‘দেহের আড়ালে থাকে প্রকৃত স্বজন’ আহমেদ মওদুদের ৪৩টি কবিতার সংকলন। এখানে আছে কবিতারা, হাতে হাত ধরে। বিচ্ছিন্ন ভিন্ন ভিন্ন কবিতারা একে একে কথা বলে একক নামকরণে, তবু তাদের আড়ালে অন্তরালে অন্তঃসলিলা সত্তা অভিন্ন কোনও এক বা একাধিক ‘অনুভব’ ধারণ করে আছে।
সংকলনের নামকরণটিও অসাধারণ; সাজ-গোজ-উপস্থাপনা শৈলী, পোজ-পাজ, কথার ভাঁজ সব কিছুতেই বিছিয়ে রাখা হয়েছে ধাঁধালো চাদর। চাদরের আড়ালে আছে প্রকৃত নায়ক।
বড়ো কবি হওয়ার ইঙ্গিতবাহী যারা, তারা বড়ো কবিদেরই একটি বৈশিষ্ট্য কৈশোরে-যৌবনে উপহার দিয়ে যাবেন। সেই বৈশিষ্টের সারাৎসার এক কথায় Appearance and Reality।
শাণিত শর নিক্ষেপে পারঙ্গম কবি আহমেদ মওদুদ।
দেহ হচ্ছে Appearance, Reality’’র বাংলা অনুবাদ ‘প্রকৃত স্বজন’। শিল্প-চাতুর্য্যের চাক-চিক্যে চিকুর জালে, মোহাচ্ছন্ন ধোঁয়াশাপূর্ণ আবহ নির্মাণে পাকা কবিরা হাত পাকিয়ে থাকেন। আড়ালে লুকিয়ে হাসে আসল সুরুজ। ভাব দেখানো হয়, শিল্প নয় যাদু নয়-কারুকর্ম নয়! আসলে অনেক শিল্প, বহু ছলা কলা।
Art Consists in Concealing art
পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০ এর গদ্যকায় কবিতা ‘ক্ষত’ ছায়া সুনিবিড় দেশ, প্রজাপতি, প্রিয়তম আকাশ-এমন সব পরিচিত ও রোমাঞ্চ সমর্পিত দৃশ্যকল্পের আড়ালে খবর দিচ্ছে এক অমিমাংসিত দুষ্ট কীটের, যে কীট স্বাধীনতার এতো বছর পরেও ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে আমাদের দেশের এই ভূমিদেহে। অথচ পরিকল্পকগণ ক্ষমতারুঢ় হন এবং প্রমোদে ঢালিয়া দেন মন।
দারুণ ধুরন্ধর, শৈল্পিক, কুশলী স্ট্রাইকার এই কবি আহমেদ মওদুদ। কথার ফুটবল নিয়ে এঁকে বেকে ত্বরিতে চলেন ছুটে এ-উইং থেকে সে-উইং। হঠাৎ করে বল বাম পায়ে, ডি বক্সের কাছে!এবং নির্ঘাত গোল।
কবিতায় গানে ঈশ্বর খোঁজা-এ এক চিরাচরিত প্রথা। এ কাজ হরহামেশাই করেছেন লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ। আহমেদ মওদুদও করেছেন, তবে আরো বেশি আড়ালে আবডালে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৩-এর কবিতার তিনি যা বলেন তা হলো; মানুষ আসলে নিজেকেই খোঁজে, ঈশ্বরকে নয়। যুক্তিটা হচ্ছে; ঈশ্বর তো অসীম, ধরা-ছোয়া-দেখাদেখির উর্ধে। এই কবিতাটির নাম আয়না।
একজন সুধী মানুষ সোহরাব দুলাল। তাকে সম্বর্ধনা জানাচ্ছেন কবি আহমেদ মওদুদ। সম্বর্ধনার ভাষা ব্যতিক্রমী। সোহরাব দুলালকে তিনি অভিহিত করেছেন ‘প্রতিনিধি’। বলেছেন, সোহরাব দুলালরা আছেন বলেই ‘পৃথিবী সুরক্ষা পায়’। সাধারণ নয় অসাধারণ পথের পথিক এই সোহরাব দুলালকে সাধারণ্যে বিবেচনা করা হয় ‘বে-পথু’ বলে। কবি আহমেদ মওদুদ প্রত্যয়ী প্রণোদনায় এই বেপথুকে ধন্য মানেন। তিনি বলেন, সোহরাব দুলালরা ব্যতিক্রমী ধারায় পথ-চলা জানেন বলেই এবং পথে চলেন বলেই পথগুলো সব পূণ্য, পথগুলো সব ধন্য।
আহমদ মওদুদ গুণবর্ণনায় ঈর্ষাতুর। তিনি নন সোহরাব দুলালদের মতো জ্ঞান-পিপাসুদের জ্ঞানর্জনের ভারে হিংসাতুর। উল্টো, এদেরই বিরল বৈশিষ্ট্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তিনি।
‘১৭’ সংখ্যক পৃষ্ঠার কবিতা ‘ফলাফল’। এই কবিতাটি আছে এক কঙ্কাবতী আপাতঃভঙ্গিমায় দেহবতী নারী, কিন্তু আড়ালে অন্য এক আয়তন আছে তার। সে আয়তন চুয়ান্ন হাজার বর্গমাইল। এই আয়তন বিশিষ্ট উপাদানটি কোন পথে যায়, বুঝা যায় না। এর গন্তব্য কি মার্কিনপন্থী গ্লোবাইজেশান, না-কি অন্য কিছু। প্রশ্নটি ভয়ংকর অথচ তাৎপর্যপূর্ণ।
আত্মশক্তি ও আত্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ এই কথাগুলো। উষ্মেষকালে যিনি ছিলেন নামহীন গোত্রহীন, ব্যবহার করতেন নিত্য নতুন ছদ্মনাম, বছর শেষে অর্থাৎ ক্যারিয়ার পরিক্রমা শেষে তিনিই হয়ে ওঠেন যথার্থ, অন্যরাই নামহীন গোত্রহীন। কল্যাণ মিত্রের ‘সাজানো বাগান’ নাটকে এরকম বিবর্তনশীলতা আছে। জীবন মানেই নাটক, জীবন মানেই পরিবর্তন এবং উত্তরণ। সেই সাথে অন্য অনেকের অপসারণ। নষ্টালজিয়া তো রোমান্টিকতা। স্মৃতিকাতরতাও কাতরতা বটে, যা কিছু কাতরতা তার সবই অতীত- আর্তি, বর্তমান ভুলে যাওয়ার চেষ্টা, আত্মপ্রবঞ্চনা এবং পলায়নপরতা। রোমান্টিক যুগের কবি কীটস্ ও কোলরিজ এই প্রকার রোমান্টিকতার রোগী ছিলেন। স্নিগ্ধতা দিয়ে তারা কেড়ে নিয়েছেন হাতের অস্ত্র; যা কিছু শাণিত, প্রাণিত যাদের বলা হতো ত্রিশোত্তর, তাদেরই বলা হয়েছে চল্লিশোত্তর এবং পঞ্চাশোত্তর এবং...। ওরা বাংলা কবিতায় প্রথম পর্বের পাচ-ছয় বা আট-দশ জন পান্ডব কিংবা রাম-লক্ষণ ছাড়া আর সবাই খেলা খেলে চলেছেন শব্দের বাক-প্রতিমা, চিত্রকল্প উৎপ্রেক্ষা উপমা যে একই বালিশ এদিক থেকে সেদিকে পাচার করা। নতুন কি দর্শন দিয়েছেন তারা? এই প্রশ্ন এসেছে কবিতাটিতে। প্রশ্নটি যথার্থ। শাণিত শর নিক্ষেপে পারঙ্গম কবি আহমেদ মুওদুদ। তার কবিতা, সে গদ্যকবিতা পদ্যকবিতা যা-ই হোক শক্তিমান ব্যাঙ্গ, ধারালো Banter এগুলোকে বলা যাবে।
স্পষ্টবাদ এই কবিতায়‘গান’ এর সামনে ‘মহান’ বিশেষণ ব্যবহার করে বুঝানো হয়েছে যে এগুলো আর নিরেট নিখাদ‘গান নয়, মূলত স্ততিবাদ। ব্যাক্তি স্তবকতায় টইটুম্বুর এবং বিবমিষা উদ্রেককারী এসব গান সেই বিশেষ কারণেই ‘মহান’। বিপন্ন জনতার বক্তব্য ও দাবী অবলম্বনে রচিত কবিতা গুলোকে যর্থাথ ভাবেই বলা উচিৎ স্লোগান’। যে কবি গান স্লোগানের মিথস্ক্রিয়া ঘটাতে জানেন, তিনিই প্রকৃত কবি, বলেছেন আহমেদ মওদুদ।
সমূহ শিশুর কাছে এ আমার অকৃতজ্ঞ দাবি
লাইনটি ‘নবজাতকের কাছে এ আমার দূঢ় অঙ্গীকার’ এর মতো শোনালেও গৃঢ় বিশ্লেষণে ‘মাদার’ কবিতাটি গতানুগতিকতা তথা বৃত্তবন্দিত্ব থেকে বহুদূর বাইরে। কম্পিউটারের পরিভাষায় ‘মাদার’ এর একটি আলাদা অর্থ আছে; সেই মাদার সব ট্রু-কপি-র প্রমূর্তি। আহমেদ মওদুদ এরকম ট্রু কপি কবিতার মৃত্যুগীত গেয়েছেন। পরবর্তী কবিতাটি (প্রকৃত কবির নাম উহ্য থাক) ‘মাদার’ কবিতাটিরই পরিণত রুপ।
বেশ ক’টি কবিতায় বৃত্ত-ভাঙার অঙ্গীকার করেছেন আহমেদ মওদুদ। বৃত্ত উদ্দেশ্য করে বলেছেন,
আজ বুঝি আমি তার কবি নই মোটে।
প্রাচ্য-প্রতীচ্য নিয়ে ইংরেজ নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক Rudyard Kipling এর যে কথা, ওদের অর্থাৎ বিত্তবানদের সাথে বিত্তহীনদের সম্পর্ক প্রসংগে আহমেদ মওদুদেরও সেই কথা,
পঠিত সকল পথ অপঠিত তোমাদের বাড়ি।
Rudyard Kipling বলেছিলেন, ‘East is East, West is west, the two can never meet’।
গদ্য কবিতার পাশাপাশি অক্ষরবৃত্তে বেশ কয়েকটি কবিতা রয়েছে কবিতা গ্রন্থটিতে যেগুলো সুস্বাদু, বিশেষত Biological উপাদান ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যরূপে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে। এই Biological বৈশিষ্টের আড়ালে কবিতাগুলোর মজ্জায় সুচারুরূপে মিশানো বাউল ব্রহ্মা-তত্ত্ব এ কারণে গদ্য কবিতাগুলো ও অক্ষরবৃত্ত পদ্যগুলো ভিন্ন রুচি ও বক্তব্যে মেরুকরণিত। এর ফলে সাজুয্যপনা হার মেনেছে কুশলীপনার কাছে। তারপরেও সত্য এই যে, আহমেদ মওদুদের আগমন নবঘনশ্যামসম সরব ও সুন্দর। বইটির প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি-২০০৯, বইটি প্রকাশ করেছে মাটিয়াল, প্রচ্ছদ করেছেন মনজুরুল আহসান, মূল্য-৫০ টাকা।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম