অনেক বছর পর আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী কিনলাম। কত বছর মনে নেই। এক সময় লাগাতার পড়ার পরেও হতাশা আসছিলো বলে কেনা বন্ধ করেছিলাম। আমাদের শৈশব কেটেছে গত শতাব্দীর আশি ও নব্বই দশকে। আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীতে তখন উপন্যাসে বিমল করের কিকিরা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু, সমরেশ মজুমদারের অর্জুন, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের পাণ্ডব গোয়েন্দা। এর সঙ্গে মতি নন্দীর খেলা নিয়ে অসাধারণ উপন্যাস। আর শৈলেন ঘোষের অনবদ্য রূপকথা। এছাড়াও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পেতাম বুদ্ধদেব গুহর ঋজুদা আর সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মামা সিরিজ। এর সঙ্গে সত্যজিৎ রায়, দুলেন্দ্র ভৌমিক, দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। গল্পের কথা তো বাদই দিলাম। এছাড়াও অনেক অনেক ফিচার। সেই শৈশব ছিলো সত্যিই রূপকথার মতো। সেই বইগুলো পড়তে এখনও ভালো লাগে।
মাঝখানের সংখ্যাগুলো ভেতরে এই সব চরিত্রের অনেক কিছু থাকলেও মন ভরছিলো না। নতুন কিছু প্রাপ্তির আশাতে নয় ছোটোবেলাকে ফিরে দেখার জন্যই এত বছর পর আবার আনন্দমেলা নিলাম। এই বছরেও সাতটা উপন্যাস। কালের নিয়মে লেখক সূচীও প্রায় অনেকটাই বদলে গেছে। সাতটা উপন্যাস নিয়ে কয়েকটা কথা বলি।
১/ আশুবাবুর টেলিস্কোপ — শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
এই উপন্যাসটা একদম শেষে ছাপা হয়েছে। আমি আলোচনার প্রথমেই রাখলাম। ছোটোবেলা থেকে শীর্ষেন্দুবাবুর লেখা ছিলো আনন্দমেলার অন্যতম আকর্ষণ। চক্রপুরের চক্করে, কুঞ্জপুরের কাণ্ড, ঝিলের ধারে বাড়ি, বিপিনবাবুর বিপদ, পাতালঘর, নবীগঞ্জের দৈত্য ইত্যাদি আমরা পূজাবার্ষিকীতেই পড়েছি। আমরা আগেই জানতাম তাঁর উপন্যাসে কী ধরণের চরিত্রদের সঙ্গে মুখোমুখি হতে হবে। সেই চরিত্রগুলো খুব পছন্দের ছিলো। এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করতাম। এবারেও যেনো ছোটোবেলার সেই চরিত্রগুলোই খুঁজে পেলাম। এদের সবার দেখা আগে কোনো না কোনো উপন্যাসের মধ্যে পেয়েছি। বেশ ভালো লাগছিলো। টানটান গতি থাকলেও কিন্তু শেষটা দুম করে হয়ে গেলো। তাই শেষ মুহূর্তে এসে ভালো লাগার একটা ছন্দপতন হয়েই গেলো। তবে এই গল্পে বড় বেশী ‘পাতালঘর’ খুঁজে পেলাম।
২/ নিঃসঙ্গ প্রহরী — স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা ছবিতে ফেলুদা ক্লাইম্যাক্সের দিকে এগিয়ে যাবার পথে একবার লালমোহন বাবুকে কোনো প্রশ্ন করতে বারণ করেছিলেন। তারপরেই লালমোহন বাবুর চোখের সামনে এমন সব দুঃসাহসিক ক্রিয়াকলাপ হতে থাকলো যে তিনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও বলতে থাকলেন “কোনো প্রশ্ন নয়। কোনো প্রশ্ন নয়।” এই উপন্যাস পড়ার সময় এই কথাটা মাথায় রাখতে হবে। উপন্যাস পড়ে যেতে হবে আগাপাশতলা কমার্শিয়াল হিন্দি ছবি দেখার মতো। এটা কেমন করে সম্ভব ? ওটা কি করে হলো ? পা ভাঙার পরেই প্লাস্টার করে এত দেশ বিদেশে অভিযান কি সম্ভব ? এই জাতীয় প্রশ্ন দূরে সরিয়ে দিতে হবে যেমনটা আমরা পাণ্ডব গোয়েন্দা পড়ার সময় দিতাম। পড়ার সময় মনে রাখতে হবে লেখক যা লিখেছেন সবই সম্ভব। তাহলে এই উপন্যাস ভালো লেগে যাবে। এইভাবে আমারও ভীষণ ভালো লেগে গেলো। ভালো লেগে গেলো কূষাণকে।
৩/ রেড ভেলভেট রহস্য — দেবারতি বন্দ্যোপাধ্যায়
এই উপন্যাসের ক্ষেত্রেও সোনার কেল্লা ছবির একটা সংলাপ ধার করতে হবে। মুকুলের বিষয়ে বলতে গিয়ে ফেলুদাকে নকল হাজরা রূপী ভবানন্দ বলেছিলো, “কখন যে এই জন্মে থাকে আর কখন যে আগের জন্মে চলে যায় তা কিছুই বুঝতে পারি না।” এই উপন্যাসটার ব্যাপারস্যাপার অনেকটা সেই রকমই। পটভূমি এসেক্সে। শুরু হয়েছে ১৭৯৬। এসেছে ফ্রান্সিস স্লেটার রেবো, ওয়েলেসলি, স্বয়ং নেপোলিয়ান। আর বর্তমান সময়ে এসেছে বাণী, বহ্নি, জন, সোফি ব্রাউন। বর্তমান সময়ের এর মধ্যে ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে যায় ইতিহাস। এই ২০২১ তো এই ১৮১২, ১৮২৩, ১৮৩৪, ১৮৩৫ ,১৮৩৬, ১৮৪২। কখন যে বর্তমানে থাকে আর কখন যে অতীতে ঢুকে যায় তা বোঝা বড় মুসকিল। ঘটনা একটা বাড়ি নিয়ে। উইভেনহো পার্ক৷ প্রথম কয়েক পাতা পড়তে অনেক সময় লেগেছে। প্রতি লাইন কয়েকবার করে পড়েও ভালো বুঝিনি। এটা হয়তো আমার অক্ষমতা। এত বর্ণনা সত্ত্বেও বাড়ি ও তার পরিবেশ চোখের সামনে ফুটে ওঠেনি। ঠিক যেমন চরত্র হয়ে উঠতে পারেনি দুটো ওক গাছ। ফ্রান্সিস স্লেটারের বংশধরেরা ১৭৫ বছর ধরে যার পাঠ উদ্ধার করতে পারেনি তা বেড়াতে গিয়ে খুব অল্প সময়ের করে দেখিয়ে দিলো শান্তিনিকেতনের ছাত্রী। সত্যিই দুর্দান্ত কেমিস্ট্রি। ভিক্টরের চরিত্র গল্পে আসার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেলো ভবিষ্যতে এর বংশধর আসবে। এলোও তাই। আর যাকে ভাবা হচ্ছিলো সেই হলো। এত কিছু নিয়ে গল্প শেষ হলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। পুরো পথটুকু পাঠ করে পেরোতে যা কষ্ট হয়েছে তার দশভাগ সমস্যাও বোধহয় হয়নি বহ্নির রহস্য সমাধানে পৌঁছতে৷ সত্যি বলতে কি ইংরেজি সাহিত্যের কোনো অসাধারণ থ্রিলারের খুব দুর্বল অনুবাদ পড়লে যেমন খাপছাড়া লাগে আমার অনেকটা তেমনই লেগেছে।
৪/ ফ্লাইট ৩৭৭ — কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়
ভীষণভাবে মন ছুঁয়ে গেলো। কল্পবিজ্ঞান। দারুণ লাগলো। একটা বিমান ছিলতাই নিয়ে ঘটনা। ছিনতাই বিমান নিয়ে অনেক লেখা আর চলচ্চিত্র হয়েছে৷ কিন্তু এখানে ভাবনাটাই আলাদা। বিমানের ঘটনা খুব সামান্য। কিন্তু বিমানে ওঠার আগে পর্যন্ত গল্পের খুব মজবুত নির্মাণ আছে। অনাথ আশ্রম আনন্দধারার ছোটো ছোটো বাচ্চারা উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ভীষণ ভালো লাগে রহস্যময় বাচ্চা মেয়ে পুণ্যিকে এই উপন্যাস নিয়ে কিছু বলার নেই। পড়লেই বোঝা যাবে আসল মজা। সবগুলো চরিত্রকেই ভালো লাগলো। অন্যতম সেরা উপন্যাস এটা৷
৫/ পাহাড়ে রহস্যের মেঘ — সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়
অনবদ্য। ভীষণ ভালো লাগলো। লেখক প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যুক্তি দিয়ে পাঠককে আটকে রেখেছেন। ঝিনুক আর দীপকাকুর রহস্য অভিযান। পটভূমি দার্জিলিং। লেখকের লেখনশৈলী নিয়ে বলার কিছু নেই। সেই শৈলীর কাছে অপরাধির সঙ্গে পাঠকও কিস্তিমাত। গল্পে মনাস্ট্রির চিত্র ভীষণভাবে ফুটে উঠেছে লেখকের কলমে।
৬/ প্রফেসর রবিনের গুপ্তসমাধি — রাজেশ বসু
লেখকের লেখা প্রথম পড়ছি। এখানেও “কোনো প্রশ্ন নয়” মানসিকতা নিয়ে পড়ে যেতে হবে। যুক্তি খুঁজলে হবে না। ধরে নিচ্ছি ঘটে যাওয়া সব ঘটনাই সম্ভব। তাহলে এই উপন্যাস ভালো লাগার কথা। আমার অন্তত ভালো লেগেছে।
৭/ উড়ন্ত মানুষ — সুস্মিতা নাথ
আনন্দমেলার বিজ্ঞাপনে এই উপন্যাসটার নাম দেখেই বইটা কিনেছি। আর প্রথম এটাই পড়েছি৷ লেখাটা নিয়ে প্রত্যাশা ছিলো তুঙ্গে। বলতে হবে প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ হয়েছে। লেখিকা চমৎকার গল্প বলেছেন। এটাও কল্পবিজ্ঞান। মূল চরিত্র অন্তুকে ভালো না বেসে উপায় নেই। সিনেমাতে যেমন কিছু কিছু কিছু চরিত্রের আবির্ভাব হলেই দর্শকেরা আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে তেমন অন্তু এলেই মনটা খুশিতে ভরে উঠেছে৷ প্লটে একটা বৈচিত্রতা আছে যেটা পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে ধরে রাখে। অন্তুকে এতটাই ভালো লেগে গেলো যে ওকে আবার অন্য উপন্যাসে দেখতে ইচ্ছে করছে। অন্তুকে নিয়ে সিরিজ হলে খুব ভালো হয়। এই প্রত্যাশা থেকেই গেলো।
অবশেষে দাঁড়ালো সবগুলো উপন্যাসই এডভেঞ্চারাস। তারমধ্যে তিনটে উপন্যাসের পটভূমি ভারতবর্ষের বাইরে। বাকি চারটে দেশের মধ্যে। এর মধ্যে নিঃসঙ্গ প্রহরী, রেড ভেলভেট রহস্য, ফ্লাইট ৩৭৭, পাহাড়ে রহস্যের মেঘ, প্রফেসর রবিনের সমাধি পুরোপুরি থ্রিলার। আশুবাবুর টেলিস্কোপ আর উড়ন্ত মানুষও ভীষণ রহস্যময়।
খেলা, রূপকথা বা সামাজিক উপন্যাস নেই। থাকা উচিৎ ছিলো। এই সব না থাকায় বইটাকে থ্রিলার সংকলন বললে খুব একটা ভুল হবে না। এই বছর ছিলো না ফেরারি, বুড়ো ঘোড়া, সোনাঝরা গল্পের ইনকা, বন সবুজের দ্বীপে, গৌড় নিতাই, রাবণবধ, শিউলির মতো সামাজিক উপন্যাস তবুও ভীষণ ভালো লাগলো পড়তে। সবচেয়ে বড় কথা সেই নব্বই দশকে ছোটোবেলার ফ্লেভারই যেনো পেয়ে গেলাম। অর্থাৎ এত বছর পর আনন্দমেলা আমার প্রত্যাশা পূরণ করেছে।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম