কবিতা লেখাকে এক ধরনের ভ্রান্তি বলেছেন ওদুদ ভাই। অবশ্য সেটা বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা। ওদুদ ভাই নিজের কথা বলবেন, সেটা তাঁর নিজস্ব বিষয়। একজন পাঠক হিসেবে আমি বলব আমার অনুভূতির কথা। ভালো লাগার কথা, ভালো না লাগার কথা। বিস্মিত হবার কথা, বিস্মিত হতে পারার ব্যর্থতার কথা। সেটা অবশ্যই টেক্সট নির্ভর, টেক্সটের বাইরে কিছু নয়। আমার ধারণা শিল্প তৈরি হওয়ার পর, শিল্প শিল্পী থেকে আলাদা হয়ে যায়। কবিতা লেখার পর কবিতা থেকে আলাদা হয়ে যান কবি। কবিতা থাকে, তার ভেতর থাকে কবির চিন্তাবিশ্ব। কবি যেটা ভাবেননি সেটাও থাকে লুকিয়ে। কবি যে রঙের কথা বলেননি, যে অনুভূতির সংরাগে ভাসেননি, সেটাও থাকে। এজন্য কবিতা আমার কাছে লৌকিক হয়েও লোকোত্তর। কবিতা পাঠকের একান্ত অনুভূতির সাথে মিশে গিয়ে একটা নতুন ব্যঞ্জনা তৈরি করতে পারে বলে মনে করি। আমি কবি নই, পাঠক মাত্র। তবে ওদুদ ভাই যে একজন কবি এটা নিশ্চিত। ওদুদ ভাইয়ের দ্বিতীয় কবিতার বই 'কোলাজ' সম্প্রতি পড়ে শেষ করেছি৷ একসাথে "কোলাজ" ও "সুফলা নক্ষত্রের আকাশ" বই দুটো পেলেও (ওদুদ ভাই পাঠিয়েছিলেন) এখন পর্যন্ত কোলাজ পড়ে শেষ করেছি। এর কারণ তাড়াহুড়ো করে পড়লে কবিতা উপভোগ্য থাকে না। এর সাথে আলসেমির ব্যাপারটাও অস্বীকার করছি না। "কোলাজ" বইটিতে কবিতা আছে ৫৩ টি। কবিতায় প্রেম এসেছে, এসেছে যাপিত জীবন বাস্তবতার ছবি। শৈশব, পেরিয়ে আসা সময়, বন্ধুর কথা, যৌবনের কথা, কথা রাখার কথা। সবকিছু ছাপিয়ে একটা শূন্যতা, একটা করুণ সুর বেজে উঠতে দেখা গেছে। কেবল ক্ষয়ে যাওয়া সময়ের হাড়জিরজিরে ভগ্ন মূর্তিটা বার বার মনে পড়ে। সভ্যতার উৎসমুখে যেমন ফিরে যাওয়া আছে, তেমনি আছে চেতনার অতলের ডুব সাঁতার। শেকড় সন্ধানী আত্মজিজ্ঞাসার কাছে যেতে যেতে কবিতায় খুলে গেছে, জড়িয়ে গেছে চিন্তার সূতো। একটা ক্ষোভ, অভিমান, ধ্বসে পড়া সভ্যতার প্রতি উদ্বেগও আছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে সেই হারিয়ে যাওয়া, হারিয়ে ফেলা, পেরিয়ে আসা সময়কে ঘিরে হাহাকারটাই শোনা যায়। ওদুদ ভাই যেন স্মৃতির পশরা সাজিয়ে রেখেছেন। কবিতা তার আত্মজীবনী হতে পারে, বিশেষত সেই পেরোনো সময়ের টুকরো টুকরো চিত্রকল্প। আমি যা বলছি ওদুদ ভাই হয়ত তা বলেননি, বলতেও চাননি৷ আমি মনে করি কবিতার সবথেকে বড় শক্তি এটাই। কোলাজ বইয়ের কবিতাগুলোর মধ্যে কিছু কিছু কবিতা, বরং বলা ভালো কবিতার ভেতর কিছু কিছু লাইন বেশ ভালো লেগেছে। আবার কিছু কবিতা পড়ে খুব ভালো লাগেনি। কিছু জায়গায় মনে হয়েছে শব্দ ও অনুভূতির মাত্রা পরিমিত হয়নি। কেবল ভালো লাগার কথা বলা যেত। কিন্তু এই ভালো না লাগার কথাটাও বলা জরুরি। মিথ্যে, অসত্য মিশ্রিত স্তুতি বাক্যে ওদুদ ভাই খুশি হবেন এটা আমার মনে হয়নি। বরং সত্য কঠিন বলে, কঠিনকে তিনি ভালোবাসেন বলেই বিশ্বাস। তিনিও যে সত্য খোঁজেন তাঁর পরিচয় লেখায় পাওয়া যায়। ওদুদ ভাই খুব চমৎকার পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখতে পারেন। তাঁর শব্দ যোজনা ও অনুভূতির জাদুকরী প্রকাশ দেখেছি কবি নুসরাত নুসিনের "কামনা ফলের দিকে" বইয়ের প্রতিক্রিয়ায়। তাঁর মতো শব্দের শাসন আমার নেই। শব্দের মোহন জাদুতে অনুভূতি উদঘাটনের মতো বুদ্ধিদীপ্ত যোগ্যতা আমার নেই। যা বলা হলো তা আলোচনা নয়, পূর্ণাঙ্গ প্রতিক্রিয়াও নয়৷ ইচ্ছে ছিল কবিতার বইদুটো নিয়ে ওদুদ ভাইয়ের সাথে কথা বলার। ইচ্ছে এখনও আছে। ব্যস্ততা, আলসেমি আর বিস্মৃতির কবলে পড়ে বইটি সম্পর্কে কথা বলা হয়ে উঠছিল না। একটা পুরোপুরি নির্ঘুম রাতের শেষ, মাথা ভারী জড়তা নিয়ে দুটো এলেমেলো কথা বলতে যাওয়া কতটুকু ঠিক হলো জানিনা। আমার ব্যর্থতা ওদুদ ভাই ক্ষমা করবেন। "সুফলা নক্ষত্রের আকাশ" পড়ার পর কথা বলতে চাই। ততদিনে কোলাজও পড়া হবে আরেকবার। "কোলাজ" থেকে কিছু ভালো লাগা লাইন উদ্ধৃত করছিঃ
মানুষের পৃথিবীতে যেন দূরূহ অশান্তি অদ্ভুত
কোথাও শান্তি নেই, হয়ত আগেও ছিলনা
আছে শুধু প্রবৃদ্ধি, - কাঁটাতারে ঘেরা অস্থির সংকেত
নেই নির্মল বোধ আর চৈতন্য, - রয়েছে ঘোলাজলে মাছের শিকার
দৈন্যের পরাভব রঙিন আঁচলে ঢাকা -
তাই বুঝি দারিদ্র্যও রঙিন
স্বাধীন সংবিধান মানুষকে করেছে পরাধীন
শৃঙ্খলার নীতিকথা করেছে বিশৃঙ্খল
এখন তবে সবকিছু উতল বিপরীত।
(ধৃষ্ট সভ্যতা)
*
এখানে একদিন বহতা নদী ছিল, - যারা দেখেছে অতীত-
তারা শুধু জানে
এখন শুধুই বালুচর, চিকচিক হাহাকার
অভিমানী নৌকা কিছু পড়ে আছে তীরঘেঁষা নির্জনে
স্মৃতিবুকে স্মৃতিভূক সময়ের আঁধারে হারাবে বলে-
..
মন্ডলবাড়ির কুমারী মেয়ে গোপনে ধরেছিল দেহে প্রণয়বিষ
লজ্জায় অপমানে মরেছিল ডুবে কলসি- গলায়
সেই অভিশাপে নদীও কি মরে গেল তবে?
(চিতা)
*
মানুষের মতো কতো বেমানুষ [ অমানুষ / না মানুষ নয় কেন? - ই.আ ]
শকুন উড়েছিল কবে আকাশের ডানায় মৃতকে ভালোবেসে
গাংচিল খুঁজেছিল আহার জলের থালায় জীবনকে কাছে ডেকে!
(এসেছি যখন)
*
শ্বাসরোধী মেঘের সংকাশে নিজেকে জানতে চেয়েছি-
অভিমানী নীলিমার কাছে আমার কোনো ঋণ ছিল কি না-!
[ অভিমানী শব্দটি বাদ দেয়া যেত- ইআ ]
(আত্মজিজ্ঞাসা)
*
আকাশ ভেঙে কান্নাগুলো নামে-
মেঘের জলে গহন কালো
বারে বারে মদির বেদন তোমার কাছে ডাকে
সূর্যদেহে জমতে থাকে তরল বেদন যত
রাতের গোপন আঁধার ঘন আড়াল
ছড়িয়ে দেবে রোদ্রজলে [ রৌদ্র? ] সকাল- বাতাসে
.... [ পুরো কবিতাটি ভালো লাগে... এখানে কেবল সামান্য উদ্ধৃত হলো ]
(ধুলোর সংসার)
*
একটা বসন্ত আবার চলে গেল, হয়ত ফুটেছিল ফুল
কিছু গেছে কোনো মুগ্ধ খোঁপায়, কিছু গেছে ঝ'রে
কিছু বা হয়েছে মধুজীবী কীট কিংবা পাখিদের আহার
তবু কিছু ফুল ছিল তোমার অপেক্ষায়-
..
এই প্রাক সন্ধ্যার ম্লান সবুজে, তুমি থাকলে-
একসাথে কিছুটা বৃষ্টিতে ভেজা যেত।
(একটা বসন্ত আবার)
*
কতোটা সাধনায় সিদ্ধিলাভ, সাধকের জানা
কতোটা শীতলে বরফ জমে, সেই শোক শুধু জলের
(সময়ের পথে)
*
এখন প্রায়শ ভেঙে পড়ে আকাশ
শালিক- মদের খ্যামটা বুকে পোড়া ঠোঁট
ব্রোথেল জুড়ে জেগে থাকে রাত্রির সুখ, উদ্বাস্তু ঈশ্বর-
কাঁটাতারে বন্দী ফুলের বাগান-
সভ্যতার মড়কে মাছিদের ভিড়
বুনো শুয়োরেরও সাধ জাগে-
তার নামে একটি কবিতা লেখা হোক!
(অদ্ভুত)
*
সূর্যের রুদ্র গভীরে দ্রোহের চিৎকার যেন কিছুতেই ঘুমাতে দেবে না
মাধবী লতার পেঁচানো আদর, হয়ত কাল- কেউটের তীব্র চুম্বনে-
জানাবে প্রতিশোধ [ নাকি প্রতিবাদ? ], - অসভ্য বেয়াড়া যত শিশ্নের উত্থান।
(মগ্নচৈতন্য)
*
বাম হাতে ধরা কোমল হৃদয়, - ডান হাতে উদ্যত ছুরি.
জীবন যেন মৃত্যুর মতোই সৌন্দর্যহীন
মৃত্যুই বুঝি জীবনের জীবন্ত উপমা!
(বিপরীত)
*
হয়তো বসন্ত আসবে না আর
কোকিল ফিরে যাবে বেদনার ক্লান্তি ছুঁয়ে
ছলনার সভ্যতা একদিন ধ্বংসের জাদুঘরে প্রত্ন- রূপকথা হবে
হাড়ের গায়ে লেখা থাকবে সময়ের দিনলিপি
যে দেহ ধরেছিল একদিন মানবের ইতিহাস।
(মানবের ইতিহাস)
*
মন্থন শেষে অমৃত যত নিয়ে গেছে সব দেবতার দল
রেখে গেছে অমৃতস্যঃ পুত্রঃ, নষ্ট মানুষ, মনোহর মসনদ
হায় মসনদ, তুমি শিখিয়েছ নোংরা প্রতারণা, অনাচার অশেষ...
ইডিপাস- শয্যায় দয়িতার মতো বন্দী মাতা আমার স্বদেশ!!!
(মসনদ)
*
একদিন কাশফুল হাতে ফেরি হতো কিশোর প্রেম
কিশোরী চুলে ঝরা শিউলির খোঁপা
নকশি রুমালে বাঁধা কতো ভালোবাসার রূপকথা
নবান্নের দুধগন্ধ মাঠে জোছনার অভিসার।
(ছায়াটিও যেন নিজের নয়)
*
মেঘের আড়ালে পুৃঁথি বগলে পালিয়েছে ঈশ্বর -
ভগমামের [ ভগবানের?] বংশাবলি গোলার আঘাতে ভেঙে চুরমার -
আসমানী মালিকেরা আরও উপরে-
সপ্ত আসমান খোলসে নিরাপদে বসবাস
আধিপত্যের শিল্পিত আগুনে বুদ্ধের প্রেতাত্মা-
অবাক চোখে চেয়ে দ্যাখে অগণিত জীবনের অহেতুক নির্বাণ!
(অহেতুক নির্বাণ)
.
.
.
[ লেখাটি সামগ্রিক চিন্তার প্রতিফলন নয়। কোলাজ বইটির পাঠ প্রতিক্রিয়ার খন্ডিত অংশ মাত্র। ব্যাকরণিক দৃষ্টিতে নয় বরং শুধুমাত্র ভালো লাগা মন্দ লাগার উপর ভিত্তি করে এই দু' চারটে কথা বলা হলো। ]
_()_()__()_()__()_()_
কোলাজ
আব্দুল ওদুদ
প্রকাশনার সালঃ ২০১৭
প্রকাশনীঃ কবি
প্রচ্ছদঃ মোস্তাফিজ কারিগর
পৃষ্ঠাঃ ৬৪
মূল্যঃ ১৫০
ISBN: 978- 984- 92190-4-0
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম