একটা দেশ যেভাবে দাঁড়ায় - রউফুল আলম

একটা দেশ যেভাবে দাঁড়ায় - রউফুল আলম


যে অল্প কয়েকটি পথ ধরে একটা দেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যায়, তার মধ্যে প্রধান হল শিক্ষা। একবিংশ শতকে বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দরকার নতুন উদ্ভাবন। আর নতুন চিন্তা, নতুন গবেষণা করতে সক্ষম মানবসম্পদ ছাড়া এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। নতুন সময়ের উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়া মানসম্পন্ন জাতি তৈরি দূরাশা মাত্র। আর তাই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অর্থবহ পরিবর্তন চান রসায়নবিজ্ঞানী রউফুল আলম। সেই অর্থবহ পরিবর্তন বলতে তিনি যা বোঝেন, শিক্ষা কাঠামোর যে সব দিকে ঘষামাজা করা দরকার, মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন, সেই সব দিক নিয়ে তাঁর বই 'একটা দেশ যেভাবে দাঁড়ায়'

দারিদ্র্য মানুষের বড় হওয়ার পথে অন্তরায়, তবে একমাত্র বাধা নয়।
লেখকের প্রধান চিন্তা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে। তিনি নিজে বিদেশে থাকেন। উন্নত দেশের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রসায়ন নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার কারণে তিনি জানেন একটা দেশের এগিয়ে যাওয়ার পিছনে কোন অনুঘটকগুলো কাজ করে। অভিজ্ঞতার নিরিখে অগ্রসর দেশ ও সমাজের উন্নয়ন চিন্তার আলোকে বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করেন। আর তাই, দুই তিন পাতার ছোট ছোট প্রবন্ধে পরামর্শ দিয়েছেন। এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করে রচনা করেছেন ষাটটির বেশি প্রবন্ধ। জানিয়েছেন পরিবর্তনযোগ্য সামাজিক পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক।

আরো আলোচনায় যাওয়ার আগে সূচিপত্রের কয়েকটি শিরোনাম দেখা যেতে পারে। আগেই জানিয়েছি ষাটটির বেশি রচনা রয়েছে এই বইয়ে। পাঠকের আগ্রহকে উৎসাহিত করতে প্রথম বিশটি শিরোনাম উল্লেখ করা হলঃ-

  • একটি সাবমেরিন বনাম পাঁচ হাজার জানালা
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দীর্ঘশ্বাসটুকু শুনুন
  • চিত্ত যেথা ভয়যুক্ত, নিচু যেথা শির
  • একটা দেশ যেভাবে দাঁড়ায়
  • কোটা নাকি মেধা? জন্ম নাকি কর্ম?
  • কর্মে হোক জন্ম জয়
  • জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষ্পাপ প্রাণগুলো
  • দেশটা যেভাবে হেরে যায়
  • সজাগ হও, হে তারুণ্য
  • সেশনজটে ক্ষয়ে যায় সমাজ
  • থেমে থেকো না
  • সম্ভাবনাকে জাগতে দিন
  • উন্নত সমাজের মূলমন্ত্র
  • লক্ষ্য হোক দক্ষতা অর্জন
  • কোথায় ছুড়ছ তোমার সোনালি যৌবন?
  • দয়া করে ওদের ঠকাবেন না
  • বাংলাদেশ কি মেধাবীদের ফিরিয়ে নেবে?
  • নেতায় নেতাচ্ছন্ন এক দেশ
  • সহজাত মেধা যেন ক্ষয়ে না যায়
  • মগজের ধ্বংসযজ্ঞ


এই কয়টি শিরোনাম দেখেই লেখকের মনোভঙ্গি অনুধাবন করা যায়। তাঁর আগ্রহ বাংলাদেশের মেধাবী জনগোষ্ঠী নিয়ে। মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে গবেষণায়, নতুন আবিষ্কারের প্রতি উৎসাহী করতে চান। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে চান। সেজন্য শিক্ষাব্যবস্থায় প্রভাবক সবকিছুর প্রতি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন; সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদির ভূমিকা নিয়েও কথা বলতে ছাড়েন নি। তাঁর হৃদয়ে আন্তরিকতার অভাব নেই। দু'য়েকটা নিবন্ধ আলোচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দীর্ঘশ্বাসটুকু শুনুন' রচনাটি শুরু করেন 'ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া' এর গবেষণা সংস্কৃতি নিয়ে। সেখানে গবেষণা নিয়ে কর্তৃপক্ষের আগ্রহ কতটা তার উদাহরণ দিয়ে বলেন-

ল্যাবরেটরি থেকে বের হতে হতে প্রায়ই রাত ৯টা-১০টা বাজত। কখনো কখনো ১১টা কিংবা ১২টা। বহুবার লক্ষ করেছি, এই গভীর রাতেও অনেকে বসে বসে কাজ করছেন। তাঁদের ঘড়িগুলো যেন বন্ধ হয়ে আছে। ঘড়ির কাঁটা তাঁদের সামান্যতম তাড়া দিতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রাত দুইটা পর্যন্ত কিছু বাস (শাটল) সার্ভিস দিয়ে রেখেছে। কেউ যদি গভীর রাতে বাসায় ফিরতে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন, তাহলে সে গাড়িগুলো তাঁকে বাসার দরজায় পৌঁছে দেয়। পৃষ্ঠা-১৮


গবেষণায় নিবিষ্ট শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই ভালবাসা লেখকের পাশাপাশি পাঠককেও বিস্মিত করে। আসলেই তো, গবেষণা একটি নিরবিচ্ছিন্ন কার্যক্রম। অনবরত নতুন নতুন দিক থেকে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নতুন ভাবনার কার্যকারীতা পরীক্ষা করে যেতে হয়। আর কর্মদ্যোগ তো ধরাবাঁধা সময়ের ধার ধারে না। একেকজনের চিন্তা একেক সময়ে উদ্দীপিত হয়। একেকজনের শরীরবৃত্তি একেক সময়ে কর্মচঞ্চল থাকে। আর সেজন্য একজন প্রত্যয়ী গবেষক দিন রাতের বন্ধনে বন্দী থাকতে চান না। দিন রাতের যে কোন সময়ে তিনি কাজ করতে চান। লেখক প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকার্যের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেন। এখানে অফিস টাইমের বাইরে গবেষণাকক্ষ ব্যবহারের সুযোগ নেই। গবেষকের স্বতস্ফুর্ততা ঘড়ির কাঁটার নিয়মনীতি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। লেখক আক্ষেপ করে কথার টানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের উল্লেখ করেন। উদ্ভট এই সমস্যার জালে পড়ে কত গবেষণাপ্রবণ ছাত্রের জানার স্পৃহা নষ্ট হয়ে যায়, কত ছাত্রের গবেষণা উৎসাহ নিষ্প্রভ হয়ে যায়, তার প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাদের কোন সহানুভূতি নেই।

‘কর্মে হোক জন্ম জয়' রচনাটি বেশ উদ্দীপনামূলক। আলবার্ট আইনস্টাইন, মাইকেল ফ্যারাডে, কাজী নজরুল ইসলাম, জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, গণিতবিদ রামানুজম, আম্বেদকর প্রমুখকে উল্লেখ করে লেখক জন্ম নয় কর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। বাংলাভাষায় প্রবাদ রয়েছে যে-

কর্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভাল


লেখক এই চেতনায় বিশ্বাসী। উপর্যুক্ত ব্যক্তিত্বগণ কেউ প্রখ্যাত বা এমনকী স্বচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নি। ভাল খাবার, ভাল বাসস্থানের অভাব প্রত্যেককে পীড়া দিয়েছে। অথচ প্রত্যেকেই নিজ মেধাপ্রসূত কর্মগুণে সমাজের সকলের চোখে নমস্য হয়ে উঠেছিলেন। লেখক জন্মের সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে কর্মে বড় হওয়ার জন্য তরুণদেরকে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি বলেন-

জন্ম হলো পৃথিবীতে আসার নিছক সূত্র। এর ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। মানুষের যেটার ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে, সেটা হলো কর্ম। মানুষ দরিদ্র পরিবারে জন্মালেই সম্ভাবনাহীন হয় না। দারিদ্র্য মানুষের বড় হওয়ার পথে অন্তরায়, তবে একমাত্র বাধা নয়। আর জন্ম যেহেতু মানুষকে বড় করে না, সেটা নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করেও লাভ নেই। পৃষ্ঠা-৩১


‘সেশনজটে ক্ষয়ে যায় সমাজ' বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সেশনজট নামক এক অদ্ভূত প্রতারণা রয়েছে। বিভিন্ন অজুহাতে এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। ফলে শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেটে পাশের বৎসর ও প্রকৃত পাশের বৎসরের মাঝে কয়েক বৎসরের ফারাক থেকে যায়। এই অপচয় হওয়া সময়ের দায় শিক্ষাদানকারী কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে না। হতাশার জগদ্দল পাথর বহন করার ভার এসে পরে শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে। লেখক বিদেশের শিক্ষক-ছাত্রদের সাথে আলোচনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সেশনজটের কথা উপস্থাপন করতে গিয়ে বিব্রত হন। লেখক দুঃখ করে বলেন-

একটা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় যে অকারণে বন্ধ থাকতে পারে, দুনিয়ার কোনো দেশ সেটা কল্পনাও করতে পারে না। পৃষ্ঠা- ৪৩


অথচ এর নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষার্থীকে সারাজীবন বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়। জীবনগড়ার প্রচেষ্টায় পিছিয়ে যেতে হয় বারবার। লেখক তার গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে শিক্ষার্থীর মানসিকতায় সেশনজটের অশুভ প্রভাবকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে-

আমাদের বহু শিক্ষার্থী বিশ্বমানের শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ পান না। তদুপরি যদি যৌবনের মোক্ষম সময় থেকে কয়েকটি বছর ক্ষয়ে যায়, তাহলে নিজেকে প্রস্তুত করার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হন। আর এমন সামষ্টিক বঞ্চনার কারণে অনেকের ভেতর নেমে আসে নৈরাশ্যের অন্ধকার। এই তরুণগুলোকে এভাবে বঞ্চিত করার কোনো অধিকার কি আমাদের আছে? এটা কি অপরাধ নয়। সমাজের তরুণদের জীবন থেকে সময় কেড়ে নিয়ে পরোক্ষভাবে সমাজেরই ধ্বংস ডেকে আনছি আমরা। যে সমাজের তরুণেরা হতাশা ও নিরাশায় মাথা ঝুঁকিয়ে রাখে, সে সমাজ সহজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। পৃষ্ঠা- ৪৪


‘থেমে থেকো না' রচনাটি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে রচিত। লেখক তাদেরকে থেমে না থেকে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পরামর্শ দিয়েছেন। জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে নিজের ও সমাজের ভিত কীভাবে শক্ত করা যায়, তার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি শিক্ষার্থীদেরকে সারা পৃথিবীর উচ্চমানের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে জ্ঞান অর্জন করার পরামর্শ দিয়েছেন। আর সেজন্য নিজেকে যেভাবে যোগ্য করে তুলতে হবে, সে বিষয়ে পরামর্শমূলক উৎসাহ দিয়েছেন। চীন কোরিয়ার উদাহরণ টেনে লেখক জানান শুধু প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফল বা টোফেল, আইএলটিএস এ ভাল করলে হবে না। ভাল গবেষণার জন্য একটি সত্যিকারের অনুসন্ধিৎসু মন দরকার। গবেষণার প্রতি নিবেদিত মন না থাকলে একাডেমিক রেজাল্ট কোন ভাল ফলাফল বয়ে নিয়ে আসবে না। তরুণ গবেষককে উৎসাহ দিয়ে তিনি বলেন-

ভালো করার উপায় অনেক তাকে। অনেক পথ অনুসরণ করে ভালো করা যায়। আমরা যেন শুধু একটি পথেই পড়ে না রই। একটি পথে গন্তব্য খুঁজে না পেলে যেন থেমে না যাই। পৃষ্ঠা-৪৭


অভিভাবকদের প্রতি আহ্বানমূলক লেখা 'সম্ভাবনাকে জাগতে দিন'। বাংলাদেশের অভিভাবক সন্তানদের ইচ্ছাকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন, লেখক তার সমাপ্তি চেয়েছেন। বাংলাদেশের কিশোররা আন্তর্জাতিক জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড থেকে পুরষ্কার অর্জন করেছে। লেখক এই ঘটনায় বেশ উৎফুল্ল, আশাবাদী। নিছক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার নয়, তার চেয়েও বড় কিছু হবার সম্ভাবনা আমাদের নতুন প্রজন্মের রয়েছে, লেখক সেকথা বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন। অভিভাবকগণ সন্তানদের প্রতি আন্তরিক, সেকথা ঠিক, কিন্তু তা যেন সন্তানের সম্ভাবনাকে নষ্ট না করে দেয়। লেখক তাই অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলেন-

কখনো কি ভেবেছেন, আপনার যে ছেলেমেয়েটিকে স্রেফ একজন ডাক্তার বানাবেন, সে হয়তো তার চেয়ে অনেক বড় কিছু হওয়ার যোগ্যতা রাখে। সে সম্ভাবনাকে বের করে আনার চেষ্টাও করতে হয়। কোনো সম্ভাবনার ক্ষয় হলে, শুধু একটি পরিবার নয়, সমাজ-সভ্যতাও বঞ্চিত হয়। পৃষ্ঠা- ৫০


‘নিজেকে আবিষ্কার করো' শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ প্রেরণামূলক রচনা। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব কিছু গুণাবলী আছে। প্রত্যেকের আগ্রহ আলাদা, তাই প্রত্যেককে আলাদাভাবে নিজের প্রতিষ্ঠার কথা ভাবতে হবে। নিজের মনে গভীরে লুকিয়ে থাকা দক্ষতা ও সম্ভাবনাকে চিনতে হবে। তাহলেই সে হয়ে উঠবে অনন্য। যার ফল সে নিজে যেমন ভোগ করবে, তেমনভাবে উপকৃত হবে সমাজ ও দেশ। তিনি খুব আফসোস নিয়ে বলেন-

যে তরুণ ডাক্তার বিসিএস দিয়ে সার্জন হয়ে বসে আছেন, তিনি হয়তো গবেষণা করতে পারতেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ব্যাকম্যান রিসার্চ সেন্টারে। তিনি কাজ করতে পারতেন ফাইব্রোটিক ডিজিজ, আলঝেইমার কিংবা অন্যান্য রোগ নিয়ে। কিন্তু এঁরাই যখন কায়মনোবাক্যে হাতে জপমালা নিয়ে সকাল-সন্ধ্যা বিসিএস জপতে থাকেন, তখন খুবই করুণা হয়। কষ্ট বোধ করি।… আমাদের দেশটার জন্য অনেক গবেষক, উদ্ভাবক প্রয়োজন। আমাদের বিজ্ঞানের ছেলেমেয়েরা যদি শুধু বিসিএস পরীক্ষাকেই আরাধনার বিষয় মনে করেন, তাহলে কী করে আমরা বিজ্ঞানী ও গবেষক পাব? কী করে উদ্ভাবনে সারা দুনিয়ায় খ্যাতি অর্জন করব? পৃষ্ঠা- ১০০


বাংলাদেশের যে শিক্ষকরা বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও আন্তরিকভাবে কাজ করেন, নতুন চিন্তা, নতুন উদ্ভাবনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, তাদের কথা লেখক অল্প করে হলেও উল্লেখ করেছেন। 'আত্মঘাতী নীতিমালা' রচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের যে নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে (সাল উল্লেখ নেই, তথ্যসূত্র অংশে রিডাইরেক্ট লিংক আছে) তার নেতিবাচক আলোচনা রয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতা নির্বিশেষে একঢালা নিয়মের তিনি বিরোধীতা করেছেন। তিনি মনে করেন এর ফলে আন্তরিক ও উদ্যমী শিক্ষকরা হতোদ্যাম হয়ে পড়তে পারে। শিক্ষকদের মনোবেদনা নিজের মত করে অনুভব করে তিনি লিখেছেন-

যে কয়েকজন মানুষ কঠোর-কঠিন পরিশ্রম করছেন, তাঁরাই বা দীর্ঘদিন কেন কষ্ট করবেন? ড্রাইভিং ফোর্সটা কী? আমি অনেক সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপককে চিনি, যাঁরা কাজকে ভালোবেসে অনেক কষ্ট করেন। তাঁরা হয়তো প্রমোশনের আশায় গবেষণা করেন না। কিন্তু তাঁরা একসময় উপলব্ধি করবেন, তাঁদের চেয়ে আরামে-আয়েশে থেকে অনেকেই প্রফেসর হচ্ছেন, হবেন। সমপরিমাণ বেতন পাবেন। তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগবে, এত কষ্ট করে কী লাভ? পৃষ্ঠা- ১৬৬


‘কেমন হয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়' নিবন্ধে লেখক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্টতা সম্পর্কে বলেছেন। তিনি পৃথিবী বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও চাকুরী করেছেন। উন্নত সভ্যতা তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোন কোন গুণাবলী নিয়ামক ভূমিকা রেখেছে তা নিজের চোখে দেখেছেন। ফলে তিনি জানেন শুধু পড়াশোনা করানো বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র কাজ নয়। প্রতিবৎসর বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি ব়্যাংকিং হয়। সেখানে সম্মানজনক পর্যায়ে বাংলাদেশের নাম থাকে না। কারণ লেখকের মতে বিশ্ববিদ্যালয় অন্য জিনিষ, যা আমরা তৈরি করতে পারি নি। তিনি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ১৯টি বৈশিষ্ট্যের একটি তালিকা দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন যে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো যদি বিশ্ববিদ্যালয় হত, তাহলে সেখানে এই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকত না।

‘আলোকিত সমাজের মূলমন্ত্র' বর্তমান সমাজের উপযোগী একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ। সমাজে জ্ঞানচর্চার পরিবেশ তৈরি করতে হলে সেরকম সহনশীল সংস্কৃতি থাকতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন সেই সংস্কৃতি অনুধাবনের বোধ। জ্ঞানভিত্তিক সংস্কৃতি একদিনে তৈরি হয় না। লেখক মনে করেন সেরকম সংস্কৃতি তৈরির জন্য সমাজে বহুদিন ধরে কয়েকটি বিষয়ের চর্চা থাকতে হয়। সেগুলো হল:

আন্ডারস্ট্যান্ডিং, ডিসকাশন, আরগুমেন্ট ও আইডিয়া। পৃষ্ঠা- ৯২


আন্ডারস্ট্যান্ডিং বলতে তিনি কোন বিষয় ঠিকমতো বুঝে পড়াশোনা করাকে বুঝিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা যাই পড়ুক না কেন, তা যেন সঠিকভাবে বুঝে নেয়। না হলে সে বিষয় তার ভাবনাকে পল্লবিত করতে পারবে না। ডিসকাশন বা আলোচনা জ্ঞান-গবেষণায় খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন। প্রতিষ্ঠিত পুরনো জ্ঞানকে আলোচনা করতে দিতে হবে। সে বিষয়ে ভিন্নমতকে গ্রহণ করতে শিখতে হবে। নিঃসঙ্কোচ ও নির্ভয় দ্বিধাহীন চিত্তে আলোচনা করতে হবে। না হলে মানুষ এক নির্দিষ্ট সীমানার ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে যাবে। লেখক মনে করেন আরগুমেন্ট বা তর্কহীন সমাজ হল মৃত। জ্ঞান এগিয়ে যায় তর্কের উপর নির্ভর করে। তাঁর মতে:-

যুক্তির তর্ককে যে সমাজ 'বেয়াদবি'র ট্যাগ দিয়ে চাপিয়ে রাখে, সেখানে বেয়াদবই থাকে – আলোকিত মানুষ থাকতে পারেন না। পৃষ্ঠা- ৯৩


আইডিয়া হল যে কোন সৃষ্টির মূল। আইডিয়া ছাড়া গল্প, কবিতা, রাষ্ট্রনীতি, জ্ঞান-গবেষণা কোন কিছুই আগায় না। আমাদের সমাজে তরুণদের আইডিয়াকে অবহেলা করা হয়। ফলে তরুণরা নতুন নতুন বিষয়ে ভাবতে উৎসাহিত বোধ করে না। যার প্রভাব পড়ে সরাসরি সমাজ কাঠামোয়। লেখক সরাসরি প্রশ্ন করেন:-

আন্ডারস্ট্যান্ডিং, ডিসকাশন, আরগুমেন্ট ও আইডিয়া – এগুলো হলো আলোকিত সমাজের মূলমন্ত্র। কুসংস্কার, গোঁড়ামি, অন্ধত্বকে মুছে দেওয়ার অনিবার্য হাতিয়ার। আমরা কী এগুলোর চর্চা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে পারছি? পৃষ্ঠা- ৯৪



তাঁর বেশিরভাগ প্রবন্ধ এরকম উৎসাহ প্রদায়ী, আশার স্বপ্ন দেখায়। তরুণদের মানসিক জড়তা ও কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে সৃষ্টিশীল হতে অনুপ্রেরণা যোগায়। তাঁর আরও যে প্রবন্ধগুলো বারবার পড়ার মতো সেগুলো হল- উন্নত সমাজের মূলমন্ত্র, লক্ষ্য হোক দক্ষতা অর্জন, কোথায় ছুড়ছ তোমার সোনালী যৌবন?, দাঁড়াতে হলে শিখতে হয়, প্যারালাইজড মাইন্ড, সম্ভাবনা খুন হয়ে যায়, অন্তরে বাহিরে দাসত্বের রজ্জু, মেধাবীদের কত দিন দূরে রাখবে সমাজ, সত্যিকারের নায়ক, কিশোর-কিশোরীর জ্ঞানানন্দ, প্রিয় অভিভাবক একটু শুনুন, ডিজিটাল ইগনোরেন্স, ফড়িংয়ের চোখ তৈরি করো, ছোট দেশের বড় স্বপ্ন, উদ্ভাবনে আমরা কেন পিছিয়ে, চাপিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি, আমাদের সম্ভাবনাময়ী মেয়েরা প্রভৃতি। লেখক তরুণদের চিন্তাকে সৃষ্টিশীল করে তুলতে চান। বাংলাদেশের সমাজের পিঠে চেপে বসা শত বৎসরের জগদ্দল পাথর সরাতে তরুণদের আহ্বান করেন। তাদের জানিয়ে দেন সম্ভাবনার সূত্রগুলো। যার মাধ্যমে তারা নিজেরাই নিজেদের দুর্বলতা ও সবলতাগুলোকে চিহ্নিত করতে পারবে। বুঝতে পারবে আত্মশক্তির অপার ভবিষ্যতকে।

রচনাগুলোর কোন কোন অংশ লিখতে গিয়ে তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নি বলে মনে হয়। কখনো মনে হয় অতিশয়োক্তি হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু শব্দ যেমন বারুদ, ধ্বংস, লড়াই, সংগ্রাম, যুদ্ধ ইত্যাদি সহিংসতা বিষয়ক, শিক্ষা আলোচনার উপযোগী নয়। এসব বিষয়ে লেখকের আরও সতর্ক থাকা দরকার। তবে সার্বিকভাবে লেখকের মনোভঙ্গি ও আন্তরিকতার প্রশংসা করতেই হয়। তিনি শিক্ষাবিজ্ঞান পড়েছেন কি না, তা কোথাও উল্লেখ নেই। তাই শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হতে হলে সমাজকে যে সেই আধুনিক চিন্তার উপযোগী হতে হয়, সে বিষয়ে তার সচেতনার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হয়। তিনি তরুণদের শিক্ষা বিষয়ক দূরাবস্থার জন্য শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতিকে দোষারোপ করেছেন। কিন্তু এসব যার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, সেই শিক্ষাবিনাশী দর্শন-চিন্তা-মতবাদের কথা হয়তো বুঝতে পারেন নি বলেই মনে হয়। তারপরও বলতে হবে যে, তার অণুপ্রবন্ধগুলো পাঠককে শিক্ষা ব্যবস্থাপনার দুর্বল দিকসমূহ চিনতে সাহায্য করবে; সমস্যা সমাধান করতে উৎসাহিত করবে; শিক্ষার্থীরা নিজেদের চিন্তার সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝতে পারবে; কূপমণ্ডুকতার স্বরূপ চিহ্নিত করতে পারবে।

বইয়ের মলাট বোর্ডবাঁধাই হওয়ায় বেশ শক্তপোক্ত। বহু ব্যবহারে জীর্ণ হবে না। কাগজ, ছাপানোর মান, বইয়ের সেটিং উন্নতমানের। তবে ফন্টের আকার অপ্রয়োজনীয় বড় বলে মনে হয়। ফন্টের আকার ও কাগজের মান পরিবর্তন করলে বইয়ের দাম আরও কম রাখা যেত। যে শিক্ষার্থীদের জন্য লেখকের এত দুঃশ্চিন্তা, তাদের কথা ভেবে বইয়ের দামের দিকটা বিবেচনা করা যেতে পারত। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। কোন চিত্র ব্যবহার না করে শুধু বইয়ের নামকে থীম ধরে একটি আধুনিক নান্দনিক দৃশ্যপট তৈরি করেছেন। বইয়ের শেষে একটি তথ্যসূত্র আছে। সেখানে ১৩টি ভুক্তির একটিতে সৈয়দ আবুল মকসুদ রচিত 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা' নামক একটি বইয়ের নাম এবং ১২টিতে পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন খবর ও প্রবন্ধের উল্লেখ আছে।

তরুণদের শিক্ষা নিয়ে চিন্তিত লেখকের সংখ্যা বাংলাদেশে খুব একটা নেই। এই শূন্যতা রউফুল আলম পূরণ করেছেন। তিনি যে সব দিক নিয়ে কথা বলেছেন, সেসব দিক ভাববার সামর্থ সবার নেই। তিনি নিজে গবেষক ও বিদেশের উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করেছেন বলে সমস্যার সঠিক স্বরূপগুলোকে নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করতে পেরেছেন। এই বই অভিভাবক, শিক্ষক, শিক্ষা ব্যবস্থাপক ও শিক্ষার্থী অর্থাৎ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকেরই পড়া দরকার। 'শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড' এই বহুল উচ্চারিত বাক্যটির যথার্থতা বুঝতে এই বই পড়ার বিকল্প বর্তমান বাংলাভাষায় খুবই কম। সেদিক থেকে বলা যায়, লেখকের প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে।


**********

একটা দেশ যেভাবে দাঁড়ায়
রউফুল আলম

প্রকাশকাল: ২০১৯

প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশনী: সমগ্র প্রকাশন, ঢাকা
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১৯২
মূল্য:  ৩০০ টাকা
ISBN: 978-984-439-002-7

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ