আহমেদ মওদুদ রচিত "দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানে" কাব্য প্রসঙ্গে 'শামীম সৈকত'

আহমেদ মওদুদ রচিত "দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানে" কাব্য প্রসঙ্গে 'শামীম সৈকত'

এক.
কবির মাথার উপর ছায়া দেওয়ার কথা যে বৃক্ষের তা কেটে ফেলা হয় কবি 'র জন্মের আগেই। ফলে,  কবি হেঁটে চলেন তপ্ত মরুভূমি ভালোবেসে। জেগে উঠতে চান,  জাগাতে চান। ঘুমভাঙা ভূমি ও ফসল আঁকরে স্পর্শ করতে  চান ছায়ার সমাধান, পাখির কান্না, ঘূর্ণনরত লোক। না, কোনো দাবি নেই। পৃথিবী গতিশীল। কোনো কিছুই স্থির নয় জেনে প্রিয় ফুলটির কাছে দাবি নেই। সংঘাতে, দ্বন্দ্বে ফোঁটা ঘাতকফুল।

পৃথিবীও ঘূর্ণনরত, সরে যাচ্ছে দূরে, তাদের থেকে, অতএব জেগে ওঠো পাখির কন্ঠ, মাটির কান্না, মানুষের বধিরতার মহান ঔষধ।

কবি আহমেদ মওদুদ এমনই ঘুমভাঙা, মাটির বুনন। যার যাপিত হৃদয় চষে অক্ষরের ফুল হয়ে ফুটে আছে কাব্যগ্রন্থ দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানে, খন্ডচিত্রে। যে লোকটা পুতুল বানায়। মাটির পুতুল। অথবা ধরে নেওয়া যাক, উনি মাটির পাহারাদার।

দুই.
মাটির মানুষ বলতে আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষকে বোঝানো হয়। যাদের হাতে আমাদের ভোগ বিলাসিতার উপকরণ অথচ তারা সুবিধা বঞ্চিত থেকেই যান মৌলিক অধিকারের। কবি এই চিত্রে ব্যতিত হোন। মানুষের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন।

মানুষের জন্য আর কোনও প্রার্থনা নয় বরং শুয়োর যারা ময়লার স্তুপ থেকে খাবার খুঁজে নেয়, তাদের স্মরণে নির্মিত হোক ভাতের ভাস্কর্য আর শপিংমল ছেয়ে যাক আবর্জনার স্তুপে।



রুঢ় বাস্তবতার চিত্র হতে উৎসারিত ক্ষমাহীন চোখ  মুক্তির নেশায় টলমলে। 

হায়, রাতভর বন্টনের পরও থেকে গেলো ঝুড়ি বোঝাই হৃদয়ের টুকরো । 

কবি হারিয়ে ফেলেন নিজেকে। হৃদয় ভাঙার ব্যথা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালে, দেখে অন্য কেউ।

কবি কে?

কবির অন্তরে ভেতরে, তারও গভীরে বোধমূলে প্রশ্ন করে কোনো উত্তর মেলে নি। তাই নিরন্তর খুঁজে চলেছেন। নিয়েছেন কবিতার আশ্রয়।

কবিতা, আমার দহনলিপি, লিপিবদ্ধ করো দেখি দিবস ও রাতের শ্বাসগুলি, দীর্ঘশ্বাসগুলি। 

তিন.
নির্ঘুম আর আলোকিত রাতগুলোর বিপরীতে একটা দীর্ঘ রাত আমরা পেতেই পারি দীর্ঘতর, মহাকাব্যিক দুঃস্বপ্নের জন্য, দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানের জন্য। রাতের পরিধি তবে বেড়ে যাক চিরস্থায়ী বাগানের মতো, দুঃস্বপ্নের।


সারারাত জেগে থাকলেও আয়না বোবা তাই কবি কথা বলার স্বপ্ন দেখেন। এতোগুলো মানুষ শব্দের আড়ালে খুঁজে চলেন মানুষের দিকে ঘুমহীন চোখে। এটা কি হতে পারে দুঃস্বপ্ন? যার চিরস্থায়ী বাগানে ফুটে আছে রাতফুল। অন্ধকার। দীর্ঘতম কোরাসে লিপিবদ্ধ মানুষের মানুষ হওয়ার ইতিহাস।

মওদুদ নামে বেঁচে আছি জীবিতদের কাছে আর মৃতদের কাছে আছি মরে 


কবি আহমেদ মওদুদ।  ১৯৮১ সালের১৫ এপ্রিল তারিখে, রংপুরে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন। পেয়েছেন শব্দের পেয়ালা ভরা মাটির গ্লাস, পান করেছেন দর্শনের মদ। তাই চাষ করতে চেয়েছেন কবিতার মাঠ। মাটির পাহারাদার হয়ে।

চার.
কবিকে প্রশ্ন করুন। কবি পবিত্র চিত্তে সরলীকরণ শেষ হলে জানবেন তিনি প্রকৃতির পবিত্র দেব। তার ভেতরে জন্মগ্রহন করেছে তুলনীয় বিশ্বস্ততা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন,

মানুষের পায়ের নীচে কুকুর হয়ে বসে থাকি, তার ভেতরের কুকুরটা দেখবো বলে।

 এখানে কবি মওদুদ বলেন,

যদি কেউ আমায় বলো, কুকুরের মতো শরীর তোমার, অপবিত্র। আমি বলব, আমার মনটাও কুকুরের মতোই। বিশ্বস্ত আর পবিত্র।


প্রাণ>প্রকৃতি >পৃথিবী সাজানো হলে প্রাণী পবিত্র, সেখানে অপবিত্রতার কোনো স্থান নেই। যদি আপনার হৃদয় কবির মতো পবিত্র ও বিশ্বস্ত হয়।
 
পাঁচ.
অতীতের প্রেক্ষাপটে ঐতিহাসিক ছবি বানিয়েছেন পরিচালক মহোদয়। খ্যাতিমান হচ্ছেন আর পুরস্কার নিচ্ছেন বর্তমানের স্বৈরশাসকের হাত থেকে। বর্তমান নিয়ে চলচিত্র হয় না। ছলচিত্র তৈরি হয় অনেক।


খ্যাতির শঙ্খ চূড়ায় আরোহণের জন্য বেহায়াপনা হারহামেশায় লক্ষনীয়। কিন্তু কবির এখানে বিষাদ অভিযোগ। খ্যাতির দিকে মন নয়, বরং নিজের শিল্পের দিকে মনোযোগী হও। শিল্পের প্রতি রয়েছে একছত্র দায়বদ্ধতা।

ছয়.

প্রতিষ্ঠান তার কাঠামোবদ্ধতার ভেতরে গ্রাস করে মেধা, শ্রম। কিন্তু প্রতিষ্ঠান থেকে পালিয়ে নিজেই প্রতিষ্ঠান হওয়ার ব্যাপারটা কবির ভাষায় ওঠে এসেছে।

মূর্খরা স্কুলে ভর্তি হয় জ্ঞানীরা স্কুল থেকে পালিয়ে যায়। আমরা পালাতে গিয়ে বন্দী হলাম।


সাত.
কাউকে খুন করতে চাইলে তাকে ভুলে যাওয়াই যথেষ্ট। অন্তর্জাল না বুনলে অন্তর্জ্বালা বাড়ে না কখনো।

কাউকে ভুলে যাওয়া মানেই নিজের সঙ্গী হওয়া। নিজের সঙ্গী হলে বাড়ে অন্তর্জালা। যেখানে পুড়ে যায় মনের নগর অথবা সবুজ বনানীতে ভরে যায় হৃদয়ের মাঠ। দ্বিধা থেকে বেরিয়ে পড়ে খরগোশের পান্ডুলিপি। যেখানে লেখা থাকবে আহমেদ মওদুদ চিরস্থায়ী বাগানে বসে একা বুনে যাচ্ছেন সময়ের খন্ডচিত্র।

-+-+-+-+-+-+-
দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানে
আহমেদ মওদুদ

প্রচ্ছদ : চারু পিন্টু
প্রকাশক : ঘাসফুৃল
মূল্য : ১২০৳

মতামত:_

1 মন্তব্যসমূহ

  1. সুন্দর কথা "কাউকে খুন করতে চাইলে তাকে ভুলে যাওয়াই যথেষ্ট। "

    উত্তরমুছুন

মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম