অনল রায়হানের বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ‘ফ্রিম্যান': আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে

ফ্রিম্যান- অনল রায়হান

খান আলাউদ্দীন

২৭০২ সাল। মানব প্রজাতি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর এক ভাগে অ্যাডভান্স ডি.এন.এ হিউম্যান। অন্যভাগে কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা ইলেক্ট্রনিক ভাইরাস, রেনজার্সরা। ডি.এন.এ সিকোয়েন্স ম্যানুফ্যাকচারিং করে অ্যাডভান্স ডি.এন.এ হিউম্যানদের জেনেটিকস ল্যাবরেটরিতে তৈরী করা হয়। রেনজার্সদের প্রোগাম করে রাখা আছে মিঁউলি নদীর জলে। ভোমরার পেটের ভেতর লুকোনো রাক্ষুসীর প্রানের মতো কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ লুকিয়ে রাখা জলের মলিকিউলে। ভবিষ্যতের রুপকথা বুঝি এমনই হয়। প্রজেক্টটা ছিলো নাসার। দুই হাজার শতকের একশোজন মানুষের জিন সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিলো । তাদের বাঁচিয়ে তোলা হয়েছে। পৃথিবীতে তিন ধরনের বিকাশমান বুদ্ধিমান প্রাণী জড়িয়ে পড়েছে অস্তিত্ব সংকটে । বেঁচে থাকবে কারা:

রেনজার্স —দ্রিপি আলমের, অট্টো, বেবেলেবে, নিত্তনি হেনাসিয়ান সি, মুর, আজগরিয়...?

অ্যাডভান্স ডিএনএ সিকোয়েন্সের মানুষ —নিল, টুল, অ্যাবেট অ্যালয়...?

দুই হাজার শতকের মানুষ— আবিদ, জেরার্ডো মার্টিনো ...?

২০২২ থেকে সাতশ’ বছর পর। পৃথিবীতে কোন দেশ নেই। পুরো পৃথিবীটাই একটা দেশ। সাম্যবাদীরা এমন একটি দেশের স্বপ্নই দেখেছিলো রাশিয়ায়, ভারতবর্ষে, ইউরোপে, অ্যামেরিকায়। ভেদাভেদহীন, কাঁটাতারহীন মানব পৃথিবী।

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে, নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কি শর্তে?


সিগারেট বিড়ি সাইজ, নিউ আফ্রিকার তিন দিক ঘিরে সমুদ্র, অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের অর্ধেকের বেশি জায়গা সমুদ্রে তলিয়ে গেছে, মালদ্বীপের ভাগ্যেও ঘটেছে সলিল সমাধি, বিবর্তনের সূত্র অনুসারে বা মানবসৃষ্ট কারণে চিরতরে হারিয়ে গেছে ক্যাঙ্গারু আর কোয়েল প্রজাতি প্রাণী। মানুষের বয়সের উর্দ্ধসীমা দাঁড়িয়েছে ১৬০-২০০ বছর। ঢাকা বলে কোনো শহরের অস্তিত্ব নেই। ঢাকার নতুন নাম ফরেস্ট টাউন, একটা মেগা সিটি। জাহাঙ্গীর নগর থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে ফরেস্ট টাউন। ঢাকা শহরের রুপান্তর এবং ঢাকা শহরকে ঘিরে মানুষের কর্মকোলাহল অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চিত্রায়ণ করেছেন লেখক।

মানুষের বসবাসের সুবিধার জন্য রয়েছে অ্যাকোয়াসিটি, সুপারসনিক লিফট, ভার্চুয়াল কার। জল-স্থল- আকাশ পথে মাটির গভীরে চলতে সক্ষম গ্লাস হাউস। যোগাযোগের জন্য ভার্চুয়াল কমিউনিকেশন মডিউল।

অমর হওয়ার ইচ্ছা মানুষের চিরন্তন। জৈবিক ভাবে চিরজীবন লাভ করা সম্ভব নয় জেনে মানুষ কল্পনা করেছে চিরজীবী আত্মার, আদিঅন্তহীন পরকালের। কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও সৃষ্টিশীল মানুষেরা বেঁচে থাকতে চায় তাদের কর্মের মাধ্যমে। সোনার তরীতে আশ্রয় হবে শুধু অর্জিত ফসলের, কৃষকের নয়। বর্তমান যুগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির কারণে মানুষ অমর হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন পরিণত কোষকে অপরিণত কোষে রূপান্তর করার উপায়। আবিষ্কৃত হয়েছে অ্যান্টিএজিং পদ্ধতি। এপিজেনেটিক মার্কারকে উল্টে দিয়ে মানুষেরা বয়স ও শারীরিক স্বাস্থ্য ফিরে পাবে। কিন্তু প্রাকৃতিক আপদ ও দুর্ঘটনাজনিত কারনে মানুষ হয়তো মৃত্যুকে রুখে দিতে পারবেনা। তাছাড়া মানুষের আত্মবিধ্বংসী প্রবণতাতো রয়েছেই। ফ্রিম্যান জুড়ে অনুরণিত হয়েছে মানুষের মরণশীলতারই গান। সালটা ২৭০২ হলেও নিউিক্লয়ার বোমা ও প্রকৃতির ছন্দ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দুই ধরনের অপ্রাকৃতিক মানুষ তো বটেই বাঁচিয়ে তোলা দুই হাজার সালের হান্ড্রেড পার্সেন্ট ন্যাচারাল হিউম্যানও বেঁচে থাকতে পারছেনা।

মেগা হাইরাইজেস। সাতশো বছর পরের ঢাকায় অতিকায় সব ভবন। কোনোটাই একহাজার তলার কম নয়। সোফাসেটের স্প্রিংয়ের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে উপরে। বাহ্ ! লেখকের কল্পনার তারিফ করতে হয়। তবে তিনি কল্পনার ফানুসই উড়িয়েছেন,কল্পনাকে শক্ত ভিত দিতে পারেননি। কমলালেবুর মত পৃথিবীর উপরের স্তর কি এরুপ এক হাজার তলা ভবনের ভর ধারণ করতে পারবে? ভূগর্ভস্থ ভলকানো, ঝড় ও বাতাসের প্রভাবে অতিকায় ভবনের ভেঙে পড়ার ঝুঁকি রয়েই যায়। বিশাল স্কাইস্ক্যাপারের নির্মানে স্প্রিং নয়, পিরামিড আকৃতিই অধিক যুক্তিযুক্ত।

এরূপ ভবনের উপরের তলাগুলোর অক্সিজেনস্বল্পতা, চাপ ও ঠান্ডার কথা চিন্তা করে বাড়তি দক্ষযজ্ঞের ব্যবস্থা নিতে হবে। সো কল্পবিজ্ঞানের পাতায় একশো কি এক হাজার তলা উচ্চতা বিশিষ্ট ভবনের ধারণা যত সহজ মনে হয় বাস্তবে তা নির্মাণ তত সহজ নয়।


জমির থেকে জামর


লুই বেনোয়া জামর। চট্টগ্রামের ছেলে। অজপাড়াগাঁয়ের এই ছেলেটি ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছিলো। তিনভাগে বিভক্ত ফ্রিম্যানের দ্বিতীয় ভাগ পুরোটাই জমিরের কাহিনী। তাঁর শৈশব,পর্তুগিজদের দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে যাওয়া,দুর্ঘটনাক্রমে ফ্রান্সের রাজ প্রাসাদে উপনীত ও ফরাসিসম্রাট পঞ্চদশ লুইয়ের প্রিয় রক্ষিতা কাউন্টেস দ্য বারির প্রিয় পাত্রে পরিণত হওয়া, জ্যঁ জ্যাক রুশোর বই পড়ে জ্যাকব পন্থী বিপ্লবী দলে যোগদান, ফরাসী বিপ্লবে অংশগ্রহণ, কারাগারে মৃত্যু। সব। তবে পাঠকের মনে রাখতে হবে লেখক ইতিহাস লেখেননি ,সেটা ঐতিহাসিকের কাজ অনল রায়হান সাইন্স ফিকশন লিখতে গিয়ে ইতিহাসকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সেজন্যই লুই বেনোয়া জামর ফ্রিম্যানে উপস্থিত হয়েছে নওশাদমিয়া, জ্যঁ পিয়েরে রূপে, কাউন্টেস দ্য বারি রাণী অ্যান্তনে রূপে, ইংরেজ বিপ্লবী জর্জ গ্রিভ ম্যাক্সিমিলিয়ে রবিসপিয়েরে রূপে।

বাস্তবে ১৭৭৩ সালেই লুই বেনোয়া জামরের বয়স ছিলো ১১ বছর। ১৭৮৮ সালে তার বয়স হওয়ার কথা ২৬ বছর। অথচ ১৭৮৮ তে লেখক উপন্যাসের বর্ণিত পিয়েরকে গড়ে তুলেছেন বিশ বাইশ বছরের তাগড়া যুবক হিসেবে।

উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র আবিদুর রহমান জ্যঁ পিয়েরের উত্তর পুরুষ। আবিদুর রহমানের মেমোরিতে জ্যঁ পিয়েরের অস্তিত্বকে অ্যাকটিভ করা হয়। যার ফলে সে একই সঙ্গে দুটো মানুষের কর্মপ্রণালি পরিচালনা করতে সক্ষম। আবিদুর রহমানের মধ্যে দ্বৈত সত্তা বিরাজমান থাকায় পাউলি লিওকে জড়িয়ে ধরে জ্যঁ পিয়েরের চুমু খাওয়া ও নিলের চোখে আবিদুরের আলতো চুমুর মধ্যে সাদৃশ্য নিকটতর হয়ে উঠে। লুই বেনোয়া জামরের প্রকৃত মৃত্যু তারিখ ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮২০। কারণ দারিদ্র ও অনাহার। অথচ উপন্যাসে জামরের ছায়াচরিত্র জ্যঁ পিয়েরের মৃত্যু দেখানো হয়েছে ১৭৯৪ সাল। গল্প কবিতায় উঠে আসা ইতিহাস অনেক সময় বাস্তবের অপভ্রংশ হয়ে স্থান করে নিলেও কালের করাল গ্রাস থেকে সে ইতিহাসের জীবন প্রাপ্তি ঘটে। লুই বেনোয়া জামরও বেঁচে থাকবে ফ্রিম্যানের পাতায় পাতায়। চির উজ্জ্বল।

আমাদের মস্তিষ্ক নিউরাল নেটওয়ার্ক স্বরূপ। চিন্তা ভাবনা পুরো মস্তিষ্কজুড়েই ছড়িয়ে থাকে। এমআরআই স্ক্যানারে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশে বৈদ্যুতিক সক্রিয়তা দেখা যায়। ফলে মস্তিষ্কের কোনোঅংশ অকেজো হয়ে গেলে অন্য অংশ কাজ করতে থাকে । এতো গেলো একটি মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে সিন্যাপসে সিন্যাপসে সংযোগের কথা। মস্তিষ্কে মস্তিষ্কে নেটওয়ার্ক স্থাপন করা কি পসিবল? সাতশ বছর পরের পৃথিবীতে মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যেতে থাকলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় অ্যাডভান্স ডি.এন.এ সিকোয়েন্সের ও বিশ শতকের মানুষের কয়েকশো মস্তিষ্ক অ্যাকটিভ রাখার। কয়েকশ মানুষের মস্তিষ্কের নেটওয়ার্ক কয়েকশ বছর পৃথিবী শাসন করবে। এরাই আবার দেহঅলা মানুষ তৈরী করবে। কিন্তু তিন হাজার শতকের পৃথিবীতে সেন্ট্রাল সিস্টেম নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চারশ বছর আগের সংরক্ষিত জিনস, রেনজার্স সব ধ্বংস হয়ে যায়। পৃথিবীতে আবিদুর রহমান ছাড়া আর কোনো জীবিত মানুষ থাকেনা। সমাপ্তি ঘটে ফ্রিম্যান উপন্যাসের ।

লেখক যদি বইটির দ্বিতীয়াংশ লিখতে চায় তাহলে সেটি কেমন হবে? বাইবেলের রেফারেন্স টেনে বলা যায় আদম যেমন একজন সঙ্গী চেয়েছিলো আবিদুর রহমানও একার পৃথিবীতে সঙ্গী খুঁজে বেড়াবে। সেক্ষেত্রে সে তার স্টেমসেলকে জননকোষে পরিবর্তন করতে পারবে। সেই জননকোষ দিয়ে ল্যাবে সৃষ্টি হবে পরিপূর্ণ মানবী। ঘুচবে তার একাকীত্ব। ব্যাপারটা অনেকটা পুরুষের বাম পাজঁরের হাড় দিয়ে নারীকে তৈরীর মতোই।

ব্রেইন নেটওয়ার্ক, ব্রেইন টু ব্রেইন নেটওয়ার্ক। ধারণাটি টেলিপ্যাথিক জোক মনে হলেও একুশ শতকে এটাই হতে যাচ্ছে মানবজাতির সবচে বড় অর্জন। আমরা ইতোমধ্যে কম্পিউটারের সাথে ব্রেইন সংযোগ করতে সক্ষম হয়েছি। কারো মস্তিষ্কের এমআরআই স্ক্যান করে বলতে পারছি সে আসলে কি ভাবছে— উড়োজাহাজ, পাখি, সমুদ্র না রাসায়নিক অস্ত্র। ব্রেইন নেট বাস্তবায়িত হলে ব্রেইনে ব্রেইনে শুধু তথ্যই স্থানান্তরিত হবে না। মানবীয় আবেগ, অনুভূতি, ইচ্ছাও স্থানান্তরিত হবে। ফ্রিম্যানের অন্যতম অনুষঙ্গ ব্রেইন নেটওয়ার্ক। ব্রেইন নেটওয়ার্কের তেলেসমাতিতেই আবিদের মাথার ভেতর কথা বলে উঠে নিল। লিপি আবিদের মাইন্ড রিডিং করে বলে,

 আপনি আমাকে কাঁদাতে চাচ্ছেন কেন?



অর্থাৎ সাতশো বছর পরের পৃথিবীতে সবাই সবার মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত। দেহহীন কয়েকশো মস্তিষ্কের নেটওর্য়াক কয়েকশো বছর পৃথিবী শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

সাম্রাজ্যবাদ, নওশাদ মিয়ার ভাগ্য বিড়ম্বনা, পাউলি লিউর প্রতি তার প্রেম, রানী ষোড়শ লুইয়ের স্ত্রী অ্যান্তনের সাথে মাতৃসম্পর্ক, ফরাসি বিপ্লব, মানবপ্রজাতির অস্তিত্ব সংকট, ভবিষ্যতের জাদুকরী প্রযুক্তি, আবিদুর রহমানের সময় ভ্রমণ (২০২২ সালের মানুষ সে অথচ তার পুনরার্বিভাব তিনহাজার শতকে— এটা সময় ভ্রমণ ছাড়া আর কি?) ঢাকার অতীত ঢাকার ভবিষ্যতে, এইসব বিষয়ই ফ্রিম্যানের শরীর গঠনে আমিষ - প্রোটিন জুগিয়েছে।

ভবিষ্যৎ কি অনুমান করা যায়? অনুমান করা যায় কিনা তা জানতে আসুন ফ্রিম্যান পড়ি। কল্পকাহিনী নামের গ্লাস হাউসে ঘুরে বেড়াই সাতশ বছর পরের পৃথিবীতে। সুনিপুন নৃতাত্ত্বিকের মতো উন্মোচন করি সতেরো শতকের অজানা ইতিহাস।
 

 -:-:-:-:-:-:-:-:-:-

ফ্রিম্যান
অনল রায়হান


প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন

প্রথম প্রকাশঃ অমর একুশে বইমেলা ২০২০।

প্রচ্ছদ : মাসুক হেলাল

মূল্য : ৩৫০ টাকা।

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ১৯২ ।

ISBN 978 984 94365 1 5

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ