বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম স্থান দখল করে আছেন। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকার এ মানুষটিকে বলা হয় বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি বেশ সমাদৃত। বাদ যায়নি গীতিকার কিংবা চিত্রশিল্পীর পরিচয়ও। সৃজনশীলতার প্রতিটি শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল। অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ সফলতা এবং তুমুল জনপ্রিয়তা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি জাতিকে হুমায়ুন আহমেদ উপহার দিয়েছেন তাঁর অসামান্য বই, নাটক এবং চলচ্চিত্র।
৯ টি ছোটগল্প নিয়ে সংকলন আনন্দ বেদনার কাব্য। হুমায়ুন আহমেদ এর উপন্যাস পড়েছি অনেক তবে গল্প পড়া হয়ে ওঠেনি। প্রথমবারের মতো তাঁর গল্প পড়ার অভিজ্ঞতা বেশ ভালোই ছিল বলা যায়।
প্রচ্ছদ
কথায় বলে "আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী" কারন অনেক পাঠক আছেন যারা বই এর প্রচ্ছদ দেখে বই কেনেন। এই বই এর প্রচ্ছদ শিল্পী ধ্রুব এষ। উনার আঁকা প্রচ্ছদ এর অনেক গুলি বই আমি এর আগে পড়েছি, আর প্রতিটিই অত্যন্ত সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। এই বই এর প্রচ্ছদ টি ও দেখতে অসাধারণ।
বাঁধন
এই বই এর বাঁধন অত্যন্ত মজবুত, আর পাতার মানও বেশ ভালো, তার সাথে হরফ সজ্জা ও বেশ সুন্দরভাবে সজ্জিত হয়েছে।
সূচিপত্র
* আনন্দ বেদনার কাব্য
* এইসব দিনরাত্রী
* ঊনিশ শ একাত্তর
* জলছবি
* খেলা
* শিকার
* পাখির পালক
* অসুখ
* কবি
আলোচনা - সমালোচনা
১ম গল্পঃ আনন্দ বেদনার কাব্য
“রিক্তশ্রী পৃথিবী” নামক একটি কাব্য গ্রন্থ পড়ার সময় লেখকের অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে গল্পে। ১১৩টি কাব্য ছিলো সেই গ্রন্থে। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছে গ্রন্থাকারের স্কুল পড়ুয়া মেয়ে। বইটি লেখার পাঁচ বছর পরে যখন বইটি ছাপা হয় তখন লেখকের সেই প্রচ্ছদ শিল্পী মেয়ে আর বেঁচে নেই।
২য় গল্প : এইসব দিন রাত্রি
একজন হতদরিদ্র স্কুল শিক্ষক হঠাৎ করেই দুই টাকার লটারিতে দুই লাখ টাকা পেয়ে যান। একসময় তিনি তার মেয়ের চাওয়া এক হাজার টাকা দিতে পারেননি। কিন্তু এখন পকেটে আছে দুই লাখ টাকার লটারির টিকেট।
৩য় গল্প : ঊনিশ'শ একাত্তর
গ্রামে হঠাৎ করেই এসে পরে একদল পাকিস্তানি মিলিটারি, সবাই ভয়ে পালিয়ে যায় বনে। একটি পাগল কিন্তু পালায় না। পাগলকে গাছের সাথে বেঁধে রেখে তারা সেখানে বিশ্রাম নিতে বসে। গ্রামের মুরব্বীদের অনুরোধে ভীতু এক প্রাইমারি শিক্ষক দেখা করতে আসে মিলিটারির সাথে। তাকে চরম অপমান করা হয়। শেষে ভীতু সেই শিক্ষক মিলিটারি অফিসারের মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়ে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে থাকেন।
৪র্থ গল্প : জল ছবি
জলিল সাহেব প্রতিদিনই ঠিক সময়ে অফিসে আসেন, কখনো দেরি হয় না। আজ অফিসে আসার সময় হঠাৎ জুতাটা ছিড়ে গেলো। সেটা ঠিক করতে দেরি হয়ে গেলো অফিসে আসতে। অফিসে এসে শুনলেন তাকে বড় সাহেব খুঁজেছেন। জলিল সাহেবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে কোন কারণে পছন্দ করেন না, অকারণে তার খুঁত ধরেন। সারা দিন তিনি ভয়ে ভয়ে কাটালেন দুপুরের দিকে আবার তার ডাক পরলো বড় সাহেবের ঘরে। ভয়ে ভয়ে দেখা করতে গেলেন তিনি। তখন শুনলেন হেড অফিস তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে অফিসার পদে পদোন্নতি দিয়েছে। খবরটা শুনে তিনি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন।
৫ম গল্প : খেলা
নলিনী বাবু একটি স্কুলে ইংরেজী পড়ান। তার বন্ধু জালাল সাহেবের পাল্লায় পরে দাবা খেলা শিখে ফেলেন। শিখেই তিনি তার বন্ধুকে খেলায় হারিয়ে দেন। একের পর এক তিনি প্রতিটা খেলাতে জিতে যান। এরপর ১৫ বছর কেটে যায়, তিনি পনের বছরে কোন দাবা খেলায় হারেন নি। সারা শহরে তার নাম ছড়িয়ে পরে। এমনকি তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসলে বাংলাদেশের দাবা চ্যাম্পিয়ান তার সাথে দাবা খেলেন। নলিনী বাবু তাকে তিনবার হারান। নানান যায়গা থেকে অনেক লোক খেলতে এসে হেরেছেন। পনের বছরে দরিদ্র শিক্ষক নলিনী বাবুর শরীর খুব খারাপ হয়ে পরলো। তখন তার রিটায়ারমেন্টের সময় এলাকার চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন নলীনি বাবুকে যে হারাতে পারবে তাকে ১৫ হাজার টাকা পুরস্কার দিবেন। নলিনী বাবুর চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার। তাই তখন ঠিক করা হয় তিনি জীবনে প্রথমবার হারবেন তার বন্ধু জালাল সাহেবের কাছে। জেতার পনের হাজার টাকা দিয়ে তার চিকিৎসা করা হবে। কিন্তু তিনি চেষ্টা করেও জীবনের শেষ খেলায় হারতে পারেন নি। ঠিকই জিতে গেলেন।
৬ষ্ঠ গল্প : শিকার
আজরফ ও তার বাবা কীভাবে বক শিকার করতো তার কাহিনী এখানে বর্ণিত হয়েছে।কিন্তু কখনো কখনো বকেরা শিকারির চোখে ঠোকর দিয়ে তাকে অন্ধ করে দেয়ে। আজরফের বাবারও দুটি চোখই এভাবে নষ্ট হয়েছে, এবার ওর নিজের পালা।
৭ম গল্প : পাখির পালক
একজন বেকার যুবকের সারাদিনের এলোমেলো উদ্দেশ্যহীন কিছু কর্মকান্ডের কথা বলা হয়েছে এই গল্পে।
৮ম গল্প : অসুখ
একজন অপ্রকৃতস্থ মা যার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পরলে তাকে মাঠের মাঝে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিলো। এই কথা মনে হলেই মা আরো অপ্রকৃতস্থ হয়ে যান। তাই যুদ্ধে ছেলের সাথে থাকা বন্ধু মাঝে মাঝে এসে বলে যায় তার ছেলেকে জবাই করা হয়নি, তার পেটে গুলি লেগে মারা যায়। এ কথা শুনে মা কিছু দিনের জন্য শান্ত হয়।
৯ম গল্প : কবি
মা হারা অসুস্থ এক ছোট্ট মেয়ে আর তার কবি বাবা বৃষ্টির রাতে লিখে চলে চোখে জল নিয়ে নতুন কোন কবিতা।
সবচাইতে ভালো লেগেছে 'খেলা' গল্পটি। 'খেলা' গল্প অবলম্বনে পরবর্তীতে একটি নাটক নির্মিত হয় হুমায়ুন আহমেদ এর পরিচালনায়। একমাত্র হুমায়ূন আহমেদই পারেন মাত্র সাত আট লাইনের মধ্যে একটা চরিত্র দাঁড় করিয়ে সেই চরিত্রের আনন্দ বেদনার সাথে পাঠককে মিশিয়ে ফেলতে। যে কাজটা অন্যান্য লেখকদের করতে পাতার পর পাতা খরচ হয়ে যায়।
এরপর ভালো লেগেছে- 'অসুখ', 'এইসব দিনরাত্রি' আর 'জলছবি'।
আনন্দ বেদনার কাব্য, পাখির পালক, শিকার গল্পগুলো খুব একটা ভালো লাগে নি। এই গল্পগুলোতে মনে হয়েছে লেখক দায়সারাভাবে কাজ সারতে চেয়েছেন যদিও এগুলো আমার একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত।
সবশেষে আমি মনে করি, মন ছুঁয়ে যাওয়ার মত কয়েকটা গল্প নিয়ে এই সংকলন। বাইরে থেকে দেখলে সাদামাটা মনে হলেও গল্পগুলো আসলে সাধারণ জীবনের কিছু অসামান্য অনুভূতির শাব্দিক রূপায়ণ।
**********
আনন্দ বেদনার কাব্য
হুমায়ূন আহমেদ
প্রচ্ছদশিল্পী: ধ্রুব এষ
প্রকাশকালঃ প্রথম অন্যপ্রকাশ সংস্করণ - একুশের বইমেলা ২০০৮
প্রকাশনী: অন্যপ্রকাশ, ঢাকা
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৬৪
মূল্যঃ ১০০ টাকা
ISBN: 984 868 474 3
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম