উপল বড়ুয়া লিখিত 'ডিনারের জন্য কয়েকটি কাটা আঙুল' গল্পগ্রন্থ প্রসঙ্গে তানজিন তামান্না

উপল বড়ুয়া লিখিত 'ডিনারের জন্য কয়েকটি কাটা আঙুল' গল্পগ্রন্থ

কয়েকটি উপল বড়ুয়া

উপল বড়ুয়া একজন কবি, গল্পলেখক, গদ্যকার ও অনুবাদক। তিনি ১৯ ডিসেম্বর কক্সবাজারের রামুতে জন্মগ্রহন করেন। ২০২০ বইমেলায় উড়কি থেকে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ডিনারের জন্য কয়েকটি কাটা আঙুল’। মোট সাতটি গল্প নিয়ে এই গ্রন্থটি পৃষ্ঠা সংখ্যায় পাতলা হলেও গল্পের কনটেন্ট আমাদেরকে অন্যরকম গল্পের দেশে নিয়ে যায়।

গল্পের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে মনোজগতের বিচিত্র সব লুকায়িত ভাবনা এবং প্রশ্নের আধার। যেসকল প্রশ্নের উন্মুক্ত জিজ্ঞাসা কোন জটিলতা ছাড়াই গল্পের ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সহজ ভঙ্গিমায়। ঘটনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়েও সিরিয়াস বা নন-সিরিয়াস বিন্দুটুকু এমন একটি দ্বন্দ্বের জন্ম দেয় যাকে অনেক সময় পছন্দ না হলেও আঁকড়ে থাকতে ভালো লাগে। গল্প নিজে নিজে এগিয়ে যায় সত্য এবং আরো বেশি সত্য, পাঠককে অধিকতর সক্রিয় করে তোলে। নিস্তেজ পাঠকের আর উপায় থাকেনা, সক্রিয় হতে হতে সে হাঁপিয়ে ওঠে ঠিকই আবার নিজের প্রতি আস্থাও ফিরে পায়।

সোডিয়াম আলো লোকটির সামনের গাড়িতে পড়েছে বেশ সোজাসুজি। আর তার মধ্যে দেখলো এক কাপল নিজেদের জড়িয়ে ধরে যতটুকু পারা যায় ভালবেসে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সে গাড়ির ভেতরে ঢুকে দরজা লগ করলো। আলতো করে তরুণীকে টেনে নিলো বুকে। তারপর সঙ্গীর কানে কানে ফিসফিস করে বললো,

‘মন্ত্রীর অপেক্ষা করে লাভ নেই’।
[গল্প: মন্ত্রীর জন্য অপেক্ষা]


কখনও গ্লামার জগত, আবার কখনও কোন বিখ্যাত মানুষের চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে প্রকাশিত হয় পুঁজিবাদী সমাজের চিন্তা ও চিন্তার অলিগলি। এবং এইসব ঘটনা ও চরিত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে কখনও স্পষ্টভাবে, আবার কখনও ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যে পরিবেশবান্ধব মেসেজও পৌঁছে যায় পাঠকের কাছে।

সাংবাদিক ফিরতি প্রশ্ন করেছিল, ‘কিন্তু আপনার এই পোশাক বানানোর জন্য অনেক পশুকে হত্যা করতে হয়েছে। তা কি আপনি সমর্থন করেন?’

মনিকার উত্তর ছিল এমন,

‘আমি একজন আর্টিস্ট। আর্টিস্টকে প্রচলিত ভাল-মন্দের সংজ্ঞায় বিশ্লেষণ অযৌক্তিক। তার আর্টের জন্য সে যেখান থেকে খুশি উপাদান সংগ্রহ করতে পারে।’
তবুও আমার মাঝেমধ্যে মনিকাকে চলতি চিড়িয়াখানা বলে মনে হয়।
[গল্প: মনিকা দুরান্তে]


বইয়ের গল্পগুলো পাঠকের মনে বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারনার জন্ম দেয়। গল্পের শুরুতেই ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হলেও তা পাঠকের মনে সৃষ্টি করে অনুসন্ধান। এই অনুসন্ধানই পাঠককে পৌঁছে দেয় গল্পের গভীরে। গ্লামার জগতের বিখ্যাত চরিত্রদের পাশাপাশি গল্পে সৃষ্টি করা হয়েছে সাধারন মধ্যবিত্ত চরিত্র। সেইসব চরিত্রদের কেন্দ্র করে মানুষের মনোজগতের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা প্রকাশিত হয়েছে । মনোজগতের প্রকাশের ভেতর সহজাত ভঙ্গিতে উঠে এসেছে কিছু বাস্তব ঘটনার উদাহরন।

পৃথিবীতে সে এমন অনেক ভয়ংকর জ্যামের কথা শুনেছে। ব্রাজিলের সাও পাওলোতে যানজট নৈমিত্তিক ঘটনা। একেকটা জ্যাম ছাড়তে লেগে যায় বেশ কয়েকদিন। তবে তেমন একটা দিন কি আজ তাদের সামনে!
[গল্প: মন্ত্রীর জন্য অপেক্ষা]


মনোজগতের সূক্ষ্ম ভাবনার স্পষ্ট বর্ণনা এবং দৃশ্যকল্পের স্বচ্ছ চিত্রায়ন গল্পের চরিত্রগুলোকে বাস্তবতায় দাঁড় করিয়ে দেয়। পাঠকের মনে হতে পারে চরিত্রগুলো যেন পাঠকের সামনে দাঁড়িয়ে তারই উদ্দেশ্যে কথা বলছে। এবং পাঠক হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলতে পারে তাদের আশ্চর্য সব শরীর— মঞ্চে মনিকা দুরান্তের হেঁটে যাওয়া অথবা জ্যঁ জেনের আঙুলবিহীন হাতটি। আজান আলীও কাশতে কাশতে বাঁকা হয়ে যাওয়া কৈ মাছের মতো শরীর নিয়ে— বাঁ হাতে ধাক্কা দিতে পারে পাঠককে!

সমাজের মধ্যবিত্ত মানুষের নানারকম ক্রাইসিস নয় বরং তাদের মনোজগতের নানা অন্তর্দ্বন্দ্ব উঠে আসে গল্পে— সৃষ্টি হয় ‘আকন সাহেব ও মাবিয়া বানুর’ মতো চরিত্র।  উন্মোচিত হয় ভদ্র মানুষের আড়াল এবং আবিষ্কৃত হয় লোকচক্ষুর অন্তরালে তাদের লুকায়িত ঈর্ষাকাতরতা, হতাশাগ্রস্ত দৃষ্টিভঙ্গি।

এ্যাদ্দিন যারা কেবল দেখেছে পাগলার কারবার অথচ দেখেনি পাগলের যন্ত্রকে তারা বুঝতে পারে এইরকম হয় না সচরাচর। যাদেরটা ছোট তারা হতাশ হয় পাগলের যন্ত্রের সাথে তুলনা করে। কিন্তু মধ্যবিত্ত চোখ চক্ষুলজ্জার নিমিত্তে কোনকিছুতে বেশিক্ষণ আটকে থাকতে পারেনা।
[গল্প: উত্থিত শিশ্নের রাগ]


মানুষের জীবন যাপনের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি উঠে আসে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির ছোট ছোট বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে। আর সেই পুনরাবৃত্তির বাহক হিসেবে গল্পে সৃষ্টি হয় ‘মহাথের’ চরিত্র। যিনি আটকে গেছেন একই নিয়মের চক্রব্যূহে।

ভোর হতেই গতকালকের পুজারিরাই আজ তাঁকে দিতে আসবে ছোঁয়াইং। আগামীকালও তারা আসবে। একই জীবন পালন ও প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকবেন তিনি উপাসকদের। তিনি ক্লান্ত হতে চেয়েও পারবেন না। আগামীকালকের জন্য তাঁকে শরীর টিকিয়ে রাখতে হবে।
[গল্প: মহাথের]


উপলের গল্পে চরিত্ররা কথা বলে। শুধুমাত্র একটি চরিত্রকে কেন্দ্র করেই গল্প এগিয়ে যায়না বরং গল্পের প্রত্যেকটি চরিত্রেরই থাকে স্ব-স্ব অবস্থান এবং ঘটনা। এইসব ছোট ছোট ঘটনার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে গল্প এগিয়ে যায় কাহিনীর মূল জোয়ারে। গল্পের ভেতর প্রতিফলিত হয় উপল বড়ুয়ার নিজস্ব চিন্তা। চিন্তাগুলো ঘটনার জটিলতা এড়িয়ে পাঠককে হাত ধরে ধরে এগিয়ে নিয়ে যায় সহজ-সরল সমাপ্তিতে।


-0-0-0-0-


গল্পগ্রন্থ: ডিনারের জন্য কয়েকটি কাটা আঙুল
লেখক: উপল বড়ুয়া
প্রচ্ছদ: মোশারফ খোকন
প্রকাশক: উড়কি
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০২০


মতামত:_

1 মন্তব্যসমূহ

মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম