কালের কফিন | জুলকারনাইন স্বপন

কালের কফিন | জুলকারনাইন স্বপন


অমর একুশে বইমেলা ২০২১ এ প্রকাশিত হয়েছে জুলকারনাইন স্বপনের কবিতার বই "কালের কফিন"। মোট ছেচল্লিশটি কবিতা দিয়ে এই বই সাজানো। জীবনের বহুবিদ দৃশ্য কবির দেখা হয়ে গেছে। প্রৌঢ়ত্বের দ্বারে দাঁড়িয়ে যখন ফেলে আসা যাপিত জীবনের দিকে তাকান তখন এক লহমায় দেখে ফেলেন বহমান ইতিহাস। বৈচিত্রময় জীবনাভিজ্ঞতার প্রভাব রয়েছে কবিতাগুলোর সর্বাঙ্গে। জন্ম শহর কুড়িগ্রাম, কালো শাড়ি, পথ, ভাগ্যলিপি, আড্ডা, বিজয়, হরতাল, চে গুয়েভারা, মফিজ, স্বাধীনতাসহ জীবনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে।

জীবনকে কখনো তাঁর অচেনা লাগে, কখনও বিরামহীন পথিক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন নিঃসঙ্গ প্লাটফর্মে। বিক্ষুব্ধ সময়ে তাঁর মন-প্রকৃতি যে ডাক দেয় তাকে আর উপেক্ষা করেন না। জন্ম হয় স্বপ্নের মত জ্বলজ্বলে কবিতামালার।

আবেগ প্রকাশে তিনি অকৃত্রিম, শব্দ চয়নে সাবলীল। কাব্যের নামকবিতায় তিনি নিঃসীম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন-

শূন্যতা, শুধুই শূন্যতা
সীমাহীন অন্ধকারে নিমজ্জিত জীবন।
একটুও পলিমাটি পড়ে না বিবেকের জমিনে
সত্তা আজ লাশ হয়ে পড়ে আছে কালের কফিনে। কালের কফিন, পৃষ্ঠা - ১২


দেশের প্রান্তভূমে বাস করার কারণে জনজীবনের প্রকৃত অবস্থা তাঁর অজানা নয়। মানুষের জীবন-সম্পদের নিরাপত্তা নিয়ে সমাজে ডানা মেলে থাকা যে উৎকণ্ঠা তাকে লুকিয়ে রাখেন নি-

শংকা জাগে দুর্বল চিত্তে
আবার বুঝি আসবে সেই বর্গী।
লুটে নিয়ে যাবে ধনসম্পদ
আর ভাতের সানকি। নবরূপে বর্গী, পৃষ্ঠা - ২৮


কবির নন্দনবোধ প্রণিধানযোগ্য। তাঁর স্বাধীনতা-২, হৃদয় নাচে, চৈত্রের কবিতা, মন-প্রকৃতি, কালো শাড়ি প্রভৃতি কবিতায় কবির মানবিকতাসঞ্জাত নন্দনচেতনার পরিচয় মেলে।

‘কবিতা’ বিষয়টিকেই তিনি প্রসঙ্গ হিসেবে কবিতায় উপস্থাপন করেছেন। বেশ অভিনব কবিতা এটি। কবিতাকে তিনি কি মনে করেন, কবিতার স্বরূপ কীরূপ তার একটি বর্ণিল চিত্র পাওয়া যায় 'কবিতা' নামক কবিতায়-

কবিতা- সেতো কৃষাণী বধুর মধুর হাসি
কবিতা- সেতো উদাস দুপুরে রাখালের বাঁশি।
কবিতা- মেঘবালিকার ডানা মেলে ওড়া
কবিতা- বাউলের একতারা। কবিতা, পৃষ্ঠা- ৩৬


বইয়ের শেষে তিনটি পৃষ্ঠায় ছোট আকারের কবিতাকৃতির কয়েকটি রচনা রয়েছে। কবিতাগুলো গঠনে ভিন্ন, দুই থেকে ছয় লাইনের স্বল্পায়তনের; স্বল্পকথায় আবেগের স্ফুরণ দানা বেঁধে ওঠার সচেতন প্রয়াস রয়েছে। এই অংশের নামকরণ করা হয়েছে "কালের পদাবলী"। এগুলো ঠিক কী, তার বর্ণনা কোথাও নেই। লেখক বইয়ের ভূমিকায় কবিতার সাথে তাঁর যাপিত জীবন, বিভিন্ন ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা, ভালবাসা, ধন্যবাদ সবিনয়ে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু 'কালের পদাবলী' শিরোনামের কবিতাকারের রচনাগুলোর কোন পরিচিতি বা বইয়ের শেষে সংযোজনের উদ্দেশ্য বা প্রয়োজনীয়তা কিছু উল্লেখ করেন নি। ফলে বিষয়টি সম্পর্কে কিছুটা ধোঁয়াশা থেকে গেল। তবে এই অংশেও সুখপাঠ্য কবিতা রয়েছে বেশ কয়েকটি। জীবনচেতনায় জারিত রসে সিক্ত কবিতাগুলো যেন আর্তনাদ, উপলব্ধি, অভিপ্রায়, হতাশার সংক্ষিপ্ত বহিঃপ্রকাশ। লুকোচুরি কবিতায় কবি বলেন-

জীবন খোঁজে জীবনকে
সেই আদি থেকে আজ অব্দি
কখনও দেখা মেলে
কখনওবা লুকোচুরি খেলে। পৃষ্ঠা ৪৪


আবার আর একটি কবিতা "কষ্টের ভেলা" -তে কবি এক অপার্থিব হাহাকারে আর্তনাদ করে ওঠেন

দুঃখ নদীর বুকে ভাসে কষ্টের ভেলা
সুখের পায়রারা ভুলে গেছে ডানা মেলা। পৃষ্ঠা- ৪৬


বইয়ের ছাপার মান ভাল। বোর্ড বাঁধাই হওয়ায় বেশ শক্তপোক্ত। সহজে ছিঁড়ে যাবে না; বহুদিন টিকে থাকবে। অসাধারণ অপার্থিব প্রচ্ছদটি একেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ। তাঁর চেতনা ও নন্দনবোধের মিথস্ক্রিয়া সত্যি প্রশংসনীয়। বইয়ের বহুল পঠন প্রত্যাশা করি। কবিতা নিয়ে আগ্রহী পাঠক এই বইপাঠে উৎসাহিত হতে পারেন।



********
কালের কফিন
জুলকারনাইন স্বপন


প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ
প্রকাশনায়: ঘাসফুল, ঢাকা।

পৃষ্ঠা: ৪৮
মূল্য: ১৪০
ISBN: 978-984-94860-9-9

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ