সাজঘরে ক্রীতদাস - মাহমুদ আল হেলাল উজ্জামান

সাজঘরে ক্রীতদাস - মাহমুদ আল হেলাল উজ্জামান


ধ্যানীমননের মর্মচেতনায় আত্মমগ্ন কবি মাহমুদ আল হেলাল উজ্জামান। মনের খেয়ালে তৈরি হওয়া অনুচ্চারিত অস্ফুট শব্দমালা তাঁর একান্ত আপনার; নিজেকে খুঁজে পাবার সহায়কাঠি। ২০২১ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত 'সাজঘরে ক্রীতদাস' কাব্যের ভূমিকাতে তাঁর এই সংগোপন সক্রিয়তার কথা বলেছেন। অনুভূতির বহিপ্রকাশের এই আত্মবোধ তো একজন কবির আশ্রয়। তিনি সরলমনে অকপটে জানান-

মানুষ তাঁর স্বপ্নের সমান বড়। আমার স্বপ্ন দেখা হয়ে ওঠেনি কোনদিন। ছবি আঁকা, অভিনয়, আবৃত্তি প্রতি ক্লাস পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের প্রফুল্লতা স্থায়ী হয়নি সময়ের যাঁতাকলে। তবুও জীবন পেরিয়ে এসেছে তার সময়গুলো। ইচ্ছে থাকলেও যে কথাগুলো বলতে পারিনি কখনও কাউকে, তেমন কিছু কথার সংকলন 'সাজঘরে ক্রীতদাস'।


তাঁর কবিতা সাবলীল, সুখপাঠ্য। অবিরল শব্দধারার মত চিন্তাপ্রবাহকে বয়ে নিয়ে যায়। পড়তে গিয়ে বিভোর হয়ে যেতে হয়। কোথাও কোন জটিল, অপ্রচলিত বা অপরিচিত শব্দ ব্যবহারের গরিমা নেই। সাধারণ মানুষ হিসেবে সাধারণ পাঠকের কথা ভেবে তিনি সাধারণ প্রচলিত শব্দকে সাথী করেছেন।

কবি সহজবোধ্য ভাষায় বর্ণনা করেন নিজের মনোভাব, চিন্তাদর্শন। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপকের অজুহাতে নিজের শিল্পচেতনা আড়াল করেন নি। সমাজের বিভিন্ন ঘটনা তাঁর চোখ এড়ায় না। একজন মরমী শিল্পীর মত প্রাত্যাহিক সামাজিক অনুষঙ্গগুলোতে নিজের সংশ্লেষ খুঁজে পান। সামাজিক বিকৃতিগুলোর দায় এড়িয়ে যান না। এক অমোঘ মহাপ্রাণ তাকে প্রশ্রয় দেয়; যার প্রকাশ ঘটে কবিতাগুলোর পংক্তিতে পংক্তিতে। সমকাল, ইতিহাস, জীবনবোধ, কষ্ট, ধর্মচেতনা, মৃত্যুভাবনা, মনুষ্যত্ব, দুঃখবোধ প্রভৃতি মানবিক উপাদান তাকে উদ্বেলিত করে। সামাজিক আস্থার প্রেক্ষিতে নিজের অবস্থান মূল্যায়ন করেন। যার প্রকাশ কবিতাগুলোতে বড়ই স্পষ্ট।

কবিতাগুলোর প্রত্যেকটির নিচে রচনাকাল উল্লেখ রয়েছে। সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ১৯৯৭ সালে রচিত কবিতার পরিমাণ বেশি। ১৯৯২ সালের একটি কবিতা আছে; এছাড়া ১৯৯৮, ২০০০, ২০০৬, ২০১৮, ২০১৯ সালেরও বেশ কিছু কবিতা বইতে রাখা হয়েছে। তবে শুরু করেছেন সাম্প্রতিক সময়ে রচিত 'সারা বিশ্ব তাকিয়ে আছে জানালায়' কবিতা দিয়ে। যে করোনা ভাইরাসের আতংকে ২০২০ সালে পৃথিবী তটস্থ ছিল, তার আলোকে কবিতাটি রচিত। এক স্বপ্নহীন, ভবিষ্যতহীন, গতিহীন, নিষ্পলক মহাকালের ফাঁদে সবাই বন্দী হয়েছি। এক সর্বব্যাপী নিরাশার বেড়াজাল চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে-

ম্লান হয়ে গেছে উৎসব, মহোৎসব
জন্ম হচ্ছে না যে,
মৃত্যুও থেমে গেছে স্বাভাবিক
থেমে আছে, না খেয়ে কেউ ত্রাণের অপেক্ষায়। পৃষ্ঠা- ১১


দ্বিতীয় কবিতাটি বেশ ওজোগুণমণ্ডিত। 'ঠিকানা বাংলাদেশ' কবিতায় কবি চার হাজার বৎসরের ইতিহাসকে স্মরণ করেছেন। বাঙালি জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস খোঁজেন ভূমিতে 'আল' দেয়ার প্রথম ঘটনা থেকে। সহজাত ভঙ্গিতে এগুতে থাকা দীর্ঘ কবিতাটি সম্পূর্ণ হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এসে। যার ডাকে বাঙালি জনগোষ্ঠীর স্বাধীকারের আকাঙ্ক্ষা সফল হয়, সেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা সগৌরবে ঘোষণা করেন-

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব'র ডাকে ফের পথে নামে লক্ষ কোটি প্রাণ
বুকের রক্তে রাজপথ লাল ডুবে যায় শত্রুর কামান
ত্রিশ লক্ষ শহীদের খুনি শোষক বাঁচায় আপন প্রাণ
মুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্রে বাঙালি গায় ফের জয়গান
পৃথিবীর বুকে শস্য শ্যামল সবুজ সোনার দেশ
গড়েছে বাঙালি একাত্তরে ঠিকানা বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা- ১৬

পরিযায়ী জীবনের এক সময় দেশের পাহাড়ী অঞ্চলে বাস করেছিলেন। সেই উচ্ছল অভিজ্ঞতা তাঁর স্মৃতিতে এখনও সমুজ্জ্বল। 'কষ্টের সাথে মিশে প্রাণ কেড়ে নেয়' কবিতায় পাহাড়ের নৈসর্গিক প্রান্তর তাঁর মননে উথলে ওঠে। তিনি বলেন-

টিলা থেকে পাহাড় হয়ে পর্বত
মেঘ ছুঁতে চায়
হিমালয় হয়ে মেঘের পথ আটকায়
জল চায় জল। পৃষ্ঠা- ৩২


‘মানুষ বুঝি এমন হয়' শিরোনামে তিনি তিনটি কবিতা লিখেছেন। মনুষ্য চরিত্রের প্রামাণ্য অবয়ব নিরূপণের জটিলতা তাঁকেও পীড়ন করেছে। তাই তিনি বারবার মানুষকে সংজ্ঞায়িত করতে চান বিভিন্ন রূপক, বিভিন্ন চিত্রকল্পের সাহায্যে। তিনটি কবিতাতেই প্রচারিত সামাজিক চিত্রের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা মনুষ্যত্বকে খুঁজেছেন। জানতে চেয়েছেন মানুষ নামক দ্বিপদ প্রাণিটির আসল স্বরূপ। 'মানুষ বুঝি এমন হয় (৩)' শিরোনামের কবিতার সূচনাংশ এরকম-

জগৎ সংসারে বলে স্বর্গের সুখ থাকে
তয় কোন পাপে হাতে গড়া সংসার ছিন্নভিন্ন হয়
ক্যান সুখের সংসারে
সাপ-বেজির যুদ্ধ চলে? পৃষ্ঠা- ৫৩


কবির মধ্যে দীর্ঘকবিতা লেখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বেশ কয়েকটি দীর্ঘাকারের কবিতা এই কাব্যে রয়েছে। ওকে ঘুমোতে দে, শুধু তোমাকেই, ভেবেছি মাটিই আমার মা, ঠিকানা বাংলাদেশ, পোষ্যপুত্রের বাঁশি, তুমি ও মৃত্যু, জীবনের সংলাপ, আবার আসতে যদি কবিতাগুলো দুই থেকে তিন পৃষ্ঠাব্যাপী বিস্তৃত। প্রতিটি কবিতা উপস্থাপনা বৈচিত্র্যে অভিনব। সম্পূর্ণ কবিতা চার থেকে পাঁচ লাইনের একাধিক স্তবকে বিভক্ত। আবেগের অনুভূতি ও তার বহিঃপ্রকাশ ধাপে ধাপে গিয়ে পূর্ণতা পায়; কবিতার বক্তব্য পূর্ণাঙ্গরূপ ধারণ করে। মনে হয় কবি এক গভীর ধ্যানের অন্তরালে আত্মমগ্ন থেকে কবিতাগুলো রচনা করেছেন। আনমনে টানা একের পর এক বাক্যের জন্ম দিয়েছেন।

দীর্ঘ কবিতার পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু স্বল্পায়তনের কবিতাও লিখেছেন। এরকম মোট ষোলটি কবিতা বইয়ের শেষে 'ছেঁড়া কবিতা' শিরোনামে যুক্ত হয়েছে।  দুই থেকে আট লাইনের কবিতাগুলো কীভাবে লিখলেন, কোন প্রেক্ষিতে কেন লিখলেন, স্বতন্ত্র বই না করে কেন এই বইয়ের শেষে জুড়ে দিলেন তার কোন ব্যাখ্যা কোথাও উল্লেখ নেই। ভূমিকায় দুলাইনের একটা বক্তব্য থাকতে পারত। তবে এই খেদ মিটে যায় কবিতাগুলো পাঠ করলে। গোপনে লালিত এক অনুচ্চারিত হদয়স্পর্শী আর্তনাদ কবিতাগুলোতে প্রতিফলিত। গভীর প্রশ্ন, অপার উপলব্ধি কবিতাগুলিকে দিয়েছে 'উচ্চারিত সত্যে'র মর্যাদা। যেমন-

চোখের দেখাটাও ভুল বনে যায়
কখনও মিথ্যায়
কখনও গোলকধাঁধায়। পৃষ্ঠা - ৬৩


কবিতাগুলোর বিশিষ্টতার আলোকে কবি মাহমুদ আল হেলাল উজ্জামানের হৃদয়াবেগের প্রশংসা না করে পারা যায় না। কবিতার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ মানসিকতা নিয়ে তিনি হাতে কলম তুলে নেন। পাঠকের আগ্রহ এবং অন্বেষণ তাঁর এই কাব্যে পথ খুঁজে পাবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

বইয়ের প্রচ্ছদটি আকর্ষণীয়। রঙের ব্যবহারে মুন্সিয়ানার পরিচয় মেলে। মানুষের অবয়ব প্রকাশের অভিনবত্ব শিল্পী শামীম আরেফিনকে স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছে। বইয়ের ছাপানো বেশ মানসম্পন্ন। হার্ডবোর্ড মলাটের বাঁধাই বেশ মজবুত। হাতে নিলেই বোঝা যায় এই বই দীর্ঘস্থায়ী হবে। বইয়ের কবিতাগুলোর নিবিড় পাঠ, উৎসাহী পাঠকের আগ্রহকে তৃপ্ত করবে এমন প্রত্যাশা অমূলক হবে না।


=+=+=+=+=

সাজঘরে ক্রীতদাস
মাহমুদ আল হেলাল উজ্জামান


প্রচ্ছদ: শামীম আরেফিন
প্রকাশনায়: ঘাসফুল, ঢাকা
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৬৪
মূল্য: ১৬০
ISBN: 978-984-94851-0-1

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ