আশি ও নব্বই দশক জুড়ে তিনি ছিলেন এক রহস্যময় জগতের অন্যতম স্রষ্টা। কিশোর তরুণদের মন যে রোমাঞ্চকর জগতের খোঁজ করত, তিনি ছিলেন সেসবের খবরদাতা। প্রখ্যাত শিশু-কিশোর সাহিত্যিক কবি, প্রবন্ধকার আলী ইমাম তরুণদের মনের খবর রাখতেন। তাই তাঁর রচনায় হাতছানি দেয় কোন এক রহস্যময় দ্বীপ, সুউচ্চ পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা আর সুগভীর গুহা-গিরিখাদ, উঁকি দেয় ঘন জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গোপন অনাবিষ্কৃত কোন জগৎ। অবাক করা ঘটনার পর পাল্টে যায় গল্পের গতিপথ, কিশোর তরুণ মগ্ন হয়ে ডুবে যায় আলী ইমামের লেখার ভাঁজে ভাঁজে।
তাঁর গল্পের ভাষা সহজ, সরল। অল্পবয়সী হরিণের মত তরতরিয়ে এগিয়ে চলে। পাহাড়ের ছোটখাট উঁচুনীচু খাদ লাফিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যায়। পাঠক স্বপ্নাবিষ্টের মত সম্মোহিত হয়ে পরে। অভিযাত্রীর উত্তেজনা নিয়ে পাতার পর পাতা উল্টাতে থাকে। তাঁর লোভনীয় ভাষাভঙ্গির উদাহরণ নিম্নরূপ:-
এ কোন রাজ্যে এসে পড়েছি। প্যাডেল বোড যত এগিয়ে চলেছে আমি খোলা চোখে দেখতে পাচ্ছি তলায় প্রবাল, নানা রঙের প্রবাল, হীরে, চুনি, মণি, পান্নার মতো প্রবাল। প্রবালের ঐশ্বর্যময় নিঃশব্দ জগত স্বচ্ছ, স্তব্ধ জলের মধ্যে তার অসাধারণ সৌন্দর্য বিকিরণ করে দিয়েছে। সেই জলের মধ্যে খেলা করে চলেছে নানা রকমের মাছ। ছোট্ট কচ্ছপ ঘুম ভেঙে মাথা নেড়ে ভেসে উঠছে। তার গায়ে কত রকমের রঙিন দাগ। দুপায়ে ধূসর কালোর উপরে সাপের খোলসের মতো ছাপ ছাপ আর প্রবালের উপরে পা ফেলে থপথপ করতে করতে কচ্ছপ চলে গেলো দূরে।… আমার এই চোখের নিচ দিয়ে ভেসে গেল বাটারফ্লাই মাছ। ঠিক প্রজাপতির মতো দেখতে। হলুদ পাখনার উপরে এক চোখের মতো বড়ো কালো চিহ্ন, খোব ছোট সবুজ ঘেরা সেই চোখের মণি আর দুটি সবুজ দাগ পিঠের উপরে, তার সামনে ছোট্ট মুখ। অজস্র রঙিন সোনালি মাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে তাকে ঘিরে চলেছে। আরও দূরে সুইটলিপ মাছ। মুখ নিচু করে আড়চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। এদের ঠোঁট ভারি সুন্দর, মনে হয় কিছু বলতে চাইছে। ঠোঁটের উপরে বেশ উঁচুতে দুটো চোখ, দেখে মনে হয় যেন এক মাথাসর্বস্ব মাছ। ছোট্ট পাখনা মেলা আর পিছনে হলুদ চামড়ার মতো ছোট্ট ছোট্ট দাগ। ঝাঁকে ঝাঁকে অন্তত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ সুইটলিপ মাছ, পাখনা নেড়ে আড় চোখে আমাকে দেখতে দেখতে সরে গেল।
তারপর চাঁদের মতো ল্যাজ নেড়ে রককর্ড মাছ বেরিয়ে গেল। রককর্ডের গায়ে কালোর উপরে শাদা শাদা অজস্র দাগ। এ যেন আকাশের তারা আর তার পাশে ঘিরে সামনে, পেছনের পাখনায়, লেজের উপরে রাঙাভাঙা চাঁদ সবুজ রঙের। মনে হল তারাভরা আকাশে যেন তিনটে চারটে বাঁকা চাঁদ। কি অপরূপ মাছ। পৃষ্ঠা- ২৯
শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে প্রকৃতির এমন নিটোল বর্ণনাশৈলী খুব বেশি লেখকের জানা নেই। তার রচনাগুণের কারণে ছবি আর চোখে না দেখলেও চলে। মনের চোখে প্রতিটি উপাদানের বিবরণ চেনা হয়ে যায়।
ছিয়ানব্বই পৃষ্ঠার বইয়ে প্রচ্ছদ ছাড়া আর কোথাও কোন ছবি নেই। সাদাকালো রঙের কোন রেখাচিত্রও নেই। আসলে সে সময়ে ছবি প্রিন্ট করার প্রযুক্তি এখনকার (২০২১) মত অগ্রসর ছিল না। ছবি না থাকলেও বইয়ের আবেদনে কমতি ছিল না। ছবি নেই, কিন্তু তাতে কল্পনাভ্রমণে কোন ছেদ পড়ে না। লেখকের সরল ভাষাশৈলী পাঠকের মনে দ্বীপগুলোর এক স্বপ্নিল ছবি এঁকে দেয়। স্বপ্নডিঙায় চেপে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে ভ্রমণ করার উত্তেজনা জাগিয়ে তোলে।
আলী ইমামের রচনাশৈলীর গুণে দ্বীপগুলোর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, সাগর-পাহাড়, নীল আকাশ, অগভীর লেগুন, বর্ণিল প্রাণীজগত জীবন্ত হয়ে ওঠে। প্রবাল প্রাচীর, নীলাভ লেগুন, বুদ্ধিমান অক্টোপাস, বাটারফ্লাই মাছ, ওরাংওটান, কমোডো ড্রাগন, আদিবাসী, মাঝিমাল্লা, উজ্জ্বল রোদ, চকচকে সমুদ্র সৈকত, ফুলে ভরা উপত্যকা, পাহাড়ী নদী, বন্য ঝর্ণা, সামুদ্রিক আগাছা, বাগদা চিংড়ি, উড়ুক্কু মাছ, লাল কাঁকড়া, ঘোড়ামাছ, তিমি, হাঙর, কচ্ছপ, ফিঞ্চ পাখি, নারকেল বিথি, পাথর বিছানো ডুবো চর, কালো হরিণ সবাই যেন এক এক করে পাঠকের সামনে এসে দাঁড়ায়। পাঠক নিমেষে মুক্তি পায় বাস্তবের জটিল পৃথিবী থেকে।
আলোচ্য বইটি আহমদ পাবলিশিং হাউসের 'জানা অজানা গ্রন্থমালা' সিরিজের বই। ১৯৯০ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে এই সিরিজ প্রকাশ করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে প্রকাশক মহিউদ্দীন আহমদ 'প্রকাশকের নিবেদন' অংশে বলেন:-
এ বইগুলো প্রকাশের উদ্দেশ্য হলো সাধারণ পাঠক ও শিশু-কিশোরদের জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করা। কারণ আমরা বিশ্বাস করি একমাত্র জ্ঞানীরাই সত্যিকার অর্থে সুন্দর ও সমৃদ্ধ সমাজ নির্মাণ করতে পারেন – দিতে পারেন জাতিকে সঠিক দিক নির্দেশনা।
লেখক নিজে কোন ভূমিকা লেখেননি। আসলে তার রচনাই তার ভূমিকা। তিনি এমনভাবে বর্ণনা করেন, তাঁর ভাষাভঙ্গি এতটাই আকর্ষণীয় যে বই পড়তে পড়তে প্রকৃতির সাথে পরিচয় ঘটে যায়। প্রকৃতির প্রতি এক অপার ভালবাসায় বুক ভরে যায়। প্রাণপ্রকৃতির প্রতি মায়া জাগিয়ে তোলে। এই ধরণের বিষয় নিয়ে এখন আর কেউ বই লেখে না। প্রকৃতিজগতের সাথে তরুণদের পরিচিত হবার উপায় নেই। গল্পের ভঙ্গিতে পাহাড়ের উপত্যকায় অভিযানে নিয়ে যাবার মত, প্রবাল আর রঙিন পাথর দিয়ে সাজানো নীল সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে নিয়ে যাবার মত লেখক নেই। আলী ইমাম তার স্বকীয় রচনাশৈলী দিয়ে পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। সমকালে তাঁর বই সেভাবে উপস্থাপন করা হয় না বলে পাঠক তাঁকে চেনে না। ফলে নতুন যুগের পাঠক অস্বাভাবিক সাহিত্যধারায় পথ হারিয়েছে। আলী ইমামের বইগুলো পুনঃপ্রকাশ করা গেলে কিশোর তরুণ প্রজন্ম তাদের মনের মত বিষয় খুঁজে পেত; বইয়ের প্রতি সত্যিকারের ভালবাসা অনুভব করতে পারতো।
=~=~
দূরের দ্বীপ কাছের দ্বীপ
আলী ইমাম
প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার
প্রকাশকাল: ১৯৯০
আহমদ পাবলিশিং হাউস, ঢাকা।
পৃষ্ঠা: ৯৬
মূল্য: পঁয়ত্রিশ টাকা মাত্র
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম