বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিকশিত সভ্যতাগুলোর নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন আছে। একেক সমাজের রাজনৈতিক চিন্তা একেক রকম। রাজনীতি কী, কত প্রকার, কাকে বলে সংজ্ঞা কি এসব নিয়ে প্রত্যেকের রয়েছে স্বতন্ত্র মূল্যবোধ। সময়ান্তরে এই মতসমূহের বিবর্তন ঘটে। সময় ও প্রয়োজনের তাগিদে মানুষের চিন্তাধারা পাল্টে যায়, যেতে বাধ্য হয়। রাজনৈতিক চিন্তার এইসব বিভিন্ন বিবর্তন নিয়ে নিউইয়র্কের কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও দার্শনিক জর্জ এইচ স্যাবাইন (George H. Sabine 1880-1961) এর সুপরিচিত বই "রাজনৈতিক তত্ত্বের ইতিহাস" (A History of Political Theory)। বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক হিমাংশু ঘোষ। আটশয়ের বেশি পৃষ্টার এই বিশালাকার বইয়ে জর্জ এইচ স্যাবাইন আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস লিখেছেন। মানুষের চিন্তাবিবর্তনের তত্ত্ব ও তথ্যসমৃদ্ধ এই বই পেয়েছে অমরত্বের মর্যাদা।
পয়ত্রিশটি অধ্যায়ে বিভক্ত বইয়ের শেষে একটি ছয় পৃষ্ঠার নির্ঘন্ট (Index) আছে। বইটিকে চেনার জন্য সূচীপত্রটি দেখা দরকার। উল্লিখিত সূচীপত্রে শিরোনামসমূহের পাশাপাশি থাকা সংশ্লিষ্ট উপশিরোনামগুলো বাহুল্যবোধ বাদ দেয়া হল।
- প্রথম পর্ব
- নগর রাষ্ট্র
- প্লেটোর পূর্ববর্তী রাজনৈতিক চিন্তা
- প্লেটোঃ দি রিপাবলিক
- প্লেটোঃ দি স্টেটসম্যান এবং দি লজ
- এ্যারিস্টটলঃ রাজনৈতিক মতাদর্শন
- এ্যারিস্টটলঃ রাজনৈতিক বাস্তবতা
- নগর-রাষ্ট্রের গোধুলিলগ্ন
- প্রকৃতির বিধান
- সিসেরো ও রোমান আইনজীবিগণ
- সেনেকা ও ধর্মযাজকগণ
- জনগণ ও তাদের আইন
- অভিষেক সম্পর্কিত বিতর্ক
- বিশ্বব্যাপী সমাজ
- ফিলিপ দি ফেয়ার এবং অস্টম বনিফেস
- পডুয়ার মার্সিলিও এবং ওকামের উইলিয়াম
- চার্চ প্রশাসনের পরিষদীয় তত্ত্ব
- ম্যাকিয়াভেলী
- আদি প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারকগণ
- রাজতন্ত্র সমর্থক ও রাজতন্ত্র বিরোধী তত্ত্ব
- জাঁ বোঁদা
- প্রাকৃতিক বিধানের আধুনিক তত্ত্ব
- ইংল্যান্ডঃ গৃহযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব
- টমাস হবস
- আমুল সংস্কারবাদী ও সাম্যবাদীগণ
- প্রজাতন্ত্রিগণঃ হ্যারিংটন, মিলটন ও সিডনী
- হ্যালিফ্যাক্স এবং লক
- ফ্রান্সঃ প্রাকৃতিক বিধানের অবক্ষয়
- লোকসমাজের পুনরাবিষ্কারঃ রুশো
- প্রথা ও ঐতিহ্যঃ হিউম এবং বার্ক
- হেগেলঃ দ্বন্দ্ববাদ ও জাতীয়তাবাদ
- উদারনীতিবাদঃ দার্শনিক চরমবাদ
- উদারনীতিবাদের আধুনিক রূপ
- মার্কস এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
- সাম্যবাদ
- ফ্যাসিবাদ ও জাতীয় সমাজতন্ত্র
- নির্ঘন্ট
নগর রাষ্ট্রের তত্ত্ব
(THE THEORY OF THE CITY-STATE)
দ্বিতীয় পর্ব
বিশ্বজনীন লোকসমাজের তত্ত্ব
(THE THEORY OF THE UNIVERSAL COMMUNITY)
তৃতীয় পর্ব
জাতীয় রাষ্ট্রের তত্ত্ব
(THE THEORY OF NATIONAL STATE)
রাজনীতি মূলত সমাজ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য কতিপয় ধারণা মাত্র। এই ধারণাগুলো বিকশিত হয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আর্থিক, সামাজিক, ভৌগলিক, বৌদ্ধিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে।
এই বইতে বিস্তারিত তথ্যসহ রাজনৈতিক চিন্তার সহস্রাধিক বছরের বিবরণ আছে। ফলে নির্মোহ দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতে সমস্যা হয় না। সহজে এ্যারিস্টটল, প্লেটো, সিসেরো, স্টুয়ার্ট মিল, হেগেল, রুশো প্রমুখের ভাবনার প্রভাবসমূহ চিহ্নিত করা যায়। জনগণ, নাগরিক, রাষ্ট্র, আইন, অধিকার, শাসন, শিক্ষা ইত্যাদি প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের ভূমিকা ও পদক্ষেপ কিরূপ হওয়া উচিত, কোন পদ্ধতি গ্রহণ করলে মানুষের জীবন নির্ভয়, সমৃদ্ধ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় হয় সে ব্যাপারে প্রত্যেক মনীষীর স্বতন্ত্র্য, বৈচিত্রময় মতামত রয়েছে। এগুলো রাষ্ট্রের আইনের প্রেক্ষিতে কীভাবে প্রতিফলিত তার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ এই অংশটি দেখা যায়-
রোমান আইন বিকাশের স্বর্ণময় যুগ খ্রীষ্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে দেখা যায়। ৫৩৩ সালে সম্রাট জাস্টিনিয়ানের (Justinian) নির্দেশে সেই যুগের শ্রেষ্ঠ আইন বিশারদগণের রচনা হতে উদ্ধৃত ও সংকলিত হয়ে 'ডাইজেস্ট' (Digest) অথবা "প্যানডেক্টস" (Pandects) প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত আইন-সংকলনে যে রাষ্ট্রদর্শন নিহিত, তা হল সিসেরো রচিত তত্ত্বসমূহের পুনরাবৃত্তি ও সম্প্রসারণ মাত্র। পৃষ্ঠা- ১৫৭
ষোড়শ শতকের স্বেচ্ছাচারী রাজাদের এক উন্নত ও কল্পিত রূপ ম্যাকিয়াভেলীর রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণায় ছিল। এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক বলেন-
রোমান প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি ম্যাকিয়াভেলীর যে সুগভীর আগ্রহের পরিচয় মেলে, সে তুলনায় একচ্ছত্র রাজতন্ত্রের বর্ণনায় তেমন কিছু আগ্রহ দেখা যায় না। কারণ তাঁর মতে রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব আইনের গুণাগুণের উপরেই নির্ভর করে এবং নাগরিকদের সকল পৌর গুণাগুণের সেটাই উৎস। পৃষ্ঠা - ৩২৯
যুগে যুগে রাজনৈতিক দর্শন বিষয়ে দার্শনিকদের মতবিরোধ হয়ে এসেছে। তেমনই একটি ক্ষেত্রে লেখকের বর্ণনা নিম্নরূপ-
হবস অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে কঠোর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নীতির ভিত্তিতে রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্রের স্বপক্ষে প্রমাণসমূহ হাজির করেন; কাজেই সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠার সমর্থনে লকের পক্ষে হবসের মতবাদ খন্ডন করা অপরিহার্যরূপে দেখা দেয়। পৃষ্ঠা- ৪৮৭
স্টুয়ার্ট মিল নিজের সমাজ দর্শনের ঘাটতিকে স্বীকার করেন। তারপরও মানুষের স্বাধীনতার যে ধারণা তিনি প্রস্তাব করে গেছেন তা সময়ের প্রেক্ষিত যথেষ্ট অগ্রসর ছিল। তবে তার উদারতাবোধের কোন জুড়ি ছিল না। লেখকের ভাষ্যে-
উদারনীতিবাদের ক্ষেত্রে মিলের নীতিশাস্ত্র অত্যন্ত তাৎপর্যবহ ছিল, কারণ তা অহংবাদকে ত্যাগ করে এবং সমাজকল্যাণকে মনে করে সকল মানুষের সদিচ্ছা এবং স্বাধীনতা, সংহতি, আত্মসম্মান এবং ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি সুখকে বর্ধিত না করলেও তা কাম্যবস্তু বলে চিহ্নিত করে। এই প্রকারের দৃঢ় নৈতিক বিশ্বাসই ছিল মিলের উদারনৈতিক সমাজ ধারণার মূল বৈশিষ্ট্য। পৃষ্ঠা - ৬৪১
রাজনীতি বুঝতে হলে রাজনীতির দর্শন ও তত্ত্বগুলো জানা প্রয়োজন। পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক মতসমূহের সাথে পরিচিতি থাকা দরকার। যত বেশি তথ্য ও তত্ত্ব জানা যাবে, নিজের বুদ্ধি ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে তত নিখুঁত চিন্তা করা যাবে। এজন্য প্রত্যেক শিক্ষিত ও রাজনীতি সচেতন মানুষের এই জাতীয় বই পড়া থাকা উচিত।
জর্জ এইচ স্যাবায়িন এর এই রাজনৈতিক তত্ত্বের ইতিহাস বইটি তথ্য ও ব্যাখ্যায় সমৃদ্ধ। প্রত্যেকটি অধ্যায়ের শেষে সংযুক্ত গ্রন্থপঞ্জীতে প্রয়োজনীয় আকরগ্রন্থের নাম রয়েছে। আর শেষের নির্ঘন্ট তো রয়েছেই। বাংলাদেশ ও ভারতের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ছাত্রদের পড়ানোর জন্য এই বইকে সিলেবাসে যোগ করেছে। সম্মান শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের উপযোগী বিস্তারিত ও প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক চিন্তার আলোচনা এতে রয়েছে। যারা রাজনীতির জগতে নিজেকে ছাত্র মনে করেন, তাদের কাছে এই বই মহামূল্যবান বলে বিবেচিত হবে।
অনুবাদ সাবলীল হয়েছে। পাঠ করতে গিয়ে কোথাও হোঁচট খেতে হয় না। এই বইতে অবশ্য শুধুমাত্র ইউরোপের রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাস রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের রাজনৈতিক মতবাদ, তত্ত্ব, প্রস্তাব, মতাদর্শ এখানে আলোচিত হয় নি। যারা শুধু ইউরোপের রাজনৈতিক দর্শনের ইতিহাস জানতে চান তারা এই বই থেকে প্রভূত উপকৃত হবে।
-−-−-−-
রাজনৈতিক তত্ত্বের ইতিহাস
হিমাংশু ঘোষ
প্রচ্ছদ শিল্পী: শ্রীঅঞ্জন চক্রবর্তী
প্রকাশনায়: লেখক নিজে
পরিবেশনায়: বিশ্বাস বুক স্টল, কলিকাতা।
প্রকাশকাল: ১৯৯৩
পৃষ্ঠা: ৮২৬+৬
মূল্য: এক শত টাকা
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম