সাখাওয়াত টিপু'র কবিতাবই 'রাজার কঙ্কাল' প্রকাশিত হয় ২০২০ সালের অমর একুশে বইমেলায়। এই বইয়ের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের আলোচনা এবং বই প্রকাশকালীন সময়ের অনুভূতি নিয়ে লেখকের সাক্ষাৎকার 'গ্রন্থগত' সাইটে প্রকাশিত হয়েছে। আজ উক্ত বইয়ের একটি আলোচনা প্রকাশ করা হল।
সাখাওয়াত টিপু নব্বুই দশকের একজন তুখোড় কবি। নব্বুই এর বাংলা কবিতা যাঁদের হাত ছুঁয়ে পোক্ত হয়েছে টিপু তাঁদের অন্যতম একজন। ইতোমধ্যে, ভিন্ন ভূগোলেও তিনি বাংলাভাষী কবি হিসেবে তুমুল পরিচিত। সম্প্রতি স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, সার্বিয়ান, স্লোভেনিয়ান এবং ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর কবিতা। আলোচিত হচ্ছে তাঁর কবিতার বিবিধ অনুষঙ্গ। এবার একুশে বেরিয়েছে রাজার কঙ্কাল। কবিতার ভাব- বিশ্বে তিনি কঙ্কাল নন। বরং রক্তকমল তীক্ষ্ণ অনুভাবী এক কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। এই ট্রিনিটির অন্দরমহলে টিপু আগুনমুখা কবি হয়ে ওঠেছেন। কবিতার ভাষা ও বিষয় জীবন থেকে ধার করে নিজস্ব রেসিপিতে বুনন করে চলেছেন অন্তর্গূঢ় দার্শনিক প্রত্যয়। আজ সামন্তবাদী সমাজ নেই, রাজা নেই, রাজকার্য ও যুদ্ধজয়ের রাজঘোড়া নেই। অথচ ছায়াদেহ এক অদৃশ্য কঙ্কাল পড়ে আছে যত্রতত্র। সেসব ছাই কুড়িয়ে তিনি প্রাত্যহিক গার্হস্থ্য চলনমুখী ভাষায় প্রতিকায়িত করেছেন কবিতানুষঙ্গ। রাজার কঙ্কালে মা, মাটি, বাবা সহ রাষ্ট্রিক মানুষের বিবিধ ব্যাকরণ অত্যন্ত সুদক্ষ হাতে নির্মিত হয়েছে। কিছু কবিতায় তিনি সরগরম, কিছু কবিতার ব্যাঙ্গভাষায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ভাবচিত্র; যেমন, লিচু চোষা বুদ্ধিজীবীগণ "
রবীন্দ্র গায়িকা দেখলে দুইপাটি হাসেন।
কোমল কোমল সাহিত্য ভালোবাসেন।
-------------------------------------
দু'চামচ তেল পেলে কেবলই হাত কচলায়
কী বলতে কী বলেন। যাতা তৈলাক্তবাহিত!
ঢিলা ঢিলা ভাব ভাব নিয়ে ওই গৃহ পালিত যায়'।
এই কাব্যরেকাবিতে উঠে আসে বাস্তবানুগ কিছু চিত্ররথ। পোষ্য, নমস্য দেশের বুদ্ধিজীবীদের হাল হকিকত। আমাদের দেশে কিংবা এই উপমহাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের যাবতীয় অন্ধকার কে চ্যালেঞ্জ করা ঘাড়ত্যাড়া বুদ্ধিজীবীর বড়ই অভাব। এভাবে টিপুর কনকাচল বড় হতে হতে তামাদি লেলিন পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কতকজোড়া মার্বেলের মধ্যে একটি মার্বেল যদি খেলতে গিয়ে গর্তে পড়ে, দাবি যে মার্বেল ছুড়েন তার! প্রশ্ন ওঠে আসে লেলিন কার! ভলগার পাড়ে যে লেলিনের উন্মেষ সারাবিশ্বকে জাগিয়ে তুলেছিল, সে কি মৃত মানুষের হাড়! সে কি বাজেয়াপ্ত, তামাদি! সত্তর বছরের সোভিয়েত ইউনিয়ন শেষ পর্যন্ত টেকেনি। মানুষের মহাসমুদ্র হঠাৎ ভরাট হয়ে গেলো।
সব্বাই যেন অস্পৃশ্য দৃশ্যময় পূজিবাদীর নকর হয়ে ওঠেছেন। ছায়াহীন ভ্লাদিমির দাঁতাল রাষ্ট্রের শিকার। আমরা কি এমন বিশ্ব চেয়েছিলাম? আমরা কেমন দেশে, আব্বাজান, এ দেখি যাবতীয় অনিয়মের খসড়া, যেখানে উঁইপোকা, করাত, মেশিনের হাহাকার শুনি,যেন কোথাও কিছু আর অবশিষ্ট নেই। সমকালীন ব্যঞ্জনা, সমাজবাস্তবতার অক্ষরের ছাউনির মধ্যে এক দুঃসহ বিরামহীনতার প্রত্যয়ন পত্র। কে থামাবে শব্দের লড়াই! কে থামাবে শব্দের পঙ্খীরাজ। তিনি শান্তির বোরাকে চড়ে মা' গো লড়াই করতে শেখো বলে সবক দিচ্ছেন। মায়ের কবিতায় টিপু অন্য রকম স্থিতধী, কিছুটা শান্ত, অনেকটা মৌলিক। মেয়ের অসহায়ত্ব কে ঝাড়ি মেরে নারী জন্মের সক্ষমতার ভেতরে পুরুষ জন্মের কথা বলেছেন, পক্ষান্তরে নারী ক্ষমতায়ন। এই কবিতার প্রথম স্তবকের কোমল সুশোভিত পঙক্তি বিন্যাসে মনে পড়ে গেলো বিশ্বনন্দিত কৌতুক অভিনেতা চার্লি চ্যাপ্লিনের একটি কথা; আমি বৃষ্টির মধ্যে দ্রুত হেঁটে যাই, কেউ যেন আমার চোখের জল না দ্যাখতে পায়। চার্লি চ্যাপ্লিনের অন্তর্দাহ আমাদের রক্তাক্ত করে, বেদানাক্ত করে। অনিঃশেষ এক দহনের সবক এটি। টিপু'র এতো লাশ লইয়া কোথায় যামু আম্মাজান? এটি যেন লাশের সারেগাম, সংগীতের বিক্ষুব্ধ স্বরলিপি; যেন বিধানের পাতাগুলো বিধবার সাদা শাড়ি / যেন স্তব্ধ কাফনের সাদা কাপড়ের স্তূপ। এই উপমহাদেশের রাজনামায় লেখা আছে রক্ত, ক্ষমতার মসনদে লেখা আছে খুন। এখানে মায়েদের মুখে কথা থাকেনা। মায়ের সম্মুখে ছেলের লাশ নিয়ে কবরপাড়ায় যেতে হয় বাবাদের। এখানে মা'রা নিঃস্পৃহ, অসহায়। এভাবে শত শত মৃত্যুর ফিরিস্তি দিয়ে নিজের মৃত্যুর কথা যেন নিশ্চিত করতে চান কবি প্রবল সংবেদনশীলতায়;
কবিকে শান্তিতে ঘুমানোর জন্য একটা কবর দাও
যেন কোনো মনুষ্য পায়ের ছাপ না জাগে, এমন কি
যেন কোনো পাখির শব্দও কবির কুহরে না পৌঁছায়।
কবি যে শব্দের জন্মদাতা, ধবল ধাত্রীর একদম
এতিম কবিতা রেখে কবি কামিনীর কোলে ঘুমাবে এখন।
কবি সমাজ বাস্তবতাকে উন্মোচন করেন বিস্ময়কর কৃৎকৌশলের আশ্রয়ে। রাজার কঙ্কাল এর কবিতাগুলো আপাতমধুর মনে হলেও অভ্যন্তরে গভীর অরণ্যের নান্দনিক ব্যবস্থাপত্র।
কবি সাখাওয়াত টিপুর কাব্যধর্ম এরকম :
- ক) খুব সহজগম্য ভাষা, শব্দের কসরত নেই, তবে গভীরককণ্ঠের নিনাদ আছে।
- খ) বিষয় অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। কোথাও জটিলতা নেই, তবে বিবিধ অন্বয়ের অপূর্ব মোচড় আছে।
- গ) প্রতিটি শব্দ স্বাধীন চলিষ্ণু গড়িয়ে গড়িয়ে পোক্ত বাক্য নির্মাণ করে।
- ঘ) বিষয়ানুযায়ী বাক্য ও শব্দের ব্যবহার চাতুর্যপূর্ণ।
- ঙ) অনুভূতিময় সংবেদ্য পরিবেশ।
- চ) অধিকন্তু কোমল স্বরাঘাতে জটিল বিষয়ের সরল উপস্থাপনা।
- ছ) কবিতায় ব্যবহৃত আঞ্চলিক শব্দ ভিন্ন ভাবালুতায় কবিতা হয়ে ওঠেছে স্পন্দিত।
- জ) ছন্দের চর্চিত শাসনে বাক্যাংশ অনুভূতিময়
- ঝ) মাঝেমধ্যে নমিত স্বরব্যঞ্জনের কবিতা ভীষণ অন্তর্মুখী।
এসব তরঙ্গধর্মের ভেতরে হন্তদন্ত এদিকওদিক ছুটে ক্লেদাক্ত রক্তাধিক্য কবি কি একটু শান্তি পাবেনা? হে আচার্য, তুমি কবিকে শান্তি দাও। মাটির জৈবসারে জেগে ওঠার শক্তি দাও। মানুষ ও মানবতার রেলগাড়িতে কবিকে স্বপ্ন নির্মাণে ফুরসৎ দাও। রাজার কঙ্কাল যাতে ঘুণে না খায়। হে গুণেন্দ্রনাথ, তুমি কবিও এই কিতাবকে ভালবাসিবার শক্তি দাও।
আরও পড়ুন:-
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম