আমি সাধারণত কোনো গল্পগ্রন্থ একটানা পড়ে শেষ করে ফেলি না। সাধারণত সময় নিয়ে একটা একটা করে পড়ি। কারণ প্রথমত, আমি ফিকশন পড়ি একটা ভাল মানের প্রবন্ধের বইয়ের অভাববোধ থেকে।
উপন্যাসে যেমন নতুন একটা গল্প থাকে, আবার একটা ছোটগল্পতেও একটা পূর্ণাঙ্গ গল্পই থাকে। অভাবপূরণ হয়ে গেলে আর করবার কিছু থাকে না তাই সময় নিয়ে পড়ি। দ্বিতীয়ত, টানা পড়ে ফেললে আর গল্পগুলোকে নিয়ে আলাদা চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ থাকে না, সব একসাথে মাথার মধ্যে ঢুকে পড়ে, কোনো এক ফাঁকে সন গল্পের পাখি একসাথে ফাঁকি দিয়ে মাথা থেকে পুরোপুরি হাওয়া হয়ে যায়। নতুন করে আর কোন বই পড়া শুরু করতে পারিনা। কিন্তু 'লকডাউন' বইটা একটানা পড়ে ফেললাম। কারণ এটা সমকালীন ঘটনাপ্রবাহ, আঞ্চলিক শব্দমালা ও পরিচিত স্থানের বর্ণনার সুখ অনুভুতির লোভে লোভে টানা পড়ে ফেলেছি। পড়া শেষ। পরিতৃপ্তি হচ্ছে। কিন্তু সেই সমস্যা, সব একসাথে মাথার ভিতর ঢুকে জট পাকিয়ে গেছে। লকডাউন পড়ে লক হয়ে গেছি, তাই রিভিউ লেখাটা অনেকটা কঠিন কাজ হয়ে গেছে।
সমকালীন সময়ে জনপ্রিয় এবং অতি নতুন জনআগ্রহপ্রিয় শব্দ লকডাউন। আর লকডাউনের মহত্ত্ব আমরা প্রায় সকলেই জানি। গল্পকার আব্দুল খালেক ফারুক সেই জনআগ্রহকে বিবেচনায় রেখে রচনা করলেন গল্পগ্রন্থ 'লকডাউন'। জনআগ্রহ বিবেচনায় রেখে শব্দটা বলবার ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। মার্কেটিং। জাতি হিসাবেই আমরা সাহিত্য পাঠ বিমুখ। বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সাথে যেমন আনন্দের যোগ নাই, তেমনি একাডেমিক পাঠসূচীর খতম অন্তর বই নামক বস্তুর প্রতি অবহেলার অন্ত নাই। এমতাবস্থায় কাউকে কোন বিষয়ে আগ্রহী করে তোলবার জন্য সমকালীন ও আলোচিত বিষয়ভিত্তিক নামকরণ করলে মার্কেটিং ভাল হয়। কারণ আমরা বংশ পরস্পরায় হুযুগে মাতাল জাতি। যাই হোক, গল্পকার আব্দুল খালেক ফারুকের কল্পনার মিশেলে বাস্তব ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা এবং সমকালীন করোনার সময়ের আমুদে বাঙ্গালির নাটকীয় চোর পুলিশ খেলবার যে মাঠ তার খেলাঘর হিসাবে রঙ্গ ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে রচিত গল্পগ্রন্থ 'লকডাউন'।
আপনার আমার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা, চেনাজানা নাম, চরিত্র, চেনা পরিবেশ এবং সমকালীন জীবন ব্যবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে লকডাউন গল্পগ্রন্থে। প্রতিটি গল্পের পটভূমি লেখক এমন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা পাঠকমাত্র মনে হবে এটা আমার গ্রামের ঘটনা কিংবা আমার সাথে ঘটে যাওয়া বিষয়। প্রত্যেক কবি সাহিত্যিকের নিজ অঞ্চলের ভাষা, স্থান ও ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা তাঁর অজান্তেই সাহিত্যকর্মে ফুটে ওঠে। সেদিক থেকে 'লকডাউন' গল্পগ্রন্থ পড়ে মনে হলো লেখক আব্দুল খালেক ফারুক খুব সচেতন ভাবেই তাঁর নিজ অঞ্চলের স্থানের নাম, রংপুর অঞ্চলের রাজবংশী ভাষার ব্যবহার টেনে এনেছেন বইটির প্রতিটি গল্পে। প্রচ্ছদে আড়াআড়ি প্রস্থে টাঙ্গানো শিকলে ঝুলছে কালো হরফের কয়েকটি বর্ণ 'লকডাউন' তার নিচেই প্রতীকী অর্থে পুলিশ বাহাদুরের লাঠি হাতে উঁচু করে আমজনতার প্রতিনিধি জোড়হাত করে হাঁটু গেড়ে মিনতির দৃশ্যপটে প্রহারের বার্তাবাহন বইটির লকডাউন নামের সাথে কাজের প্রমাণের তাৎপর্যকে দ্বিগুণ করেছে। মোট ছয়টি গল্পের প্রথম গল্পটি বইয়ের নামগল্প লকডাউন। ব্যঙ্গ ও রম্যতার ছলাকৌশলে লেখক করোনাকালীন যাপিত জীবন এবং তথাকথিত লকডাউন বনাম পুলিশ জনতার চোর-পুলিশ খেলার দৃশ্যপট ফুটে ওঠে সুন্দরভাবে। এগল্পে লেখক সমাজের নানান অসংগতি তুলে ধরার পাশাপাশি বাস্তব সমাজচিত্র শিল্পকর্মের মাধ্যমে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। এখানে গল্প পড়ে মনে হয়েছে যে সেই গল্পতে একটিও অপ্রয়োজনীয় শব্দ নেই। একটি শব্দ তো দূরের কথা, এক একটা দাঁড়ি-কমাও প্রয়োজন ছাড়া দেননি।
লকডাউন গল্পের নায়ক মজনু মিয়া। পেশায় মোটর শ্রমিকের প্রতিনিধি। করোনার কারণে তার পেশা বন্ধ, আয় নাই। সারাদিন বাসায় বসে থাকেন। মাঝে মাঝে লকডাউন দেখতে বাইরে বের হন। এই জায়গায় মজনু মিয়া আমজনতার প্রতিনিধি। যারা অতি উৎসাহী হয়ে লকডাউন দেখতে যায়। আবার অন্য দিকে মজনু মিয়া মোটর শ্রমিকের প্রতিনিধি হওয়ায় রাস্তা ঘাটে পুলিশ বনাম পরিবহন মালিক শ্রমিকের যে সখ্যতা তার চিত্রও ফুটে উঠে লকডাউন গল্পে মজনুর বক্তব্যে- এসব পুলিশ সউগ হামার পরিচিত।
পুলিশ ক আর ম্যাজিস্ট্রেট ক মটর ডিপার্টমেন্টের লোকক সগাই ভয় করে, বুঝলু?
কথাটি দ্বারা মজনু শুধু তার স্ত্রীর কাছে নিজের ক্ষমতা জাহির করেনি, মজনু সমকালীন সমাজের বাস্তব চিত্র বর্ণনা করেছেন। তার বক্তব্যে সমাজের একটি অসংগতির স্পষ্ট ছাপ লক্ষ করা যায়। অতঃপর মজনু বেড়িয়ে পরেন লকডাউন দেখতে, রাস্তায় অভাবী কর্মহীন মানুষের জমায়েত, সরকারের ১০ টাকা কেজি চাউলের প্রহসন এবং লকডাউন লকডাউন খেলায় জন ভোগান্তির চিত্র ফুটে ওঠে গল্পকারের লকডাউন গল্পে। একদিকে লকডাউন অন্যদিকে বাজারের পাশে ছোট চায়ের দোকানে সাধারণ মানুষের করোনা তোয়াক্কা না করেই চলে আড্ডা। কেউ দোকানের একটি ঝাপি বন্ধ রেখে কেউবা প্রকাশ্যেই খোলা রাখে দোকানপাট। অবশ্য মাঝে মাঝে অতর্কিত পুলিশ হামলা চালায় সেই সব দোকানে। সেরকম একটি চায়ের দোকানের আড্ডার মধ্যে হঠাৎ পুলিশের হামলার ফলে গল্পের নায়ক মজনু মিয়া আহত হয়ে ভ্যান গাড়িতে করে যখন বাড়ি পৌঁছায়, তখন টানটান উত্তোজনার মাঝে গল্পের সমাপ্তি ঘটে। আনন্দ বিহবল হয়ে যখন হাততালি দিতে যাবো তখন দৃষ্টি যায় দ্বিতীয় গল্পের দিকে। চমকে উঠে, থমকে যাই।
দ্বিতীয় গল্পের নাম 'করোনা পজেটিভ'। চলমান দূর্বিষহ দিনগুলোর কথা ভেবে হতাশ হই। প্রতিনিয়ত এই করোনা পজেটিভ শব্দটি কেড়ে নিচ্ছে আমাদের কত কাছের প্রিয়জনকে। কতজনকে স্বার্থপরের কাতারে দাঁড় করালো। টাঙ্গাইলে তো এক বৃদ্ধা মাকে তার সন্তানেরা বনে ফেলে গেল। সবই নিকষ কালো শব্দ করোনা পজেটিভের কারণেই ঘটেছে। আর গল্পকার সেই করোনা পজেটিভকে গল্পে উপস্থাপন করেছেন! ভয় ভয় করে গল্পের ভিতরে প্রবেশ করি। তারপূর্বে প্রিয় পাঠক, আমি একবার চোখ বন্ধ করে পাঁচ সেকেন্ড দম স্থির করে বসে ছিলাম। তারপর বইটি খুলে পড়া শুরু করেছি। এই গল্পেও লেখক বিচক্ষণ ভাবে আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র, আমাদের লোভ এবং অভাবের মাঝে করোনাকে পুঁজি করবার মানুষিকতার ছক সুন্দরভাবে একটু নিজের মনের রঙ মেখে অঙ্কন করেছেন। গল্পের নায়ক ইয়াকুব আলী। করোনার ভয়ে বাসার বাইরে তেমন বের হননা। সমাজ সচেতন মানুষ। কিন্তু গল্পের শুরুতেই একটি জরুরী কাজে তাকে ডিসি অফিসে যেতে দেখা যায়। তাঁর বন্ধু ডিসি অফিসের জরুরী খাদ্য বিতরণের কাজে নিয়জিত। সরকারী ভাষায় করোনার সম্মুখ যোদ্ধা। কিছুদিন আগেও পিপিই পরিধান করে ফেসবুকে ছবি দিয়েছিল। ইয়াকুব আলী বন্ধুর রুমে যান। অনেকদিন পর বাইরে বেড়িয়েছেন তাই খায়েশ মেটাতে বন্ধুর সাথে বসে গল্পে মেতে ওঠেন। একসময় বন্ধুটি জানায় তার চাকুরী করে কোন টাকা জমানো নাই। সব টাকা ব্যয় হয়ে যায় সংসার চালাতে। বন্ধুটি মনে প্রাণে চায় তার করোনা পজেটিভ হোক। করোনা পজেটিভ সম্মুখ যোদ্ধাদের নাকি সরকার থেকে কয়েক লক্ষ টাকা উপহার দেওয়া হবে। ফলাফল নিজের ফেবারে নেওয়ার জন্য তিনি রংপুর ল্যাবে তার এক আত্নীয়কে বলে রেখেছেন। বিনিময়ে কিছু খরচ করে হলেও তিনি করোনা টেস্টের রিপোর্ট তার পক্ষে নিতে চান। সমাজ বিচক্ষণ গল্পকার আব্দুল খালেক ফারুক যেমন ভাবে এই গল্পে একজন নিম্ন পদস্থ সরকারি চাকুরীজীবি মানুষের অভাবের কথা তুলে ধরেছেন, তেমনি তিনি সমাজের অনিয়মের চিত্রও ফুটিয়ে তুলেছেন। দুই বন্ধু গল্প শেষে বাড়ি ফেরে। কিছুদিন পর গল্পের নায়ক ইয়াকুব আলীর ফোনে একটি কল আসে। ফোন ধরতেই বিপরীত দিক থেকে ভেসে আসে একটি উল্লাসী কন্ঠ। বন্ধু সুখবর আছে। কি সে সুখবর! উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে মন। পরক্ষণে বন্ধুটি জানায় করোনা টেস্টে তার ফলাফল পজেটিভ এসেছে। মানে ফলাফল তার ফেভারে এবং করোনা পজেটিভ হওয়ায় তার মনে কোন দুঃখ নাই।
গল্পকার এভাবেই সমাজের অসংগতির পাশাপাশি আমাদের অভাব ও হীন মননে পরিবর্তন জরুরী কিনা সেটার একটি সুক্ষ্ণ ধাক্কা পাঠকদের জন্য দিয়ে যান করোনা পজেটিভ গল্পে। গল্পটি পড়ে আপনা আপনি দীর্ঘশ্বাস বের হয়েছে। নিজেদের শিক্ষিত ভাববার মননে চপটাঘাত করে দিয়ে লেখক গল্পের সমাপ্তি টানেন। আমরা যাত্রা শুরু করি কুড়িগ্রাম টু ঢাকা।
জ্বি! হ্যাঁ!! কুড়িগ্রাম টু ঢাকা 'লকডাউন' গল্পগ্রন্থের তৃতীয় গল্প। একটি রেল ব্যবস্থাপনার অনিয়ম এবং কুড়িগ্রাম জেলার জন্য রংপুর এক্সপ্রেসের মাত্র কয়েকটি আসন বরাদ্দ দিয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করে কুড়িগ্রাম ও রংপুর দুই কূলে কৃত্রিম টিকিট সংকট দেখানো হয়েছে। এসি বগিতেও অতিরিক্ত বিনা টিকিটের যাত্রী তুলে টাকা নেওয়ার হরহামেশা ঘটনার বর্ণনা রয়েছে কুড়িগ্রাম টু ঢাকা গল্পে। যদিও লেখক যে সময়ে গল্পটি লিখতে পারতেন তার থেকে মাত্র ১১ ঘন্টা বিলম্বে গল্প লেখা শুরু করেছেন। কারণ রাত ৮ টার ট্রেন ১১ ঘন্টা বিলম্ব করে সকালে যাত্রা শুরু করে। কুড়িগ্রামবাসীর জন্য যে সকাল ও রাত আলাদা আলাদা একটি করে পূর্ণাঙ্গ ট্রেন দরকার তা ফুটে ওঠে গল্পটির শুরুর দিকের টিকিট প্রাপ্তির যুদ্ধের বর্ণনায়। লেখকের ভাষায়, স্থানীয় সমাজকর্মীর সহযোগিতায় টিকিট প্রাপ্তিতে ব্যর্থ হয়ে,তাঁর বুদ্ধিতে একটি কামলা নিলাম। কামলা আমার টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়ালো। কিন্তু টিকিট পাওয়া কি এতোই সোজা। কামলা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তি ভোর রাতে ইট বিছিয়ে তাদের লাইন রাখেন। অন্য কেউ টিকিট করতে আসলে দাঁড়াতে হয় পিছনে। ফলে সে টিকিট পায়না। আর অসাধু ব্যক্তিগণ তাদের ক্রয়কৃত টিকিট বিক্রি করেন উচ্চ দামে। স্টেশন পাড়ায় এই ঘটনা সকলের জানা।কেউ কিছু বলার নাই। আমরাও এটা নিয়ে বেশী কথা বলছি না। আমরা কুড়িগ্রাম টু ঢাকা গল্পের ভিতরে প্রবেশ করতে চাই। গল্পকার ভাগ্যবান বটে। এতোকিছুর পরেও তিনি এসি বগিতে একটি আসন পেয়েছেন। কিভাবে পেয়েছেন সেটা আলোচনার বিষয় নয়। কিন্তু ঢেকি স্বর্গে গেলেও যেমন ধান ভানে তেমনি বিচক্ষণ দৃষ্টিভঙ্গির গল্পকার লক্ষ্য করলেন তার পাশের টুলে একটি মেয়ে বসে আছেন। গল্পকার তার বর্ণনা টেনেছেন রেল ভ্রমণের শেষ অবধি। কিন্তু প্রগতিশীল চিন্তার গল্পকারের চিন্তার গভীরতা নিয়ে এখানে পাঠকের মনে খটকা জাগবে। লেখক তার আসনের পাশের টুলে বসা মেয়েটির পরিচয় তুলে ধরেছেন একটু অন্যভাবে। গল্পকার তার নাম দিয়েছেন দস্তানাকন্যা। গল্পকারের বর্ণনায় দস্তানাকন্যার চোখে চশমা, হাতে পায়ে দস্তানা, গায়ে বোরখাবৃত। শরীরের কোন জায়গা নেই যেটায় তার শরীরের কোন চামড়া দেখা যায়। একজন প্রগতিশীল মানুষ হিসাবে গল্পকার তার গল্পে মেয়েটির পরিচয় অন্য ভাবে তুলে ধরতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা সচেতনভাবে একদল লোকের কিয়াবাত শুনবার বাসনায় নেগেটিভ ভাবে পাঠকের সামনে হাজির করেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। এমনকি গল্পকার তাকে মানুষ হিসাবে চিন্তা না করে, একক একটি জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে ভেবে বসেছেন। যা একজন প্রগতিশীল চিন্তার মানুষের নষ্ট চিন্তার ফসল। এমনকি কুড়িগ্রাম টু ঢাকা গল্পের শেষের দিকে দস্তানা পরিহিত একটি কলেজ স্টুডেন্ট আইডি থেকে একটি মেয়ের ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট আসে তখন গল্পকার যাচাই বাচাই না করেই তাকে জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে প্রকট ভাবে ভাবতে শুরু করেন এবং রিকুয়েষ্ট এক্সসেপ্ট না করে ডিলেট করে দেন। যা পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগায়, এইটা গল্পকারের ধর্মনিরপেক্ষতা নাকী বিশেষ ধর্মের প্রতি অবজ্ঞা।?।
প্রশ্নত্তোরে লেখক তার নিজস্ব ভীরু যুক্তি দিয়ে গল্পের যাত্রা সাঙ্গ করেন। কুড়িগ্রাম টু ঢাকা ট্রেন যাত্রা শেষ হওয়ার সাথে সাথে শেষ হয় আমাদের তৃতীয় গল্প।
বইটির চতুর্থ গল্প 'কোবাত আলীর খাঁচা'। করপোরেট দুনিয়ার নষ্টামি, ভন্ডামী ও একজন নারীর কারণে কারখানার দক্ষ, বিনয়ী কর্মীর উপর নির্যাতনের বর্ননা করা হয়েছে গল্পকারের নিজস্ব ভঙ্গিতে। যা পাঠকের কাছে করপোরেট দুনিয়ার হালচালের সন্ধান দিবে।
পঞ্চম গল্প 'মায়াবী জননী' সহ গল্পগ্রন্থটির অন্য একটি আঞ্চলিক কাহিনী নির্ভর গল্প ''ধরলার জলে ডাকাতেরা''। গল্পকার আব্দুল খালেক ফারুক চমৎকার উপস্থাপন ও বর্ণনাশৈলী দিয়ে গল্পটিকে পাঠকপ্রিয় করে তুলেছেন। বর্ণনা করেছেন দূর অতীতে ধরলা নদীর পানিতে ফেলে ডাকাত নিধনের কাহিনী। গল্পকার বর্ণনা করেছেন আশির দশকের জিয়ার সময়ের নির্মম ভাবে পানিতে ফেলে ডাকাত নিধনের কাহিনি।
যদিও পানিতে ডুবিয়ে মারার কাহিনি নির্মম। কিন্তু সে সময়ের প্রয়োজনে সেটা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। গল্পের নায়ক সাদুল্লা মামুদ। এক সময়ের ভিডিপির কমান্ডার ছিলেন। সেসময়ে ডাকাতের উৎপাতে অতিষ্ট হয়ে পরে ফুলবাড়ি, ছিনাই, কাঁঠালবাড়ি এলাকা। থানার ওসি ও চেয়ারম্যান মিলে সিদ্ধান্ত হয় ডাকাত নিধনের। দায়িত্ব পরে ভিডিপি কমান্ডার সাদুল্লা মামুদের উপর। কার্য হাসিল হলে মিলবে পুরস্কার। সাদুল্লা মামুদ ও তার দলবল মিলে রাত দিন খেয়ে না খেয়ে নিজের শরীরের রক্ত মশাকে খাইয়ে ডাকাত নিধন করে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু বিনিময়ে কোন সুযোগ পাননি। এমনকি সরকার থেকেও পাননি কোন ভিজিডি কার্ড। বয়সের ভারে সামনের দিকে হেলে পড়া সাদুল্লা মামুদ জীবিকার জন্য রিক্সার পেডেল মারেন। মাঝে মাঝে রিক্সা থামিয়ে দম নেন আর অতীতের স্মৃতি হাতরে ভাবেন নিজের বিরত্বের কথা। তার সেই সময়ের নিঃস্বার্থভাবে সরকারকে সহযোগিতার কথা। যে ঘটনা কোন একসময় দাদুদের মুখে শিশুদের জন্য কল্প-কাহিনি মনে হতে পারতো আজ সেই গল্পের নায়কের জীবন সংগ্রাম কাহিনি দাদুদের মুখের গল্প হয়ে ফেরে।
লকডাউন গল্পগ্রন্থের কিছু কিছু গল্প পড়ে সুখী হয়েছি, কিছু গল্প পড়ে জিতেছি, আবার কোনো গল্প পড়ে হেরে গেছি, যেমন মায়াবী জননী। কিন্তু লকডাউন গল্পগ্রন্থের সবগুলো গল্প সমান স্ট্রং নয়। তবু আঞ্চলিক গল্পের বিবেচনায় সবগুলোতে পাঁচতারা দেওয়া চলে। তবে লকডাউন গল্পগ্রন্থের বড় সফলতা এই যে, যাঁরা জানেননা গল্পকার আব্দুল খালেক ফারুক একজন প্রতিবাদী প্রগতিশীল কলম সৈনিক, তবুও তাঁরা এই লকডাউন গল্পগ্রন্থের লেখাগুলো পরে অনুভব করতে পারবেন উনি রাজপথের লড়াকু মানুষ।
চমনপ্রকাশ থেকে ফেব্রুয়ারী ২০২১ সালে প্রকাশিত 'লকডাউন' ৬৪ পৃষ্ঠার বইটির মুদ্রিত মূল্য ১৮০ টাকা। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন, আলমগীর জুয়েল। বইটির ISBN নাম্বার ৯৭৮৯৮৪৯৪৬৭৫-৩-৩
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম