বাদল ধারার কবিতার বই ‘শূন্যতার সার্কেল’ নিয়ে একটি বিশ্লেষণাত্মক পর্যালোচনা

বাদল ধারার কবিতার বই ‘শূন্যতার সার্কেল’

খান আলাউদ্দিন

পোষ্টমডার্ণ কালখণ্ডে আমরা মুখোমুখি হচ্ছি ডি.এন.এ ন্যানোবট, বায়োপ্লাষ্টিক, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হেডসেট, কোয়ান্টাম সায়েন্স, সামাজিক রোবট ... নানা কিছুর। এসবের অভিঘাত পড়ছে কবিতায়। ফলে,কবিতায় বিশেষ বৈশিষ্ট্যরূপে প্রকাশ পাচ্ছে কাঠামো বিরোধীতা, রাইজোম্যাটিক চিত্রকল্প, সর্বেশ্বরবাদ, এনট্রপি বা বিশৃঙ্খলা, অস্তিত্বের সংকট- বিশেষ করে এথেষ্টিক এক্সিস্টেনশিয়ালিজম । ঈশ্বর, আত্মা এ সময় মৃত। ফলে বাদল ধারার "শূণ্যতার সার্কেল" কাব্যগ্রন্থের 'জেলিফিশের তরল আকাশ ...’ কবিতার ‘অন্তর আত্মা' শব্দবন্ধ কোনো অলৌকিক আত্মার প্রতিনিধিত্ব করে না।

অন্তর আত্মা~দূর গ্যালাক্সির পাখি হয়ে উড়ে যায়

–নিউরন , নিউরোট্রান্সমিটার , সিন্যাপস আর হোয়াইট-গ্রে ম্যাটারের সম্মিলনেই এই আত্মার সৃষ্টি।

নারী ও প্রকৃতিকে তিনি আলাদা করে দেখেন না বলেই দৃঢ় উচ্চারণ করেন,

আমাকে কেন্দ্র করে সমস্ত প্রকৃতি~ নারী হয়ে উঠে।
 
বিষণ্ন সম্পাদ্য, সন্ধ্যার ষড়যন্ত্র, সাইকি পারফিউম_এই তিন খন্ডে বিভক্ত শূন্যতার সার্কেল বইটি। শূন্যতার কাতরতা , অনন্ত আঁধার , জ্যামিতিক ও গাণিতিক মুগ্ধতা বইটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে। উত্তরাধুনিক এই বইতে আঁধার বিষয়টি এতোবার উচ্চারিত হয়েছে যে তা আমাদের জীবনানন্দের আঁধারের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু কবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখিতভাবে জানিয়েছেন, তাঁর আঁধার জীবনানন্দের আঁধার থেকে আলাদা। কথাটা আংশিক সত্য , পুরোপুরি নয়। জীবনানন্দের বনলতা সেন কবিতার শেষ দুটি চরণ পাঠ করলে মন্তব্যটি আরো স্পষ্ট হবেঃ

'সব পাখি ঘরে আসে –সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন,
থাকে শুধু অন্ধকার , মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।'

উপরোক্ত আঁধার অবশ্যই যৌনতার আঁধার । এবং এই যৌনতার আঁধার শূন্যতার সার্কেলে বার বার ঘুরে ফিরে হাজির হয়েছে। উদাহরণ :

একখন্ড ট্রাইঙ্গে ল আধাঁরে ~আমি মেখে নিচ্ছি জ্যোৎস্না ও রৌদ্র
–ট্রাইঙ্গেল আধাঁর...


চোখ থেকেই যাত্রার শুরু~অথচ আমার সমস্থ পথ ডুবে আছে~ নিষিক্ত আধাঁরে
তবে হাত সাঁতরিয়ে` কার ঘ্রাণ~ কার ঘ্রাণ খুঁজি।
– শূণ্যতার কুন্ডলী...


উৎক্ষিপ্ত আতশবাজির মতো ফেটে যাই নিষিক্ত আঁধার আঁধারে ~
–নাক্ষত্রিক ঘড়ি...


নারীর নিবিড় আঁধারে ~ ডুবে আছে ঘর
–নিস্তব্দতার সুর...


প্রানরসায়ন বারবার ~ জেগে উঠতে চায় ~ কী কারণ ~কী কারণে
নৈশ নৈ:শব্দের সুরে সুরে ~ নিষিক্ত আধাঁর ডুবে আছে~ খনিজ আঁধারে
– প্রাণ রসায়ণ...

 
গন্দম গন্দম আধাঁর
– থার্ড ব্র্যাকেট...


নিষিক্ত আঁধারে ~ বিদ্যুৎ শিকড়~ অস্থির বিন্দুর মতো
উত্তুঙ্গ কামনার~ আগুন রাঙা বৃষ্টি
বিষদাঁতের দাগ~ আমার অধর আঁধারে~
– স্থানচ্যুত...



আঁধারের বিভিন্ন ডাইমেনশন আছে নিশ্চয়। তবে তার কবিতায় আঁধার জীবনের লুকায়িত আঁধার প্রকাশ না করে যৌনতার্থে অধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে। যৌনতা শুধু আঁধারের ছদ্মবেশে তার কবিতায় আগমন করেনি। জ্যামিতিক ক্ষেত্র থেকে তিন বাহু দ্বারা আবদ্ধ ক্ষেত্র বা ত্রিভুজও উড়ে এসে শূন্যতার সার্কেলে সেক্সুয়াল চিত্রকল্প হয়ে উঠেছে।
উদাহরণ:

জ্যামিতি বক্স ব্যর্থ হলে
কুমারীর কাছেই শিখেছিলাম ত্রিভুজের সকল সূত্রাবলী
 –অন্তর বৃত্ত...


সোনালি গমের দানার মতোই~ একটি ~দ্বিখন্ডিত রেখা আমাকেই টানে~ ত্রিভুজের ~অন্তর বৃত্তে টসটসে টলমলে~ স্তন যুগলের ঝলকে~
–থার্ড ব্যাকেট...


বাংলা কবিতায় ত্রিভুজ, আধাঁর, শূন্যতা (জীবনানন্দ ছাড়াও অপরাপর কবিদের কবিতায়) বহুল ব্যবহৃত চিত্রকল্প। অপ্রচলের পথে হাঁটতে গিয়ে প্রচল চিত্রকল্পের ব্যবহার শূন্যতার সার্কেলকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে।

বইটিতে গাণিতিক বিষয় বা পদার্থ ,রসায়ণ... বিষয় বা বিষয়াংশের Deconstruction বা বিনির্মাণের উদাহরণ উল্লেখ করার মতো। যেমন তার 'সোনালি হলুদ →Nacl...' কবিতার দুটি লাইন:

আয়নিক বন্ধন থেকে ~একটি ইলেকট্রন ~ হ্যাক হয়ে গেলে
একজোড়া পাখি~ একা হয়ে যায়~ একটি পাখি ধীরে ধীরে অস্তিত্ব হারায়।


প্রথমেই বলে নেয়া ভালো Nacl/লবন/সোডিয়াম ক্লোরাইড একটি আয়নিক যৌগ। এসিড ও ক্ষারকের বিক্রিয়ায় লবণ উৎপন্ন হয়। বিক্রিয়ায় ক্ষারকের ধাতু এসিডের হাইড্রোজেনের স্থান দখল করে। যেমন: Hcl+NaoH=Nacl+H2o।


আয়নিক বন্ধন ইলেক্ট্রন স্থানান্তরের জন্য দায়ী। সোডিয়াম( Na)ও ক্লোরিনের(Cl)বিক্রিয়ায় সোডিয়াম পরমানু একটি ইলেক্ট্রন বর্জন করে। অন্যদিকে ক্লোরিন পরমানু ওই ইলেক্ট্রন গ্রহন করে। আর এভাবেইNacl/ সোডিয়াম ক্লোরাইড গঠিত হয়।

তার 'জোড় শূন্য '.... কবিতাও একটি বিনির্মিত কবিতা। চলুন আগে কবিতাটি পাঠ করি ,তারপর ব্যাখ্যা করে দেখব কবিতাটি কোন মৌল বিষয়ের উপর ভিত্তি করে রচিত।

বিজোড়ের অভ্যন্তরে ~জোড় জোড় তাড়না~জোড় জোড় তাড়না~ক্রমাগত
নি:সঙ্গ
ক্রমাগত শূন্য পরিধির কেন্দ্রে– অস্তিত্ব গেঁথে যাচ্ছে~ ক্রমাগত অস্তিত্ব ~শূন্য


এবার ’জোড় শূন্য’ কবিতার শানে নুযূল : শূন্য একটি জোড় সংখ্যা। ২ দ্বারা নি:শেষে বিভাজ্য সংখ্যাই জোড় সংখ্যা ।
যেমন : ৮ ÷ ২=৪
১২÷ ২=৬
তেমনি ০÷ ২= ০
অর্থ্যাৎ ০ কে ২ দ্বারা ভাগ করলে ভাগশেষ হয় শূন্য বা কোনো ভাগশেষ থাকে না।
আবার, জোড় +জোড় = জোড়
বিজোড় + বিজোড় =জোড়
বা, ১০ + ৪=১৪
০+০= ০
আবার, ২× ১=২
২×২=৪
২×১৭=৩৪
২× ০=০ অর্থ্যাৎ দুইকে যা দিয়ে গুন দেই তাই জোড় । শূন্যও ২ এর একটি গুণিতক। শূন্যের এই রহস্যময়তাই 'জোড় শূন্য ...' কবিতায় ডুবে গেছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এসব ডিকন্সস্ট্রাকশান কি বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে? আমার তা মনে হয় না। পোয়েট্রি জার্নালিজম নয়। পূর্ববর্তী ধারণা বা বিষয়, বিনির্মিত কবিতার ক্ষেত্রে যাকে আমরা টেক্সট বলি, তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত হবার পর বিশেষ অর্থান্তর ঘটেনি বা নতুন কিছু হয়ে উঠেনি, বর্ণিত হয়েছে মাত্র।

সাইকোলজিতে আবেগকে নানাভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর একটি বিপরীতধর্মী আবেগ। সুখের অপর পিঠে থাকে দুঃখ। ভালোবাসার অপর পিঠে থাকে ঘৃণা। ভালোবাসা ও ঘৃণা একই সাথে মানবমনে ক্রিয়াশীল হয়না। আবেগের এই প্রসঙ্গটিও বাদল ধারার কবিতায় বিনির্মিত হয়েছে।

আমাদের সম্পর্কের ভগ্নাংশের উপরের সংখ্যা যদি
ভালোবাসা
হয়
তাহলে নিচের সংখ্যার
নাম
ঘৃণা।
–{(ভালোবাসা)}÷{ঘৃণা} = ধ্রুবক...


অর্থ্যাৎ ভগ্নাংশ = ৬÷৮ =লব÷হর। এই বিষয়টিই কবিতায় উঠে এসেছে। তবে আমরা কবিতাটির বিনির্মান নিয়ে আলোচনা না করে এর শিরোনামের মাঝে ওত পেতে থাকা বিতর্কের প্রসঙ্গে চলে যাবো। – ধ্রুবক একটি স্থির রাশি বা বাস্তব সংখ্যা । অন্য কোনো মান দ্বারা ধ্রুবকের মান পরিবর্তন হয়না। অপর দিকে ভালোবাসা বা ঘৃণা নামক আবেগীয় অনুভূতির মাত্রা মানুষের মনে উঠা নামা করে থাকে। ফলে ভালোবাসা ÷ ঘৃণা =  ধ্রুবক হওয়া অসম্ভব।
 
অনেক সময় কবিতার শিরোনাম কবিতার অন্তনির্হিত ভাবকে প্রতিনিধিত্ব করে। তবে পোষ্টমডার্ণ কবিতায় একটি বিষয়ের পরিবর্তে একাধিক বিষয়ের অবতারণা ঘটলে মাঝেমধ্যে শিরোনাম আর কবিতাকে শাসন করতে পারেনা। তাও শিরোনাম ও কবিতার মধ্যে দৃষ্টিকটু ব্যবধান সম্পূর্ণ কবিতাকেই প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিতে পারে। যেমনটি ঘটেছে 'নিউক্লিয়ার ফিউশান .…' কবিতায়। নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ায় একাধিক হালকা নিউক্লিয়াস সংযুক্ত হয়ে ভারী নিউক্লিয়াস গঠন করে । ফিউশন সংঘটিত হয় সূর্যে শক্তি উৎপাদনে, হাইড্রোজেন বোমা তৈরীতে। কবিতার শিরোনাম 'নিউক্লিয়ার ফিউশন' হলেও কবিতার শরীর গঠনে নিউক্লিয়ার ফিশন সংঘটিত হয়েছে। ফিউশন ও ফিশন দুটির মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান বিদ্যমান হলেও তা কবির দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।কবিতাটি–

92 এর রাত থেকে ইউ টার্ন নিয়ে~ আমি পৌঁছে গেলাম 235 এ
তীব্র অন্তর ও বহিমুর্খীতার~ দ্বন্দ্ব
এক চোখ থেকে উড়ে যাচ্ছে~ সোডিয়াম ক্লোরাইডের নিবিড়~ নিবিড়তা
আর এক চোখ থেকে~ বের হয়ে আসলো ~বিপুল বিপুল পরিমাণ নিউক্লিয়ার ফিউশান
আকাশ কাঁপিয়ে এক নীল জোকার~ হাসে ~আপেক্ষিক হাসি
তীব্র উন্মাদ মূহুর্তের ~অন্তর থেকে~ বের হয়ে আসছে ~গৌতম
কেডমিয়াম চকলেট~ খেতে খেতে একজোড়া স্থির~ নীল পা~ কিংকর্তব্যবিমূঢ
চোখ জুড়ে ক্রমাগত~ নেমে আসে~ অনন্ত আধাঁর


উপরোল্লিখিত কবিতাটি পাঠে এটাই বুঝা যাচ্ছে যে, এতে ফিশন বিষয় হয়েছে।কেননা, ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা ৯২ বা ইউরেনিয়ামের কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসে অবস্থিত প্রোটন বা নিউক্লিয়ন সংখ্যা ৯২ । ইউরেনিয়ামের তিনটি আইসোটোপ U২৩৪ , U২৩৫ও , U২৩৮। পারমানবিক চুল্লিতে ফিশন বা ভারী পরমাণুর নিউক্লিয়াস বিভক্ত হয়ে সমভরবিশিষ্ট দুটি নিউক্লিয়াস উৎপন্ন করে।বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে ভারী পানি (D2O) , ক্যাডমিয়াম দন্ড , গ্রাফাইট দন্ড ব্যবহার করা হয় । নিউক্লিয়ার ফিশন মানব মনোচুল্লিতেও ঘটে থাকে আর এর তেজস্ক্রিয়তা নিয়ন্ত্রণে কেডমিয়াম চকলেট উপশক হতে পারে। বইটির পরবর্তী সংস্করনে এরূপ ভুল সংশোধন করা হবে বলে আশা করা যায়।
 
’শূন্যতার সার্কেল’ এক নিরন্তর মহাজাগতিক ভ্রমণ। পৃথিবীর স্মৃতি বুকে নিয়ে মহাবিশ্বে ঘুরে বেড়ানো এক পরিব্রাজকের লগবুক। এই ভ্রমণের প্রবেশ পঙক্তি প্রবেশ পথ–
আমার বহুমাত্রিক স্পেইসশিপে~ ক্রমাগত জমে উঠছে~ বিষন্ন রঙ
দীর্ঘ হিম নিদ্রার কোমায়~ আটকে পড়ে আছে~ আমার দেহ’
–পরিব্রাজক ...


সূর্যের নিকটতম নক্ষত্র হলো প্রক্সিমা সেন্টারাই। সূর্য হতে এর দূরত্ব ৪.২ আলোকবর্ষ।  অর্থাৎ আলোর গতিতে সেকেন্ডে ১, ৮৬, ০০০ মাইল বেগে বা ৩,০০,০০০ কিলোমিটার বেগে চললেও আমাদের নিকট নক্ষত্রে পৌঁছাতে সময় লাগবে ৪.২ বছর। আয়ন বা প্লাজমা ইঞ্জিন, সৌরপাল, রামজেট ফিশন যেকোন ধরণের স্পেসশিপে ভ্রমণ করলেও সেখানে পৌঁছাতে মহাকাশচারীদের কয়েক উত্তর প্রজম্মের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। তবে তাদের বাঁচিয়ে রাখার উপায় একটা আছে। তা হলো সাসপেন্ডেড অ্যানিমেশন। অর্থ্যাৎ মহাকাশচারীদের দৈহিক সক্রিয়তা বা তাপমাত্রা এমনভাবে কমিয়ে আনা যাতে তাদের দৈহিক কার্যপ্রণালী থেমে যায়। প্রক্রিয়াটি হাইবারনেট বা শীতনিদ্রা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ কবিও পরিব্রাজক। ইন্দ্রিয় ভ্রমণে সে পৌঁছে যায় দূর নক্ষত্রের গ্রামে, মহাবিশ্ব থেকে মহাবিশ্বে। ৯২ এর রাত থেকে ইউটার্ন নিয়ে -২৩৫ এ। সময় ও স্থান গ্রন্থি ছিঁড়ে ভিন্ন সময়, ভিন্ন স্থানে, পরমাণুর অভ্যন্তর জগতে। ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে যখন তার ঘুম ভাঙ্গে, জাগিয়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন তার মানসিক অনুভূতি –

ক্রমশ এক মহাজাগতিক তাড়না ~ তরঙ্গ ~ ভেঙ্গে চুরে ~অজস্র
অজস্র দেয়াল চেপে আসছে~অজস্র অজস্র দিক থেকে
বাক্সের নেতানো ছায়ায় ~একজোড়া চোখ ~ চোখ মেলে
–ঘুম ঘুম রঙ...


শূন্যতার সার্কেল থেকে আরো কিছু পঙক্তি:

১৮০ডিগ্রির জ্যোৎস্নার পাশে ~ চুপচাপ দাড়িয়ে আছে ব্যক্তিগত ~ একফালি অমাবস্যা


চাঁদের নিজস্ব আলো না থাকলে ও জ্যোৎস্নার সাথে চাঁদ জড়িত। পূর্ণিমার চাঁদ সাধারণত বৃত্তাকৃতি হয় আর একটি বৃত্ত কেন্দ্রে মোট ৩৬০°কোণ উৎপন্ন করে। সে হিসেবে অর্ধবৃত্ত বা অর্ধচাঁদ কেন্দ্রে মোট ১৮০°কোণ উৎপন্ন করে । অর্থ্যাৎ অর্ধ চাঁদের প্রতিফলিত আলোই ১৮০° জ্যোৎস্না ।

পাশে শুঁয়ে আছে ~রিমোট কন্ট্রোল প্রেমিকা
–প্রানরসায়ন

রিমোট কন্ট্রোল প্রেমিকা, সেক্সক্ষম রোবট।

চুলের বাঁকে বাঁকে জমে উঠে ~ জ্যোৎস্নার শীষ ~ সিক্ত সুর ~ মূর্ছনা
–ঘুম ঘুম রঙ...

জ্যোৎস্নার শীষ , পক্ককেশ।

একই ধ্বনির পুনরাবৃত্তি, শব্দের দ্বিরুক্তি বা অনুপ্রাস বা ধ্বনিমাধুর্য তৈরীর প্রয়াস শূন্যতার সার্কেলের লক্ষ্যণীয় বিষয়। এই অনুপ্রাস cosmic microwave radiation এর মতো বার বার শোনা যাচ্ছে। যা অনেক সময় আমাদের ক্লান্ত ক্লান্ত ক্লান্ত করে । যা অনেক সময় বাহুল্যদোষে দুষ্টও হয়ে উঠে। শুধু যে ধ্বনি, শব্দের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে তাই নয় খন্ড বাক্যেরও পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। ধ্বনি, শব্দে ও খন্ডবাক্যের পুনরাবৃত্তির উদাহরণঃ

এক একটি দাগ পবিত্র ~প্রেম ভম্ম~ এক একটি কক্ষ পথ জানে ~ এই চক্র শূণ্য শূণ্য শূণ্যে
গ্রহে গ্রহে ~ উপগ্রহে ~নক্ষত্রের গ্রাম ছাড়িয়ে আরো দূর দূরে ~ আরো এক নক্ষত্রের গ্রামে
অনন্ত অনন্ত আদি অন্তে ~ অনন্তে অনন্তে - এক একটি কক্ষপথ জানে
এই চক্র শূণ্য ~শূণ্য শূণ্যে
–শূন্যতার সার্কেল ...


বিজোড়ের অভ্যান্তরে জোড় জোড় তাড়না ~জোড় জোড় তাড়না
–জোড় শূন্য...


কোনো একটি শব্দের উপর জোড় প্রদানের অভিপ্রায়েও শব্দের বার বার ব্যবহার ঘটেছে বইটিতে। কামিনী রায়ের পরার্থে কবিতায় যেমনঃ

‘বিষাদ বিষাদ বিষাদ বলিয়ে
কেনই কাঁদিবে জীবন ভর?’


বাদল ধারার 'অক্সিজেন প্রাচীর...' কবিতায় –
‘অক্সিজেন অক্সিজেন~ অক্সিজেন বণিক~ অক্সিজেন শূন্য বায়ু~ অক্সিজেন’


শূন্যতার সার্কেলে Oxymoron :

‘একখন্ড ট্রাইঙ্গেল আঁধারে ~ আমি মেখে নিচ্ছি জ্যোৎস্না ও রৌদ্র’
–ট্রাইঙ্গেল আঁধার ...


আঁধার মানেই আলোর অনুপস্থিতি । ট্রাইঙ্গেল আঁধারে জোৎস্না ও রৌদ্র মেখে নিলে আঁধার আর আঁধার থাকবে না।

জোৎস্নাকে আঁধার থেকে আলাদা করতে গিয়ে
–বিমূর্ষ বিমূর্তিতা...


পরিশেষে অক্ষরবৃত্তে রচিত, অজস্র ডট ও পরিব্রাজক চিহ্নের বাহুল্য ব্যবহারে জর্জরিত শূন্যতার সার্কেলের শূন্যতা সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। এই শূন্যতা প্রাচীন গ্রিকদের ভয় করা ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী শূন্যতা নয়। এই শূন্যতা কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে তৈরী হওয়া অজস্র জগতের সম্ভাবনা । 'এক এক জগতের ভেতরে অজস্র জগৎ।‘ এই শূন্যতা ইমোশনাল –'এক ধরনের~ বিষন্ন শূন্যতা~ চারিদিকে নিরন্তর~ শূন্যতার সার্কেল~'। জীবনানন্দের কবিতায় যেমন শূন্যতার আবর্ত–

শূন্যতার থেকে আরো অবিকল শূন্যতার দিকে
আবর্ত ক্রমেই আরো দ্রুত হয়ে আসে।
–ভয় ভুল মৃত্যু গ্লানি সমাচ্ছন্ন পৃথিবীতে


=#=#=#=#= 

শূন্যতার সার্কেল

বাদল ধারা
প্রচ্ছদ: আমান উল্লাহ
প্রথম প্রকাশ: ২০১৭
পুনর্মুদ্রণ: ২০১৯
ঘোড়াউত্রা প্রকাশনী
দাম : ১৩০টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ