শিল্প- সাহিত্যের এমন কিছু সৃষ্টি রয়েছে যা ক্লাসিক বা চিরন্তন এবং যার রূপ-রস-গন্ধ বারবার দর্শন বা পাঠেও অনাবিষ্কৃত বা অধরা থেকে যায়। ফলে প্রতিটি পাঠকেই মনে হয় নতুন পাঠ এবং প্রতি পাঠেই ধরা দেয় নতুন স্বর ও সুর।
ফরাসি লেখক আলবেয়ার কামুর ‘দি আউটসাইডার’ উপন্যাসটা পুনর্পাঠে নতুন অভিজ্ঞতা হলো যেন। ক্লাসিক সাহিত্যের স্বার্থকতা এখানেই। প্রতি পাঠেই এর থেকে নতুন নতুন মনি-মুক্তা আহরণ করতে পারবেন আপনি। লেখকও হয়তো খুঁজে ফিরেছেন তার উপন্যাসের চরিত্রের মধ্যে দিয়ে জীবনের গোপন প্রকোষ্ঠে লুকিয়ে থাকা মুনি-মুক্তা গুলো। কামু তাঁর ‘আউটসাইডার’ উপন্যাসের মূল চরিত্র মারসোকে এতটাই নির্লিপ্ত ভাবে, ব্যক্তিত্ববান হিসাবে গড়ে তুলেছেন যে, মস্তিস্কহীন, অনুর্বর আর ছদ্ম সমাজ তাকে সন্দেহ করতে শুরু করে। দেখা যাচ্ছে এটা কেবলমাত্র আলজেরীয় বা ইউরোপীয় উপসর্গ নয়, এটা ভারতীয় উপসর্গও বটে এবং উপন্যাস প্রকাশের প্রায় একশত বছর পরও প্রচল ভেঙ্গে গড়ে ওঠেনি সেই উর্বর আর উন্নত সমাজ যা কামু তাঁর উপন্যাসের মূল চরিত্র মারসোর মধ্য দিয়ে প্রত্যাশা করে গেছেন। মারসো আজও ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা নির্লিপ্ত আর আনমনে হেটে চলা হাজারো মানুষের পায়ে ভর করে, হৃদয়ের হ্রদে হ্রদে।
উপন্যাসের প্রথমে দিকে আমরা দেখি মারসো এমন এক ব্যক্তি যে কিনা কারো আগে-পিছে নেই। কেবলমাত্র নিজের কাজ নিয়ে, নিজের তৈরি জগত নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। অথচ এধরনের একজন মানুষকেই হৃদয়হীন, উদ্ভট সমাজ নেতিমূলক ভাবে নিস্ক্রিয় হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকে। পাশাপাশি নানান অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকা ব্যক্তিকে, ধর্ষককে, সুদ-ঘুষ-দূর্নীতিতে সিদ্ধহস্ত ব্যক্তিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে সক্রিয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অর্থাৎ যে সমাজ যে ধরনের নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে সে সমাজে সে ধরনের মানুষই মূল্যায়িত হয়ে থাকে। বৃদ্ধাশ্রম থেকে মায়ের মৃত্যুর টেলিগ্রাম পাওয়ার পর সপ্তাহের অফিস করে ক্লান্ত মারসো দুই ঘন্টার জার্নি শেষে আশ্রমে পৌঁছালে তাকে কিছুটা ভাব-লেশহীন ভাবে আবিস্কার করে আশ্রমের দারোয়ান এবং তত্ত্বাবধায়ক। বিশেষ করে মারসো তাঁর মাকে দেখতে চায় কী না, এমন প্রশ্নের জবাবে নীরব থাকা, মায়ের শবদেহের পাশে বসে সিগারেট খাওয়া, শোকে কাতর হয়ে চোখের জল না ফেলা; এসব আশ্রমবাসীকে বেশ খানিকটা অবাক করে।
যদিওবা দারোয়ানের বাড়াবাড়ি আর বেঁটেমতো তত্ত্বাবধায়কের বকবকানিতে মরসোও খানিকটা বিরক্ত হয়। সমাজে এমন অনেককেই দেখা যায় যারা স্বজনের মৃতুর দিন চোখের জলযোগে মূর্ছা যায় আবার তারাই দিন না গড়াতেই অট্টহাসিতে শোকের পরিবেশকে বিনোদনের পরিবেশে রূপান্তরিত করে। ছদ্ম সমাজও তথাকথিত বিনোদনের অংশীদার হয়ে যায় হরহামেশা। কিন্তু আউটসাইডারের মারসো না পেরেছে সামাজিক কায়দা-কানুন রপ্ত করতে না পেরেছে সমাবব্ধ কৈয়ের ঝাঁকের সাথে মিশে যেতে। ফলে তাকে হোঁচট খেতে হয় পদে পদে।
মায়ের শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান থেকে ফিরে প্রেমিকা মারীকে নিয়ে সমুদ্রস্নানে যায় এবং সেখান থেকে ফিরে দু’জনে এক সঙ্গে সিনেমাও দেখতে যায়। এপর সিনেমা হলে প্রবেশের আগে মারী যখন জানতে পারে গতকালই মারাসোর মা মারা গিয়েছেন তখন সেও চমকে যায়। কিন্তু সিনেমা শুরু হলে মারীরও আর কোন কিছু খেয়াল থাকে না এবং সেই রাত মারী-মারসোর সাথেই কাটায়। সেদিন অফিস শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় প্রতিবেশি রেমন্ড যে কিনা স্থানীয়দের কাছে দেহপসারিনীর দালাল হিসেবে পরিচিত; তার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে যায় মারসোর। অবশ্য রেমন্ড নিজেকে দেহপসারিনীর দালাল হিসেবে স্বীকার করে না। সে বরং একটা গুদাম ঘরে কাজ করে বলেই দাবী করে। সমাজের চোখে রেমন্ড খারাপ মানুষ হিসেবে পরিচিত হলেও মারসোর তাকে খারাপ মনে হয়না। মারসো সে রাতে রেমন্ডের ঘরে গিয়ে মদপান করে এবং তার ব্যক্তিগত অনেক বিষয়ের সাথে মারসো জড়িয়ে যায়। এর সুত্র ধরে একটা পর্যায়ে মারসো রেমন্ডের শত্রু জনৈক আরবকে সমুদ্র পাড়ে গিয়ে গুলি করে দেয়।
মূলত এখান থেকেই বড় ধরনের বাঁক নেয় গল্পের কাহিনী। পুলিশের কাছে আটক হয় মারসো। আদালত তদন্তে নামে এবং আশ্রম পর্যন্ত যায়। আদালতে স্বাক্ষী হিসেবে হাজির করা হয় দারোয়ান এবং তত্ত্বাবধায়ককে। আদালত খুনের ঘটনার চেয়ে মায়ের মুখ দেখতে না চাওয়া, শব্দদেহের পাশে বসে সিগারেট খাওয়া এবং চোখের জল না ফেলানোকে বড় করে তোলে। অর্থাৎ একজন নির্লিপ্ত মানুষকে হেনস্তা করার সকল অস্ত্র যেন হাতে পেয়ে যায় সরকারী উকিল, আদালত আর ছদ্ম সমাজ। অন্যদিকে জনৈক আরবকে খুনের কারণ হিসেবে আদালতকে সে যখন জানায় যে প্রচন্ড রোদের তাপের কারণেই তার হাতে থাকা পিস্তলের ট্রিগারে চাপ পড়ে গিয়ে গুলি বের হয়ে যায় এবং সেই গুলিতেই মৃত্যু হয় আরবটির তখন মারসোকে উম্মাদ ঠাওরায় আদালত। মারসোকে উন্মাদ ঠাওরালেও উন্মাদনার কারণে তার শাস্তি কমায়না আদালত। আর তাকে যদি উন্মাদও ধরে নেওয়া হয় তবুও প্রশ্ন কিন্ত থেকে যায়। মূলত একজন উন্মাদ বা পাগলের মাথায় কোন সেন্সর থাকে না। ফলে সে অবলীলায় মনের কথা বলে যায়। এমনকি সত্য-মিথ্যার ধারও সে ধারে না। সে যা ঠিক মনে করে তাই বলে। কথা বলার সময় বিন্দু পরিমাণ ভাবার অবকাশও সে পায়না। ফলে কথা বলার সময় সে স্বার্থগত দিকটা মোটেই ভাবেনা। অন্য দিকে সাধারন মানুষ ব্যাক্তিস্বার্থ ঠিক রেখে ভেবে চিন্তে কথা বলে। এজন্যই বোধহয় বলা হয় সত্য কথা যে কোন ভাবেই বলা যায় আর মিথ্যা কথা ভেবে-চিন্তে সাজিয়ে-গুছিয়ে বলতে হয়। যাই হোক গুছিয়ে কথা বলতে না পারার কারণে ব্যাক্তিগত উকিলের কথার সাথে একমত হতে না পারার কারণে, সর্বোপরি মিথ্যার আশ্রয় না নেওয়ার কারনে আদালত ফরাসি জনগনের নামে কোন এক পাবলিক স্কোয়ারে মারসোর শিরোচ্ছেদ করার ঘোষণা দেয়। রায় কার্যকর হওয়ার আগে আদালতের নিয়ামানুযায়ী পাদ্রী বার কয়েক দেখা করে নানান প্রশ্ন করে মারসোকে। পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে বলে ঈশ্বরের কাছে। মারসো জানায় পাপ যে কি সেটাই সে জানেনা তবে সব সময় সে সত্যটাই বলার চেষ্টা করেছে। পাদ্রীকে সে আরও বলে পাপের শাস্তির রায় যখন মানুষই দিয়ে দিয়েছে তখন ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চেয়ে আর লাভ কি? তার কথায়, এখন না মরলেও বিশ বছর পর তাকে ঠিকই মরতে হতো। অতএব দুঃখ পাওয়ার মতো কিছু নেই।
এভাবেই নানান নাটকীয়তার মধ্যে দিয়ে শেষ হয় ‘দি আইসাইডার’ উপন্যাসের কাহিনী। তুষার তালুকদারের করা অনুবাদটি যথেষ্ট ঝরঝরে এবং প্রাণবন্ত হলেও ‘দি আউটসাইডার’ এর অনুবাদ হিসেবে তিনি ‘অচেনা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন যা যর্থাথ মনে হয়নি। কামু সম্ভবত ‘Outsider’ দ্বারা ‘অচেনা’ বোঝাতে চাননি। এই অনুবাদটি ২০১৭ এর একুশে বই মেলায় প্রথম প্রকাশিত হয়। বইটির প্রচ্ছদ্দ করেছেন সঞ্জয় দে বিপন। প্রকাশ করেছে, ধ্রুবপদ প্রকাশনী। ৭১ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ১৪৪ টাকা।
________
* প্রচ্ছদে লেখকের নাম 'আলব্যের কামু' লেখা হলেও আলোচক লিখেছেন প্রচলিত বানান 'আলবেয়ার কামু'
1 মন্তব্যসমূহ
জি না, এই বইটি আরো অনেক আগে বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছি, দা আউটসাইডার নামে। আমি আমার কিশোর বেলাতেই সেই বইটি পড়েছি। সম্ভবত: আমার বুক সেলফে বইটি আছে। অনির্বায কারনে দেখে বলতে পারছি না।
উত্তরমুছুনমার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম