ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান সাহিত্য রচনার অবস্থা কেমন ছিল, তার তথ্যবহুল বিবরণ রয়েছে তপন চক্রবর্তী রচিত ব্রিটিশ ভারতে বাংলা বিজ্ঞানসাহিত্য বইয়ে। ব্রিটিশ আমলের প্রায় শুরু থেকে বিজ্ঞান বিষয়ে বই রচনা ও প্রকাশ করার কাজ শুরু হয়। ভারতীয় ও ব্রিটিশ পণ্ডিতগণ সকলে মিলে ভারতবর্ষে বিজ্ঞানশিক্ষা, বিজ্ঞানচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতাকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। রচনা করেছেন একের পর এক বিজ্ঞান বিষয়ক বই ও প্রবন্ধ। বইয়ের পাশাপাশি প্রকাশ করেছেন অনেকগুলো বিজ্ঞানবিষয়ক পত্রিকা। তৈরি করেছেন বিজ্ঞানচর্চার জন্য একাধিক সংগঠন।
বিজ্ঞান প্রসঙ্গ নিয়ে যে সাহিত্য রচিত তাকে বিজ্ঞানসাহিত্য বলা যেতে পারে। এর পরিসীমা ব্যাপক। লেখকের ভাষ্যে বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করা যাক।
ব্রিটিশ রাজত্বে বাংলায় বিজ্ঞানসাহিত্য রচনার ইতিহাস দু'শ বছরের অধিক। বিজ্ঞানসাহিত্য আলোচনার অনুষঙ্গ হিসেবে মৌলিক ও অনূদিত বিজ্ঞানসাহিত্য, বিজ্ঞান প্রচার-প্রসারে বিজ্ঞান বিষয়ক ও বিজ্ঞান সমর্থনকারী পত্র-পত্রিকা, প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ও রহস্যকাহিনি, বৈজ্ঞানিক পরিভাষা, ইত্যাদির ইতিহাসও জানা আবশ্যক। পৃষ্ঠা-১২
বইতে যে বিষয়গুলো লেখক আলোচনা করেছেন তার একটি রূপরেখা পাওয়া যায় সূচিপত্রে। তাই বিস্তৃত বিবরণে যাওয়ার আগে সূচিপত্রটি একবার দেখে নেয়া যাক।
প্রথম অধ্যায়: বিজ্ঞানসাহিত্য
দ্বিতীয় অধ্যায়: উনিশ শতক (১৮০০-১৯০০)
তৃতীয় অধ্যায়: বিশ শতক (১৯০০-১৯৫০)
চতুর্থ অধ্যায়: সাতটি সাময়িকীর উপর বিশেষ জরিপ (১৮৫০-১৯৫০)
পঞ্চম অধ্যায়: বিজ্ঞান মানসিকতা সৃজনে ও প্রচার-প্রসারে প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস
ষষ্ঠ অধ্যায়: ১৮০০-১৯০০ শতকে প্রকাশিত বিজ্ঞান বিষয়ক বাংলা সাময়িকী
সপ্তম অধ্যায়: বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য
অষ্টম অধ্যায়: বাংলা বিজ্ঞান পরিভাষা
প্রথম অধ্যায়ে বিজ্ঞানসাহিত্য বলতে কী বোঝায় তার উপর লেখক আলোকপাত করেছেন। পাশাপাশি জানিয়েছেন 'বিজ্ঞানসাহিত্যিক' কাদেরকে বলা যায়। তিনি মনে করেন বিজ্ঞানসাহিত্যের ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হতে হবে যেন তা সহজে বোঝা যায়। অনুবাদ করতে গেলে মূল অর্থের প্রতি নিষ্ঠ থেকেও যেন তার ভাষাভঙ্গী জটিল না হয়, সে বিষয়ের উপর লেখক জোর দিয়েছেন বেশি।
(সাহিত্যের ভাষার সহজবোধ্যতা প্রসঙ্গে পড়ুন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরামর্শ)
দ্বিতীয় অধ্যায় এর শিরোনামের পাশে স্পষ্ট করে সময়কাল উল্লেখ করা আছে। ১৮০০ থেকে ১৯০০ এই একশত বৎসরে যে মণীষীগণের হাতে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক বইপত্র রচিত হয়েছে তাদের কথা এই অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। বাঙালি লেখকগণের পাশাপাশি ইউরোপীয় লেখকগণও বিজ্ঞান সাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ছাপাখানার আবির্ভাব, ইউরোপে নিত্য নতুন বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি, প্রযুক্তির উদ্ভাবন, ইউরোপীয় রেনেসাঁস এর প্রভাবে বাঙালিদের চিন্তা-দর্শনের পরিবর্তন – এরকম বিষয়গুলো এই অধ্যায়ের প্রধান আলোচ্য।
এই অধ্যায় থেকে জানি বাংলাভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধিতে এবং বইপত্র রচনায় যে পণ্ডিতগণ এগিয়ে এসেছেন, তাঁদের কয়েকজন হলেন রাজা রামমোহন রায়, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, জে. বি. এস. হ্যালডেন, উইলিয়াম কেরি, গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য্য, লর্ড মিন্টো, উইলিয়াম হপকিন্স পিয়ার্স, পিটার ক্লেটন, রামকমল সেন, পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, রাধাকান্ত দেব, অক্ষয় কুমার দত্ত, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহামহোপাধ্যায় মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন ভট্টাচার্য্য, পূর্ণচন্দ্র মিত্র, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারিণীচরণ চ্যাটার্জী, রাধাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, জে হার্ল, কালীপ্রসন্ন গাঙ্গুলী, প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারী, ব্রজমোহন মল্লিক, কানাইলাল দে, প্রিয়নাথ সেন, আর. সি. মিত্র, শ্রীকালী দাস, লালমাধব মুখার্জী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, কালিদাস মৈত্র প্রমুখ। তাঁদের রচিত বইগুলোর বিষয় বহুবিচিত্র। ভূগোল, জোতির্বিদ্যা, গণিত, শরীরতত্ত্ব ও শরীরবিদ্যা, চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞান, রসায়ন, প্রাণীবিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, ঔষধ প্রস্তুতকরণবিদ্যা, খনি ও খননবিদ্যা প্রভৃতি। এসবের পাশাপাশি তাঁরা কেউ কেউ বাংলা ব্যাকরণ, অভিধান, নীতিকথা, সংস্কৃতি বিষয়ক বই রচনা করেছেন। স্কুল বুক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা ও বিভিন্ন বই প্রকাশে এই সংঘটনের ভূমিকার কথাও এই অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত সর্বমোট বইয়ের একটি তালিকা আলোচ্য অধ্যায়ে রয়েছে। তালিকাটি অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য প্রকাশ করা হল। পৃষ্ঠা-৪৪
১৮৭৫ সালে কলিকাতা বুক সোসাইটি প্রকাশিত বইয়ের তালিকা |
তৃতীয় অধ্যায়েও (বিশ শতক ১৯০০ ১৯৫০) আলোচিত হয়েছে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও তাদের রচিত বইয়ের বিবরণ। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদানন্দ রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মুহাম্মদ কুদরত-এ-খুদা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এই অধ্যায়ের আলোচ্য মণীষী। লেখখগণের ব্যক্তিগত পরিচিতির পাশাপাশি তাঁদের রচিত বইয়ের বিবরণ ও অন্যদের চোখে এই লেখকগণের আলোচনা সমালোচনাও সংযুক্ত হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আসে। এই বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই প্রণয়ন ও প্রকাশ করে। বাংলা পরিভাষা সৃষ্টির জন্য একই সালে গঠিত 'পরিভাষা কমিটি'র পরামর্শে ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকুলেশন স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য 'অঙ্কশাস্ত্র', ‘জ্যামিতি', ‘প্রাথমিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান', ‘শিক্ষা' বিষয়ে ৫০টির মত প্রকাশিত বইয়ের তালিকা আলোচনার এক পর্যায়ে যোগ করা হয়েছে।
চতুর্থ অধ্যায়ে মোট সাতটি সাময়িকী বা পত্রিকার উপর চালানো জরীপের ফলাফল বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর সময়কাল ১৮৫০ থেকে ১৯৫০। এগুলোর প্রতিটি সংখ্যায় বিজ্ঞান বিষয়ক একাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হত। জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, কৃষিবিজ্ঞান, ভূবিজ্ঞান, প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চা প্রভৃতি বিষয়ের উপরে পত্রিকাগুলো যেসব প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন সেগুলোর উপর আলোকপাত করা হয়েছে। প্রখ্যাত লেখকগণের লেখায় সমৃদ্ধ এই পত্রিকাগুলি বাংলাভাষী সমাজে বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব প্রকাশে ও বিজ্ঞান বিষয়ে মনোযোগ বৃদ্ধিতে যথেষ্ট কাজ করেছে। অধ্যায়ের শেষে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে বিষয়ভিত্তিক মোট প্রবন্ধের সংখ্যা নিয়ে একটি ছক ছাপানো হয়েছে। অধ্যায়ের শেষ অনুচ্ছেদে তপন চক্রবর্তী লিখেছেন-
উপরে আলোচিত সাতটি বিজ্ঞানবিষয়ক প্রতিনিধিত্বশীল সাময়িকীতে সর্বমোট ১৫৩৬টি প্রবন্ধ পত্রস্থ হয়েছে। প্রবন্ধগুলোর শ্রেণিবিন্যাস করলে বিজ্ঞান ৭৬৭টি ও প্রযুক্তি ৭৬৯টিতে দাঁড়ায়। নিচে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কোন শাখায় কতটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল তা সারণিতে দেখানো হল। পৃষ্ঠা - ৮৬
১৮৫০-১৯৫০ সালে প্রকাশিত বিজ্ঞান প্রবন্ধের তালিকা |
পঞ্চম অধ্যায়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞানমনস্কতা বিকাশে বিচিত্ররকম প্রচারকার্য চালিয়েছিল সেই সব সংগঠনের পরিচয় ও কার্যক্রম এই অধ্যায়ের প্রধান আলোচ্য। সমাজ উন্নয়নে বিজ্ঞানচিন্তা কতটা প্রয়োজনীয় তা তৎকালীন শিক্ষিত মানুষেরা বুঝতে পেরেছিলেন। সমাজে বিজ্ঞানচেতনার প্রসার হলে মানবজীবনে যে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়, সেই বিষয়ে তাঁরা সচেতন ছিলেন। তাঁদের পরিচালিত সংগঠনগুলো শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে ইতিহাস, বিজ্ঞান ও দর্শন বিষয়ক জ্ঞান বিস্তারে ব্রতী ছিল। পাশ্চাত্য জ্ঞানের আলোকে মানুষকে যুক্তিবাদী, সত্যসন্ধানী, কুসংস্কারমুক্ত হবার প্রেরণা দিয়েছিল। যে সংগঠনগুলোর নাম বইয়ের এই অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হল – আত্মীয় সভা, ইউনিটেরিয়ান সভা, সর্বতত্ত্বদীপিকা সভা, একাডেমিক এসোসিয়েশন, জ্ঞানোপার্জিকা সভা, তত্ত্ববোধিনী সভা, জাতীয় গৌরবসম্পাদনী সভা, হিন্দুমেলা, সঞ্জীবনী সভা, বিজ্ঞানসভা, সারস্বত, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ডন সোসাইটি, জাতীয় শিক্ষা পরিষদ এবং বসু বিজ্ঞান মন্দির।
ষষ্ঠ অধ্যায়ে ১৮০০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে বাংলা ভাষায় যে সব বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী প্রকাশ হয়েছিল সেগুলোর উপর আলোচনা করা হয়েছে। এই সময়কালে পঞ্চাশটির উপর পত্রিকা সমাজে বিজ্ঞানচেতনা বিকাশের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয়েছিল। চিকিৎসাবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, ভূগোল, ভূতত্ত্ব, নতুন আবিষ্কার বা প্রযুক্তি, উদ্ভিদবিজ্ঞান, রসায়ন, শিল্পকারখানা, বিজ্ঞানে নতুন অগ্রগতি, কুসংস্কারের স্বরূপ, প্রচলিত বিশ্বাস বা ধারণার অসারতা প্রভৃতি বিষয়ে পত্রিকাগুলো আলোচনা সমালোচনা প্রকাশ করত।
সপ্তম অধ্যায়টি বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার এক বিশেষ দিক নিয়ে রচিত। বিজ্ঞান কল্পকাহিনী বা Science Fiction এই অধ্যায়ের প্রধান আলোচ্য। লেখক অধ্যায়ের সূচনাংশে বলেন-
উনিশ শতকের শেষে, শিল্প বিপ্লবের সময়কালে বাংলায় প্রথম কল্পকাহিনি রচনার শুরু। এসময় মানুষ জীবনের স্বল্প পরিসর জীবনে প্রযুক্তির অভূতপূর্ব দ্রুত পরিবর্তন ও অগ্রগতি দেখেছে। বিজ্ঞানের দর্শনকে প্রয়োগ করাই হল প্রযুক্তি। পাশ্চাত্যে বিজ্ঞানের অভাবিতপূর্ব কর্মকাণ্ড এদেশের শিক্ষিত নাগরিকদের কাছেও রহস্যগল্প বলে মনে হত। পৃষ্ঠা- ১০৭
কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য রচনায় সেকালের বাঙালি সাহিত্যিকগণ সকলে আত্মনিয়োগ করেন নি। যে কয়েকজন কল্পবিজ্ঞান লেখকের নাম এই অধ্যায়ে পাই তাঁরা হলেন- অক্ষয়কুমার দত্ত, জগদানন্দ রায়, হেমলাল দত্ত, জগদীশচন্দ্র বসু, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এবং সুকুমার রায়। বাংলা ভাষায় প্রথম কে কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য রচনা করেন, সে বিষয়ের মতদ্বৈধতা লেখক উল্লেখ করেছেন।
অষ্টম অধ্যায়ে বিজ্ঞান সাহিত্য রচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক পরিভাষা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে মূল শব্দের অর্থ ঠিক রেখে পরিভাষা নির্ণয় বা রচনা করা দূরূহ কাজ সন্দেহ নেই। প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়াস ব্যতীত ব্যক্তি লেখকের দ্বারা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক শব্দের পরিভাষা রচনা করা ততোটা সহজ নয়। আবার তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে ভাষাও সমান তালে সময়ান্তরে পরিবর্তিত হয়। ফলে নতুন নতুন শব্দের সাহায্যে সাম্প্রতিক বিজ্ঞান প্রযুক্তির উপাদানগুলোকে প্রকাশ করতে হয়। সেজন্য বিজ্ঞান শব্দের পরিভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রসঙ্গক্রমে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী একটি পরামর্শ দিয়েছিলেন-
যে শব্দটি উচ্চারণ করিবে, তাহার যেন একটি নির্দিষ্ট বাঁধাবাঁধি, সীমাবদ্ধ, হেঁয়ালিত্বহীন অর্থ থাকে। একটি নির্দিষ্ট শব্দ একটি অর্থে ব্যবহার করিবে। সেই শব্দটি আর দ্বিতীয় অর্থ ব্যবহার করিবে না। এই হল বৈজ্ঞানিক পরিভাষার মূল সূত্র। পরিভাষা প্রণয়নে যদি অস্পষ্টতা থাকে তাহলে বিজ্ঞানের অগ্রগতি ব্যাহত হতে পারে। পৃষ্ঠা- ১১০
শ্রীরামপুর মিশন, কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটি, ভার্নাকুলার ট্রান্সলেশন সোসাইটি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় পরিভাষা সমিতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞান বিষয়ক শব্দের বাংলা পরিভাষা নির্বাচন ও রচনার কাজ করে। পাশাপাশি ডব্লু এস এটকিনসন্স, ডা. এল. সিবর, ডা. জে. এওয়ার্ট, ডা. এস. জি. চক্রবর্তী, ডা. ডি. বি. স্মিথ, খান বাহাদুর মৌলভী তমিজ খাঁ, বাবু রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রজনীকান্ত গুপ্ত, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, শারদারঞ্জন রায়, রামকমল ভট্টাচার্য, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনবিহারী গুপ্ত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অপূর্বচন্দ্র দত্ত, মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যোগেশচন্দ্র রায়, মণীন্দ্র সিংহদেব, কালিদাস মল্লিক, রাজশেখর বসু, প্রমথনাথ বিশী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে, বিভিন্ন সমিতি তৈরির মাধ্যমে এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগেও পরিভাষা সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত, নিয়ম, বিধি প্রধান করেছেন।
ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামলে বিজ্ঞানসাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশের ধারা বুঝতে 'তপন চক্রবর্তী' প্রণীত "ব্রিটিশ ভারতে বাংলা বিজ্ঞানসাহিত্য" বইটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরণের বই বাংলা ভাষায় বিরল। যারা ভারতবর্ষে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক রচনার ধারাবাহিক তথ্যমূলক ইতিহাস জানতে চান, এই বই তাদের নিকট প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হবে। লেখকের উপস্থাপনভঙ্গী গবেষণাধর্মী, ফলে তত্ত্ব ও তথ্যের মিথস্ক্রিয়া কোথাও বাহুল্য বলে বোধ হয় নি।
বইয়ের কয়েকটি জায়গায় তিনি এক প্রকারের মত দিয়েছেন যার কোন ব্যাখ্যা বইয়ের কোথাও পাওয়া গেল না। যেমন ৪৭ পৃষ্ঠার এক জায়গায় তিনি মন্তব্য করেছেন-
ভারতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্রিটিশের স্বার্থে বিজ্ঞান চালু করতে কোন বাধা ছিল না, তবে এখানে ভারতীয়দের কোন স্থান ছিল না।
এক পৃষ্ঠা পরের ৪৯ পৃষ্ঠায় তিনি জানান--
ব্রিটিশ ইউরোপীয় নব্যবিজ্ঞান ভারতবর্ষে তাদের স্বার্থে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রবর্তন করলেও সেখানে ভারতীয়দের প্রবেশাধিকার ছিল না।
আবার বইয়ের প্রথম ব্লার্বে লেখা আছে
ব্রিটিশ সরকার এদেশে সাহিত্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রচার প্রসার ঘটুক তা কখনো চায়নি। বিশেষ করে বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণা ও সাহিত্য রচনায় ওদের প্রতিবন্ধকতা ছিল বেশি।
এই বাক্যগুলোর স্বপক্ষে কোন উদাহরণ বা মতামত বা ব্যাখ্যা বাক্যস্থিত বা পরবর্তী অনুচ্ছেদ বা কোন পৃষ্ঠায় তিনি প্রদান করেন নি। বরং উপর্যুক্ত বাক্যগুলোর বিপরীত উদাহরণ বইয়ের পাতায় পাতায় জাজ্বল্যমান হয়ে রয়েছে। এই বাক্যগুলো তিনি কেন লিখেছেন, কোন অবস্থান থেকে ভেবেছেন, তার কোন ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ বইয়ের ভূমিকা অথবা অন্য কোথাও দেন নি।
বইয়ের ভূমিকার ভাষ্যমতে বইপ্রকাশকাল ২০১৪ সালের পাঁচ/ ছয় বৎসর পূর্বে বাংলা একাডেমি 'বাংলা -ও বাঙ্গালি' নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। সেই প্রকল্পে প্রকাশের জন্য লেখককে 'ব্রিটিশ ভারতে বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যের ইতিহাস' বিষয়ক একটি বই লিখতে আহ্বান করা হয়েছিল। লেখক সময়মতো বই রচনার কাজ শেষ করলেও অজানা কারণে বাংলা একাডেমি বইটি আর প্রকাশ করেনি। পরে সুখ্যাত প্রকাশনী সংস্থা 'গ্রন্থ কুটির' এই বই প্রকাশের দায়িত্ব নেয়। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করে গ্রন্থ কুটির প্রকাশনী বেশ ভাল কাজ করেছে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানসাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস জানতে আগ্রহী পাঠক এই বই পড়ে উপকৃত হবে। মোটা অফসেট কাগজে বোর্ড বাঁধাই হওয়ায় বইটি দীর্ঘস্থায়ী হবে। বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে পড়বে না। দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ অঙ্কনের জন্য ধ্রুব এষ এর প্রশংসা করতেই হয়। বিজ্ঞানসচেতন পাঠকের নিকট বইটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হিসেবে বিবেচিত হবে।
#_#_#_#_#_#
ব্রিটিশ ভারতে বাংলা বিজ্ঞানসাহিত্য
তপন চক্রবর্তী
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশকাল: ২০১৪
প্রকাশনী: গ্রন্থ কুটির, ঢাকা।
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১১৮
মূল্য: ১৪০ টাকা
ISBN: 978-984-91232-5-5
-:-:-:-:-:-:-
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম