ছোটদের বিজ্ঞানী ভাবা - কালীপদ দাশ

ছোটদের বিজ্ঞানী ভাবা - কালীপদ দাশ

ব্রিটিশ ভারতে যে কজন বিজ্ঞানী নিজ কর্মগুণে সাফল্যের উচ্চশিখরে আরোহন করেছিলেন তাদের মধ্যে 'হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা' [Homi Jehangir Bhabha (30 October 1909 – 24 January 1966)] অন্যতম। খ্যাতির পিছনে ছোটেননি কখনও। শুধু জানতেন মাতৃভূমির সেবা করতে হলে বিজ্ঞান চর্চা বাড়াতে হবে; বিজ্ঞানের রহস্যদ্বার উন্মোচন করতে হবে।

মধ্যযুগে ইউরোপে তখন রেনেসাঁস এসেছে। এর আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। এই কল্যাণশিখার অনির্বাণছটা ভারতবর্ষেও এসে পৌঁছায়। দেশের সংস্কৃতি জগতে ঘটে যায় এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন। দেশের প্রান্তবর্তী তরুণদের মধ্যে তখন সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, ডাক্তার, উদ্যোক্তা হবার এক উদগ্র আকাঙ্ক্ষা দেখা দেয়। লেখকের ভাষ্যে সেই সমাজচিত্র এরকম:-

তখন থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কত মনীষী, কত মহাপ্রাণ মানুষের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে ইতিহাসের দিগন্তে। একে একে এলেন কত মহাজন। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্ম শিক্ষা, শিল্পকলা, রাজনীতি প্রভৃতি জাতীয় জীবনের এমন কোন দিক রইল না যেখানে প্রতিভার সঞ্জীবনী স্পর্শ পড়েনি তখন। মৃতপ্রায় জাতির জীবনে সেদিন এইভাবেই এসেছিল প্রাণের জোয়ার। পৃষ্ঠা- ০৩

বিজ্ঞানচিন্তায় ভারতবর্ষের জেগে ওঠার কালে ১৯০৯ সালের ৩০ অক্টোবর বোম্বাই (অধুনা মুম্বাই) শহরের এক ধনী সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন 'হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা'। সেসময়ে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ বা থিওরি অব রিলেটিভিটি প্রকাশিত হয়েছে। পৃথিবীতে শুরু হয়েছে পরমাণুবিদ্যার নতুন গবেষণা। বিজ্ঞানের এক নবযাত্রার কালে বেড়ে ওঠে তিনি। ছাত্রজীবনেই মেধার পরিচয় দিতে থাকেন। বিজ্ঞানের নতুন নতুন তত্ত্ব ও উদ্ভাবনের প্রতি তার আগ্রহ দিনে দিনে বাড়তে থাকে। তৈরি হতে থাকেন আগামীদিনের পরমাণুবিজ্ঞানী হিসেবে।

ভারতবর্ষে বিজ্ঞান চর্চার এক প্রাচীন ইতিহাস আছে। লেখকের বর্ণনায়:-

এক সময় আমাদের এই দেশ ছিল সমস্ত পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক শ্রেষ্ঠ পীঠভূমি। তখন দেশ-দেশান্তর থেকে অনেক শিক্ষার্থী জ্ঞানলাভের আশায় ভারতের তক্ষশীলা, নালন্দা, কাঞ্চী, বিক্রমপুর প্রভৃতি শিক্ষার পীঠস্থানগুলিতে আসত। গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, স্থাপত্যবিদ্যা, আয়ুর্বেদ প্রভৃতি  বিজ্ঞানের নানা শাখায় ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অবদান তখন সমস্ত বিশ্ববাসীর শ্রদ্ধা ও সম্মান অর্জন করেছিল। কণাদ, আর্যভট্ট, নাগার্জুন প্রভৃতি বিজ্ঞান-সাধকদের নাম তখন সারা পৃথিবীর লোক জানত। পৃষ্ঠা-০৭


সেই প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ধারা যে সব মণীষীর হাত ধরে আধুনিক ভারতে জেগে ওঠে তাদের একজন হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা। ভারতীয় পদার্থবিদ্যা ও পরমাণু গবেষণা ক্ষেত্রে তাঁর একাধিক অবদান আছে। তিনি নিজে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিদ্যায় উচ্চতর পড়াশোনা করেছিলেন। পরমাণু নিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল তার। ছাত্রজীবনে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় দিয়েছেন নিজের উচ্চ মেধার স্বাক্ষর।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাবাকে তত্ত্বীয় পদার্থবিদ হিসেবে চাকুরীর প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। তিনি এর উত্তরে চিঠিতে লিখেছিলেন:-

আমাদের মতো লোকের উচিত স্বদেশে গবেষণার উপযোগী কেন্দ্র স্থাপন করা। সকলের আগে আমাদের দেশ – আমি এই আদর্শে বিশ্বাসী এবং এই আদর্শকে সামনে রেখেই আমি এখন কাজ করে চলেছি। - পৃষ্ঠা - ৩৭


তিনি মূলত গাণিতিক পদার্থবিদ হলেও প্রায়োগিক পদার্থবিদ্যার প্রতি সমান আগ্রহ বোধ করতেন। তিনি ছিলেন সুদক্ষ সংগঠক, অবসরে ছবি আঁকতেন। দক্ষিণ ভারতীয় ধ্রুপদী ঘরানার মার্গসঙ্গীত, উচ্চাঙ্গ নৃত্য যেমন ভারত নাট্যম উপভোগ করতে পছন্দ করতেন। তিনি একজন বৃক্ষপ্রেমী ছিলেন; বাগান করা তাঁর অবসরের অন্যতম কাজ ছিল। চিত্রকলার প্রতি আগ্রহ ছিল খুব। দেশ-বিদেশের অনেক চিত্র তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল। অর্থাৎ হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা একজন পরিপূর্ণ সংস্কৃতিমান মানুষ ছিলেন।

পারমাণবিক শক্তি কমিশনের দ্বিতীয় চেয়ারম্যান ডক্টর বিক্রম সারাভাই ভাবার বহুমুখী ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বলেন:-

ডক্টর ভাবা জীবনকে সমগ্রভাবে গ্রহণ করেছিলেন; তাই বিজ্ঞানের পূজারী হয়েও তিনি ছিলেন একজন সৌন্দর্যের উপাসক, কলানুরাগী ব্যক্তি। তিনি শুধু বিজ্ঞানের ভাষাই বুঝতেন না, ভারত নাট্যম থেকে আবৃত্তি শুনেও তিনি রীতিমত রোমাঞ্চ অনুভব করতে পারতেন অথবা কোন মন্দিরের প্রস্তর বা ব্রোঞ্জে তৈরি একটি মূর্তি দেখলে তাঁর শিল্প-সুষমায় মুগ্ধ হতেন। তিনি ছিলেন একজন গোটা মানুষ। প্রকৃতিকে ভালবাসা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ছিল। পৃষ্ঠা- ৫৪


ভারতে তিনি তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছেন। রাষ্ট্র তাঁর প্রতিভাকে সম্মান দিয়ে পরমাণু শক্তি গবেষণা কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে ভারত পরমাণু শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে। এই কাজে ভারতীয় উপাদান ও ভারতীয় প্রযুক্তির ব্যবহার করে ভাবা নিজের তথা দক্ষিণ এশীয় অঞলের মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থের প্রমাণ রেখেছেন।

১৯৬৬ সালের ২৪ জানুয়ারি ইউরোপের আল্পস পর্বতমালার মাউন্ট ব্লাঙ্ক পর্বতশৃঙ্গে এক বিমান দুর্ঘটনায় এই দেশপ্রেমিক পরমাণু বিজ্ঞানীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। ভারতীয় বিজ্ঞান জগতের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বকে সম্মান করে পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে তাঁর নামে রাখা হয়েছে "ভাবা এটমিক রিসার্চ সেন্টার"।

সাহিত্যমালা প্রকাশনীর জীবনীগ্রন্থ সিরেজের একটি বই "ছোটদের বিজ্ঞানী ভাবা"। আরও বিশ জন সুখ্যাত মণীষীর জীবনীর পাশাপাশি বিজ্ঞানী ভাবার জীবনী প্রকাশ করে তারা ভাল কাজ করেছেন। শিশু-কিশোরদের সামনে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের প্রখ্যাত দেশপ্রেমিক মানুষদের পরিচয় তুলে ধরার কাজ সবাই করতে পারে না। সাহিত্যমালা প্রকাশনী এই কাজ করে বেশ প্রশংসিত হয়েছে।

দুই রকমের বাঁধাইয়ে এই বই পাওয়া যায়। হাতের বইটি বোর্ড বাঁধাই। প্রকাশ হয়েছে ১৯৯১ সালে। ত্রিশ বৎসরের কাছাকাছি সময়ে এসেও বইয়ের সেলাই, আঠা সব অক্ষুন্ন আছে। নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপানো বইয়ের কোন শারীরিক ক্ষতি হয় নি। এত বছরেও ছাপানোর মান বা কালির ঔজ্জ্বল্যে কোন মলিনতা আসে নি।

লেখক কালীপদ দাস সম্পর্কে বইয়ের কোথাও কোন তথ্য নেই। তিনি কে, কী করেন, বাড়ি কোথায়, অন্য কোন বই লিখেছেন কী না - এরকম দু একটি তথ্য কোথাও লেখা থাকতে পারত। কিন্তু সাহিত্যমালা প্রকাশনী কর্তৃপক্ষ কোথাও সে তথ্য উল্লেখ করেন নি। অবশ্য ১৯৯১ সালে বইয়ের কোথাও লেখক সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়ার রীতি ছিল না।

বইটি ছোটদের জন্য, কিশোর কিশোরীদের উদ্দেশ্য করে লিখিত। ভাষাভঙ্গি, উপস্থাপনশৈলী সহজ জটিলতাহীন। বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব ও তথ্যগুলো নবীন পাঠকরা যেন বুঝতে পারে সেরকম সরল বাক্যে রচিত। বলা যায় শিশু কিশোরদের সামনে একজন দেশপ্রেমিক নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানীর জীবন উপস্থাপনে এই বই সফল।


--==--==--==--
ছোটদের বিজ্ঞানী ভাবা
কালীপদ দাস

প্রকাশকাল: ১৯৯১
প্রচ্ছদ: সরদার জয়নুল আবেদীন
প্রকাশনায়: সাহিত্যমালা, ঢাকা।
পৃষ্ঠা: ৫৮
মূল্য: সাদা কাগজ: ৩০ টাকা, নিউজপ্রিন্ট: ২০ টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ