হন্ডুরাস এই কথাটার অর্থ হলো অনাব্য খাঁড়ি। ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর নাম শোনেন নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়, কিন্তু হয়তো অনেকেই ওনার আবিষ্কার করা একটি নতুন দেশ হন্ডুরাস এর নাম শোনেন নি। আর লেখক কৌশিক রায় ঠিক ওই অজ্ঞাত একটি দেশকে নিয়ে লিখেছেন এই সুদীর্ঘ উপন্যাস "হন্ডুরাসে হাহাকার"।
প্রথমে আমি বইটির কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য বলবো।
প্রচ্ছদ
কথায় বলে "বই এর মলাট হলো বই এর ললাট" কারণ অনেক অনেক পাঠক আছেন যারা বই এর প্রচ্ছদ দেখে বই কেনেন। এই বই এর প্রচ্ছদ শিল্পী কৃষ্ণেন্দু মন্ডল দাদার আঁকা প্রচ্ছদ এর অনেকগুলি বই আমি এর আগে পড়েছি, আর প্রতিটিই অত্যন্ত সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। এই বই এর প্রচ্ছদটি ও অসাধারণ দেখতে। সবথেকে বড় ব্যাপার প্রচ্ছদটি উপন্যাস এর চরিত্র কেন্দ্রিক। তাতেই আরো বেশি সুন্দর এবং আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
বাঁধন এবং পাতার মান
বিভা পাবলিকেশন এর বই এর কথা আর কী বলবো। অভিজিৎ খাঁ দাদাদের কাজ অত্যন্ত সুন্দর। এই বই এর বাঁধন অত্যন্ত মজবুত, আর পাতার মানও বেশ ভালো, তার সাথে হরফ সজ্জা ও বেশ ভালো। তাই অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ BIVA Publication এর কর্ণধার দের। এবং অনেক অনেক ধন্যবাদ এই বই এর সাথে যুক্ত সকলকে।
নামকরণ
এই বই এর নামকরণটি আগেও শোনা। ফেলুদা সিরিজ পড়াড় সময় অনেকেই হয়তো শুনেছেন। কারণ এই 'হন্ডুরাসে হাহাকার' লালমোহন গাঙ্গুলি এর একটি বই এর নাম। আর তার চরিত্র হলেন প্রখর রুদ্র। এখানেও তাই , কিন্তু লেখক একেবারে অন্য ধারায় রচনা করেছেন উপন্যাসটি, শুধু মাত্র নামের মিল ছাড়া আর কিছুই মিল নেই। তাই নামটি আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। তবে লালমোহন বাবু ওরফে জটায়ু এর বাস্তব অস্তিত্ব থাকলে উনি Copyright এর অভিযোগ করতেন কিনা তা আমার মতো ছোট্ট পাঠকের বলার ক্ষমতা নেই।
কারা বইটি পড়তে পারবেন আর কারা পারবেন না- প্রথমেই বাপু আমি বলে দিই আমি হলুম ওই সর্বভুক পাঠক এর দলের লোক। মানে লেখা ভালো লাগলে যেকোন বিষয়ে পড়তে ভালোবাসি। আর এই বইটির কথা যদি বলি তাহলে এটুকু বলবো যদি আপনি রহস্যপ্রেমী হন, যদি আপনি ইতিহাসপ্রেমী হোন, যদি আপনি মেডিকেল ক্রাইম থ্রিলার পড়তে ভালোবাসেন তবে, এই বই আপনার জন্য। আর যদি আপনি কোন বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হোন তবে তো কোন কথায় নেই। চটপট পড়ে ফেলুন হন্ডুরাসে হাহাকার।
বিষয়বস্তু
ক্রিস্টোফার কলম্বাস ইউরোপ থেকে পশ্চিমে মাত্রা করে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন এশিয়ার মূল ভূভাগে। ভাগ্যের ফেরে আবিষ্কার করে ফেললেন আমেরিকা। সংক্রামক ব্যাধি, কারাবাস, লাঞ্ছনা অতিক্রম করে পরবর্তীতে ১৫০২ সালে পৌঁছালেন নতুন দেশ হন্ডুরাস এ। আর এই উপন্যাস এর সূচনা হয় সেই জায়গা থেকেই।
এর সাথে সাথে ঘটনাচক্রে উঠে এসেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন বাঙালি বিজ্ঞানী আনন্দমোহন চক্রবর্তী ১৯৭১ সালে পরীক্ষাগারে কৃত্রিম ভাবে আবিষ্কার করলেন 'ওয়েল ইটিং ব্যাকটেরিয়া' দীর্ঘ টানাপোড়েন এর শেষে পেটেন্ট করানো হলো ১৯৮০ সালে। এটিই হয়েছিল পৃথিবীর প্রথম কোন জীবিত অংশের উপর করা পেটেন্ট। আর তার সাথেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে নেমে এসেছে এক অন্ধকার। কী সেই ক্ষতি? কেন দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে জীবনদায়ী ঔষধ এর ? এই প্রশ্নের উত্তর দেবে এই উপন্যাস।
স্পেনের অভিযাত্রী হ্যারনান কর্তেজ হন্ডুরাস আবিষ্কার এর কয়েক বছর পরই সেখানে গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করেন। সেখানের প্রাচীন উপজাতিদের থেকে জানা যায় এক হারানো শহরের কথা। কোথায় সেই শহর? কোন দেবতার অভিশাপ এর ফলে এই দশা? কোথায় সেই প্রাচীন পুঁথি? আর বানর দেবতাই বা কে? কোথায় তার মন্দির? "সাচি" কী? এর সাথে নিকারাগুয়ার সম্পর্কই বা কী? আর কেনই বা মাটির উপরে সোনার পাত? এই সকল প্রশ্নের উত্তর ও দিয়েছে এই উপন্যাস।
এর সাথে এই উপন্যাস-এ উঠে এসেছে বাঙালি বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী এর কথা। তার সাথে রোনাল্ড রস ও William Boog Leishman এর কথা। তাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানে অবদানের কথা।
এরপরও উঠে এসেছে বহু প্রশ্ন আর সব প্রশ্নের অবতারণা করেছে এই উপন্যাস আর উত্তর ও দিয়েছে এই উপন্যাস ই।
যেমন কেন খুন হলেন প্রখর রুদ্র এর বাবা মৃণাল রুদ্র? কে করলো খুন? টিম জটায়ু এর অস্তিত্ব ই বা কতটা? এই টিমের কাজ কী? Nine man of Emperor কী? তাদেরই বা কাজ কী? কেন একের পর এক খুন হচ্ছে টিম জটায়ু র মেম্বার রা? ড. হাজার ই বা আসল পরিচয় কী? থ্রিলার ঘরানার সমস্ত ধ্যান ধারণা বদলে দেওয়ার উপন্যাস হলো এই "হন্ডুরাসে হাহাকার"।
চরিত্র
এখানে অনেক চরিত্রই বর্তমান, তবে যেগুলি বেশ কিছু সময় ধরে দেখা গেছে সেগুলো সম্বন্ধে দু এক লাইন বলবো।
- প্রখর রুদ্র- বলার অপেক্ষা রাখে না, অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ ব্যাক্তি। দেশের স্বার্থে খুন করতেও পিছপা হন না। অত্যন্ত কঠোর মানসিকতার লোক।
- ড. হাজরা- পুরো নাম অদ্রীশ হাজরা। চারিত্রিক দিক থেকে বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ ব্যাক্তি, একজন দৃঢ় ব্যাক্তিত্ব। তবে নিজেকে বড্ড বড় ভাবেন, তাতে অপরের বুদ্ধি ব্যবহার করে হলেও।
- তোর্সা- একটি বুদ্ধিমতি নারী চরিত্র। ইতিহাস বিষয়ে আগ্রহী।
- পামেলা- এও এক জন বুদ্ধিমতি নারী চরিত্র। এবং এও ইতিহাস এর বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী।
লেখক এর চরিত্র সৃষ্টি ক্ষেত্রে নিজের যে প্রতিভার প্রকাশ করেছেন উপন্যাস এ, তার সত্যিই প্রসংশনীয়।
ভালো লেগেছে -
১. উপন্যাস এর প্লট বেশ ভালো লেগেছে।
২. বই এর বাহ্যিক গঠন খুবই ভালো
৩. লেখকের লেখনি অত্যন্ত সুন্দর।
৪. রহস্য এর ঝাঁপি বলা যায় বইটিকে।
৫. তথ্যযুক্ত একটি বই। বহু নতুন জিনিস জানা যায়।
৬. ইতিহাস, রহস্য, ক্রাইম সব কিছুর মিলিয়ে একটি যোগ্য সাসপেন্স এর বই।
৭. এত বড় বই হলেও বানান ভুল প্রায় নেই বললেই চলে।
২. বই এর বাহ্যিক গঠন খুবই ভালো
৩. লেখকের লেখনি অত্যন্ত সুন্দর।
৪. রহস্য এর ঝাঁপি বলা যায় বইটিকে।
৫. তথ্যযুক্ত একটি বই। বহু নতুন জিনিস জানা যায়।
৬. ইতিহাস, রহস্য, ক্রাইম সব কিছুর মিলিয়ে একটি যোগ্য সাসপেন্স এর বই।
৭. এত বড় বই হলেও বানান ভুল প্রায় নেই বললেই চলে।
ভালো লাগেনি -
১. সাহিত্য রসের অভাব অনুভব করেছি। তথ্যের খচখচানি বড্ড বেশি লেগেছে।
২. উপন্যাস টিতে মাইক্রোবাইলজি এর অংশ গুলো আর একটু কম করলে বোধহয় ভালো হতো।
৩. চরিত্র সৃষ্টির দিকে লেখক আর একটু সচেতন হতে পারতেন।
৪. উপন্যাস এর প্রথম দিকে যেন প্রখর রুদ্রকে হাজরা দিয়ে চেপে দেওয়া হয়েছে। (কিন্তু পরে অবশ্য স্কোপ বেশি দেওয়া হয়েছে)
৫. বই এর ভাষা আর একটু সহজ ও মার্জিত ভাবে হলে বোধহয় আরও ভালো হতে পারতো।
২. উপন্যাস টিতে মাইক্রোবাইলজি এর অংশ গুলো আর একটু কম করলে বোধহয় ভালো হতো।
৩. চরিত্র সৃষ্টির দিকে লেখক আর একটু সচেতন হতে পারতেন।
৪. উপন্যাস এর প্রথম দিকে যেন প্রখর রুদ্রকে হাজরা দিয়ে চেপে দেওয়া হয়েছে। (কিন্তু পরে অবশ্য স্কোপ বেশি দেওয়া হয়েছে)
৫. বই এর ভাষা আর একটু সহজ ও মার্জিত ভাবে হলে বোধহয় আরও ভালো হতে পারতো।
তবে ভালো লাগা এবং না লাগা মিলিয়ে মিশিয়ে বইটি আমার কাছে একটি অত্যন্ত প্রিয় এবং পছন্দ এর বই হয়ে উঠেছেন। লেখকের প্রখর রুদ্র সিরিজ এর আগের বই অর্থাৎ চক্রব্যূহে প্রখর রুদ্র আমার পড়া, আর এটি দ্বিতীয় বই শেষ করলাম। বেশ ভালো লেগেছে। তাই লেখকের কাছে প্রার্থনা আরও প্রখর রুদ্র সিরিজ এর লেখা চাই।
===========
হন্ডুরাসে হাহাকার
কৌশিক রায়
প্রচ্ছদ শিল্পী- কৃষ্ণেন্দু মন্ডল
প্রকাশ কাল- এপ্রিল, ২০২১
প্রকাশনী- বিভা পাবলিকেশন, কলকাতা
পৃষ্ঠা সংখ্যা- ৪৪৮ টি
মূল্য- ৩৩৩/- (ভারতীয় মুদ্রা, মুদ্রিত মূল্য)
ISBN: 978-93-90890-08-8
১৫ থেকে ৩০ জুলাই ২০২১ এ গ্রন্থগত'র পৃষ্ঠপোষকতায় 'হিজিবিজি' ম্যাগাজিন আয়োজিত বুক রিভিউ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হওয়ায় রিভিউটি প্রকাশ করা হল।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম