'বুদ্ধদেব গুহ'র উপন্যাস আমার দুটি কারণে খুব ভালো লাগে। এক ভাষা, আর দুই প্রকৃতি। ভাষার গায়ে রেশমি সুতো দিয়ে কারুকাজ করা ঠাস বুনোট, যা বহুক্ষণ হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ইচ্ছে করে।
এই ভাষা, শব্দচয়ন, পশমিনা শালের মত মখমলি উষ্ণতা ছড়িয়ে দেয় শরীরের কোষে কোষে।
শরীরের সাথে, মনের সাথে বহুক্ষণ লেপ্টে থাকে। একেবারে ঝিমধরানো নেশা ধরায়। তার হ্যাংওভার কাটিয়ে ঝরঝরে হতে বেশ সময় লাগে, আমার তো তাই মনে হয়।
বুদ্ধদেব গুহর উপন্যাসে সব চরিত্রকে ছাপিয়ে যেটা বরাবরই কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠে তা প্রকৃতি। আর প্রকৃত চরিত্রগুলো যেন সেই বিস্তীর্ণ প্রকৃতির বুকে ফুটে থাকা বনজ ফুল।
এই প্রকৃতি কখনো সবুজ ধনেখালি শাড়ি পরা জবুথুবু অনুঢ়ার মত কোথাও লাজ রক্তিম, আবার কোথাও সাদা থান পরা বিষন্নতার শুভ্র প্রতীক। আবার কখনো বা কলকলিয়ে তিরতিরিয়ে বয়ে চলা চপলা নারী।
লেখক বুদ্ধদেব গুহ সেই প্রকৃতির সৌন্দর্যকে পেঁয়াজের খোসার মত একটু একটু করে ছাড়িয়েছেন বা নববধূর সৌন্দর্যের অবগুন্ঠন খুব ধীর লয়ে উন্মোচন করেছেন, ব্যাপারটিকে বেশ আ্যস্থেটিক করে তুলেছেন প্রত্যেকটি উপন্যাসে। "একটু উষ্ণতার জন্য" উপন্যাসটিও তার ব্যতিক্রম নয়।
লেখক যখন বলেন
এ জায়গাটা সকাল হয়না, সকাল আসে। অনেক শিশির ঝড়ানো ভেজা পথ মাড়িয়ে, অনেক শঙ্খিনী নদী পেরিয়ে সোনা গলানো পোশাক পরে সকাল আসে এখানে
তখন সত্যি বলতে কি থম মেরে সকালের পরশ গায়ে মাখতে ইচ্ছে করে। সকালের সাথে মুখোমুখি বসে দুদন্ড রোদ পোহাতে ইচ্ছে করে।
সামনে বিস্তীর্ণ প্রকৃতি ও ভাষার মিনেকারী করা পশমিনা চাদরটা গায়ে জড়িয়ে জাঁক করে বসে উপন্যাসের শরীরে একটু একটু প্রবেশ করি।
উপন্যাসের নায়ক সুকুমার বোস একাধারে একজন লেখক ও দুঁদে ব্যারিস্টার। ধরাচুড়ো পরে যার এক সওয়াল জবাবে বিবাদী পক্ষ কাত হয়ে যেতে পারে, তিনি সুন্দরী তন্বী নম্র স্বভাব বিশিষ্টা রমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেন।
লেখক সুকুমার বোসের নারীর সৌন্দর্য সম্পর্কে মনের মধ্যে কয়েকটি ব্যাখ্যা আছে। তিনি মনে করেন নারী যদি নিজেকে যত্ন করে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে না রাখতে পারেন তাহলে তাঁদের প্রতি তিনি একটা অবিমিশ্র ঘৃণা পোষণ করেন।
সুকুমার বোসের জবানীতে বুদ্ধদেব গুহর নারীর প্রতি এই রূপসর্বস্বপ্রিয়তা আমাকে ব্যথিত করেছে। নারী মাত্রেই তাকে সেজেগুজে পুটুলি সেজে থাকতে হবে। তার মনের সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব শুধু অন্তঃসারশূন্য ফাঁকা বুলি এবং তা শুধুমাত্র কপচানিতে শোভা পায় সেটাই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। এর চেয়ে "মাধুকরী " উপন্যাসে কুর্চির রূপবর্ণনায় লেখকের প্রতি সমীহ জাগে।
ঠিক এমন ধাক্কা "বাবলি" উপন্যাসে ও খেয়েছিলাম। যখন পৃথুলা বাবলিকে টেনিস খেলিয়ে স্লিম করা হয়। আমার মনে হয়েছিল লেখকের রোমান্টিসিজম ঘা খাচ্ছিল বাবলির গোলগাল গড়নে। এতক্ষণে উনি নায়িকার সৌন্দর্যে শান্তি পেলেন।
লেখক সুকুমার বোস একজন উন্নতিকামী। তিনি মান সম্মান যশের জন্য দিনরাত এক করে পরিশ্রম করেন। রাত দুটো তিনটে অবধি লাইব্রেরীতে সময় কাটিয়ে যখন তিনি বেডরুমে আসতেন তখন তাঁর সুন্দরী স্ত্রী শুকিয়ে যাওয়া ফুলের মত গুটিসুটি পাকিয়ে ঘুমের বুকে ঢলে পড়েছেন। এইসময় তাঁর জৈবিক চাহিদা জাগলেও তিনি স্ত্রীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে শরীরে তাড়া খাওয়া বাঘটাকে নির্বিবাদে খাঁচায় পুরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলস্বরূপ তাঁর স্ত্রী যখন হসপিটালের বেডে তাঁর বাল্যবন্ধু সলিলের আঙুলে আঙুলে কুরুশ বুনেছে তখন তাঁর টনক নড়ে। সে তার ব্যস্ততম সময় থেকে টুকরো টুকরো খুচরো সময় ভাঙিয়ে ব্যয় করতে চায় স্ত্রীর জন্য।
কিন্ত ততদিনে বন্দুক থেকে গুলি বেরিয়ে গিয়েছে। লেখকের সুন্দরী স্বাজাত্যভিমানীনী স্ত্রী কোনো বুক র্যাকের রেফারেন্স বুক নন যে লেখক তাকে প্রয়োজনে র্যাক থেকে নামিয়ে ধুলো ঝাড়বেন। আর ঠিক এইখানেই দাম্পত্যের মধ্যে যখন দুরত্ব কয়েক যোজন ব্যাপী! তখন লেখকের জীবনে আবির্ভাব ঘটে ছুটির। লেখক সুকুমার বোসের একনিষ্ট পাঠিকা "ছুটি"।
ছুটি মানে আনন্দ, ছুটি মানে অবসর। ছুটি মানে হিমশীতল জীবন থেকে মুক্তি।
ছুটি মানে ছুটে চলা জীবনের দিকে।
গল্পের নায়িকা ছুটি, আধুনিকা।
অতীত নয়, বর্তমান নয়, ভবিষ্যতে বিশ্বাসী। সে লেখককে শীতার্ত জীবন থেকে ছুটিয়ে নিয়ে যায় জীবনের দিকে। একটু উষ্ণতার দিকে।
এই হল গল্পের জিস্ট। তবে এই গল্প যদি কোন নারীর দৈহিক সৌন্দর্য হয়, তাহলে তার অলংকারস্বরূপ উঠে আসবে আরো কতগুলি কাহিনি।
নয়নতারা ও শৈলেনের প্রেমকাহিনী, আ্যডভেঞ্চার প্রিয় কিশোর লাবু ও তার কিশোরী বেদেনী প্রেমিকা নুড়ানির কাহিনী, ঠিক ততটাই আকর্ষক মিষ্টার বয়েলস ও প্যাটের কাহিনী।
এই অলংকারগুলো না থাকলে এই গল্পের সৌন্দর্য্য এমন খোলতাই হতনা, এ আমি বুক ফুলিয়ে বলতে পারি।
উপন্যাসটি আদ্যপান্ত সম্পর্কের জটিল উপপাদ্য। সম্পর্ক গুলোর এপিঠ ওপিঠ উল্টে যা উপলব্ধি করেছি বা যা মনে হয়েছে, তা হল "সীমারেখা" ও "সমতা"! এই দুইয়ের সমানুপাতিককতা ভীষণ জরুরি।
প্রত্যেকটা মানুষকে জানতে হয় কোথায় তাকে থামতে হবে,কতদূর অবধি তার সীমাবদ্ধতা।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর "কৃষ্ণ চরিত্র" প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন যে সর্বকালের সেরা মানুষ "শ্রীকৃষ্ণ"। জ্ঞানার্জনী, হ্লাদিনী, চিত্তাকর্ষিণী সমস্ত গুণের আধার ছিলেন তিনি।
কিন্তু বাস্তবে একজন মানুষের মধ্যে এত গুণের সমাহার হওয়া সম্ভব নয়, তাই বোধহয় আমরা ভুল করি, ট্রাজিক ভাঙা হাটে একা একা কাঁদি, হাহাকার করি।
লেখক সুকুমার বোস উন্নতির জন্য যখন দিনরাত পরিশ্রম করছেন,তখন তিনি ভুলে গেলেন একটা নারীর মন কি চায়! অর্থ, যশ খ্যাতি ঠিক কতটা প্রয়োজন জীবনে! সুখের চেয়ে কি স্বস্তি বড় নয়? একটা নারী শুধু ধন দৌলতে নয়, অনেক বেশি পরিতৃপ্ত হয় স্বামীর সাহচর্যে। সে সাহচর্য শুধু শারীরিক নয়, তা বরং অনেক বেশি মানসিক।
তিনি দৈহিক পরিতৃপ্তির জন্য ঘুমন্ত স্ত্রীকে বিরক্ত না করার মত ভালো মানুষী না দেখিয়ে তার চেয়ে বরং স্ত্রীর কবোষ্ণ কাঠবেড়ালি বুকের মাঝে নিজেকে যদি সেঁদিয়ে দিতে পারতেন, তাহলে তাঁকে সম্পর্কের শৈত্য কাটাতে ছুটির কাছে ছুটতে হতনা একটু উষ্ণতার জন্য। লেখকের স্ত্রী রমা যদি তার চাহিদাটাকে একটু ট্রিম করতে পারতেন বা নিজের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে স্বামীর বন্ধুর আঙুল না ধরে স্বামীর কাঁধে আঙুল ছোঁয়াতেন তাহলে হয়ত সম্পর্কের এই চৈতালি ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খেতে হতনা তাদের তিনজনকেই।
পরকীয়া ভালো কি মন্দ সে প্রশ্ন যে যার দৃষ্টিভঙ্গির ওপরে নির্ভর করে। বিয়ের পরেও কোন মানুষকে ভালো লাগতেই পারে। কিন্ত সেই ভালো লাগাটা কাঁচের বয়ামে পুরে জারাতে হয়। দুপুর রোদে পিঠ ঠেকিয়ে কোন মনখারাপের শীতার্ত দিনে আলটাগরায় টক্কর তুলে একটু একটু করে চাখতে হয়, কিন্ত তাকে দৈনন্দিন জীবনে ডালভাতে পরিণত করতে গেলেই গোল বাঁধে। ছুটি ঠিক এই ভুলটাই করে তার প্রিয় লেখক সুকুদার সাথে। তাকে সে দূর থেকে নয়, দেহ মন সর্বস্ব দিয়ে পেতে চায়, আর এই পেতে চাওয়ায় মেয়েলি সুলভ হিংসায় তাকে অনেক বেশি সাধারণ লাগে।
লেখকের স্ত্রী রমার সঙ্গে একটা আল্গা প্রতিদ্বন্দ্বিতা বরাবর লক্ষিত হয়। মাঝেমাঝে তো মনে হয় লেখক সুকুমার বোস ও তার পাঠিকা ছুটি তাদের পরকীয়া প্রেমের কৈফিয়ত স্বরূপ রমার চরিত্র বা স্বভাবকেই দোষারোপ করতে চেয়েছেন। হয়ত তাতে তারা পরকীয়া সম্পর্কে একটা বৈধ যুক্তি খাড়া করে শান্তি পেয়েছেন। ছুটির প্রেম সম্পর্কে ও মনে সন্দেহ জাগে।
লেখক সুকুমার যক্ষা রোগ বাঁধিয়ে চেঞ্জের জন্য ম্যাকলাস্কিগঞ্জে আসেন, তখন বারবার ছুটি তার কাছে ছুটে এসেছে দেহ মন সঁপে দিতে। সেই ছুটিই আবার লেখকের স্ত্রী রমার কাছ থেকে তিরস্কৃত হয়ে লেখককে ভুলে অন্য ছেলের সাথে লিভ ইন করে। ম্যাকলাস্কিগঞ্জের শীতার্ত রাতে প্রচন্ড উষ্ণতার ওম পোহাতে পোহাতেও ছুটির গলায় ঝড়ে পড়ে লেখকের থেকে এই সম্মতি আদায়ের প্রতিশ্রুতি যে ভবিষ্যতে অন্য কোন পুরুষ কে নিয়ে ঘর বাঁধবে। কিন্তু লেখকের স্ত্রী রমার মধ্যে দেখা যায় লেখককে কাছে ফিরে পাবার আকুতি। না পেয়ে ছুটি ও লেখকের ওপর নিস্ফল ক্রোধ। তাই বড় বেশি বুকে বাঁধে লেখকের সাথে তার স্ত্রীর নিভৃতযাপনের শেষ দিনটি। চোখ ভিজে যায় ওদের বিচ্ছেদে। হয়ত ছুটি ওদের মধ্যে না আসলে ওরা আবার এক হতে পারত।
আর এই উপন্যাসে যিনি সবকিছু খুইয়ে দেওলিয়া হয়েছেন তিনি লেখক সুকুমার বোস। এই চরিত্রটার মধ্যে যথেষ্ট ঋজুতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। মাঝেমধ্যে তো মনে হয় তিনি ছুটি বা রমাকে নয়, শুধুমাত্র তাদের সৌন্দর্যকে ভালোবেসেছেন। সৌন্দর্য না থাকলে দুজনের প্রতি তার ভালোবাসা ভ্যানিশ হয়ে যেত। ম্যাকলাস্কিগঞ্জের পেয়ারা তলায় দাঁড়িয়ে বালুচরী শাড়ি, মুক্তার ইয়ার টপে সজ্জিত সুন্দরী স্ত্রী রমাকে তার ভালোবাসতে ইচ্ছে করে, রমাকে কাছে পেয়ে ছুটিকে ও ভুলে যেতে ইচ্ছে করে।
তখন মনে প্রশ্ন জাগে রমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে বলেই লেখকের এই ভালোবাসার বোধ। যদি লেখকের বিরহে রমা বিবর্ণ হয়ে যেত!তাহলে কি লেখক স্ত্রীর প্রতি এই ভালোবাসা অনুভব করতেন? জানিনা! সত্যি জানিনা! ছুটিকেও তিনি বলেছিলেন আইব্রো পেন্সিল দিয়ে ভ্রুটা বুলিয়ে সেজে আসতে। সুকুমার বোস লেখক। আর লেখকের বোধে সৌন্দর্য্য জাগ্রত হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু হৃদয় কি এখানে একেবারে অনাদৃত থাকবে? বরং শৈলেনকে অনেক বেশি দৃঢ় লাগে, নয়নতারার প্রতি তার একনিষ্ট সমর্পণে। কিশোর লাবু তার বেদেনী প্রেমিকার সোনালী চুল ও কাঁকই বড় যত্ন করে রাখে। নুড়ানির জন্য সে তার মা ভাইকে ছেড়ে ও চলে যেতে দ্বিধা করেনা।
সর্বশেষে বলব "একটু উষ্ণতার জন্য" গাঢ় উপলব্ধি ও অনুভবের উপন্যাস। এই উপন্যাসের প্রত্যেকটা চরিত্র জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করায়। আর এর সবচেয়ে বড় পাওনা ম্যাকলাস্কিগঞ্জের প্রকৃতি ও সুন্দর ভাষা। যা দীর্ঘদিন বুকের মাঝে আবলুশ কাঠের বাক্সে সযত্নে মুড়ে রাখতে ইচ্ছে করে।
***********
একটু উষ্ণতার জন্য
বুদ্ধদেব গুহ
প্রকাশকাল: ১৯৮৭ (প্রথম সংস্করণ)
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা।
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ২৪৬
মূল্যঃ ১৫০ টাকা
ISBN:81-7066-373-3
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম