আখতারুজ্জামান আজাদ রচিত "লক্ষ্য আমার পক্ষ নেওয়া" বইয়ের রিভিউ : মাজেদ মাহতাব

আখতারুজ্জামান আজাদ রচিত "লক্ষ্য আমার পক্ষ নেওয়া" বইয়ের রিভিউ 'মাজেদ মাহতাব'

ভূমিকা :
'লক্ষ্য আমার পক্ষ নেওয়া' কবি ও কথাকার আখতারুজ্জামান আজাদের (জন্ম ১৯৮৮) এক অসামান্য গদ্যগন্থ। এটি তাঁর প্রকাশিত (প্রথম প্রকাশ ২০১৭) প্রথম দ্বিতীয় বই। এ বইয়ের বিশ্লেষণী সমালোচনায় রয়েছে আখতারুজ্জামান আজাদের লেখার শিল্প-প্রকরণ ও বিষয়বস্তুর বিস্তারিত ব্যবচ্ছেদ এবং তাঁর স্বকীয়মাত্রার সুলুকসন্ধান। ব্যক্তি আজাদের বহুমুখী স্বাতন্ত্র্যিক সৃজনক্ষমতা নিয়ে একটি বিশদ বই লেখা সম্ভব। কিন্তু এখানে আছে কেবল উক্ত বইকেন্দ্রিক তাঁর সৃজনকলার সামূহিক রূপরেখা। সাহিত্যের শিক্ষার্থী ও গবেষক হিসেবে নির্মোহ-নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করেছি তাঁর শিল্পসত্তার স্বরূপ। চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছে লেখকের শিল্পসম্পদ। উদ্ধৃতি সহযোগে পরম যত্নে প্রদর্শিত হয়েছে প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিটি প্রবন্ধের প্রয়োজনীয় ভাষ্য। মোটাদাগে বিশ্লেষিত হয়েছে প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলোর শরীরকাঠামো ও ভেতরকার আত্মার অন্ধিসন্ধি।

সাহসী ও সত্যসন্ধানী উচ্চারণে তাঁর প্রবন্ধে প্রতীয়মান হয় স্পষ্টভাষিতা ও প্রতিবাদী প্রবণতা। বিশেষ করে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের অজস্র উপাদান উঠে এসেছে তাঁর নির্মোহ-নিরাবেগ উপস্থাপনায়-যা ব্যতীত সমসাময়িক বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করা অসম্ভব। বাংলাদেশের বরগুনা ভূমির বিরলপ্রজ এ ব্যক্তিত্ব পুরনো সামাজিক তন্ত্র এবং সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের যাবতীয় যথেচ্ছাচারে লাথি দিয়ে দিয়ে নির্মাণ করে চলছেন গতিশীল গদ্যশিল্প। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, কবি আখতারুজ্জামান আজাদের সবিশেষ শক্তিমত্তার জায়গাটি হলো প্রবন্ধ-যা সাহিত্যাঙ্গনে 'সৃজনশীল প্রবন্ধ' হিসেবে পরিচিত। অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমসহ অন্যান্যরা কবিতার যে আধুনিক সংজ্ঞার কথা বলছেন, তাতে তাঁর গদ্যগল্প ও প্রবন্ধ সমুচ্চয় আসলে একেকটি কবিতা। কবিতার ভাবোচ্ছ্বাসের ব্যঞ্জনায় বর্ণিল ও একাকার হয়ে আছে তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ। এক্ষেত্রে তিনি যেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, হুমায়ুন আজাদ, আবু হাসান শাহরিয়ার প্রমুখের উত্তরসূরি। আবার মননশীলতার ধারায় বাঙালি মন-মানসের রূপান্বেষণে আহমদ শরীফ, আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ যে কাজ করে গেছেন; তাঁর হাতে সে ধারাটিই পূর্ণতা পাচ্ছে বলে আমার ধারণা।

আখতারুজ্জামান আজাদ, যাকে বলতে চাই "বাংলার ব্যঙ্গবিদ"; কী কবিতা, কী প্রবন্ধ সর্বত্রই ব্যঙ্গকে বিশেষ করে তুলেছেন। তৈরী করেছেন বিদ্রূপের ভাষার এক অমোচনীয় আর্কেটাইপ। শিল্প-শানিত ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করে তিনি ক্ষত-বিক্ষত ও ছিন্নভিন্ন করেন প্রতিক্রিয়াশীলদের পুচ্ছ। হুমায়ুন আজাদের পর এতটা উচ্চকন্ঠ-উলঙ্গ আক্রমণ আর দেখি না। লেখার জন্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়কেই তিনি বাছাই করেন এবং এগুলোর সুপরিসর স্বরূপসন্ধানে হয়ে ওঠেন সূক্ষ্মদর্শী তাত্ত্বিক। গদ্য রচনায় তিনি যেমন বেদনার বিষাদসিন্ধু, তেমনি আবার হাস্যরসের অফুরন্ত খনি।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা ও ভাষাবোধ সঞ্চারে তিনি সতত সংগ্রামশীল। মধ্যবিত্তীয় বৃত্তাবদ্ধ মন-মানসিকতার রূপাঙ্কন এবং আধুনিক জীবনচেতনার রূপনির্ণয় তাঁর অন্যতম আধেয়। লেখার শৈলী-সংগঠনে দেখি অনুপম অনুপ্রাসের নিপুণ বিন্যাস এবং উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং চিত্রকল্পের আলঙ্কারিক আয়োজন। ভাষা- বুননে মোক্ষম শব্দাস্ত্রের প্রয়োগে পাঠকের চিন্তিত চিত্তও বিমোহিত হয়ে ওঠে। রয়েছে নিজস্ব যৌক্তিক বানানরীতি, ভাষার প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ বিষয়ক সাবধানতা, আছে শব্দের ভাঙ্গাগড়ার ক্লান্তিহীন কর্ম এবং প্রমথ চৌধুরীয় সুভাষণ (ইউফেমিজম)। এছাড়া দেখতে পাই কথায় কিছু অতিরঞ্জন এবং পুনরুক্ত প্রবণতা।

বিষয়-বাস্তবতার বিচিত্র ভুবন :
"লক্ষ্য আমার পক্ষ নেওয়া" গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোকে পুরু দাগে 'আত্মজৈবনিক' ও 'রাজনৈতিক' ধারায় ভাগ করা যায়-যেগুলো ধারণ করে আছে ২০১৪-২০১৬ এই খ্রিস্টীয় কালপর্বের বঙ্গভূখণ্ডের আর্থ-সামাজিক চালচিত্র।  কেন বইয়ের এমন নাম? তিনি কেবল পক্ষ নিয়েই থাকেন? সুবিধাবাদের পক্ষ? মূলত এ নামের মাধ্যমেই তিনি পঙ্গু প্রশ্নওয়ালাদের মুখে ঝাঁটা মেরে জবাব দিয়েছেন। বইটি পড়লেই পাওয়া যায় এর প্রতিটি পৃষ্ঠার পরতে পরতে পড়ে আছে নিরঙ্কুশ নিরপেক্ষতার পক্ষ। মোট ছিয়াত্তরটি প্রবন্ধের পরিসরে সাজানো হয়েছে বইটির আগাপাছতলা।

ক) মধ্যবিত্তমানস :

মূলত নাগরিক মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তের সাংসারিক সীমাবদ্ধতা, সামাজিক বাস্তবতা, মানসিক দীনতা কিংবা চিন্তার অন্তঃসারশূন্যতা বেশকিছু প্রবন্ধে প্রাণ পেয়েছে। কী চমৎকারভাবেই না ভাষারূপ দিয়েছেন মধ্যবিত্ত মানুষের জড়তাকে।-

আমাদের একের পর এক জন্মদিন চলে যায়। পরিবারের কেউ মুখ ফুটে আমাদেরকে 'শুভ জন্মদিন' বলেন না।  (মধ্যবিত্ত পরিবার ও আমাদের মা দিবস)


এ প্রবন্ধের অপরাংশে লেখেন-

আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় আয়োজন আছে, আড়ম্বর নেই; অনানুষ্ঠানিক আবেগ আছে, আবেগের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ নেই।


কতিপয় মগজহীন মধ্যবিত্তের রূপ-স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে "সেলফি তাণ্ডব ও সমকালীন অন্তর্জাল" এবং "অন্তর্জালের ডটকম ও ভেড়া সম্প্রদায়" প্রবন্ধে। সংক্ষোভ থেকে তিনি লেখেন-

ভাদ্রমাসে কুকুর নিধনের চেয়েও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে অন্তর্জালের ভুঁইফোঁড় চটি পত্রিকা দমন (অন্তর্জালের ডটকম ও ভেড়া সম্প্রদায়)।


"ছবির হাটের বাছুর বাহিনী ও ইন্টার পাশ বিপ্লবীরা" এবং "সৌজন্য কপির সুলুকসন্ধান" প্রবন্ধে পাই মেকি মধ্যবিত্তের মুখোশ ও কপটাচারের রূপ-

মুক্তমনার ভেক ধরে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বড় হওয়া যায় না, ঐ ব্যক্তির চেয়ে বড় কিছু করে দেখানোই বড় হওয়ার একমাত্র উপায় (ছবির হাটের বাছুর বাহিনী ও ইন্টার পাশ বিপ্লবীরা)।


গ্রামীণ নিম্নমধ্যবিত্তের আর্থিক অনটনের বিষয়টি বর্ণিত কয়েকটি প্রবন্ধে-

নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বইয়ের চেয়ে প্লেটের প্রয়োজন-আবেদন ঢের বেশি (কবিরা মানুষ না, অন্যকিছু)



খ) স্বাধীনতার চেতনা তৈরীমূলক প্রবন্ধ:
যে মূর্তি ও ভাস্কর্য বিতর্কে বাঙালি আজ বিভক্ত, বহু আগেই তিনি লিখেছেন তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। "শহিদ মিনার-মূর্তি নয়, ভাস্কর্য" প্রবন্ধে তিনি দেখান যে, শহিদমিনার একটি ধর্মনিরপেক্ষ ভাস্কর্য, শ্রদ্ধা দেখাতেই এতে ফুল দেওয়া হয় এবং কেউ এখানে কিছু প্রাপ্তির জন্য পুজো বা মানত করে না। আসল সত্যটি তিনি লেখেন এভাবে-

শেরেক যদি হয়েই থাকে, তা অহরহ হয়ে চলছে বিবিধ পিরের দরগায়। শহিদমিনারে-ভাস্কর্যে হয় নিছকই সংস্কৃতির চর্চা, অপসংস্কৃতির ধারকদের তাই শহিদমিনারকে এত ভয়

বর্তমান বিভ্রান্ত তরুণদের মধ্যে স্বদেশপ্রেম ও স্বাধীনতার ভাবচেতনা তৈরি করতে এ বইয়ে তিনি লিখেছেন "পাকিস্তান সমর্থনের ব্যবচ্ছেদ", "শাহবাগব্যবসা ও এ কালের মজিদেরা",  "পাকপ্রেম উৎপাদনে গণমাধ্যমের ভূমিকা", "বাঁশের কেল্লার গুলিস্তান ও তোপখানা শাখা", "ঊনপঞ্চাশতম অনুচ্ছেদ ও রাজাকারের ঔদ্ধত্য", "শর্তসাপেক্ষ পাকিস্তানবিরোধিতা ও একঝাঁক আসিফ নজরুল", "আওয়ামী মৌলবাদ ও মোশতাকের রেপ্লিকা" প্রভৃতি প্রবন্ধে প্রজন্মকে প্রগতির পথে আনার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ২০১৩ সালের শাহবাগের গণজাগরণ আন্দোলন নিঃসন্দেহে আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা। এ আন্দোলনের একজন সক্রিয় সংগঠক ও কর্মী হিসেবে এর শেষ পরিণতিতে তাঁর কষ্টের কথামালা স্মরণ করা যায়- 

শাহবাগ নামক লেবুটিকে কচলে-কচলে তেতো করে ফেলা হয়েছে, শাহবাগ নামক মৃত নারীটির ওপর চালানো হচ্ছে বহুপাক্ষিক গণধর্ষণ

তিনি কতটা ধুরন্ধর প্রাবন্ধিক তা ফুটে ওঠে "গোলাম আজমের স্বাভাবিক মৃত্যু ও আমার অপরাধবোধ" নামক প্রবন্ধে। তার স্বাভাবিক মৃত্যুতে মর্মাহত হলেও সান্ত্বনা খোঁজেন এহেন বিদ্রূপ-বাণীতে :  

এই প্রবল পরাক্রমশালী বুড়ো বোয়ালটি তার কোনো ইচ্ছেই পূরণ করে মরতে পারেনি

অন্যান্য প্রবন্ধে দেশের জঙ্গি-জলসা, মৌলবাদী মিছিল ও পাকপ্রীতির প্রতি আলো ফেলেন।

গ) যৌন চেতনামূলক প্রবন্ধ :
আখতারুজ্জামান আজাদ বাংলাদেশের বহুলাংশে যৌন অবদমনের রূপ ও শুদ্ধ যৌনচেতনার সন্ধান করেছেন সহশিক্ষা ও অন্যান্য অনুষঙ্গে। বয়োসন্ধি ও সোমত্ত-সময়ের স্বাভাবিক জৈবনিক আচরণ সম্পর্কে সামাজিক চোখের প্রতি তাঁর মন্তব্য বিশেষ তাৎপর্যবহ :

আমাদের জনপদে মেয়েদের ঋতুস্রাব একজাতীয় পাপ, গর্ভবতী হওয়া মানে 'অসুস্থ হওয়া' আর ছেলেদের স্বপ্নপ্রবাহ 'দোষ'। (যৌন অবদমন ও আমাদের সহশিক্ষা)। 

মধ্যবয়সী নারীর যৌনজীবনবাস্তবতা বিচার করেছেন "পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার পোস্টমর্টেম" প্রবন্ধে। 'ধর্মীয় অনুশাসন' যে ধর্ষণ বা মাদ্রাসার মৌলবির বলাৎকারে বাধা দিতে পারেনা সেটি তিনি দেখিয়েছেন। প্রকাশ্যে চুম্বনে পুলিশি পাহারা বিষয়ে বলতে গিয়ে বের হয়ে আসে নিদারুণ অকাট্য কথন-

বজ্র-আঁটুনি ফস্কা-গেরোর এই দেশে খুন-ধর্ষণের জন্য পড়ে আছে গোটা দেশটাই, কিন্তু এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ভেতর এক বর্গইঞ্চি জমিও খালি নেই অবিবাহিতদের একপ্রস্থ আলিঙ্গন বা একদণ্ড চুম্বনের জন্য (প্রকাশ্য চুম্বন ও অবদমিত পুলিশেরা)। 

দিকে দিকে ধর্ষণ-প্রবণ বাংলাদেশের চিত্র এবং পুরুষতান্ত্রিক প্রভাবে ক্ষেত্রবিশেষে নারীরাও যে ধর্ষকের পক্ষাবলম্বন করে সে বিশেষ মাত্রা দেখানো হয়েছে "ধর্ষণ-আমাদের সংসারেরই একটা অংশ" প্রবন্ধে। তাঁর বর্ণনার ভাষায় তৈরী হয় চমৎকার চিত্রকল্প-

চারদিকে ধর্ষনেচ্ছার ধেইধেই প্রলয়নাচন... ...ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়েও কেউ বা ধর্ষণেচ্ছা ব্যক্ত করে ফেলছেন!


ঘ) আধুনিক জীবনচেতনার অনুষঙ্গ :
আধুনিক জীবন-যন্ত্রণা ও টানাপোড়েনের রূপটি দারুণভাবে উঠে এসেছে 'আধুনিক বিয়েবাড়ি' নামক প্রবন্ধে-যাকে তিনি 'অঘোষিত শুটিং হাউজ'ও বলেছেন। এ রচনায় আধুনিক নারীদের সাজ-সজ্জার প্রতি বর্ষিত হয়েছে বিদ্রূপের বাণ। তিনি লেখেন-

অতি সাজের আতিশয্যে চেনাই যায় না কে কনে, কে কনের মা। ... ... এরা একেকজন একেক সেট চলমান অলঙ্কার, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত এদের সাজের অন্ত নেই। 

পঁয়ত্রিশোত্তর বিবাহিত ধনাঢ্য আধুনিকাদের প্রতি বর্ণিত বাস্তবতাকে কেউ কেউ 'বডি শেমিং' হিসেবেও মনে করতে পারেন। আজাদ চিত্রকল্প-সহযোগে লেখেন- 

পঁয়ত্রিশের পর দেহনদীতে অনিবার্যভাবে ভাঙন ধরে, এককালের পাহাড়ী ঊর্ধ্বাঞ্চল পরিণত হয় শাদামাটা সমতল ভূমিতে ('পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার পোস্টমর্টেম')

আধুনিক রাজনীতি-অঙ্গনের বাস্তবতার বয়ান আছে "ত্যাগে নয়, ট্যাগেই প্রকৃত সুখ" নামক লেখায়। তাঁর অকাট্য উক্তি : 

ত্যাগী নেতাদের অবর্তমানে এখন রাজনীতি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ট্যাগী ট্যাগী নেতারা।

 'গ্রীষ্মকাল ও একক হানিমুন' প্রবন্ধেও আধুনিক জীবনভাবনা উপস্থাপিত হয়েছে।

ঙ) দেশীয় দুর্নীতি ও যথেচ্ছাচার :
"ছহি বাঁশবৃত্তান্ত" প্রবন্ধে জানা যায় যে, চুয়াডাঙ্গার প্রকৌশলীরা 'বাঁশকে দিয়েছেন রডের সমমান'। "ছাত্রীহল ও পঁচিশ পয়সার আইন" প্রবন্ধে রয়েছে ছাত্রীহলে সান্ধ্যআইনের সমালোচনা। "ঠাকুরঘর ও একঝাঁক কলাখোর" প্রবন্ধে পুলিশ, পরিচালক (চিত্র) ও অন্যান্য পাণ্ডারা বিরোধিতা ও নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে যে প্রকারান্তরে নিজেদের দুর্বলতাই প্রকাশ করে থাকে তা প্রকাশিত হয়েছে। গোষ্ঠীগত স্বার্থের কাছে সুন্দর স্বপ্নের অপমৃত্যুর দৃশ্যায়ন আছে "শাহবাগ ব্যবসা ও একালের মজিদেরা" নামক প্রবন্ধে। এছাড়া নারী কর্তৃক নারীনির্যাতনের নৃশংসতা বর্ণিত হয়েছে "নারী কর্তৃক নারীনির্যাতন, যে গল্প গণমাধ্যমে আসে না" প্রবন্ধে।

চ) ভাষাভাবনামূলক প্রবন্ধ :

বানানভুল এখন যেন বাঙালির সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারে পরিণত হয়েছে-

এ উক্তি দিয়েই শুরু হয়েছে "ভুল বানানের বাঁদরনাচ" প্রবন্ধ। নামের বানানের ভুলকে বৈধতা দান, বাংলা অ্যাকাডেমির ভুল, কবিদের ভুল বানানের সমালোচনা করে 

দূর হোক ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখার প্রবণতা, বন্ধ হোক ভুল বানানে বাংলা বলাৎকার

-এ আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রবন্ধের পরিসমাপ্তি টানেন। বিদেশি ভাষার শব্দকে অহেতুক বাংলা বানানোর বিরোধিতা দেখা যায় "আনন্দবাজার ও কারওয়ানবাজারের বাংলা" নামক গদ্য-রচনায়। ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষায় তিনি সদা সোচ্চার।

ছ) সাহিত্য সংক্রান্ত সমালোচনা :
সঙ্গত কারণেই সাহিত্য ও সাহিত্যিক সংক্রান্ত বিষয়ও তাঁর আক্রমণের এলাকা। সাহিত্য আসরে প্রবীণ-প্রভাবশালী তথাকথিত কবিদের ভাঁড়ামোর বিপরীতে তরুণ ও করুণ কবির কাব্যক্ষমতার পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে "একটি সাহিত্য-আসরের ব্যবচ্ছেদ" প্রবন্ধে । পাঠ্যপুস্তক ও ফেসবুকে কবি ও গীতিকারদের নামোল্লেখের ন্যূনতম কৃতজ্ঞতাটুকুও যে নেই তারই সমালোচনা রয়েছে বেওয়ারিশ গান-কবিতা ও কৃতঘ্ন বাঙালি" প্রবন্ধে। এক্ষেত্রে ফেসবুককে তিনি "অকৃতজ্ঞদের বৃহত্তম আখড়াবাড়ি" হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কোনও পদক প্রদান করে কাউকে কাউকে হুটহাট তারকা বানানোর পরিণাম যে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে উভয়দিক থেকে অপাঙক্তেয় করে তোলে সে বাস্তবতা আছে "তিন চাকার তারকা ও একজন সাইয়েদ জামিল" প্রবন্ধে। "কবিতা গাছে ধরে না" প্রবন্ধে লিখেছেন একটি উৎকৃষ্ট কবিতার জন্মপ্রক্রিয়ার কষ্টক্লান্তির পথ-পরিক্রমা। তিনি লেখেন-

কবিতার জন্য সময় দরকার, অপরিকল্পিত যৌথ পথচলা দরকার, দরকার অনিয়ন্ত্রিত প্রলয়নৃত্য, অবিভক্ত তপ্ত প্রশ্বাস আর নিঃশর্ত ভ্রমণ

জীবদ্দশায় কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের রাষ্ট্রীয়-সামাজিক অবহেলা-উপেক্ষার পর মরণোত্তর জাতীয় পুরস্কার প্রদানের মতো প্রহসনের সমালোচনা রয়েছে "নির্মলেন্দু গুণের স্বাধীনতা পুরস্কার ও ইঁদুরনাচের ইতিবৃত্ত" নামক প্রবন্ধে।

জ) চলচ্চিত্র সমালোচনা :
'কৃষ্ণপক্ষের কাসুন্দি', 'আয়নাবাজি-একটি অরাজনৈতিক চক্রান্ত', 'চিলড্রেন অব ওআর-বিপর্যয়ের চূড়ান্ত চূড়া", "ফায়ার ও নায়িকাদের খুলখাল্লাম খামখেয়ালি প্রভৃতি প্রবন্ধে রয়েছে সিনেমা-সমালোচনা। সূক্ষ্মদর্শী শিল্পীর সার্থক চোখ দিয়ে তিনি চলচ্চিত্রগুলো দেখেছেন। সেখানে নিখুঁত সিনেমাগুলোকে উপহার দিয়েছেন প্রাণ-চঞ্চল প্রশংসা (যেমন- 'আয়নাবাজি') এবং ব্যর্থ  খুঁতবহুল সিনেমার ভাগ্যে জুটেছে বিষাক্ত বাক্যবাণ (যেমন- 'চিলড্রেন অব ওআর')। এছাড়া বিভিন্ন চলচ্চিত্রে নায়িকাদের খোলামেলা অভিনয়ের সদর্থক সমালোচনা রয়েছে 'ফায়ার ও নায়িকাদের খুলখাল্লাম খামখেয়ালি' নামক লেখায়। 'আয়নাবাজি' চলচ্চিত্রের পরিচালক অমিতাভ চৌধুরীর মুন্সিয়ানার স্বীকৃতি দিতে তিনি 'শকুনের চোখ' বাগধারাটি 'অমিতাভের চোখ' হিসেবে প্রতিস্থাপনযোগ্য বলে মনে করেন- এতে সিনেমাটির শিল্পমান ও বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই হয়।

ঝ) ব্যক্তিগত বিষাদাখ্যান :
'লক্ষ্য আমার পক্ষ নেওয়া' বইয়ের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে প্রাবন্ধিকের ব্যক্তিগত ভুবন-যা পাঠে বেদনায় বুক ভারী হয়ে আসে। প্রবন্ধের ভাগ বিবেচনায় এ নিবন্ধগুলো অত্যন্ত আবেগজর্জর, করুণ-কাতর ও হৃদয়ছোঁয়া। সততার শক্তি না থাকলে ব্যক্তিগত বিষয়কে বইয়ের পাতায় এভাবে স্পষ্ট করা যায় না। পারিবারিক প্রতিকূলতা ও অন্যান্য অনুষঙ্গে সংগ্রামরত কবির উচ্চারণ অত্যন্ত সংবেদনশীল : 

কোনো মা-ও চান না তার গর্ভে কবি নামক কোনো প্রাণী জন্ম নিক (কবিরা মানুষ না, অন্যকিছু)। 

'ছোটবেলার জ্বর, বড়বেলার জ্বর' নিবন্ধে দেখি শৈশবে জ্বরের জন্য সুবিধে পাওয়া আজাদের জ্বরকে মনে হতো "আল্লাহ পাকের এক নান্দনিক নিয়ামত"। কিন্তু বড়বেলার জ্বরে সেই সেবা-শুশ্রূষার খাত আটকে থাকে 'মধ্যবিত্তের মধ্যবৃত্তে'। প্রথম প্রেমিকার সঙ্গে প্রেম-পরিচয় ও বিচ্ছেদের বর্ণনা পাই 'কল্যাণী-আমার প্রথম প্রেমিকা' নিবন্ধে। "বঞ্চনা ও অপ্রাপ্তিই কবিতার কাঁচামাল"- তাঁর এ স্বীকারোক্তিতে বলতে পারি কল্যাণী কবিতা লেখার জন্য কল্যাণ হয়ে এসেছিল। নিজের ভগ্নস্বাস্থ্যের বিবরণ দিয়ে এ বিষয়ে অযাচিত উপদেষ্টাদের যা বলেন তা পড়ে না হেসে পাওয়া যায় না : 

টিভি আঠারো ইঞ্চি হোক বা চব্বিশ ইঞ্চি হোক, রিমোট কিন্তু ছয় ইঞ্চি!

'আমারও একটি প্রোপোজ-কাহিনী আছে' নিবন্ধে প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ার অনন্য অনুভব ভাষারূপ পেয়েছে। তাঁর আবেগের আতিশয্য বোঝা যায় নিম্নোক্ত উক্তিতে : 

ঐ পঞ্চান্ন মিনিটে আমি পঞ্চান্ন কোটিবার খুঁজেছি তুয়ার মুখ

ব্যক্তি লেখকের অনুভব সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনায় সম্মিলিত হতে দেখি "ছোটবেলার বৈশাখ, বড়বেলার বিতণ্ডা" নামক নিবন্ধে। স্তবকে স্তবকে ভিন্নমাত্রিক ভাব-ব্যঞ্জনা নিবন্ধটিকে নিয়ে গেছে কবিতার সীমানায়। একটি বধির বালিকার অন্তর্গত ভাষাকে অন্তরঙ্গ অনুভবে উপস্থাপন করেছেন 'এমন চলা চলতে পারে কজন' নিবন্ধে। তিনি লেখেন এভাবে: 

প্রচণ্ড শব্দমুখর এই পৃথিবীর ওর ভিন্ন একটা পৃথিবী আছে। ওর পৃথিবী নিঝুম, নিঃশব্দ; নীরব

'পুনশ্চ কল্যাণী' নিবন্ধে কল্যাণীর স্মৃতিচিহ্নের সম্ভার পরম যত্নে সংরক্ষণের সংবাদে চিত্তে লাগে অন্যরকম ছোঁয়া: 

পুরো প্যাকেট শেষ হয়ে যাওয়ার পর ক্যান্ডির খোসাগুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতাম আর খোসার ভেতর দীর্ঘশ্বাস জমাতাম। আমার তিরাশি কোটি দীর্ঘশ্বাস ভরা তিরাশিটি খোসা এখনও আছে; এখনও আছে ক্যান্ডির সেই মূল প্যাকেট, আছে ওর হাতে আমার নাম ও ধাম-লেখা খাম


ঞ) সমসাময়িক রাষ্ট্রীয়-রাজনীতি :
আমাদের দুর্বিনীত রাজনৈতিক দূরভিসন্ধির বিরুদ্ধে ক্রমাগত কলজে-কাঁপানো কলাম দেখি এ বইয়ের ভেতর। ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাহীন, আওয়ামি-বিএনপি-জামায়াত প্রত্যেকের প্রতিই তিনি বর্ষণ করেন ক্ষুরধার বাক্যবাণ। এগুলো আজাদের লেখার মূল শক্তিমত্তা ও জনপ্রিয়তার জায়গা। আবার স্পর্শকাতরতার প্রশ্নে এ সাহসী ও সত্যনিষ্ঠ উচ্চারণই বৈরী হয়ে তাঁকে বধ করছে-ভার্চুয়াল ভর্ৎসনা ও মর্মপীড়ায় জর্জরিত করে তুলছে। আজ মুজিবকে নিয়ে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর মিথ্যাচারের মত্ততা বা মুজিব-ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার যে আস্ফালন তার কারণটি আজাদের মুখেই শুনি: 

মৃত মুজিবকে একটি খামচি মারতে পারলে ক্ষণিকের জন্য ইঁদুর ও কুমির হয়ে যায়, বাঁদরও বাঘ হয়ে যায়, চামচিকে হয় হাতি (বঙ্গবন্ধু ও একালের গোয়েবলসগণ)

এছাড়া রাজনীতিসহ অন্যান্য বিষয়াদি বিশ্লেষণে ব্যক্তিনামের রহস্য-উন্মোচন ও পূর্ণনাম অন্বেষণের প্রবণতা দেখা যায় তাঁর প্রবন্ধগুলোতে। "আওয়ামি লিগ নেতাদের খন্দকার বিসর্জন ও অন্ধকার বাংলাদেশ', সালমান শাহর জন্য শোকগাথা ইত্যাদি প্রবন্ধে এর পরিচয়  আছে। প্রচলিত পোশাকি বা সংক্ষিপ্ত নামের অন্তরালে পূর্বের আসল বা পূর্ণনামের কিছু নমুনা দেখাই:


1) এ. কে. খন্দকার- আবদুল করিম খন্দকার (পৃ-54)
2) মান্না (চিত্রনায়ক)- এসএম আসলাম তালুকদার( পৃ-97)
3) আসিফ নজরুল- মো. নজরুল ইসলাম (পৃ 112)
4) ব্রাত্য রাইসু- আবুল খায়ের মো.রইসউদ্দিন ঢালী (পৃ-55)
5) হুমায়ূন আহমেদ- শামসুর রহমান (পৃ-55)

# প্রকরণ-পরিচর্যার প্রাসঙ্গিক প্রাঙ্গণ:

ক) অনুপ্রাস :
বাংলা ভাষায় অনুপ্রাস অলঙ্কার নিয়ে এতটা প্রযত্ন পরিশ্রম সচরাচর দেখা যায় না। প্রায় প্রতিটি বাক্য-বাক্যাংশে ব্যবহৃত হয়েছে অনুপ্রাসের জমকালো ঝঙ্কার। এমনকি বইয়ের বা প্রবন্ধের নামেও প্রযুক্ত হয়েছে সেই পরিচয়। দুয়েকটি দৃষ্টান্ত দেখাই।

  1. আমি আজন্ম জরাগ্রস্ত ও জ্বরগ্রস্ত (ছোটবেলার জ্বর, বড়বেলার জ্বর)
  2. প্রসাধনীর প্রচ্ছদে ঢাকা পড়তে থাকে পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার প্রকৃত প্যারাডক্স (পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার পোস্টমর্টেম)
  3. 'কৃষ্ণপক্ষের কাসুন্দি', 'সালমান শাহর জন্য শোকগাথা', 'সৌজন্য কপির সুলুকসন্ধান', পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার পোস্টমর্টেম' (প্রবন্ধনামে প্রকাশিত অনুপ্রাস)


খ) উপমা :
 কিছু অসামান্য উপমাও তিনি আমদানি করেছেন গদ্যে।
 যেমন-

  1. 'পাঙ্গাশের লাল কানশার মতো বিপ্লবী  লাল কবিতা' (পৃ-178)
  2. শুরুর দিকে এদের ঐক্য থাকে ইঁদুরের দাঁতের মতো ধারালো (পৃ-163)
  3. আওয়ামিলীগের প্রচার সেল নবতিপর বুড়োর মাঢ়ির দাঁতের চেয়েও দুর্বল (পৃ-54)
  4. গরিবের মগজে এই চিন্তাও চিংড়ির মতো লাফাতে থাকে (পৃ-14)


গ) চিত্রকল্প:
কথাসাহিত্যের বাইরেও সাধারণ সাংবাদিকী গদ্যেও তিনি চিত্তাকর্ষক  চিত্রকল্প সৃষ্টি করেছেন। কল্পনার ছবি-চিত্রের পরিচর্যায় (পিকটোরিয়াল ট্রিটমেন্ট) স্পষ্ট করেছেন বিষয়-ভাষ্য।

  1. চুয়াডাঙ্গার ঐ বাঁশ কেটে কুঁচিকুঁচি করে যে ষোলো কোটি পশ্চাৎদেশে চালান করা হয়েছে , ষোলো কোটি পশ্চাৎদেশ তা জানেইই না (পৃ-166)
  2. জ্বলন্ত জোছনার জোয়ারে দিগ্বিদিক সাঁতার কাটতে-কাটতে ভেসে যাবে দুচোখ যেদিকে যায়, সেদিকে। সেই দিন আসবে, কাল অথবা পরশু; ফারাক্কার ফাঁক গলে সেদিন নারী পাবে জল-জোছনার ন্যায্য হিস্যা (পৃ- 80)
  3. আওয়ামি লিগের আস্তিনে মাঝে-মাঝে বাস করে কিছু বিষধর দু-মুখো সাপ। পাজামার পকেটে গোঁজা হাত ওপরে তুললেই এই কালকেউটেরা আওয়ামি লিগের আস্তিন থেকে বেরিয়ে আসে। (পৃ-93)
  4. সমুদ্রসম শাহবাগকে তারা পরিণত করল কচুরিপানাভর্তি হাজা-মজা পুকুরে (পৃ-58)
  5. তারা কবিকে ভেবেছে শৌচাগারের শাওয়ার, কলে চাপ দিলেই যার মুখ থেকে ঝিরঝির করে কবিতা বেরিয়ে পড়বে; তারা কবিকে ভেবেছে এটিএম বুথ, যার পশ্চাৎদেশে কার্ড পাঞ্চ করলেই সম্মুখদেশ দিয়ে গলগল করে কবিতা ঠিকড়ে বেরোবে (পৃ-159)


ঘ) উৎপ্রেক্ষা :

  1. গহনা আর গাম্ভীর্যের গুরুভারে বিয়েবাড়ি যেন এক আশ্চর্য চিড়িয়াখানা (আধুনিক বিয়েবাড়ি)


ঙ) সুভাষণ :
মূলত অনুপ্রাসের প্রতি অতি সচেতনতার ফলেই আজাদের লেখায় তৈরি হয়েছে প্রবাদপ্রতিম প্রচুর সুভাষিত উক্তি-যা গদ্যকে করেছে কাব্যসুষমায় উন্নীত। যেমন-

  1. স্বামী হিসেবে কবি অথর্ব, পুত্র হিসেবে কবি অধম, ভাই হিসেবে কবি অপাঙক্তেয় (কবিরা মানুষ না, অন্যকিছু; পৃ-13)
  2. শাহবাগে গিয়েছিলাম কাদের মোল্লাকে ফাঁসির পাত্র বানাতে, মুক্তিযুদ্ধকে হাসির পাত্র বানাতে নয় (শাহবাগ ব্যবসা ও এ কালের মজিদেরা, শেষ বাক্য)
  3. শৈশব চেনে নিঃশর্ত নন্দন, নির্দলীয় নৃত্য (ছোটবেলার বৈশাখ, বড়বেলার বিতণ্ডা; পৃ-168)
  4. ফেসবুক পোস্টে 'বড় ভাই'কে মেনশন করলেই পদপ্রাপ্তির টেনশন বেনসনের ধোঁয়ার মতো উড়ে যায় (ত্যাগে নয়, ট্যাগেই প্রকৃত সুখ; পৃ-77)
  5. এই অ্যালোপেথিক রাজধানীতে সেই হোমিওপ্যাথিক মফস্বলের আন্তরিকতাও নেই (ছোটবেলার জ্বর, বড়বেলার জ্বর; পৃ-40)


চ) নূতন শব্দ সৃজন :
শব্দকে কায়দা করে কর-কব্জায় নিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন অসংখ্য নিত্য-নতুন শব্দ। নবতর দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করে শব্দসৃজনের এ প্রতিভা প্রশংসাযোগ্য। প্রচলিত পুরনো শব্দের ধ্বনিগত সাম্য বজায় রেখে সংশ্লিষ্ট শব্দের প্রথমাংশ পরিবর্তন করে নতুন শব্দ সৃজন করেছেন। অনেক সময় বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণেও এসব শব্দ তৈরী হয়েছে। বিদ্রূপের ভাষা হিসেবে বানানো হলেও এগুলো বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারকে করছে সমৃদ্ধ। কিছু নমুনা:

  1. বাঁশরুদ্ধ (বাকরুদ্ধ থেকে, পৃ-166)
  2. গু-জব (গুজব থেকে, পৃ-165)
  3. যদিমাতৃক (নদীমাতৃক থেকে,পৃ-112)
  4. পরমাণুশাসন (অণুশাসন থেকে, পৃ-42)
  5. ফোনগ্রাহী (গুণগ্রাহী থেকে,পৃ-25)
  6. ট্যাগী (ত্যাগী থেকে, পৃ-76)
  7. মিথ্যাকার (সত্যিকার থেকে, পৃ-173)
  8. শনির সংকেত (অশনিসংকেত থেকে,পৃ-77)

ছ) ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ভাষা :
'লক্ষ্য আমার পক্ষ নেওয়া' বইটি ভরেই আছে ভয়াবহ বিদ্রূপের বাণ। আজাদ বাংলায় বিদ্রূপের ভাষায় ভিন্নমাত্রা এনেছেন। সাধারণত কোনও কবিতার অনুকরণে যে প্যারোডি হয়, সে প্যারোডি-প্রবণতা থেকে বিদ্রূপের ভাষা এসেছে তাঁর গদ্যে। যেমন, 'যত দোষ, অভ্র ঘোষ' (পৃ-92) কিংবা 'ত্যাগে নয়, ট্যাগেই প্রকৃত সুখ' (বইয়ের একটি নাম-প্রবন্ধ)। আবার সুতীব্র সমালোচনার সূত্রে বিদ্রূপকে ভাষারূপ দিয়েছেন তিনি :

জ) নিজস্ব বানানরীতির প্রয়োগ :
কিছু কিছু শব্দের বানান তিনি নিজস্ব যৌক্তিক ব্যাখ্যানুসারে লিখেন। এই 'স্ব-নির্ধারিত' বানানের ব্যাখ্যা তিনি বইটির প্রথমেই প্রদান করেছেন। তাই বিশ্লেষণে না গিয়ে এ বইয়ের নানা জায়গায় যে শব্দগুলো এসেছে তার একটি তালিকা দিচ্ছি :

অ্যাকাডেমি, আওয়ামি লিগ, ছাত্রলিগ, রাজশাহি, জাহাঙ্গির নগর, ইনজিনিয়ার, শ্রী লঙ্কা, নিউ জিল্যান্ড, জিনিশ,শাদা, মেনু, ইশু, টিশু, ট্রাইবুনাল ইত্যাদি।

ঝ) আখতারুজ্জামান আজাদের কিছু কথায় অত্যুক্তি বা অতিরঞ্জনের ছোঁয়া আছে। পরিস্থিতির তীব্রতা বোঝাতেই তিনি ভাষায় এ অতিশয়োক্তি নয়ন করেন । তাই এটাকে প্রতীকী পরিচর্যা (সিম্বলিক ট্রিটমেন্ট) হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। ধনাঢ্য আত্মীয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ রক্ষায় গরিবের পরিস্থিতি বর্ণনা করছেন তিনি এভাবে :

হাতির বাড়িতে গরিবের পা ফেলতে গিয়ে পায়ে আট মাত্রার কাঁপন ধরে, রক্তচাপ নিম্নচাপে রূপ নেয়, অসহায় কানজোড়া উনুনের ন্যায় উত্তপ্ত হয় (আধুনিক বিয়েবাড়ি,পৃ-14)

ঞ) পুনরুক্ত প্রবণতা :
প্রায়শ পরিহারযোগ্য এ প্রবণতার পরিচয় মেলে আজাদের গদ্যে। আমি একে বলতে চাই 'অনুকরণাশ্রয়ী গদ্যভাষা'। স্মরণযোগ্য যে, পুনরায় বর্ণিত এসকল বাক্য বা বাক্যাংশের রচয়িতা তিনি নিজেই। কখনো কখনো কোনও পুরনো প্রসিদ্ধ প্রবচন বা উক্তির অনুপাতে অনন্য অনুকরণে ঠাট্টার ছলে তিনি এসব বাক্যবন্ধ বানিয়েছেন। কতিপয় প্রমাণ দেখাচ্ছি ।
 
'পঁয়ত্রিশোর্ধ্বার পোস্টমর্টেম' প্রবন্ধে তিনি লেখেন:
"কীটনাশক ও ওষুধপত্র শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন, অস্থির প্রেমিকা ও অসুখী স্ত্রীদেরকে কবিদের নাগালের বাইরে রাখুন" (পৃ-19)। একই কথা হুবহু পাই 'কবিতা গাছে ধরে না' প্রবন্ধের 159 পৃষ্ঠায়। 'কল্যাণী-আমার প্রথম প্রেমিকা' প্রবন্ধের শেষাংশের (পৃ-73)  বক্তব্য (প্রথম প্রেম, প্রথম প্রেমিকা ফিনিক্স পাখির মতো। ... ... বাড়া ভাতে ছাই দেয়) অনেকটা উপন্যাসের "চেতনাপ্রবাহরীতি"র আদলে পুনর্ব্যক্ত হয়েছে 'পুনশ্চ কল্যাণী' প্রবন্ধে (পৃ-185)। এছাড়া এ বইয়ে ব্যবহৃত "দাঁড়িয়ে শোনা যায় না,বসে শোনা যায় না, শুয়ে শোনা যায় না" (পৃ-117) এবং "শ্রম-কিণাঙ্ক কঠিন হাত" (পৃ-10) কথাংশের কথা উল্লেখ করা যায়।


উপসংহার :
'লক্ষ্য আমার পক্ষ নেওয়া' বইয়ের 'কবিতা গাছে ধরে না' নামক প্রবন্ধের পুনশ্চ অংশে তিনি লিখেছেন-
তোষামুদে জন প্রিয় হয় সবার পৃথিবীর পরিহাসে
তোষামোদ নেই রন্ধ্রে আমার-লিখে রেখো ইতিহাসে

আসলেই তাঁর ভাষায় কোনো তোষণ-পোষণ দেখি না। বক্তব্যে তিনি বলিষ্ঠ। তির্যক, নিরপেক্ষ ও নিরেট বক্তব্যে সময়ের সন্তান হিসেবে তিনি পালন করে যাচ্ছেন বিবেকী ভূমিকা। বাজে বইয়ের অহেতুক অত্যাচারে আজ আক্রান্ত আমাদের তরুণ সমাজ। তাঁর লেখা ও জীবনাদর্শের সঙ্গে প্রগতিশীল প্রজন্ম যত যুক্ত হবে, ততই ঋদ্ধ হবে তাদের ভাবনার বলয়।

সাধারণ মানুষের অসাধারণ ভালোবাসাপাওয়া লেখক আখতারুজ্জামান আজাদ। কিন্তু এই ভাবনাহীন বাংলাদেশে তাঁর প্রগতিঋদ্ধ চিন্তাকে কে কীভাবে নিচ্ছে, তাঁর লেখার তীর-তলোয়ার যাকে বিদ্ধ করছে; সে অবচেতন শত্রু হিসেবে ওত পেতে আছে কিনা; তাও এক ভাবনার বিষয়। তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্র ও সমাজ-কাঠামোয় যেখানে ধর্মানুভূতিসহ নানাবিধ বিষয়ে স্পর্শকাতরমানুষের সংখ্যা সীমাহীন; সেখানে স্রোতের বিপরীতে চলা যে কত কষ্টের তা ভুক্তভোগী না হলে বোঝা যায় না। একজন সৎ, সাহসী ও হৃদয়বান লেখকের স্রোতের প্রতিকূলে পরিবেশে দাঁড়িয়ে সংগ্রামের স্বরূপ যদি কেউ দেখতে চায়; আমি আখতারুজ্জামান আজাদকে দেখতে বলব। আমি সেদিনের স্বপ্ন দেখি, যেদিন প্রগতিশীল প্রজন্ম বহুপাক্ষিক বন্ধ্যাত্ব ও অন্ধত্বের অভিশাপ থেকে বের হয়ে প্রাণময় পৃথিবীতে বিনির্মাণ করবে সুখী-সুন্দর বাংলাদেশ।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ