চরিত্রসমূহ
- হাসান – প্রধান চরিত্র
- তিতলী – হাসানের প্রেমিকা
- তারেক – হাসানের ভাই
- রীনা – তারেকের স্ত্রী
- লাবনী – তারেকের কলিগ
- লায়লা – হাসানের বোন
- হিশামুদ্দিন – কোটিপতি ব্যবসায়ী
- চিত্রলেখা – হিশামুদ্দিনের মেয়ে
- সুমি – হাসানের ছাত্রী
- শওকত – তিতলীর স্বামী।
- নাদিয়া – তিতলীর বোন
- হাসানের মা-বাবা, তারেকের দুই ছেলে, তিতলীর মা-বাবা, লায়লার স্বামী।
গল্পের মূল চরিত্র হাসান নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একজন বেকার যুবক। হাসানকে অবশ্য ঠিক বেকার বলা যায়না। সে হিশামুদ্দিন সাহেব নামে একজন ধনী ব্যক্তির কাছে সপ্তাহে একদিন ঘন্টা হিসেবে কাজ করে। কাজ হলো হিশামুদ্দিন সাহেব তার জীবনের গল্প গুলো বলেন আর হাসান তা একটা খাতায় নোট করে।
হাসানের পরিবারে বাবা-মা, দুইভাই, ভাবি, ভাইয়ের দুই ছেলে আর ছোট বোন। পরিবারের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং চরিত্র হচ্ছে রীনা ভাবি। রীনা ভাবিই বর্তমানে তাদের সংসারটাকে দুহাতে আগলে রেখেছে। সে হাসি-ঠাট্টা করতে পছন্দ করে। হাসানকে ভীষণ স্নেহ করে ভাবী। তার মতে যদি পৃথিবীতে পাঁচজন ভালো ছেলের তালিকা করা হয় সেখানে হাসানের নাম থাকবে।
হাসান প্রায় রাতেই একধরনের দুঃস্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে দেখে সে একদল হাঁসের সাথে হেটে বেড়াচ্ছে, কাঁদার মধ্যে খাবার খুঁজছে। শামুক ঝিনুক এসবের ভেতর থেকে কপকপ করে খাবার খাচ্ছে। কি বিশ্রী ব্যাপার! এই স্বপ্নের কথা সে লজ্জায় কাউকে বলতে পারেনা, শুধু তিতলীকে বলেছে। এর সমাধান স্বরূপ তিতলী বলেছে সে একদিন সে হাসানকে হাঁসের মাংস রান্না করে খাওয়াবে তবেই হাসানের এই স্বপ্ন দেখা বন্ধ হবে।
বাংলা সিনেমার মতো সিঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে দুজনের প্রথম দেখা, এরপর আস্তে আস্তে শুরু হয় প্রেম। তবে হাসান তিতলী কে যতটা ভালোবাসে ততটা প্রকাশ করতে পারেনা, এই নিয়ে তিতলী প্রায়ই মন খারাপ করে। তার ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবে দুই-এক লাইনের চিঠি, নানা অজুহাতে তিতলীর বাড়িতে যাওয়া, কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আর মাঝে মাঝে বুড়িগঙ্গায় নৌকায় করে ঘোরা। খা খা রোদের মতো বেকার জীবনের এই একটা জায়গাতেই হাসানের এক পশলা বৃষ্টির মতো করে সুখ মিলতো। কিন্তু সেই সুখও বেশীদিন হাসানের ভাগ্যে ছিলোনা। কারন তার মধ্যবিত্ত জীবনের সাথে যে বেকার নামের একটা সিলমোহর ছিলো যার কারণে শেষমেশ সেই সুখের সুতোতেও একদিন টান পড়ে।
হিশামুদ্দিন সাহেবের মেয়ে চিত্রলেখা বিদেশে থেকে ডাক্তারী পড়ছে। সে জীবনে কোনো পরীক্ষায় প্রথম বৈকি দ্বিতীয় হয়নি। বাবাকে দেখতে দেশে আসার পর ঘটনাচক্রে বাবার ব্যবসা দেখার দায়িত্ব পড়ে তার কাঁধে। তার একাকিত্ব জীবনের সারাদিনের ব্যস্ততার পর দিনশেষে হাসানের সাথে কথা বললেই যেন তার সব ক্লান্তি কেটে যায়। কিন্তু হাসান কি আদৌ কখনও পারবে চিত্রলেখার এই একাকিত্ব দূর করতে?
বয়স মানুষের মধ্যে কতটা পরিবর্তন নিয়ে আসে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হলো হাসানের বাবা। যেই বাবাকে দেখলে তার সন্তানেরা সবাই ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকতো সেই বাবা এখন তার সন্তানদের চোখ লুকিয়ে চলেন, তার মধ্যে কেমন একটা গা-ছাড়া ভাব চলে এসেছে। সংসারে কি হচ্ছে না হচ্ছে কোনো বিষয়ে তার মাথাব্যথা নেই।
হাসানের সহজ সরল বড় ভাই তারেক। রীনা ভাবি যাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে, কিন্তু সেই ভালাবাসার প্রতি ভ্রুক্ষেপও নেই তারেকের। তার সব চিন্তা এখন লাবনীকে নিয়ে। আসলে আমরা যাদের সহজ ভেবে তাদের সব দোষ-ত্রুটি আড়াল করি, তারাই একসময় জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাত টা দেয়। যেমন পেয়েছে রীনা ভাবি।
বন্ধু মহলের এমন কেউ নেই হাসান যার উপকার করেনি, এমনি এক বন্ধু হলো সদ্যবিবাহিত লিটন। বেকার জীবনে বিয়ে করে একরকম হতাশায় পড়ে যায়। হাসানের জন্যই এখন সে বউ নিয়ে সিঙ্গাপুর থাকে, হাসানকে সে চিঠি লিখে পাঠায় যাতে তার সন্তানের জন্য কিছু সুন্দর নাম পাঠায়। কিন্তু সে জানতেও পারলোনা কার জন্য আজ তার অবস্থার এই আমূল পরিবর্তন হয়েছে।
এছাড়া নাদিয়া, শওকত, হিশামুদ্দিন সাহেব, জহিরের দাদি আরও কিছু চরিত্র নিয়েই "মেঘ বলেছে যাবো যাবো" বইয়ের ঘটনা প্রবাহ এগিয়েছে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
ছোট থেকেই অনেক ধরনেরই বই পড়েছি, তার মধ্যে থেকে কিছু বই অসাধারণ ভালো লাগার ছিল। যার মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের মেঘ বলেছে যাব যাব অন্যতম।
মূলত মধ্যবিত্ত পরিবারের কিছু মানুষের জীবনের ঘটে যাওয়া সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা, হতাশা, অপারগতা, পাওয়া-নাপাওয়ার গল্পকে ঘিরেই এই বই। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হাসানকে কেন্দ্র করেই বইয়ের কাহিনী। যখন হাসান শুনলো তিতলি তার জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। তখন হাসান কাঁদতে পারেনি, কিন্তু আমার চোখ তখন ছলছল করছিলো। তিতলীর এই চলে যাওয়ার কথা লেখক হাসানকে জানানোর আগে আমাদের (পাঠকদের) জানিয়ে দিয়েছেন , তবে যখন নাদিয়ার মুখ থেকে আবার শুনলাম তখন আমার বুকের ভেতর টা ভারী হয়ে গেলো। অজান্তেই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। বুড়িগঙ্গায় ভাসতে ভাসতে তিতলী হাসান কে কি গান শোনাতে চেয়েছিলো তা হাসানের মনে ছিলো না তবে আমার মনে আছে।
জগৎ এর কি নিয়ম! সময়ের সাথে সাথে একসময় সব কিছু ঠিক হয়ে যায়, সময় সব ঘা শুকিয়ে দেয় ৷ তবে সবার সব ঘা কি শুকায়? হাসান তো পারেনি তিতলীকে ভুলে যেতে। কিন্তু তিতলী জগতের নিয়ম মেনে নিয়েছে। শওকতের বিশ্বাস মত তিতলীর শান্ত মুখ একদিন কোমল হয়েছে। শওকতের একনিষ্ঠ ভালোবাসায় সে হার মেনেছে। আসলে এমনটা হওয়ারই ছিলো। মানুষ স্বভাবতই ভালোবাসার কাঙ্গাল, যেখানে ভালোবাসা পায় সেখানেই নিজেকে মেলে দেয়। কিন্তু যেই বেচারি হাসানকে মনপ্রাণ দিয়ে এতো ভালোবেসে গেছে এমন করুন অবস্থাতে সে হাসানকে এক নজরও দেখতে পারলোনা, জানতেই পারলোনা যে সে আর কোনোদিন চাইলেও হাসানকে সেই গান শোনাতে পারবে না। তবে তিতলী না এলেও চিত্রলেখা এসেছিলো হাসানের কাছে। কিন্তু কেনো এসেছিলো সে? কিই বা বলতে চেয়েছিলো হাসানকে? সে নিজেকে অহংকারী ভাবে বলেই হয়তো তার মন যা বলছিলো মুখ তা বলতে পারলো না।
সত্যিই মেয়েরা অনেক কিছু পারলেও কিছু অনুভূতি আপন মনে পুষে রাখতেই বেশী অভ্যস্থ, যা তারা নিজে থেকে কখনোই প্রকাশ করতে পারেনা যেমন রীনা পারেনি তারেককে দুইলাইনের একটা চিঠি লিখতে তেমনি চিত্রলেখাও পারেনি হাসানকে দেখতে আসার দ্বিতীয় কারণটা হাসানকে জানাতে। গল্পের সবগুলো চরিত্রই মাথার ভেতর গেঁথে আছে তবে হাসান আর রীনা চরিত্র দুটিকে আমি মাথায় গাঁথতে পারিনি। দুটি চরিত্রই আমার মাথায় ঘুরপাক খায়। তাদের দুজনের জন্যই আমার শুধু মনে হয়েছে আহারে! দুজনেই পরিস্থিতির স্বীকার। তাদের ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েও কত সহজেই নীরবভাবে ভালোবেসে গেছে। সত্যিই বাস্তব কখনও গল্পের মতো হয়না। তাই আমরা কঠিন বাস্তবকে না ভালোবেসে সুখের গল্পকেই ভালোবাসি, কারন গল্প যে কল্পনারই বহিঃপ্রকাশ। আর আমরা কল্পনায় বাঁচতেই বেশী ভালোবাসি।
**********
মেঘ বলেছে যাব যাব
হুমায়ূন আহমেদ
প্রচ্ছদশিল্পী: ধ্রুব এষ
প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭
প্রকাশনী: অবসর প্রকাশনা, ঢাকা।
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ২৪৪
মূল্যঃ ৪০০ টাকা
ISBN: 978-984-8798-54-6
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম