প এক বসাতে গোগ্রাসে গিলে ফেলবে।

লেখক বৈজ্ঞানিক তথ্য এমনভাবে দিয়েছেন যে পাঠক পড়তে গিয়ে মোটেও হোঁচট খাবে না। যেমন গল্পের এক পর্যায়ে স্থানীয় বিজ্ঞান ক্লাবের পরিচালক বলেন -

না, নতুন প্রজাতি ঠিক নয়। কিন্তু মিউটেশানের ফলে পাতাবাহার এবং স্বর্ণলতা দুয়েরই বৃদ্ধির হার অসম্ভব বেড়ে গেছে।- পৃষ্ঠা ৪৭


পঞ্চম ও শেষ গল্প ‘বার্নাডের তারা’। এই গল্পে মানবসভ্যতার উৎকর্ষের পরিচয় ও ভবিষ্যতে বিলুপ্তির আশংকা গল্পের মধ্য দিয়ে অনুভবযোগ্য করে ফুটিয়ে তুলেছেন। এই গল্পের নামে বইয়ের নাম রাখা হয়েছে। এই গল্প ভবিষ্যতের। দুই হাজার পঁচাত্তর সালের জুলাই মাসে মানব জাতির কয়েকজন সদস্য রওনা হয় বার্নাডের তারার উদ্দেশ্যে। এই অভিযাত্রায় তারা আলোর গতিতে ছুঁটে চলে এগারো বছর পর পৌঁছায় কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। বার্নাডের তারা নামক লাল বামনের একটি গ্রহ মিরাণ্ডা। এই গ্রহে এক সময় সভ্যতা ছিল। কিন্তু এই উন্নত সভ্যতা প্রচণ্ড তুষার স্রোতের কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। বিলুপ্ত হয়ে যায় প্রাণীকুল। তারা নিজেদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য, ছবি, ভিডিও মাটির নিচে পুঁতে রেখেছিল। পৃথিবী থেকে যাওয়া নভোচারীগণ সেই তথ্যভাণ্ডার খুঁজে বের করে। তারা মিরাণ্ডা গ্রহের প্রাণীদের সভ্যতার স্বরূপ বুঝতে পারে।

মিরাণ্ডার যন্ত্র সভ্যতা খুব বেশী দূর পর্যন্ত এগোতে পারে নি। তবে তেজস্ক্রিয়ার ওপর এখানকার বিজ্ঞানীরা বেশ কাজ করেছিল মনে হল। এদের কাজ করার ক্ষমতা তত বেশী ছিল না। প্রবল মাধ্যাকর্ষণ ও বাতাসে অক্সিজেনের স্বল্পতা এজন্য দায়ী মনে হয়। - পৃষ্ঠা ৫৬


গল্পগুলো যে কতটা আকর্ষণীয় তা সংক্ষিপ্ত বিবরণ পড়ে বোঝা যাচ্ছে। এরকম লোমহর্ষক বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখার সামর্থ খুব কম লেখকেরই রয়েছে। কিশোর কিশোরীদের মনের গঠন বুঝে গল্প লিখতে স্বপন কুমার গায়েন সিদ্ধহস্ত। ছোট ছোট বাক্যে লেখা গল্পগুলো যেন তরতরিয়ে এগিয়ে চলে।  তার হাত থেকে বাংলা বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর আরও অনেক গল্প পাওয়ার ছিল।

বইটির আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ করেছেন সমরজিৎ রায়চৌধুরী। কাঠের ব্লকে ছাপানো ছবি বর্তমান কালের ছবির মত ততোটা নিখুঁত নয়। কিন্তু প্রত্যেকটা গল্পের সাথে ছাপানো ছবিগুলো চিন্তাসৌকর্যে যথাযথ ও উপযুক্ত হয়েছে। প্রচ্ছদের ছবিটিও অর্থবোধক। একজন কিশোর তরুণ টেলিস্কোপ নিয়ে দূর মহাকাশের তারকামণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রচ্ছদশিল্পী বাঙালি শিশুকিশোরদের নিয়ে কিরকম স্বপ্ন দেখেন তা প্রচ্ছদ চিত্রতে স্পষ্ট। এজন্য তাঁকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। কিশোর পাঠকদের জন্য স্বল্পদামে এরকম বই প্রকাশ করার সাহস মুক্তধারা ছাড়া এখন আর কারও মধ্যে দেখা যায় না। দুইরকম কাগজে ছাপানো হয়েছে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। স্বল্প আয়ের পাঠক যেন বইটির স্বাদ নেয়া থেকে বঞ্চিত না হয় সেটাও তখন ভাবা হত। অন্তত মুক্তধারার নামী প্রকাশক স্বর্গীয় চিত্তরঞ্জন সাহা ভেবেছিলেন। এরকম সমাজপ্রেমী প্রকাশক এখন বিরল।

আলোচ্য বইটি প্রকাশ হয়েছে বিজ্ঞান গণ-শিক্ষা কেন্দ্রের উদ্যোগে। এরকম উদ্যোগ এই সময়ে অনেক প্রতিষ্ঠান নিতে পারে। আশির দশকের মধ্যভাগে এই রকম বিজ্ঞান রহস্যগল্প প্রকাশ হতে পারলে এখন কেন হয় না, তা বোঝা কঠিন। অথচ বর্তমান সময়ের নবীন পাঠক এই জাতীয় গল্প পড়ে আনন্দিত হতে  চায়। তারা মহাকাশের অন্তরালে অভিযাত্রায় বেড়িয়ে পড়তে চায়। তারাও চায় নতুন নতুন আবিষ্কার করে দেশ জাতির উপকার তথা মানুষের জীবনযাপন আরও সহজ করে তুলতে। কিন্তু স্বপন কুমার গায়েনের মতো হৃদয়ে উদ্দীপনা জাগানিয়া লেখকের এখন বড় অভাব। তাই এই বইগুলোই পুনঃপ্রকাশ করা যেতে পারে। তাহলে আশা করা যায় বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হবে; নতুন প্রজন্মের পাঠকও বৈচিত্র্যময় কল্পকাহিনী পড়ার স্বাদ পাবে।

-#-#-#-#-


বার্নাডের তারা
স্বপন কুমার গায়েন


প্রকাশক: মুক্তধারা, ঢাকা
প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা: সমরজিৎ রায়চৌধুরী
প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৯, দ্বিতীয় প্রকাশ: ১৯৮৪
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৫৬
মূল্য: বোর্ড বাঁধাই: তেরো টাকা, সুলভ সংস্করণ: আট টাকা।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ