হালকা সাদা ক্রিম কালারের কভারের উপর রক্ত লাল রঙে লেখা "দেয়াল"। আবার তিন দিকে মাঝামাঝি টকটকে লাল রং, যেন ছোপ ছোপ তাজা রক্ত লেগে আছে। বলছি নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের সর্বশেষ রচিত উপন্যাস দেয়াল এর কথা। উপন্যাস মানে বিভিন্ন কাল্পনিক চরিত্র এবং ঘটনার উপস্থাপনা। এর সাথে বাস্তব ইতিহাসের সংযোগ ঘটানো অনেক কঠিন কাজ। কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ তার 'দেয়াল' উপন্যাসে এই দুইয়ের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে অত্যন্ত নিপুণতার পরিচয় দিয়েছেন। গল্পে গল্পে এদেশে স্বাধীনতা পরবর্তীকালীন ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে বইটিতে।
ভাদ্র মাসের সন্ধ্যা। আকাশে মেঘ আছে। লালচে রঙ্গের মেঘ। যে মেঘে বৃষ্টি হয় না, তবে দেখায় অপূর্ব। এই গাঢ় লাল, এই হালকা হলুদ, আবার চোখের নিমিষে লালের সঙ্গে খয়েরি মিশে সম্পূর্ণ অন্য রঙ। রঙের খেলা যিনি খেলছেন মনে হয় তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।
- এভাবেই সূচনা ঘটেছে হুমায়ূন আহমেদের চার দশকের বর্ণময় লেখকজীবনের শেষ উপন্যাস 'দেয়াল' এর। সূচনা অনুচ্ছেদে আকাশের রঙবদলের খেলায় যে সিদ্ধান্তহীনতার কথা বলা হয়েছে তা বিশেষ ইঙ্গিতবহ। একটি সদ্যস্বাধীন জাতির চরম অনিশ্চতার কাল উপন্যাসটির উপজীব্য।
বইটিতে দুটি আখ্যান সমান্তরালে চলছে। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্মকর্তা সফররাজ খান, তার নাতনি প্রথাবিরোধী মেয়ে অবন্তী এবং গৃহশিক্ষক শফিককে নিয়ে ঘটনার শুরু। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধ, দাদা-নাতনির গ্রামে পলায়ন, পীরের বাড়িতে আশ্রয়গ্রহণ এবং ঘটনাচক্রে পীরের ছেলের সাথে অবন্তীর বিয়ে। যদিও সে ওই বিয়ে প্রত্যাখ্যান করে ঢাকায় চলে আসে। আবার স্বামী হিসেবে পীরপুত্রকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে নিজের পরিপূর্ণ মানসিকতার পরিচয় দেয়।
সফররাজ খানের পুত্রের বন্ধুদের একজন মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফের এ বাড়ীতে আসা-যাওয়া আছে। সেই সুত্রে কর্ণেল তাহের। এভাবেই দুই আখ্যানের যোগ সাধিত হয়।
দ্বিতীয় আখ্যানটিতে বঙ্গবন্ধুর হত্যা পরিকল্পনা, পরিকল্পনায় সাফল্য খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা লাভ, খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থান, কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যা, কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী জনতার বিপ্লব, জিয়াউর রহমানের মুক্তিলাভ ও ক্ষমতাগ্রহণ, খালেদ মোশারফ ও কর্ণেল হুদার হত্যা, তাহেরের ফাঁসি এবং জিয়া হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে ঘটে এর সমাপ্তি। বঙ্গবন্ধুর শাসনামল, বাকশাল, কাদেরিয়া বাহিনী, জিয়াউর রহমানের শাসনামল এসবই খুব সাবলীল ভাষায় লেখকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে উপন্যাসটিতে। এসবের বর্ণনা দিতে দিতেই লেখক বলেন,
যে লাঠি দিয়ে অন্ধ মানুষ পথচলে, সেই লাঠি দিয়ে মানুষও খুন করা যায়।
আবার অনেকটা আক্ষেপ করেই বলেন
মানবজাতির স্বভাব হচ্ছে সে সত্যের চেয়ে মিথ্যার আশ্রয়ে নিজেকে নিরাপদ মনে করে।
উপন্যাসটির শুরুতে গৃহশিক্ষক শফিককে একটি ভীতু চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাকে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়।
হুমায়ূন আহমেদের বইয়ে চমক কিংবা খামখেয়ালি চরিত্র থাকবেনা তা কি কখনও হয়? বরাবরের মতো এখানেও তিনি মাঝে মাঝে চমক সৃষ্টি করেছেন এবং কাল্পনিক চরিত্র দাঁড় করিয়েছেন যা পাঠকের আগ্রহকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
লেখক বইটির একাংশে নিজের ও পরিবারের সাথে উপন্যাসের সম্পৃক্ততা উল্লেখ করেন এবং ঘটনাপ্রবাহ চলমান রাখেন। প্রথম পুরুষের ভাষায় শুরু করলেও পরবর্তীতে উত্তম পুরুষের ভাষায় উপন্যাসটির সমাপ্তি ঘটান তিনি।
সর্বোপরি ইতিহাসের সত্য আর লেখকের সৃজনী ভাবনা -দুইয়ের মিলে 'দেয়াল' পরিণত হয়েছে একটি হৃদয়গ্রাহী উপাখ্যানে। যা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সত্য ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে পাঠককে ধারণা দিতে সক্ষম।
অন্যপ্রকাশ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইটির প্রচ্ছদ করেছেন মাসুম রহমান। লেখকের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হওয়ায় ভূমিকা লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ১৯৮ পৃষ্ঠার বইটির বাজারমূল্য ৩৮০টাকা মাত্র। বইটি প্রকাশ করেছেন মাজহারুল ইসলাম। প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০১৩।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম