নাসরীন মুস্তাফার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘এক্সপেরিমেন্ট’ : নারীর বর্তমান ভবিষ্যৎ , জীবন সন্তাপ, সামাজিক অবস্থান, নারীবাদী অনুভব, চেতনা...

নাসরীন মুস্তাফার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ‘এক্সপেরিমেন্ট’

খান আলাউদ্দিন

জীবজগত সাধারণত নারী ও পুরুষ এই দুই প্রজাতিতে বিভক্ত। এরা একে অপররে প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে এবং যৌন প্রজননের মাধ্যমে পূর্বসূরীদের জেনেটিক উপাদান উত্তরসূরীদের মাঝে প্রবাহিত হয়। তবে বিপরীত লিঙ্গের মধ্যেই যে শুধু যৌনতার সম্পর্ক স্থাপিত হয় তা নয়। এক্সপেরিমেন্ট সায়েন্স ফিকশনে ড.করিম নায়েরনিয়ার টিমের অন্যতম রিসার্স ফেলো হ্যারি মুর, উভকামী। রেহমানের বন্ধু আফতাব, সমকামী। ফলে সে সোহার যৌন মিলনের আবেদন হেসে উড়িয়ে দেয়। মোটকথা, বইটিতে যৌনতার বৈচিত্র অনুসন্ধান করা হয়েছে। এবং অযৌন জননপ্রক্রিয়ায় অর্থ্যাৎ পুরুষের ভূমিকা ছাড়াই নারীর সন্তান জন্মদানের বিষয়টি তুলে এনেছেন লেখক। যেহেতু বোনম্যারো সেলকে স্পার্মে পরিণত করা সম্ভব তাই একনারী উৎপাদন করবে স্পার্ম এবং অন্যজন ডিম্ব। অর্থাৎ দুই নারীই সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবে এবং স্পার্ম উৎপন্নকারী নারীই হবে সন্তানের পিতা। বাস্তবিক বোনম্যারো সেলকে স্টেমসেল ও স্টেমসেলকে (স্টেমসেলকে যেকোনো সেলেই পরিণত করা সম্ভব) স্পার্মে পরিণত করার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, ঘটনা নিয়েই এক্সপেরিমেন্টের কাহিনী। এক্সপেরিমেন্টের বিষয়বৈচিত্র ঘটনা পরম্পরায় যেন রে ব্রেডবেরির কথার আভাস পাওয়া যায়,

বিজ্ঞান ভিত্তিক যুক্তি ব্যবহার করে সায়েন্স ফিকশন লেখকরা আসলে বোঝার চেষ্টা করে বিজ্ঞান কিভাবে কোন পথে জীবনকে প্রভাবিত করবে,নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে একটি ঘটনা কোনদিকে মোড় নিতে পারে।


বোনম্যারো সেলকে স্পার্মে পরিনত করার আন্তর্জাতিক ঘটনাটি আরিফের মতো স্পার্ম উৎপাদনে অক্ষম পুরুষদের বাবা হবার পথ সুগম করলেও নারীপুরুষের সম্পর্কে পোড় খাওয়া নারী পুরুষের বীর্য নাও গর্ভে নিতে পারে। যেমনটি করে সোহা। ‘আমি তোমার বাচ্চা নেবনা’ বলে সে তার অবস্থান আরিফের কাছে পরিষ্কার করে তুলে ধরে। তবে পুরুষের ভুমিকা ছাড়া সন্তান জন্মদানের বিষয়টি মানবসমাজে নতুন হলেও কিছু মাছ, সরীসৃপজাতীয় প্রাণীদের মাঝে এ ব্যাপারটি লক্ষ্য করা যায়। কমোডো ড্রাগন পার্থেনোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় নিজে নিজেই সন্তান উৎপাদন করতে পারে।

উপন্যাসের অন্যতম দুই চরিত্র আরিফ ও সোহা। এদের নিয়ে দুয়েকটি কথা না বললেই নয়। আরিফ ,স্পার্ম উৎপাদনে অক্ষম সোহার স্বামী। তাঁর এক্সওয়াই ওয়াই ক্যারিওটাইপ হওয়ার কারণে সে সন্তান উৎপাদনের সমস্ত যোগ্যতা হারিয়েছে। সোহার সাথে বিয়ের আগে দোলা নামের মেয়ের সাথে রিলেশন ছিলো তার। তখন সে পেরেছিলো দোলার ডিম্বানুকে নিষিক্ত করতে। কিন্তু এরকম সম্পর্কে যা হয়, সে দোলাকে পরিত্যাগ করে। অর্থাৎ আরিফ নারীকে ভোগ্যপন্য হিসেবে বিবেচনা করে। আরিফ ও সোহার দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতির জন্য আরিফের ভালোবাসার অক্ষমতাই দায়ী। ‘আরিফের সন্তান উৎপাদনের অক্ষমতা নয় , আরিফের ভালো বাসার অক্ষমতা সোহাকে মৃত বানিয়েছে।’ তাই সে জামির বন্ধুর একাউন্টিং ফার্মে ম্যানেজার হিসেবে জয়েন করে।
 
একসময় ব্যাঙের ক্লোন অর্থ্যাৎ ব্যাঙের ক্রোমোজোম ব্যবহার করে হুবহু আরেকটি ব্যাঙ উৎপাদন করা হতো। এরপর ব্যাঙ, ঘোড়া, বানর, ইদুঁর ইত্যাদির ক্লোন তৈরি করা হয়। এরূপ কোনো জীবকে ক্লোনিং করা প্রজনন ক্লোনিং নামে পরিচিত। তবে সব লোক যে আইনের অনুশাসন মেনে চলবে তা নয়। আর লোকটি যদি হয় জোসেফ মেঙ্গেল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের গড়ে তোলা অসউইজ বন্দিশিবিরের প্রধান, Angel of death, তবে তো কোনো কথাই নেই। এক্সপেরিমেন্ট সায়েন্স ফিকশনে জোসেফ মেঙ্গেল হাজির হয়েছে একশো বছরের উপর বয়সী একজন জীবন্ত মানুষরূপে। তার ক্লোন করা গাদাগাদা জোসেফ মেঙ্গেল গোপনে কাজ করে যাচ্ছে হিউম্যান জেনোম প্রজেক্ট ,হিউম্যান ক্লোনিং আর ষ্টেমসেল তৈরি করা নিয়ে। শুধু তাই নয় তারা জেনেট্যিালি মডিফাইড বা জিন স্থানান্তর অর্থ্যাৎ একটি প্রাণির কোনো জিন অন্য প্রানীর জীবকোষে ঢুকিয়ে জন্ম দিচ্ছে অভাবিত নতুন সব প্রাণীর । নারীর ডিম্ব আর স্পার্ম থেকে তৈরি করা ভ্রুণে ইচ্ছেমতো জেনেটিক পরিবর্তন এনে তৈরি করেছে হাতিমানুষ। জোসেফ মেঙ্গেল নামে এই মাফিয়া ডনের খপ্পরেই পড়ে যায় আশফাক রায়হান, আকাঙ্খা ফার্টেলিটি সেন্টারের ডাক্তার, সহপ্রতিষ্ঠাতা। জোর করে তাকে দিয়ে বোনম্যারো থেকে আদিম স্টেমসেল তৈরি করে নেয়া হয়। স্টেমসেলগুলো নারী প্রজনন খামারে নারী তৈরিতে ব্যবহার করা হতে পারে। অর্থ্যাৎ নারীশরীরের মতো নারী গর্ভকেও তাদের অসম্মতিতে বাণিজ্যিক কাজে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ঊনচল্লিশ বছরের আশফাক ঊনিশ বছরের ছোরার মতো লরার প্রেমে ক্রাশড। অথচ লরার কাছ থেকে সাড়া মেলে না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে লরা আশফাককে ভালোবেসে মরতে বসেছিলো। তখন আশফাক লরার প্রেম ভালোবাসা উপেক্ষা করে। তবে বইটি হ্যাপি এন্ডিং। গল্পের শেষে লরা আশফাক বিয়ে করে। ওদের সন্তান প্রচলিত নিয়মেই অর্থ্যাৎ মডিফিকেশন ছাড়া বড় হতে থাকে সোহার গর্ভে । ওদিকে আরিফ খুঁজে বেড়ায় দোলাকে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য ।

অবশেষে, নারীর সুখ দু:খ ,ঘর সংসার চাওয়া পাওয়া নিয়ে অর্থ্যাৎ নারীকেন্দ্রিক নারীবাদী সায়েন্স ফিকশন সম্ভবত এই একটিই বাংলা ভাষায় রচনা করা হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই বাংলা সাই ফাই সাহিত্যে এটি একটি অনন্য সংযোজন এবং এর জন্যই নাসরীন মুস্তাফা অমর হয়ে থাকবেন।

বইয়ের নাম: এক্সপেরিমেন্ট
লেখকের নাম: নাসরীন মুস্তাফা
প্রকাশনী: বাংলা প্রকাশ
মূল্য: ২০০ টাকা
ISBN: 9789844290150
 

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ