সাম্য রাইয়ান - লোকাল ট্রেনের জার্নাল | অশেষ যাত্রার পথ - তানজিন তামান্না

সাম্য রাইয়ান - লোকাল ট্রেনের জার্নাল

স্বপ্ন আর না বলা কথায় ছুটতে ছুটতে গুডবাই ভর্তি ব্যাগ নিয়ে উঠে পড়তে হবে সাম্য রাইয়ানের লোকাল ট্রেনে... ‘লোকাল ট্রেনের জার্নাল’ বইয়ের প্রত্যেকটা গদ্যে ‘একটি সত্য’ জানতে চাওয়ার জানলা খুলে যেতে থাকবে ট্রেনের ছন্দে ছন্দে। আর এই ছন্দে দুলতে দুলতে পৌঁছে গেলাম কী হৃদপিণ্ডের সাইলেন্সে? লোকাল ট্রেনের জার্নালেই উদিত হবে বেঁচে ওঠার সূর্য। দৃশ্যত হবে: ‘প্রকাণ্ড এক ঋতুর ছায়া’।

“আর আমার ঘরে দুনিয়াদারি নিলামে তুলে ‘পাখি সব করে রব’। এই কোলাহল জটলা পাকায়, তবু দূরের বন্ধনী থেকে কিছুটা ঘ্রাণ- হালকা-। প্রকাণ্ড এক ঋতুর ছায়ায় বেড়ে উঠছে।” [ গদ্য: দুলে ওঠে তোমার প্রদীপ]


“ঘুম থেকে উঠি আর ভুলে যাই এখন মধ্যরাত কী দুপুর ! পাজেল মেলে না আমার। ওহ্‌ পাজেল- ওহ-! তারও কি সূত্র ভুলে গেছি ?” [ গদ্য: বিদীর্ণ আলোর ধারা]


গদ্যগুলোতে আহ্বান আছে, আছে জার্নির বিস্ময়— ভাবনা এবং ভাবনায় উঠে আসা যাপিত রাত্রির ঘুমের দ্বন্দ্ব অথবা অন্তর-দ্বন্দ্ব। ভুলে যাওয়া সূত্র মেলাতে গিয়ে মিলে যাবে কোনো কোনো স্বপ্ন। স্বপ্নের ভেতর দ্যাখা যাবে— কোনো এক জমে যাওয়া প্রেম। প্রেম জমে গেলে মনে হতেই পারে “এ কী হলো আমার?” স্বপ্নের ভেতর প্রকাশিত হয়ে যেতে পারে ভাষায় প্রকাশ করতে না পারা ‘তুমি’।

 “তোমার চুলগুলো উড়ছে। উড়ছে প্রজাপতি আর মৃদু জলের বুদবুদ জমছে দুরুদুরু বুকে। কীরকম না? আর তুমি হাসছো! অথবা তাকিয়ে দেখছো সব, জলবৎ তরলং। অথবা চিৎকার করে বলছো, ‘সিগারেট কমাতে হবে’। [ গদ্য: একটা সত্যি কথা বলো]


‘তোমাকে’ প্রকাশ করতে করতে তুমুল অন্ধকারে ডেকে উঠবে ঝিঁ-ঝিঁ পোকা। প্রচণ্ড নীরবে খ’সে পড়তে থাকবে রাত্রির এক একটি কাঠামো। ট্রেনের অপেক্ষায় কবি রাত পার করতে থাকবেন এক একটি নৈঃশব্দকে জন্ম দিতে দিতে। পুরো পৃথিবীর হলুদ রঙ নিয়ে তারা হেঁটে আসবে কি দৃশ্যের কাছাকাছি ? হাঁটতে হাঁটতে পথ ক্লান্ত হয়ে পড়লে গেয়ে উঠবে জীবনবোধের গান।

“দৃশ্যমান সকল কিছুই সত্য নয়, কখনো অদৃশ্যমান অনেক কিছুই সত্য প্রমাণিত হয়।”
[গদ্য: হাঁটতে হাঁটতে পথ গ্যাছে ক্লান্ত হয়ে]


‘লোকাল ট্রেনের জার্নাল’ পড়তে পড়তে আমিও এসে দাঁড়িয়েছি— নিজস্ব আঁধারের কাছে। এই দাঁড়ানোতে নেই কোনো উদ্দেশ্য! এখানে কোনো ঘ্রাণ ভেসে আসলে চোখ বন্ধ করি— পাখিরা ডেকে ওঠে! প্রকাশিত হয়ে যায়— নিঃসঙ্গ আকাশ!

“এইসব বিচ্ছিরি বোধের দেশে নিজের ভেতর নিজেই গুটিয়ে থাকে নিঃসঙ্গ আকাশ। আর জীবন এতোটাই প্রাণহীন যে, টোলখাওয়া চেহারায় আঁধারে দাঁড়িয়ে লাভ নেই।”
[গদ্য:টোলখাওয়া চেহারায় আঁধারে দাঁড়িয়ে লাভ নেই]


এবার ফিরে আসা যাবে স্বপ্নের কাছাকাছি! লোকাল ট্রেনে ভেসে আসবে— নদীর নিজস্ব ঘ্রাণ। কবিতার পূর্ণ-দেহ নিয়ে জেগে উঠবে নদীর তীর। ‘লোকাল ট্রেনের জার্নাল’ এ উঠে আসতে থাকবে গভীর এক শব্দপ্রবাহ— প্রস্ফুটিত আত্মহন্তারক!

“হাহাকার জমা আছে মনে। কতোটা চাই, ফিরে পেতে। পাওয়া হয় না। কতো স্মৃতি জমিয়ে রেখেছি মায়াপাশে। এই বৃথাবাক্সে জমিয়ে রাখা স্মৃতিচিহ্ন।” [গদ্য: কবিতার পূর্ণদেহে নদীর নিজস্ব ঘ্রাণ]


‘রাত্রি একটা অনাহুত বেদনার নাম’— গদ্যটি পড়তে পড়তে চমকে উঠলাম! “ঘুম ভেঙে গেলে বুঝি কান্না পায়! না হলে জন্মক্ষণে তুমি কেঁদেছিলে কেনো?”— এই প্রশ্নে আমি থেমে থাকলাম দীর্ঘক্ষণ একটা সুমধুর ভাবনা নিয়ে। ঘুমের এতো সত্য প্রকাশ আর কোথাও দেখা হয় নাই! প্রশ্নের এতো স্বচ্ছতা লোকাল ট্রেনের জার্নালের প্রত্যেকটা গদ্যে সুতীব্র বিদ্ধ করবে সবাইকে। আর সুতীব্র উত্তরও বুনে দেয়া আছে গদ্যগুলোর ভেতরেই।

“আকাশ দেখে আশ্চর্য হওয়া মানুষের অনিবার্য কর্ম নাকি! আদি থেকেই মানুষ আকাশ নিয়ে গভীর মগ্নতায় দিন কাটিয়েছে। চর্যাপদেও এ বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। শুধু কি আকাশ-নীল?” [গদ্য: শাদা অন্ধকারে অন্য মন্ত্র]


লোকাল ট্রেনের জার্নাল— এই জার্নির কোনো শেষ নেই,  ক্লান্তি নেই! শুধু এক রহস্যে ঘেরা স্বচ্ছতা খুব নীরবে বয়ে যাচ্ছে ... দূর থেকে সন্নিকটবর্তী দূরে দেখা যাচ্ছে রহস্যের আড়ালে আরো আরো রহস্য! আর শেষ পর্যন্ত ‘পৃথিবী খুব একটা মজার জায়গা না’— এই সত্য ভালো লাগার জন্ম দিচ্ছে— উস্কে দিচ্ছে জিজ্ঞাসা... প্রথম থেকে যাত্রা শুরু করার পিছুটানের জন্ম দিচ্ছে লোকাল ট্রেন।

=**=**=**=**=
গদ্যগ্রন্থ: লোকাল ট্রেনের জার্নাল । লেখক: সাম্য রাইয়ান । প্রথম প্রকাশ: মার্চ, ২০২১ ।
প্রকাশনা: ঘাসফুল । প্রকাশক: মাহ্‌দী আনাম । ‍ প্রচ্ছদ: রাজীব দত্ত । মূল্য: ১৬০ টাকা ।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ