মনিরুল মনিরের কাব্যগ্রন্থ 'ঘরবদলের মানচিত্র': রকমারি চিন্তার বিন্যস্ত মলাট - সৌমেন দেবনাথ

মনিরুল মনিরের কাব্যগ্রন্থ 'ঘরবদলের মানচিত্র'

খড়িমাটি ও কাকাতিতা সম্পাদক মনিরুল মনির আপদমস্তক একজন কবি। সরল সহজ শব্দচয়নের মধ্য দিয়ে লিখিত কবিতার ভাব-প্রগাঢ়তা অনেক। ক্ষুরধার কলমের প্রখর ও তীক্ষ্ণ লেখনি যে কাউকে ঝলসে দেবে। কবির বোধের গভীরতা পরিমাপ করতে হলে একনিষ্ঠ ও ধৈর্যশীল পাঠক হতে হবে। প্রচ্ছন্নতার বেড়াজালে প্রকৃত অর্থ উদ্ধার যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। অথচ আড়ালকথার আবহে নিবিষ্ট হতে পারলে মণিমুক্তো পাওয়ার সম্ভাবনা জাগে। বিচ্ছিন্ন ভাবনাজালে কবি বিভোর এবং সেই বিচ্ছিন্ন ভাবনা থেকে জারিত যে কবিতার দেখা মেলে তা অনিন্দ্য। কবির লেখনিশৈলী তাঁর চিন্তাশৈলীরই বহিঃপ্রকাশ। বহিঃদৃশ্যে আপাতত মনে হলেও অন্তঃদৃশ্যে ভাবগাম্ভীর্য প্রকাশমান, যা নিবিষ্ট পাঠকের বোধকে মগ্নতা দেয়। উদ্বিগ্ন পাঠক পাঠানুভূতি পাবে না, পাঠমগ্নতায় দিতে পারে প্রকৃত আস্বাদন। কবি মনিরুল মনিরের 'ঘরবদলের মানচিত্র' একটি অনন্য কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটিতে মোট ৪২টি কবিতা আছে। ৪২ ধরনের ভাবনার ৪২টি কবিতা পড়ে আমি যতটুকু উদ্ধার করতে পেরেছি তা তুলে ধরলাম।

মৃত্তিকা সংবাহী মানুষ মাটির সাথে মিতালি করে মাটিতে ফসল ফলায়। শস্য বাড়লে রোগের প্রকোপ বাড়ে, চাষ বিলাসে কৃষক মনোনিবেশ করে। কবি লেখেন,

'পৃথিবীর গতায়ু ধরে রেখেছে
পৈতৃক আগুনে পোড়া শস্য
পাঠ শেষে বংশতির ডগায় বেড়ে ওঠে
যেখানে রোগের প্রকোপ
মাটিঘেঁষা রোগ
কৃষকের নিদারুণ আশ্রয়' (মাটিঘেঁষা রোগ)


বাংলার সবুজ মানুষ সরল মনে কুণ্ঠা ভুলে লজ্জা ভুলে একে অন্যকে আঁকড়ে বাঁচে। স্বার্থের দ্বন্দ্বে বা দ্বিধার দ্বন্দ্বে দগ্ধ হয় কখনো বা সম্প্রতির শেকড়। কবির কলমে,

'ভয় ছিল না মাটির হাতে
বুকের কাছে বসলে আগুন
চিবুকখানি ছুঁতে গেলে নানা ছলে
আমরা যখন ভাগ হয়েছি দু'দলে' (আঁকড়ে ছিলে সমস্ত দিন)


সংযোজন সেতু রচনা করতে জানে না মানুষ। সম্প্রতির সেতুতে থাকতে চায় না কেউ। মধুমগ্ন হয়ে থাকে না কেউ, সবাই কেমন রুচিহীন। কবির কণ্ঠে,

'আগুনের স্মৃতি আজো রাজপথে ফেস্টুনের ছবি আঁকে। আয়োজন ফুরিয়ে
যাবার আগেই ভাঙার ধ্বনি শুনতে পাই। শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি
পথিককে ব্যঞ্জনা জোগায়'। (ভাঙার ধ্বনি শুনতে পাই)


মানব মন বদলে বিশ্বাসী, পরিবর্তনে বিশ্বাসী। তেজস্বী ভাব একদিন বিনাশ হয়, অনুতাপ হয় সম্বল। আলোর জীবন অন্ধকারে পর্যবেশিত হয়, জীবন চালচিত্র পরিবর্তন হয়। অন্ধকারে ডুবলে আলোর তৃষ্ণা জাগে। কবি তাই বলেন,

'গল্পের রেশ ঘিরে রেখেছে
সকল অন্ধকারকে
ফিরে এসো নির্বিকল্পে
খুঁজে নেবো ঘরবদলের মানচিত্র' (ঘরবদলের মানচিত্র)


'কাছিম' কবিতায় রয়েছে,

'কাঁটাতারের প্রাচীরের বাইরে
কাছিম বাঁচে না
বেঁচে থাকে লঘু সম্পর্কের
চুলোতে পড়ে থাকা ছাই'। (কাছিম)


সাম্য নামে নামে। কেউ সাম্য প্রকৃত অর্থে চায় না। একে অন্যকে ঠকিয়ে জিতে যায়, অথচ গায় সাম্যের গীত। কবি লেখেন,

শাণবিহীন কলমে...
শাণবিহীন তলোয়ারে...
দু'টো-ই খেলনা
দু'টো-তেই খুন হয়... ' (সাম্য)


কবিদের যাপিত জীবন দেবালয় থেকে গণিকালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। কবি শূন্য কোন শহর নেই। কবিতা আছে জীবনবোধ থেকে সুড়সুড়ি জাগানো চন্দ্রভোগের সংসার পর্যন্ত। কবি তাই লেখেন,

পাথরে-প্রণয়ে ঘষে ঘষে দাগ বসাতে
গেছেন কেউ কেউ ; যাদের স্বপ্নের অলিন্দে
ঢুকে গেছে কাঁচা অসুখের বীজ' (ঢুকে গেছে কাঁচা অসুখের বীজ)


পাখিরা বনে কূজনে মাতবে, সমুদ্রে বন নেই, সেখানে তার স্থান নেই। যার যেখানে স্থান সেখানেই তাকে বলয় গড়ে বাঁচতে হবে। অন্যখানে গেলে ঠাঁই পাবে না। কবির পঙক্তিতে,

'পাখিদের কাছে বন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বলয়
আর কোনও ভরপুর গ্রাম নেই
পাখিদের গন্তব্য সমুদ্রে হয় নি' (পাখিবন)


ইচ্ছেঘোড়া লাগামহীন ছুটে চলে। জীবনের খোঁজে জীবন বহমান৷ অনেক সময় ইচ্ছেগুলো গন্তব্য না পেয়ে মরে যায়। সহযাত্রী যদি সহমর্মিতার হাত না বাড়ায় কোন ইচ্ছাই আলোমুখ পায় না। কবি লেখেন,

'একদিন জীবনের খোঁজে বেরিয়েছিলাম
উদ্বিগ্ন ইচ্ছেগুলো মৃত-
সকল রেখায় চলতে শুরু করেছে
অথচ প্রতিবাসী হয়েও তোমাকে বিচলিত দেখিনি' (উদ্বিগ্ন ইচ্ছেগুলো মৃত)


দুর্দিনে ত্রাতা হয়ে ঈশ্বর হাত বাড়ায়। বিপদে যে বন্ধু হাত বাড়ায় সেই তো ঈশ্বর। কিন্তু সেই ঈশ্বরের দেখা এখন মেলে না, যা মেলে তা কেবল ভূত। কবির কলমে,

'আজও ঈশ্বর দেখিনি, দেখেছি ভূত' (ঈশ্বর)


'অন্ধভিখেরী, গাণ্ডিব ও রাষ্ট্র' কবিতার কয়েকটি চয়ন,

'অদ্ভুত হাতি দেখার গল্প শুনতে শুনতে
পচে গেছে নিমক হারামি কান,
কানের কি দোষ!
অন্ধ ভিখেরি শুনে বেশি
দেখে না গাণ্ডিবের জোর
আর কথা বললেই
বিনিময় হয় রাষ্ট্রীয় কর' (অন্ধভিখেরী, গাণ্ডিব ও রাষ্ট্র)


'পিতার সহোদর' কবিতাটি থেকে-

'বিষণ্ন প্রকৃতির কাছে মহাজীবনের পাঠ
বাঁচাতে গিয়ে হারিয়েছি রঙে মেশা ছবি
ছবির যৌবনে আজো আছেন পিতার সহোদর'


চাঁড়াল দোকানি খদ্দেরের ঝুলির ক্ষমতা না মেপে হাকিয়ে দাম চায় মদের। ক্রেতার ক্রয় ক্ষমতার সীমা আছে, পরিকল্পনা হয় বাতিল। দোকানি সংরক্ষণ করেও জিইয়ে রাখে সম্ভাবনা। কবি লেখেন,

'গরিব দেশে ভিখারিরা সেলিব্রেটি, মেলায় যায়
নিরখরচায় নেচে-গেয়ে শ্মশানের আনন্দ বর্ধন করে,
আয়োজক মাতাল-অভিনেতা, চাঁড়াল দোকানি হন্য হয়
মাল্টি-শপের খুঁজে- সংলাপের জন্ম দেয়, মদের আসরে
নগ্ন -মেয়ে হাঁটে শ্রাবণের চিতা পেতে, এটাই মনের ভ্রম'। (ক্রেতা স্বার্থ কমিটি)


'স্বপ্ন; সাধনা প্রবল হয়ে উদ্যত হয়েছে বহুবার' কবিতা থেকে-

'পৃথিবী মাথা নুয়ে শিখতে গেছে
বারবার নামতার রোদনে,
আজ ভাঙনের জন্য অসংখ্য স্তবক
উদ্যত হয়ে এগিয়ে আসে'।


সময়ের সাথে সাথে সব ভুলে যাই, সজল হৃদয়ও পাথর হয়ে উঠে বা মেনে নেয়। পিতার সমাধিও ভুলে যাই, চিনতে পারি না, পোড়া পাথরের এপিটাফগুলো মুছে যায়। কবি লেখেন,

'সমাধিগুলো পুরনো হতে থাকলে ভুলে যাই স্বজনদের
মুখশ্রী, ঘুণ-ধরা অট্টহাসি, শুকনো চোখ দিয়ে মানদণ্ডে
তুলে আনি ভণিতা ও আগুনের আমোদ'। (ভণিতা ও আগুনের আমোদ)


মানুষের ইচ্ছেঘোড়া দৌঁড়ালেও কিছু ইচ্ছে পুড়ে যায়, হারিয়ে যায়। তবুও মানুষ পাতালের রহস্য আকাশে তোলে, তবুও সব ইচ্ছে আলোমুখ পায় না। কিছু ইচ্ছে পুড়ে যায়। তবুও কবি স্বপ্নবিভোর। লেখেন,

'স্বপ্নঘর-ফুলবন-কনকচাঁপা মনে
প্রত্যাখ্যানের আগুন নিভিয়ে দেয়
আমি নির্বাপিত আগুনে দেখি নারীকে-
চুলখোলা, অনুন্নত স্তনের ঢেউ বাহিত' (পুড়ে কাগজের ইচ্ছে)


খরা মনে শান্তি থাকে না, খরা মনে একটু জল পেলে মন আনন্দে গদগদ করে। কবি লেখেন,

'বাড়ন্ত সংসার নিভৃতে নিজস্ব হলে
ভাসতে ভাসতে আমি হতে চাই নদী
কখনো সমুদ্র-জোয়ারের মাটির ওপর
পড়ে থাকা খরার উঠোন ভিজে যদি' (খরার উঠোন ভিজে যদি)


ভালোবাসার ছোঁয়ায় মৃত স্বপ্নও জাগ্রত হয়। অন্ধকারও আলোতে ভরে। কবি লেখেন,

'পালকিতে ছলনা আছেন,
প্রিয়তীর্থে নিয়তি নাচেন।
শ্মশানের বাড়িতে পুড়তে যাই
মনে চঞ্চল তোমাকে সাজাই'। (ইঙ্গিতে ভালোবাসা গোপন হয়)


ছেলেবেলার হাজারো দুষ্টুমির কথা মনে পড়ে। ধুলো কাদা জল মেখে খেলা, ঘুড়ি উড়ানো, মাঠে খেলা সব মনকে কাতর করে। কবি তাই লেখেন,

ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের সাথে
একশত বকুনির স্মৃতি উড়ে চলে
শৈশব পিছলে পড়া অমৃত ব্যথা
কিংবা মঞ্চের ফ্ল্যাশব্যাক' (ফ্ল্যাশব্যাক)


মানুষ নিমগ্নতায় শিশুবেলার কথা ভাবে। অজান্তেই সবার মনে শিশুবেলা উঁকি মারে। এই স্মৃতি মনে এলে নৌকো বানানোর কথা মনে জাগে। কবি লেখেন,

'প্রত্যেক প্রকৃত মানুষের কাছে কবিতাহীন ভোর
জেগে ওঠেনি মগ্নতার অলংকার নিয়ে
ভেবেছিলাম নিঃশব্দে বানাবো কাগজের নৌকো' (কাগজের নৌকো)


জাগ্রত স্বপ্নে বিঘ্নতা আসে ঘুম এলে। তাই বর্ণাঢ্য করে স্বপ্নকে সাজানোর সময় হয় না। মুদ্রার পিছনে ছুটি অথচ মুদ্রা উপশম দেয় না মনকে, শত প্রকারের প্রমোদ পাই স্বপ্নে। কবি লেখেন,

'শত কথার পোহানীতে
পেয়েছ এক কুড়ানো মৃতমুদ্রা
অথচ মুদ্রায় ছিলাম চলমান' (মৃতমুদ্রা)


মাছ খেলতে পারে না মানুষ নামক শিকারীর কারণে। শিকার হয়ে খাদ্য টেবিলে চলে আসে। কেউ শিকার হয়, কেউ শিকারে থাকে। কেউ শিকার হতে চায় না। কবি লেখেন,

'উজ্জ্বল আলোতে জ্যোৎস্নার
সমীকরণ;-ছিলাম মমত্বের কুসুমে
আহারে ছেদ করে ধুলোবালি নেবে
ফিরে আসিনি শিকারের কথা ভেবে'। (মাছশিকার)


স্মৃতিভ্রষ্ট না হলে কেউ স্মৃতি ভোলে না। যে যেখানেই থাক হেঁসেলের কথা ভোলে না। নিজ শহর, রাতের মগ্নতা, প্রবল আলো-বাতাস সব যেন সবুজ হয়ে ধরা দেয় চোখে। কবি লেখেন,

'থেমে গেছে রাতের নগ্নতা
প্রবল বাতাসে আলোর ত্যাগ
আমাদের দ্বিধাহীন স্পর্শ স্মৃতিতে সবুজ
ঘুমহীন চোখে স্বপ্ন কেবলই অবুঝ'। (স্মৃতি সবুজ)


দীন-মজুর খেটে খাওয়া মানুষ নিজের নিয়তি সাজায়, দেশের ভিত্তি মজবুত করে। কবি লেখেন,

'কৃষক দুর্বল আঙুলে নিয়তি সাজায়
অভিমানের নির্মোহ আকাশ থেকে
মুছে যায় রাতজাগা হাভাতের শরীর' (কৃষক দুর্বল আঙলে নিয়তি সাজায়)


কবিকে শুশ্রূষা দেয় কোন এক নারী, যে নারীর বিনিদ্র থাকা কবিকে ভাবাতুর করে। রাতের আলোয় নার্সকে সুন্দর লাগে। কবি লেখেন,

'হাসপাতালের কষ্ট-ভোগা দেয়াল
সাক্ষী হয় নির্জনতার অন্ধকারে
আচমকা মধ্যরাতের ওষ্ঠ ছুঁয়ে
উতলা আলো লেপ্টে যায় তোমার গালে' (আচমকা মধ্যরাতে)


ঘরে ফেরার প্রতি কবির তীব্র নেশা। বাড়ি ফেরার ইচ্ছামৃত মানে মানুষটিই মৃত। ঘরে আছে স্বপ্নপরী, যেখানে তাঁর নোঙর। কবি লেখেন,

'এক আর্তনাদ জীবনের কাছে তুচ্ছ
তাই তোমার উচ্ছাসে বেঁচে থাকি'। (তোমার উচ্ছাসে বেঁচে থাকি)


'উঠোনের গল্প চোরের নামে লেখা' কবিতা থেকে-

'কে-যেনো সাহস দেখিয়ে পুস্তকের পোকা মারতে এলো;
খুনী না হয়ে চোর হয়ে ফিরে গেল। চোরের মাসতুতোগণ তত্ত্ব আওড়ান।
বিনিদ্র থাকার বড়ি সেবন করেন।
হয়তো এভাবে উঠোনের গল্প চোরের নামে লেখা হবে'। (উঠোনের গল্প চোরের নামে লেখা হবে)


অপরের দোষ না খুঁজে নিজেকে আত্মদর্পণে খুঁজলে আলোয় আলোকিত হওয়া সম্ভব। আত্ম-বিশ্লেষণ, আত্ম-অণ্বেষণ, আত্ম-জিজ্ঞাসা দরকার। কবি লেখেন,

'ভাঙনের আলো খুঁজলে মানুষের ছায়া হারিয়ে যায়। সে খবর শোনার জন্য
কঠিন হিমবাহর মন লাগে। এ এমনি দূরদর্শন -আমাদের আটকে
রাখবে। যেখানে নরকের ছবি দেখতে  দেখতে চোখ রাঙাবে শহরবাসী'। (আলো খুঁজলে মানুষের ছায়া হারিয়ে যায়)


সবাই ভালোবাসায় বোকা হয়। ভালোবাসায় কাঙাল মানুষ ভালোবাসলে বোঝে ভালোবাসায় সে কত কাঁচা। আবার কেউ ভালোবাসে গাদাগাদা বই পড়তে, বইয়ের অলিন্দে ডুবে থাকে বজ্রগুণন মনের টানে। বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে প্রেম প্রাপ্তির জন্য যাওয়া লাগে না। কবি লেখেন,

'শহরের ব্যস্ততম সড়কগুলো আমাকে দৌঁড়াতে শিখিয়েছে।
তাই মাঝে মাঝে কমলাদাস বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে ভালবাসার যৌথ
খামার নিয়ে বিব্রত হইনি'। (কমলাদাস বালিকা বিদ্যালয়)


সার্কাস খেলা দেখতে দেখতে বয়োবৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছি। জীবনকে নিয়ে কেউ জুয়া খেলে, জুয়ার বলি আমরা। কবি লেখেন,

'এ কোন কল্পরাষ্ট্র বটতলায় ঝুঁকি নিয়ে বসে গেছে।
সার্কাসের টেবিলে বালক ও কুকুর সভ্যতার কড়া শাসনে নেচে যাচ্ছে '। (সার্কাস বালক কুকুর ও সভ্যতা)


ভূগোলের মেয়ে পৃথিবীর প্রান্তরেখা, আলো, সৌরজগৎ, নক্ষত্র, শহরতলি নিয়ে গ্রন্থাগারে পড়ে পড়ে জানে। নগরপিতাগণ শহরতলির উন্নয়ন করলে ভূগোলের মেয়ের চোখে বাঁধে, ফলে সে চক্রান্তের শিকার হয়। কবি লেখেন,

'রাত্রিরা ফিরে আসে না;- ফাঁকাও থাকে না গ্রন্থাগারের সমস্ত বারান্দা ও সংগ্রহঘর-
ঐ ভূগোলের মেয়েটিকে মন্ত্রচিহ্নে চিহ্নিত হতে দেখেছি
বহুবার...বহুচক্রান্তে...' (ভূগোলের মেয়ে)


মূল্যবোধ, প্রথা, বিশ্বাস অনায়াসে গড়ে না, ভাঙেও না। প্রকৃত পাঠ না পেলে ভয়ংকর সব প্রথা ভেতরে অনায়াসে প্রবেশ করে। কবি লেখেন,

'ভয়ংকর সব প্রথা অনায়াসে ঢুকে গেছে দরজা দিয়ে।
আজও কোন প্রথা ভাঙতে পারিনি'। (ভয়ঙ্কর সব প্রথা)


রঙভর্তি আকাশ দেখতে সুন্দর কিন্তু ঘর জমিন আকাশের সাতরঙে কেনো খুশী হবে। লতাপাতা মাঠ মলিন হয়, সাদা কালো মেঘে ছায় না আকাশ। কবির কলমে,

'মেঘের কাছে রঙের নিয়তি, বিস্ময়ের রেখা
কপালের দাগ বিদগ্ধজনের তুলির আঁচড়, লতা-পাতা-
সবুজের মৃত মাঠ মলিন হয়ে গেছে, রাখেনি কথা'। (সবুজের মৃত মাঠ মলিন হয়ে গেছে)


'কৌম-নাচ' কবিতা থেকে-

'পাহাড়ে গ্রন্থ নেই, লাগিয়েছি বোটানি-বীজ,
ভুলে কি গেছো বৃক্ষের ছদ্মনাম!
ফুলে-ফলে কুড়িয়ে আনবো কৌম-নাচ
সে এক ইতিহাসের আর্তনাদ;'
'জলকুচি' কবিতা থেকে-
'মৃত পাখি জলে ভাসতে ভাসতে
অনায়াসে ভীড়লো তোমার বাড়ি
স্বপ্ন আঁকা পুঞ্জমনে
কেঁকিয়ে উঠা স্বর জমাতে পারি'।


জীবনের মধ্যাহ্ন শেষে সন্ধ্যা আসে, প্রস্তুতি নিই পরপারের। অথচ শিকারী সেজে শিকার করেছি শিকারের মন না বুঝে। বুঝ ফিরলে আক্ষেপ হয়। কবি লেখেন,

'ক্লান্তি এসে ভর করেছে
হাড়-কাঁপানো শীতের কাঁধে,
ঘুণ ধরা এ জীবনের কাছে
সবই এখন গোল বাঁধে'। (গোল বাঁধে)


মৃত্যু সত্য, সহজে গ্রাস করে, আকাশ উচ্চতা থেকে নামিয়ে দেয়। অভিধান বহির্ভূত কাজ করে করে নিজেদের ক্ষতি করি। কবি লেখেন,

'পাখিপতিদের উড়ে আসা
শব্দ তুলে রাখি
তুলে রাখি মরীচিকা যত্নে
পূর্বপুরুষদের পাঁজরে গড়া
আজন্ম শৈশব' (সরল বিভোর)


কবির হৃদয় বাগানের হৃদকমল অহংকারকে সম্বল করে কবিকে এড়িয়ে গেছে। কবির বুকে জলধারা। কবি কারণ খুঁজে পান না, বালক বয়সের অজ্ঞাত সুখ কেনো শিল্পীর তুলিতে ধরা দেয় না। কবি লেখেন,

'একক কোনো কবিতাপাঠের আসরে তুমি এবং
সাদাসিধে সুররিয়ালিজম অতিকায় ভেসে ওঠো,
সমস্ত স্বপ্নের ডানা মেলে আমি রাতের কাছে
দুদণ্ড নিরুপায় নিয়ে আনি পুরুষ হতে'। (বিধুর বাগানে)


আমরা আমাদের প্রাপ্তিতে গর্ব করি, সৌন্দর্যের গর্ব করি, ধনের গর্ব করি। অথচ প্রজাপতির শরীরে কত রং তাতে তার গর্ব নেই, কেননা রং তার কেউ না, বরং শত্রু, তার বন্ধু ডানা। কবি লেখেন,

'রঙ প্রজাপতির অন্ধ আলো, ডানা অস্তিত্ব' (ডানাভাঙা প্রজাপতি)


যে শিশু কন্যা সংগ্রাম করে বেড়ে উঠে সে জানে মুদ্রার মূল্য। তাই সে শিশু ও তিলকপরা সংগ্রামী রমণীরা অহংকারী হলেও মানায়। কবি লেখেন,

'তিলকপরা রমণীদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে
আজও শৈশব ভাঙেনি কোন জাতের সংঘ
তাই চা-বনে শিশু, রমণীরা
ভয়ানক অহংকারে বেঁচে আছে'। (ভয়ানক অহংকার বেঁচে আছে)


আলো আছে তাই অন্ধকারের ইতি, অন্ধকার আছে তাই আলোর গীতি, অন্ধকারের কারণেই আলোর মাহাত্ম্য। তাই অন্ধকারও জীবনের জন্য জরুরি। কবি লেখেন,

'কাতর মানুষের ভিড়ে একদিন পৃথিবী
আনন্দ নিয়ে এগোবে
আর উচ্চারিত হবে অন্ধকারের এলিজি' (অন্ধকারের এলিজি)


শিশুরা যে পথে যায়, অভিভাবক চান না সে পথে যাক। অর্থাৎ শিশুদের পথের বিপরীতে অভিভাকের পথ। কবি লেখেন,

'আঘাতের ভার বহন করতে
অপারগ সকল অভিভাবক
তাই শিশু আর অভিভাবক
বিপথে বিপরীতে'(বিপরীতে)


পাঠান্তে, অর্জিত জ্ঞান বিসর্জিত না করে সঞ্চিত করে রাখার মধ্যেই স্বার্থকতা। বিচ্ছিন্ন ভাবনার মলাটবদ্ধ 'ঘরবদলের মানচিত্র' কাব্যগ্রন্থটি পড়ে  যে উপলব্ধি হয়েছে তা ভাষায় ব্যাখ্যাতীত। লেখনি দিয়ে প্রকাশ অসম্ভব। পাঠক পাঠ করে কিছু প্রাপ্তির খোঁজে, কখনো সেই প্রাপ্তি মেলে, কখনো মেলে না। কাব্যগ্রন্থটি পড়ে এটুকু বলতে পারি, সময় বৃথা যায়নি, মস্তিষ্ক বিরাম পায়নি। মস্তিষ্কে যে বই নাড়া দিতে পারে, সেই বই জাগ্রত রবে অনন্তকাল। কবি মনিরুল মনিরের কাব্যগ্রন্থটি পাঠক প্রিয়তা পাক এবং কবিও কাব্যজগতে বিচরণ করুন আমৃত্যু স্বার্থকতার সাথে এই কামনা থাকলো।


=0=0=0=0=
ঘরবদলের মানচিত্র
মনিরুল মনির

প্রকাশনী- জবান
প্রকাশক- আবদুল ওয়াহেদ
প্রথম প্রকাশ- ডিসেম্বর, ২০০৭
প্রচ্ছদ- খালিদ আহসান
পৃষ্ঠা- ৪৮
মূল্য- ৬০ টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ