সাজিয়া আফরিন স্বপ্না রচিত 'আঁধার পেরিয়ে' নিয়ে আলোচনা : নাছরিন আক্তার মনি

সাজিয়া আফরিন স্বপ্না রচিত 'আঁধার পেরিয়ে' বই

"ভালোবাসা আসলে একটা দুরারোগ্য ব্যধি, যা মানুষের কিশোর বয়স থেকে শুরু করে প্রবীণ বয়সে এসেও মুক্তি দেয় না" - সাজিয়া আফরিন স্বপ্না (আঁধার পেরিয়ে)

★ প্রথম কথা:

বইটির প্রথম থেকেই শুরু হয় আঁধারের গর্ভে বিলীন হওয়া এক নারীর প্রজ্জ্বলিত আলোর দিকে ছুটবার একাগ্র প্রয়াশ। যা প্রতিটি পাঠকের মন ছুঁয়ে দিবে। একজন নারী কতটা অবহেলিত, অসম্মানিত হয়ে তার স্বামীর ঘর ছেড়ে আসার কথা চিন্তা করে তা এই বইটিতে ফুটে উঠেছে। ফুঠে উঠেছে আরো কয়েকটি নারীর কখনো দূর্গার রূপ, কখনো বা লক্ষ্মীর রূপ। নারীদের নরম মনটাও এক সময় কঠিন হয়ে সমাজ নামক শক্ত দেয়ালের পাঁচিল টপকে সংগ্রামী হতে পারে তা এই উপন্যাসটির উপলব্ধির বিষয়।

★ লেখক পরিচিতি:

চলন বিল, কাঁচাগোল্লা, একসময় নাটোরে বসে অর্ধেক বাংলা রাজত্ব করা রাণী ভবানী এবং জীবনানন্দ দাশের 'নাটোরের বনলতা সেন' খ্যাত সেই নাটোরের নাটোরকন্যা লেখিকা সাজিয়া আফরিন স্বপ্না। রাজশাহী কলেজ থেকে ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন তিনি। এটিই তাঁর প্রকাশিত প্রথম বই।

★ কাহিনী সংক্ষেপ:


উপন্যাসটি শুরু হয় প্রধান একটি চরিত্র নীল নয়না মির্জাকে দিয়ে। যিনি ভালোবেসে বিয়ে করেন রুদ্রকে। এক বছর সুখে শান্তিতে বসবাস করলেও এরপরে নয়নার দেখা হয় রুদ্রের রুদ্রমূর্তি নামক এক অচেনা মুখোশ। যা রুদ্রের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত ছিলো নয়নার। দিনের পর দিন এভাবে চলতে চলতে ভেঙ্গে যায় তাদের সংসার।

অন্যদিকে, সাঁঝবাতি আর সীমান্ত দুই মেরুর মতো বিপরীত বৈশিষ্ট্যের দু'জন মানুষ। সাঁঝবাতি বাচাল আর সীমান্ত স্বল্পভাষী। কিশোর বয়স থেকে সীমান্ত সাঁঝবাতিকে ভালোবাসলেও বড় হয়েও সে তার মনের কথা সাহস করে সাঁঝবাতিকে বলতে পারেনি। সাঁঝবাতি রাগী, একরোখা মেয়েটাও কখনো বুঝতে পারে না সীমান্তর ভালোবাসার কথা। সীমান্ত কি পারবে শেষ পর্যন্ত সাঁঝবাতিকে তার মনের কথা বলতে? রুদ্র আর নয়নাও কি আর কখনো এক হবে? হবে কি আঁধার পেরিয়ে আলোর মুখ দেখা সবার? জানতে হলে পড়তে হবে রহস্যের জাল বিছিয়ে রাখা এই উপন্যাসটি।

★ পাঠ প্রতিক্রিয়া:

এই গল্পে ফুটে উঠেছে কখনো কলকল পানির ধারা বয়ে যাওয়ার মত হাসি কখনো বা মেঘে ঢাকা আকাশের কালো রূপটির মত দুঃখ। কখনো ফুটে উঠেছে নয়নার দুঃখ ভরা বিষাদ কাহিনী। কখনো বা সাঁঝবাতি আর সীমান্তের ঝগড়ার রূপ। কখনো বা তনিমার মত মায়েদের মেয়ের প্রতি গভীর স্নেহ আবার কখনো বা রেহেনা মির্জার ভয়াল দূর্গা রূপ। কখনো বা তৌসিফের লুকোনো কিছু দুঃখ বিলাস। আবার কখনো বা রবির কাউকে না দেখার তীব্র যন্ত্রণা। বিচ্ছেদ, মিলন, বিরহ, কষ্ট, সুখ সবকিছুর ছোঁয়া আছে বইটিতে। সাবলীল শব্দচয়নের মিশ্র অনুভূতির উপন্যাসটি প্রতিটি পাঠকের মন কেড়ে নেওয়ার যোগ্যতা রাখে।

★ প্রিয় উক্তি:

০১. সুসময়ে সবাই পাশে থাকে, দুঃসময়ে গর্ভধারিণী মা ছাড়া আর কাউকে দেখা যায় না।
০২. চোখ পৃথিবীর সবচেয়ে অবাধ্য জিনিস, না চাইলেও টলটলে জল গড়িয়ে দেয় কারণে অকারণে।
০৩. ভালোবাসা মানুষকে দ্বিধাহীনভাবে অসহায় বানিয়ে দেয়।
০৪. প্রণয় যখন পরিণয় হয়ে যায় তখন সুখ সীমাহীন হয়। সেই অনুভূতিটা হয় অবর্ণনীয়।
০৫. প্রিয়জন মরে গেলে যতটা না কষ্ট হয়, তারচেয়েও অনেক গুণ বেশি কষ্ট হয় চেনা মানুষ বদলে গেলে।


★ পাঠ পর্যালোচনা:

এই অংশটিকে আমি কয়েকভাবে ভাগ করে আলাদা আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করবো।


চরিত্রায়ন:
"আঁধার পেরিয়ে" এই উপন্যাসটিতে প্রধান চরিত্র ছিলো নয়না, সেই সাথে সাঁঝবাতি এবং সীমান্ত। নয়না চরিত্রটি লেখিকা এত সুন্দর, সূক্ষ্ণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যা প্রশংসার দাবিদার। নয়না পরিস্থিতি বুঝে কখনো রুদ্রকে ভালোবাসার দিকে চেয়ে নরম থাকলেও এক সময় তার মন শক্ত হয় এবং হয়ে উঠে সংগ্রামী। সমাজের মানুষের অজস্র ধারালো বুলি এবং কাজ উপেক্ষা করে ছুটে চলে নিজের গন্তব্যে। দৃঢ়চেতা, কঠিন মনের এই চরিত্রটিই আমাকে মুগ্ধ করেছে বেশি। অন্যদিকে, সাঁঝবাতি চরিত্রটি বাচাল, রাগী এবং একরোখা। তার মুখে কথার যেন শেষ নেই। একবার মুখে কথার খই ফুটলে তা বন্ধ করা মুশকিল। তবে, তার বেদনাদায়ক অনুভূতিটিও খুব ভালোভাবেই লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। তার হাসিতে কখনো নূপুরের ঝংকার তো তার দুঃখে ঘরটায় নির্বিকার। সীমান্ত বোকার মত ছেলেটা সাঁঝবাতিকে ভালোবাসি কথাটি বলতে পারে না। তার ভদ্রতা, আচরণ সাঝের প্রতি ভালোবাসা সব পাঠকের মন কাড়ার মত। রেহেনা মির্জার রাগ, তৌসিফের কষ্টরত অতীত এবং বর্তমানের কষ্টে বিলীন হওয়া; তনিমার মতো মা এবং তার মনে জমে থাকা হাজারো কষ্টের পাহাড় সাথে রবির হৃদয়ে আঁচড়ে পড়া ভালোবাসার ঢেউ এবং তার মনোকষ্ট সব এত সুন্দর করে লেখিকা তুলে ধরেছেন যা বিশ্লেষণ করে শেষ হবে না। প্রতিটি বইয়ে চরিত্র চিত্রায়ণটাই বেশি দরকার। চরিত্র ফুটে না উঠলে পাঠকের বুঝা দায় বইটি। চরিত্রগুলো পুরো গল্প জুড়ে চিত্রায়ণ করিয়েছেন লেখিকা। পরিবেশ অনুযায়ী চরিত্রগুলো পরিবর্তন হচ্ছিলো যাতে করে চরিত্রগুলো চোখের সামনে ভাসমান লাগছিলো। আমার মতে চরিত্রের ক্ষেত্রে লেখিকা স্বার্থক। সকল চরিত্রকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখিকা। চরিত্র চিত্রায়ণে আমি লেখিকাকে ১০/১০ দিবো।

ডেভেলপমেন্ট:
ডেভেলপমেন্টের কথা যদি বলি তাহলে বলবো সেটাও লেখিকা যথেষ্টভাবেই করেছেন। যেখানে যতটুকু দরকার ছিলো ততটুকুই দিয়েছেন। কোনো কিছুই বাড়তি ছিলো না। গল্পটি যথোপযুক্তভাবেই উপস্থাপন করেছেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। ঘাটতির কথা যদি বলি, তাহলে তৌসিফকে লেখা চিঠিটি ভেবেছিলাম লেখিকা তুলে ধরবে। কিন্তু, তা করেননি। যদিও তাতে গল্প বিঘ্ন হয়নি। তারপরও একটু চাহিদা রয়েই গেলো। নয়না বলেছিলো কেউ যাতে তার সাথে যোগাযোগ না করে। কিন্তু, পরে নয়নার সাথে কে যোগাযোগ করে জানায় যে রেহেনা মির্জা অসুস্থ; তাও লেখিকা উল্লেখ করেননি। এবং রুদ্র কেন নয়নার সাথে খারাপ আচরণ করতো, কেনই বা ভালোবেসে বিয়ে করে শেষ পর্যন্ত নয়নার দিকে ফিরেও তাকাতো না এসবের যথোপযুক্ত কারণ লেখিকা তুলে ধরেননি। ডেভেলপমেন্টে আমি লেখিকাকে ৯/১০ দিবো।

সেটিং ও থিম অ্যানালাইসিস:
উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে সেটিং। অর্থাৎ গল্পে কবেকার সময়ের কথা বলা হয়েছে, কোন জায়গায় কাহিনীটি ঘটেছে তা গল্পের মাধ্যমে পাঠকের কাছে তুলে ধরতে হয়। এই গল্পটির প্রতিটি দৃশ্যই এমনভাবে সাজিয়েছেন লেখিকা যাতে করে মনে হচ্ছিলো চোখের সামনে সবকিছু ভাসছে। সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন প্রতিটি জায়গা। তাই, কোনোকিছু বুঝতে অসুবিধা হয়নি। বলা যায়, লেখিকা সব পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরেছেন। থিমটি অসাধারণ ছিলো এবং তা সেটিংও করেছেন পাঠকের মনে জায়গা করে নেওয়ার মত। তাই সেটিং ও থিম অ্যানালাইসিসে লেখিকাকে আমি ১০/১০ দিবো।

স্টোরি টেলিং ও লিটারেরি টুলস:
স্টোরি টেলিং এর গুণেই একটা দূর্বল থিমও অনেক পাঠকপ্রিয়তা পায় এবং এর অভাবেই একটা চমৎকার থিম ভালো উপন্যাস হয়ে উঠতে পারে না। অর্থাৎ একটা স্বার্থক উপন্যাসের জন্য স্টোরি টেলিং এর গুরুত্ব অনেক। এই গল্পের স্টোরি টেলিং মিশ্র ধরনের। কোথাও গল্প খুব সাবলীলভাবে এগিয়েছে, আবার কোথাও মনে হয়েছে বেশ ধীরে এগিয়েছে।

শুধু ভালো গল্প এবং স্টোরি টেলিং হলেই একটা মানসম্মত উপন্যাস হয়ে যায় না। এটিকে আরো চমৎকার করে তুলে বিভিন্ন লিটারেরি টুলস। এই ক্ষেত্রে লেখিকা অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। বিশেষ করে রূপক, উপমার ব্যবহারসহ লেখিকা কাব্যিক ছোঁয়া দিয়েছেন। এই জিনিসগুলো গল্পকে আরো সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। লেখিকার শব্দভান্ডার এত উন্নত তা দেখে আমি অভিভূত। দারুণ শব্দচয়নে পুরো গল্পটি শুরু থেকে শেষ করেছেন তিনি। শব্দচয়নগুলো উপন্যাসটিকে নতুন রূপ প্রদান করছিলো। গল্পটিও হয়ে উঠলো অসাধারণ। লেখিকাকে স্টোরি টেলিং এ আমি ৯.৮/১০ দিবো এবং লিটারেরি টুলসের ব্যবহারে দিবো ১০/১০।

এন্ডিং:
"আঁধার পেরিয়ে" গল্পের এন্ডিংটি লেখক সব ঠিকভাবে করলেও তৌসিফের চিঠি আর নয়নাকে কে খবর দিলো, রুদ্রের অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের কারণ এই দিকগুলো উল্লেখ না করায় মনের মধ্যে একটু খচখচ করছে। সব পেয়েও একটু কিছু বাদ গেলো ওরকম টাইপের। তারপরও সবকিছু দিয়ে এন্ডিংটি পারফেক্ট ছিলো। এন্ডিংয়ে লেখিকাকে আমি ৯.৪/১০ দিবো।

ওভার অল অ্যানালাইসিস:
বইটিতে খুব কম ভুলই আমার চোখে পড়েছে। যে ভুলগুলো পেয়েছি তা ছাপাখানায় কোনোরকম সমস্যার কারণে হয়েছে এটা বুঝতে কারোরই মনে হয় বেগ পেতে হবে না। আশা করি সামনে এসব দিক দিয়ে আরো ভালো করে লক্ষ্য রাখা হবে। বাক্য গঠন, শব্দচয়ন সবকিছুই ঠিক ছিলো। ভুলগুলো বাদ দিলে বলা যায় উপন্যাসটি এক কথায় চমৎকার। লেখিকার এই বইটি পাঠকের মনে জায়গা করে নিতে সক্ষম হবেই।

**********

আঁধার পেরিয়ে
সাজিয়া আফরিন স্বপ্না


প্রচ্ছদশিল্পী: আঁখি সরকার রাই
প্রকাশকালঃ বইমেলা ২০২১
প্রকাশনী: সাহিত্যচর্চা প্রকাশনী, চট্টগ্রাম
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১৪৪
মূল্যঃ ২৫০ টাকা
ISBN:  978- 984- 95318-2-1

১৫ থেকে ৩০ জুলাই ২০২১ এ গ্রন্থগত'র পৃষ্ঠপোষকতায় 'হিজিবিজি' ম্যাগাজিন আয়োজিত বুক রিভিউ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হওয়ায় রিভিউটি প্রকাশ করা হল।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ