উত্তরবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার কবি-ছড়াকার, কথাসাহিত্যিক মুনিবুল হক বসুনিয়ার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অনন্তের ফেরিওয়ালা'। যেখানে পদ্য এবং গদ্যছন্দের সম্মিলনে ৩৫টি কবিতার মাধ্যমে চিত্রিত হয়েছে সমকালীন বাস্তবতা। কবির ভাষ্যে
লেখাগুলো মূলত সমসাময়িক বিষয়ের উপর পাশাপাশি মানবমনের, মানবজীবনের সেই মূল নিয়ে কথা বলে যে মূল কাঁপিয়ে দেয় জীবনের ভীত অথবা আমাদের নিয়ে যায় হারিয়ে যাওয়া অতীতে, যে অতীত কখনো হাসায় কাঁদায় ভালোবাসায় আমাদের শুদ্ধ হতে সাহায্য করে।
কবির কবিতার লাইনগুলো যেন নিরন্তর হাতুড়ির শব্দ যা সবিস্ময় সৃষ্টির মাধ্যমে পাঠক বিবেককে জাগ্রত করে।
বইটির প্রথম কবিতা 'ও মাঝি'। যেখানে মাঝির সাথে কথপোকথনে কবি তার চিরচেনা গ্রাম থেকে হারিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আর এই প্রস্থানের সাথে সাথে ক্ষণিকের জন্য হলেও কবি ভুলে যেতে চায় যাপিত জীবনের সব হাহাকার। কবি মাঝিকে বলে দেয় তাকে যেন বলা না হয় পেছন ফিরে তাকাবার। কারণ হিসেবে কবি বলেন,
ডাকলে পিছু, ভাঙবে বক্ষ,
মানবে না অশ্রু বাঁধ।
পারবো না আমি ছেড়ে যেতে,
যদিবা ঘুরাই কাঁধ!
পরবর্তী কবিতা "প্রেমিক তুমি?" -যেখানে শরীরকেন্দ্রীক প্রেমকে উল্লেখ করে সেই প্রেমিককে প্রশ্নবানে জর্জরিত করেছেন কবি। অতঃপর বলেছেন,
প্রেমিক তুমি? মন ছুঁয়ে যাও।
শরীর সেতো অন্য কথা।
মনটা ছাড়া ছুঁইলে শরীর,
কোথায় যেন লাগে ব্যাথা!
বইটির তৃতীয় কবিতা 'আর যদি না ফিরি' কবিতায় কবি নিজের মাধ্যমে আমাদের প্রত্যেকের অস্তিত্ব অনুপস্থিত থাকার সময়কার কথা বর্ণনা করেছেন। বর্ণনা শেষে কবি বলেন,
আসলে আমিহীন সব অলীক
আমিই সব, আবার আমিই শূন্য।
একটা বিখ্যাত গান আছে, 'দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা, বন্ধু চিরকাল... রেল লাইন বহে সমান্তরাল...'। 'সেদিন প্রেসক্লাবে' কবিতায় কবি খুব কাছাকাছি গিয়েও হাউজ করতে না পারার আক্ষেপ প্রকাশ করেন। কবি রমনা রেলস্টেশনে গিয়ে দেখেছেন রেললাইনের মিলিত হওয়া। যাতে করে থেমে গেছে তাদের পথচলা কিংবা নদীর দুকূল মিলিত হওয়ার মাধ্যমে থেমে যায় তাদের বহমানতা। যার সাথে কবি তুলনা করেছেন মানবজীবনের। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিকে পাওয়া হয়না জন্যই হয়তো সারাজীবন ভোলা যায় না। প্রকৃতিপ্রেমি কবি 'ভালবাসি' -কবিতায় চারপাশের সবকিছুর প্রেমে পরেছেন। মাঠ, ঘাট, দেশ, মাটি, কবি কিছুই বাদ পরেনি। তারপরেই আক্ষেপ কবিতায় এসে থমকে যেতে হয়। সাম্প্রতিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে তীব্র আক্ষেপ করেই কবি বলেছেন,
আজো কেন শাসক-শোষক,
চলছে গলাগলি?
কেন আজো ডোবায় নালায়
পাচ্ছি মাথার খুলি?
আজো কেন মা-মেয়েতে
ধর্ষিতা হয় দেশে?
কেন আজো তনু-রেণু
পায়না বিচার শেষে?
'অদ্ভুত সময়' কবিতায় ইচ্ছে থাকলেও অনেক কথা বলতে না পারার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
এই জীবনের রঙ্গমঞ্চে অনেকের সাথে পথ চলতে হলেও প্রকৃত অর্থে আমরা প্রত্যেকেই একা। 'একলা' কবিতায় এই বিষয়টিই সুস্পষ্ট হয়েছে। আবার 'মিথ্যুক বাবা' কবিতায় এসে সন্তানকে খুশি করতে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত বাবাদের অভিনয় বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে উপস্থাপিত হয়েছে। 'রাতের আকাশ' কবিতায় ফিরে আসবেনা জেনেও কারোর জন্য মাঝেমাঝে ভীষণ দিশেহারা হয়ে যাবার অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন কবি। 'কৃষ্ণা' কবিতায় কবি ছন্দে ছন্দে আরো একটি নিরেট সত্য উপস্থাপন করে বলেন,
কৃষ্ণা যখন রাধা সাজে
কৃষ্ণ তখন করে লীলা
কৃষ্ণা যখন কৃষ্ণবর্ণা
নিজের কাছে নিজেই জ্বালা
'নিষ্পাপ' কবিতায় কবি শুদ্ধতায় নিজেকে খোঁজার গল্প ব্যক্ত করেছেন। 'সর্বনাশী' কবিতায় কবি বলেন,
একটা সময় তুমি তোমার,
তোমার জীবনজুড়ে
অন্যে দেয়া দুঃখগুলো,
থাকে তোমায় ঘিরে।
এরপরেই 'চুড়ি' কবিতায় কবি চুড়ির খোঁজে নেমে পরেন। তবে প্রিয়ার মন পাবার জন্য নয়। যারা নির্লজ্জের মতো অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার দেখেও প্রতিবাদ করে না তাদের জন্য কাপুরুষের প্রতিক হিসেবে চুড়ির খোঁজে বের হন কবি।
সময়ের বিবর্তনে কতকিছুই আজ হারিয়ে গেছে। উদাসী বাউল, পিদিমের আলো, জোনাকজ্বলা রাত, লাটাই ঘুরি! এসব স্মরণ করেই কবি রচনা করেছেন তার অতীত কবিতাটি। 'চিল' কবিতায় চিলের বেশে কবি মানব জীবনের ব্যর্থ প্রেমের চিত্র রূপায়ণ করেছেন। 'বদল' কবিতায় কবি ছন্দে ছন্দে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জিনিস বদলের গল্প করেছেন। তিনি বলেন,
বদলে যাচ্ছে ডান-বাম আর
সাম্যবাদের মন্ত্র
বদলে যাচ্ছে হেফাজত বা,
মৌলিক গণতন্ত্র।
'রাধিকা' কবিতায় কবি সোশালমিডিয়ার মাধ্যমে সেকালের বিখ্যাত সব প্রেমের বর্তমান কল্পিত অবস্থা অনেকটা হাস্যরসাত্মক ভাবেই উপস্থাপন করেছেন। 'আচ্ছন্ন' কবিতাটি নির্ঘুম ব্যাথাতুর সময়ের বর্ণনা দিয়ে শুরু করলেও স্বপ্নে আচ্ছন্ন সময়ের বর্ণনা দিয়ে ইতি টেনেছেন। মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে সকল অন্যায়, অনাচার দেখেও প্রতিবাদ বিমুখ অর্থাৎ মেরুদণ্ডহীন একদলা মাংসপিণ্ড হয়ে যাওয়ার চালচিত্র 'মাংসপিণ্ড' কবিতাটি। 'ধর্ষিতার আকুতি' কবিতায় কবি যেমন বর্তমান সময়কার ঘটে যাওয়া ঘটনা অর্থাৎ চলন্ত বাসে, পল্লীবধূ কিংবা মা-মেয়ের ধর্ষিতা হওয়ার পরের আকুতি প্রকাশ করেছেন তেমনি ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হবার আহবানও জানিয়েছেন। 'প্রায়শ্চিত্ত' কবিতায় কবি যাপিত জীবনে করে আসা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছেন। সাধু সেজে থাকা সমাজপতিদের চোখে আঙুল দিয়ে কবি বলেন,
নাম দিয়েছিস বেশ্যাপাড়া
কেমনে চলছে তোরা ছাড়া
আমায় তোরা বেশ্যা বলিস
নিজের পাপ যত্নে ঢাকিস।
আর 'নারী' কবিতায় কবি ইতিহাস কিংবা ধর্মীয় উদাহরণ টেনে শেষ আশ্রয় ওই নারীতেই -এই সত্যিই তুলে ধরেছেন। অতঃপর 'বাল্যবন্ধু' থেকে শুরু করে 'একজন কণিকা' পর্যন্ত রচনা গুলোতে কবি অনেকটা মুক্তগদ্যের মত নির্মোহ ভঙ্গিতে চিত্রায়ন করেছেন এই সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া বাস্তবতাগুলি। যা মুহূর্তেই কাঁপিয়ে দেয় পাঠক হৃদয় কিংবা নাড়া দেয় জীবনের ভীত।
পেশাগত জীবনে মনিবুল হক বসুনিয়া একজন স্কুল শিক্ষক। তার কলমে যেমন প্রেম-বিরহের উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটেছে তেমনি সত্যনিষ্ঠ ভাবে উঠে এসেছে এই সমাজের অনেক অসংগতি। গদ্য আর অন্তমিল ছন্দের সমন্বয়ে পাঠককে চোখে আঙুল দিয়ে এই সমাজের প্রকৃত চিত্র দেখাতে গিয়ে কবি মনিবুল হক বসুনিয়া নিজেই হয়েছেন অনন্তের ফেরিওয়ালা। পরিশেষে, কবির এই যাত্রা গতিময় এবং সাফল্যমণ্ডিত হোক। তার বাস্তব ঘনিষ্ঠ রচনাবলী আমাদের সুষ্ঠু সমাজ বিনির্মাণের পাথেয় হোক -এই প্রত্যাশা।
=:=:=:=:=
বই সমাচার:
অনন্তের ফেরিওয়ালা
মুনিবুল হক বসুনিয়া
প্রচ্ছদ: আইয়ুব আল আমিন
প্রকাশক: এম এম খান ও
এম নন্দিনী খান
প্রকাশন: নোলক প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ: অমর একুশে বইমেলা, ২০২১
পৃষ্ঠা: ৬৪
মূদ্রিত মূল্য: ১৮০.০০টাকা
ISBN: 978-984-94758-7-3
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম