শিশুবান্ধব স্কুল তোমোএ এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে একজন শিক্ষার্থীর স্মৃতিচারণামূলক আত্মকথন - জানালার ধারে তত্তচান : নুসরাত জাহান

শিশুবান্ধব স্কুল তোমোএ এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে একজন শিক্ষার্থীর স্মৃতিচারণামূলক আত্মকথন - জানালার ধারে তত্তচান- নুসরাত জাহান


'জানালার ধারে তত্তচান' গ্রন্থটি একটি বাল্য স্মৃতিমূলক আত্মকথন। যার মাধ্যমে জাপানি লেখিকা কুরোইয়ানাগি তেৎসুকো পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন তার শিক্ষাজীবনের শ্রেষ্ঠ স্কুল তোমোএ, তার প্রিয় শিক্ষক শিক্ষাবিদ কোবাইয়াশি সোসাকু এবং তার অভিনব শিক্ষাপদ্ধতি।

তেৎসুকো (ডাকনাম তত্তচান) ছিলেন স্বাধীনচেতা কৌতুহলী মেয়ে। যা ভাল লাগত তাই করতেন যা ইচ্ছে করত তা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করতেন। এসব একজন শিশুর স্বাভাবিক গুণাবলি হলেও প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান সেটা মানবে কেন! যেখানে তাদের কাজ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। অতএব প্রথম শ্রেণির প্রথম মাসেই তাকে স্কুল থেকে বহিস্কৃত হতে হয়। তার মা সহৃদয় মানসিকতার মানুষ ছিলেন। তিনি মেয়ের অপমান মেনে নেয় নি। মেয়ের মানসিকতায় যেন এর প্রভাব না পরে সেজন্য তিনি মেয়েকে জানতেও দেননি এ কথা। শুধু নিরবে মেয়ের জন্য খুজে বের করেছেন অন্যরকম একটি স্কুল। সেই স্কুলটি হল কোবাইয়াশি সোসাকু স্যারের অভিনব স্কুল 'তেমোএ'।

ছয়টি ট্রেনের বগী নিয়ে এ স্কুলটি তত্তচানকে তীব্রভাবে আকৃষ্ট করত। সে যেমন অদ্ভুত ও অসাধারণ, স্কুলটিও তেমন অদ্ভুত ও অসাধারণ। পড়াশুনা যে কতটা আনন্দদায়ক হতে পারে তা তত্তচান এসব ট্রেনের বগীর ক্লাসের মধ্যে খুজে পেত। কিন্তু যিনি তত্তচানের জীবনকে বদলে দেন পতন থেকে রক্ষা করেন, তিনি তোমোএ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক কোবাইয়াশি সোসাকু। তার পুনঃপুন বলা একটি লাইন

জানো, আসলেই তুমি ভাল মেয়ে


 -সেই ছোট্ট শিশুটির মানসিক বিকাশে যে কি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল লেখিকা বড় হয়ে তা খুব ভাল করেই অনুধাবন করেছেন।

কোবাইয়াশি স্যার বিশ্বাস করতেন জন্মের সময় প্রত্যেক শিশুর স্বভাব ভাল থাকে। বড় হতে হতে চারদিকের পরিবেশ ও বয়স্কদের প্রভাবে তা নষ্ট হয়ে যায়। তাই তিনি চেয়েছিলেন প্রতিটি শিশুর ভাল স্বভাব খুঁজে বের করে তার বিকাশ ঘটিয়ে তাদের ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষে পরিণত করতে। তার এই চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তোমোএ স্কুলে। শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন কার্যক্রমে বিভিন্ন ব্যতিক্রমি বিষয় সংযুক্ত করে শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতিকে করে তুলেছেন বৈচিত্র্যময় ও আকর্ষণীয়। যেমন ধারাবাহিকতা ছাড়াই যার যেটা খুশি সিলেবাসের সেই বিষয়ে পাঠ, পড়া ভাল হলে বাইরে পদব্রেজে ভ্রমণ, টিফিনে পাহাড় ও সাগরের খাবার গ্রহন, লাইব্রেরিতে বই পড়া, অন্যরকম খেলাধুলা, তালে তালে গান শেখা ইত্যাদি। কোবাইয়াশি স্যার এই কিন্ডারগার্টেনের নার্সারির শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বলতেন,

ছেলেমেয়েদের শিক্ষকের পরিকল্পনার মধ্যে বন্দী করো না। তাদের প্রকৃতির মধ্যে ছেড়ে দাও।    


গতানুগতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে যখন শিক্ষার্থীদের ঝকঝকে পোষাক পড়ে আসতে বলাহয় সেখানে তোমোএ-তে সবচেয়ে খারাপ পোষাকটি পড়ে আসতে বলা হত। স্কুলে সাঁতার দিঘিতে সাঁতার কাটা, গ্রীষ্মের ছুটিতে ক্যাম্পিং, গরম পানির কুন্ডতে ঘুরতে যাওয়া, মাঠে রান্না করা, ক্ষেতের শিক্ষকের কাছে চাষাবাদ শেখা, জীবজন্তুকে কষ্ট না দেওয়া, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো, খাওয়া শুরুর পূর্বে 'ইতাদাকিমাসু' বলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন -কী ছিল না তেমোএ নামের এ প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে। একজন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় প্রায় সকল বিষয় অন্তর্ভূক্ত এখানে। এই ছোট্ট শিশুগুলো বুঝতেও পারত না এসব আনন্দদায়ক কর্মকান্ডের মাধ্যনে তারা কখন নৈতিক, সামাজিক, আদর্শিক, বৈজ্ঞানিক, তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক সহ সুষ্ঠু মানসিকতার বিকাশে প্রয়োজনীয় সকল জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছিল।

অন্যরকম শিশুবান্ধব এ স্কুলটি খুব স্বল্প সময়ের জন্য টিকেছিল। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ১৯৪৫ সালের ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমার আঘাতে স্কুলটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সাথে প্রধান শিক্ষকের স্বপ্নও। তবে তিনি তো হাল ছাড়বার মানুষ নন। এই ধ্বংসস্তুপের মাঝে দাড়িয়েও তিনি তার ছেলেকে বলেছিলেন 'এরপর আমরা কেমন স্কুল তৈরি করব?' পরবর্তীতে তিনি এখানে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেও তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার আগেই তিনি না ফেরার দেশে পারি জমিয়েছেন।

বইটির ১১৫ পৃষ্ঠায়, স্কুলটির প্রাক্তন ছাত্র ও-ওএয় একটুও লজ্জাবোধ না করে নিঃসংকোচে  তার মাধ্যমিক না পড়ার কথা বলছিলেন তখন যেকজন ভাগ্যবান ব্যক্তি এই স্বল্প সময়ে তোমোএ-তে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল তাদের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অনুধাবন করা যায়। লেখিকাও পুনশ্চ অংশে যথার্থই বলেছেন

যদি এখনও তোমোএ স্কুল থাকত তাহলে আমার ধারনা স্কুলে যেতে চায় না এমন শিশু একজনও পাওয়া যেত না।



অবশ্য তেৎসুকোর জীবন গঠনে তার মায়ের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের প্রত্যেক অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষার্থীর একবার হলেও এই বইটি পড়া উচিত বলে আমার মনে হয়। তাহলে তারা অন্তত তাদের বর্তমান অবস্থান এবং শিশুর সুষ্ঠু এবং যথাযথ মানসিক বিকাশে তাদের করণীয় সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা লাভ করতে সক্ষম হবে।

জাপানি লেখিকা কর্তৃক লিখিত এ বইটির বাংলা অনুবাদ করেছেন হিরোকা কাসুইয়া। মূল জাপানি বইয়ের প্রচ্ছদ অবলম্বনে এই বইটিরও প্রচ্ছদ আঁকা হয়েছে। ডাকঘর প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত, ১২১পৃষ্ঠা সংবলিত এই বইটির বাজার মূল্য আশি টাকা।

 

 * "জানালার ধারে তত্তচান" বইয়ের আর একটি ভাষ্য পড়ুন এখানে- 

এক শিশুবান্ধব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্মৃতিচারণঃ ‘কুরোইয়ানাগি তেৎসুকো’ রচিত “জানালার ধারে তত্তচান”

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ