'রিয়াজ ফাহমী' রচিত 'বাবা' বই নিয়ে কিছু কথা - সাইফা শান্তা

'রিয়াজ ফাহমী' রচিত 'বাবা' বই


★ লেখক-পরিচিতি

"রিয়াজ ফাহমীর" জন্ম ২১শে ডিসেম্বর, ১৯৭৯। শিক্ষাজীবন সমপন্ন করেছেন বরিশাল ক্যাডেট কলেজ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইল থেকে। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত এবং দুই সন্তানের জনক।

★ উৎসর্গপত্র

মুক্তিযোদ্ধা ও অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ।

★ বইটির সংক্ষিপ্তসার

"রিয়াজ ফাহমী" রচিত "বাবা" একটি জনপ্রিয় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচিত আড়ালে থাকা নিঃস্বার্থভাবে বাবাদের অবদানগুলোই উঠে এসেছে বইটিতে। উপন্যাসের নামানুসারেই বাবা নামটি ঠিক কতোটা উপন্যাসে জায়গা করে নিতে পেরেছে বা সন্তানের জন্য বাবাদের আত্মত্যাগ ঠিক কতোটা হতে পারে তার এক অনবদ্য সৃষ্টির উপন্যাস "বাবা"।

পিতৃ-মাতৃহীন অনাথ ছেলে আব্দুস সোবাহানের প্রেক্ষিতে উপন্যাসের শুরু হলে ও উপন্যাস জুড়ে আমরা বেশকিছু বাবাদের কৃতিত্ব রেখে যাওয়ার প্রতিচ্ছবি দেখেছিলাম। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর এতিম সোবাহানের আপন চাচা আনিসুর রহমান ব্যতীত পৃথিবীতে আপন বলতে কেউই ছিলো না। সোবাহান চাচা আনিসুর রহমানের বাসাতে থাকতেন ও সাথে চাচী হালিমা, চাচাতো বোন রুমকিসহ বসবাস করতেন। বাবা-মায়ের সঙ্গ না পেলেও সোবাহান তার চাচা আনিসুর রহমানের কাছে বাবার ঠিক কতোটা সঙ্গ পেয়েছিলো? সোবাহান তার চাচাকে যথেষ্ট মেনে চলতো এমনকি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কথা তার চাচা না বলা অব্ধি সে সাহস করে স্বেচ্ছায় নিজে নাম ও মুখে নেয়নি। সে থেকেই কিছুটা আভাস পাওয়া যায় সোবাহান তার চাচাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও সম্মান দিতো। কিন্তু আনিসুর রহমান কি পেরেছে সোবাহানকে নিজ ছেলের দায়িত্বটা দিতে? মূলত অল্পপরিসরে বলতে গেলেও উপন্যাসটি পড়ে দেখা দরকার সোবাহান ও তার চাচার সম্পর্কের রহস্যভেদ করতে।

উপন্যাসের পটভূমিতে আমরা দেখতে পাই, ১লা মার্চ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্ব তথা এপ্রিল/মে মাস পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সকল ঘটনাগুলির সুস্পষ্ট তারিখ উল্লেখ করা বর্ণনা বেশ জায়গা করে নিয়েছিলো পুরো উপন্যাসটি জুড়েই।

বিভিন্ন চরিত্রের আনাগোনা হলেও স্বল্পপরিসরে আমরা বেশিরভাগই দেখা পেয়েছি সোবাহানের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা বিষয়গুলের সুস্পষ্ট বিবরণ। উপন্যাসের আরেক দিকজুড়ে রয়েছে দুইটি হিন্দু পরিবারের ঘটে যাওয়া অসম্পূর্ণ কিছু কথোপকথন। রানু-অজিত ও তাদের মেয়ে অবনীর সেই বেদনাবিধুর মুহূর্ত কাটানোর সময়গুলি কেননা অবনীর বাবা অজিত সেই যে নিখোঁজ হয়েছিলো আর তার হদিস পাওয়া যায়নি শেষটা জুড়েও, যা কি-না উপন্যাসে যোগ করেছিল ভিন্ন মাত্রা; ও সোবাহানের নামহীন এক সম্পর্কের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে বারবার ছুটে যাওয়া তার ছাত্রী অবনীর মায়ের কাছে। অন্যদিকে সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে যেন ২৫শে মার্চ রাতে অজিতের স্ত্রী রানু ও মেয়ে অবনীর চাপাকান্না তলিয়ে যায়।

অন্য এক হিন্দু পরিবার হরিপ্রসাদ নামে একজন যার দুই মেয়ে সুষমা ও দূর্গার সাথে ঘটে যাওয়া সেই হৃদয়বিদারক দিনগুলো যাতে মিশে ছিলো একেকটি মূহুর্তে আতংকিত হয়ে কাটানোর আর্তনাদগুলো।

সোবাহানের হাত ধরেই আমরা আরো একটি পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হলাম তা হলো রহমান সাহেব ও তার কন্যা হেনার সাথে সোবহানের ঘটে যাওয়া বর্ণিত কিছু দিবসের সমাহার যা পরিসমাপ্তিতে রূপ নেয় পরিণয়সূত্রে।

উপন্যাসের মূল উপজীব্যই ছিলো বাবা, ঠিক তেমনি আমরা বীর, ত্যাগী, বীরপুরুষের মতোই কিছু বাবার সন্ধান পেয়েছিলাম যারা শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও তাদের সন্তানকে আগলে রেখেছেন বেশ যত্নে। ঠিক যেমনটা করেছিলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে তাদের রক্তবিন্দু দিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বেদনাব্যঞ্জক দিনগুলোতে আমরা প্রায়শই মা-বোনের ত্যাগ ও হাহাকারের বর্বরোচিত চিত্রের এক বাস্তব নীলনকশা দেখেছিলাম। খুব সম্ভবত বাবাদের অবদানগুলি আমাদের চোখ এড়িয়ে ধরা দেয়নি আর সম্মুখে, তাদের জন্যই বাবা একটি জনপ্রিয় উপন্যাস হবে বলে আমি মনে করি যাতে যুদ্ধের সেই ভয়াল দিনগুলোতে ত্যাগ ও হারানোর হাহাকারে নিয়ে যাবে। আজও আমরা দগ্ধ হই শুনে সেই একাত্তরের কাহিনী। তবে এটি একটি ভিন্ন বই যাতে বাবাদের আত্মত্যাগের পিছনে লুকিয়ে থাকা হৃদয়বিদারক, মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলি বেশ কষ্টময় মূহুর্তের পুরোটাই দখল করে নিয়েছে রিয়াজ ফাহমী রচিত "বাবা" উপন্যাসটিতে।

উপন্যাসের পুরোধা শক্তিকে যেন ধারণ করে আছে বাবা নামক এক কৃতিত্ব ব্যক্তি যার চিত্র আমরা দেখতে পেয়েছি কয়েকটি চরিত্রে যাদের পরিচয় হলো সবচেয়ে বড় পরিচয় আর তারাই হলেন বাবা।

একদিকে যেমন আনিসুর রহমান দূর্গা ও রুমকিকে বাঁচাতে নিজেকে একাই সঁপে দিয়েছেন পাকবাহিনীর টার্গেট করা ও বুলেটের সামনে, ঠিক তেমনি অন্যদিকে বন্ধুর ফেলে রাখা মেয়ে রুমকিকে যে কি-না ছোটবেলায় আনিসুর রহমানের হাতে তুলে দিয়েছিল সেই রুমকিকে নিয়েই বাঁচবার তাগিদে ছুটে বেড়িয়েছিলেন হরিপ্রসাদ, কিন্তু পরিশেষে তাকে ও পাকবাহিনীর হাতে নিহত হতে হয়, অথচ মৃত্যুর আগেও হরিপ্রসাদ নিজের সুঠাম দেহ দিয়ে রুমকিকে আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলেন। ভিন্নতার দিকে গেলে অবনীর প্রতীক্ষার পরে ও ফিরে না আসা বাবা অজিতের কথা কি সে আদৌ ভুলতে পেরেছে মন থেকে? শেষের দিকে রহমান সাহেবের দেওয়া সোবাহানকে কথাটা ছিলো উপন্যাসের প্রাণ যেন,

তোমাকে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে,শুধু আমার মেয়ের জন্য নয়, একজন বাবার জন্যও।


কিন্তু ফিরে যাওয়ার সেই মূহুর্ত টা অজ্ঞাত ই রয়ে গেলো।

উপন্যাসের সর্বশেষ প্রশংসার দাবি রাখা দুই চরিত্র হাসান ও রানা যাদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার দুর্দান্ত সাহস ও হাসানের রুমকিকে পাকবাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করার মুহূর্তটি আজও চোখে অম্লান। সবমিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বহন করা মায়ের পাশাপাশি আড়ালে থাকা বাবাদের অবদানগুলি ও বেশ দারুণভাবেই রিয়াজ ফাহমী তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন তার "বাবা" উপন্যাসটিতে যা পাঠকমহলে বেশ খ্যাতি লাভ করবে বলে আমি আশাবাদী। উপন্যাসের ভেতরে লুকিয়ে থাকা হৃদয়বিদারক দিনগুলো সবার মনকে আলোড়িত করে হৃদয়কে স্পর্শ করে যাবে নির্দ্বিধায়।

★ প্রচ্ছদ

একটা বইয়ের সৌন্দর্য বাড়াতে প্রচ্ছদ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রিয়াজ ফাহমী রচিত বাবা উপন্যাসটিতে ও আমরা প্রচ্ছদটাতে দেখতে পাই কালো মলাটে বাঁধার উপর লাল রঙের অক্ষরে লেখা ছোট ছোট করে বাবা শব্দগুলো দিয়ে তৈরি একটি মানচিত্র। মূলতঃ কালো মলাটটা বহন করে আমাদের ২৫শে মার্চ কালোরাত্রির সেই দুঃসহ রাতটির কথা। আর লাল রঙটা বহন করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সেই লালরক্তের ভালোবাসাটা যা দিয়ে এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মানচিত্রের। এককথায় প্রচ্ছদটা এতোটাই আকর্ষণীয় যে পুরো বইটার সাথে মিলে সেই একাত্তরের কথাই যেন বলে যায় প্রচ্ছদের মাঝেই। নিঃসন্দেহে প্রচ্ছদকারী শাহরিয়ার সাদাত প্রশংসার দাবিদার।

★ উল্লেখিত কিছু উক্তি

  • মানুষের ভাগ্য নিয়ে মাঝে মাঝে নিষ্ঠুর খেলা চলে। যিনি খেলেন শুধু তিনিই জানেন তাঁর রহস্য।
  • এই অনিশ্চিত পরিবেশে একটা ব্যাপার নিশ্চিত। সামনের দিনগুলোতে আরও বড় কিছু হতে চলেছে। সন্ধ্যার পরেও আমি মিছিলের শব্দ শুনেছি। ইয়াহিয়া খান সবাইকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছেন।
  • দেশের সব জায়গা থেকে আকাশ কি একই রকম দেখায়? হাসানের তা মনে হয় না। আকাশ হলো আয়নার মতো, অতীতের ছায়া পড়ে। সব আকাশে সেই ছায়া দেখা যায় না।
  • তোমাকে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে, শুধু আমার মেয়ের জন্য নয়। একজন বাবার জন্যও।
  • এখন তাদের ঋণ শোধ করতে হবে। যদিও এই ঋণ কোন দিন শোধ হবে না। কিছু ঋণ কখনো শোধ হয় না।


★ ইতিবাচক/নেতিবাচক দিক
 

ইতিবাচক দিক

ভাষার সুস্পষ্ট ব্যবহার ও বেশ সহজ ভাষায় বোধগম্য ছিলো যা বুঝতে বেশ সহায়তা করেছিল। উপন্যাসের ভাব, প্রেক্ষাপট, প্লট ও কাহিনীর মধ্যে একটা অসাধারণ মিল ও ভালো লাগার অন্যরকম ভাব ছিলো। শব্দচয়ন ও সুন্দর করেই তুলে ধরা হয়েছে যা পড়ার মধ্যে যোগ করেছে এক ভিন্ন মাত্রা।

নেতিবাচক দিক

বইয়ের কয়েক জায়গায় বেশ কিছু বানানে ভুল ছিল, মাঝেমধ্যে বানানগুলো ভুলের কারণে কয়েকটা চরণ একটু খাপছাড়া মনে হয়েছিলো। টাইপিং দক্ষতা ও লেখক বানানের প্রতি সামনের দিকে একটু যত্নশীল হলে আশা করি লেখক ভুলটি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবেন।

তাছাড়া পুরো উপন্যাসটি সত্যি বেশ প্রশংসনীয় একটি উপন্যাস ছিলো।

★ চরিত্র বিশ্লেষণ


সোবাহান (প্রধান চরিত্র),
রুমকি (সোবাহানের চাচাতো বোন),
রানু (অজিতের বউ), অজিত, অবনী (অজিতের মেয়ে),
আনিসুর রহমান খান (সোবাহানের চাচা),
হালিমা বেগম (সোবাহানের চাচী),
হরিপ্রসাদ (আনিসুর রহমানের বন্ধু),
সুষমা (হরিপ্রসাদের বড় মেয়ে)
দূর্গা (হরিপ্রসাদের ছোট মেয়ে),
রহমান সাহেব (হেনার বাবা)
হেনা (সোবাহানের স্ত্রী),
হাসান, রানা, আখতার হোসেন, ক্যাপ্টেন মেজবাহসহ আরও কিছু চরিত্রের সমন্বয়ে রচিত রিয়াজ ফাহমীর "বাবা" উপন্যাসটি।



★ পাঠ-প্রতিক্রিয়া

একাত্তর সে তো এক প্রজ্বলিত হওয়া শক্তির নাম যেখানে লাখো শহীদের রক্তে মাখা স্বাধীনতার সোনালী অর্জন হিসেবে এসেছিলো বহুল প্রতীক্ষিত সে বিজয়। "বাবা" উপন্যাস টি পড়ার সময় ও একাত্তরের সেই রক্তাক্ত জখম করা বীর শহীদদের চোখের সামনেই অনুধাবন করা যাবে। আর বাবা যে এক বীর তাদের সন্তানদের জন্য করা ও নিজেদের মৃত্যুর মুখে দিয়ে সন্তানদের রক্ষা করা এমনকি আর্তনাদ, চাপাকষ্টগুলোকে অনুভব করতে হলে রিয়াজ ফাহমী রচিত বাবা বইটি হবে এক অনবদ্য সৃষ্টির দলিল। নিঃসন্দেহে লেখক সহজ সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করেছে যা সবার নিকট অতি সহজেই বুঝতে সহায়ক হবে। বাবাদের কৃতিত্ব গুলো জানতে ও মুক্তিযুদ্ধের সময় চলাকালীন বাবাদের অবদানগুলি আমাদের আবারো স্মরণ করিয়ে দিবে সেই একাত্তরের কাহিনীতে চলে যাওয়া দিনগুলোতে। পাঠককে অবশ্য অবশ্য বইটি পড়ার অনুরোধ রইলো, অনেক ভালো লাগার ও পছন্দের জনপ্রিয় বইটি যাতে বাবা নামক ছোট্ট শব্দটিতেই লুকিয়ে থাকার বিশালতা লেখক প্রতিটি পার্টে পার্টে উপস্থাপন করেছেন অনিন্দ্য সুন্দরের সংমিশ্রণে। আড়ালে থাকা কষ্টগুলো, হাহাকার, আর্তনাদ, মর্মস্পর্শী, হৃদয়বিদারক ইতিহাসের এক জলজ্যান্ত রূপ যেন উপন্যাসের মাঝেই ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক বেশ দারুণভাবে "বাবা" উপন্যাস টিতে।

=============


বাবা
রিয়াজ ফাহমী

প্রচ্ছদ: শাহরিয়ার সাদাত
প্রকাশকালঃ জুন,২০২০
প্রকাশনী: চন্দ্রভুক, ঢাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৪২
মূল্যঃ ৩২৫৳
ISBN: ৯৭৮-৯৮৪-৩৪-৮১৭৫-৭

১৫ থেকে ৩০ জুলাই ২০২১ এ গ্রন্থগত'র পৃষ্ঠপোষকতায় 'হিজিবিজি' ম্যাগাজিন আয়োজিত বুক রিভিউ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হওয়ায় রিভিউটি প্রকাশ করা হল।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ