বাঙ্গালীর পারিবারিক জীবনের নানা টানাপোড়নের পাশাপাশি সামাজিক ও জাতীয় জীবনের সংকট নিয়ে উপন্যাস লিখে যিনি বারংবার শাসকদের রোষানলে পড়েছিলেন তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ভারতবর্ষের ক্ষয়িষ্ণু সমাজের আর্তনাদ, পীড়িত বঞ্চিতদের অধিকার নিয়ে প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি কলম ধরেন। এরই প্রেক্ষিতে উপনিবেশ শৃঙ্খলিত বাংলার পল্লী সমাজের অনাচার ও জমিদারী রাজনীতির পটভূমিকায় রচনা করেছেন পল্লী সমাজ উপন্যাসটি।
উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় ১৯১৫ সালে। লেখক উপন্যাসে সকল অনাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে উপন্যাসের নায়ক রমেশকে সচেতন যুবক এবং দ্রোহ ও বিপ্লবের প্রতীক হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। ফলে ঐ সময়ে উপন্যাসটি সাড়া ফেলে এবং সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়। সে সময়ে বিভিন্ন শ্রমিক শ্রেনীর সামাজিক আন্দোলনের ইশতেহাররূপে কর্মীদের মাঝে উপন্যাসটির কিছু কিছু অংশ হাতে লিখিত আকারে প্রচারিত হয়। অতঃপর উপন্যাসটি ১৯১৬ সালে মানে এখন থেকে প্রায় ১০৫ বছর পূর্বে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। সে সময়ে বাংলার তথা পল্লী সমাজের অর্থনীতি ছিল কৃষি নির্ভর। আর কৃষি ছিল জমিদার নির্ভর। বিষয়টা জটিল হলো(?) অর্থাৎ সে সময়ে জমির মালিক ছিল জমিদার। জমিদাররা ছিল সম্ভ্রান্ত পরিবার। বাদবাকী চাষাভুষারা ছিলেন প্রজা। তারা জমিদারের জমি বর্গাচাষ করতেন।
সেরকম দুইটি জমিদার পরিবারের পারিবারিক কলহের জের ধরে উপন্যাসের যাত্রা শুরু হয়। দুই জমিদার পরিবারের একটি পরিবার মহাকুলীন বলরাম মুখু্য্যের ছেলে যদু মুখুয্যের মেয়ে রমা। অন্য পরিবারটি হলো বলরাম মুখুয্যের মিতা বলরাম ঘোষাল পরিবারের রমেশ এবং বেণী মাদব ঘোষাল। বলরাম মুখু্য্য শুধু কুলীন ছিলেন না, তিনি ছিলেন অনেক বুদ্ধিমান এবং বর্ধমান রাজ সরকারের চাকুরীজীবি। সেই সুবাদে তিনি বর্ধমান সরকারের কাছে কুঁয়াপুরের জমিদারী লিখে নেন এবং বলরাম মুখুয্য তার মিতা বলরাম ঘোষালকে নিয়ে বিক্রমপুর থেকে এই গ্রামে আসেন। গ্রামটির নাম কুঁয়াপুর। বলরাম ঘোষালের বিয়েকে কেন্দ্র করে দুই বন্ধুর মধ্যে মনোমালিন্য হয় এবং শেষ অবদি দুই বন্ধুর বন্ধুত্ব এমন বিবাদে রূপ নেয় যে বছর বিশেক তাদের পরস্পরের মুখদর্শন বন্ধ থাকে। অতঃপর মৃত্যুকালে বলরাম মুখুয্য নিজের সমস্ত সম্পদ আপন সন্তান যদু মুখু্য্য ও বন্ধুর দুই সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে দেন। সেই থেকে কুঁয়াপুরে এই দুই পরিবারের প্রধান্য। মূলত পরিবার ও পারিবারিক কলহকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও উপন্যাসটি পুরো সে সময়ের একটি সমাজ ব্যবস্থাকে ফুটিয়ে তুলেছে।
কেন্দ্রীয় চরিত্র রমেশের বাবার শ্রাদ্ধকে ঘিরেই এ উপন্যাসের সূচনা ঘটে। রমেশকে এ উপন্যাসের নায়ক চরিত্র এবং রমাকে নায়িকা হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। উপন্যাসে বেণী মাধব জটিল চরিত্রের কুটিল মানুষ হলেও রমেশ নরম প্রজা দরদী জমিদার। আর উপন্যাসের নায়িকা রমা একদিকে যেমন প্রভাবশালী জমিদার অন্যদিকে বাঙালী সমাজের স্বাভাবিক নারী চরিত্র। যিনি জমিদার হয়েও একজন গ্রামীণ নারীর মতো পুরুষের কলংকের ভয়ে সত্যকে সত্য বলতে পারেননি। অন্যদিকে দুই পরিবারের প্রধান চরিত্র হলো বিশ্বেস্বরী। যিনি বেণী মাধবের মা। বাকি চরিত্রগুলোর সবাই গল্পের প্রয়োজনে এসেছে।
জমিদারদের নিষ্ঠুর দ্বন্দের মধ্যে পরে অসহায় প্রজাদের চিরকালের হাহাকার ধ্বনিত হয়েছে পল্লী সমাজ উপন্যাসে। এখানে এসেছে মহাজন ও জমিদার শ্রেণির স্বার্থান্বেষী চরিত্র। আগুনের শেষ, ঋণের শেষ ও শত্রুর শেষ রাখতে নেই- এ চিন্তাধারার মধ্যে পড়ে যায় প্রগতিশীল সকল আবেগ ও কার্যকলাপ এবং তাতে নষ্ট হয় সমাজ, বাধাগ্রস্থ হয় সমাজ সচেতনতা। উপন্যাসের সূচনা ঘটে তারিণী ঘোষালের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানকে ঘিরে। সেখানেই প্রথম পল্লী সমাজের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়। নিজের কাকার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পণ্ড করবার জন্য বেণী ঘোষাল দল পাকানো শুরু করে। এর ভিতরের একটাই কারণ বেণী ঘোষাল যে সেখানের মোড়ল, তার মোড়লীপনা প্রমাণ করা। কিন্তু শিক্ষিত রমেশের সততার ও সরলতার কাছে তা পরাস্ত হয়। সেই পরাস্তের গোপন অস্ত্র হিসাবে সে সময়ে রমেশের পাশে এসে দাঁড়ান উপন্যাসে ন্যায় ও নিরপেক্ষ মা বিশ্বেস্বরী। এরপর শ্রাদ্ধক্রিয়া শেষ হলে রমেশ যখন এলাকার শিক্ষা ও রাস্তাঘাট সংস্কারমূলক কাজে হাত লাগান তখন সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় গ্রামের প্রপগতিশীল নামধারী মোড়ল সমাজ। অথচ সেই মোড়ল সমাজের বিচারক ও ন্যায় অন্যায়ের দণ্ডদাতা বেণী ঘোষাল স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বেতনের খাতায় স্বাক্ষর নেন এক, কিন্তু দেবার সময় বেতন দেন কম। এভাবে যখন একসময় স্কুলটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম ঠিক সে সময়ে গ্রামের ছোট কর্তা রমেশ স্কুলের সংস্কারের কাজে হাত দেন এবং নিজে প্রতিদিন এক বেলা করে স্কুলে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। এই সময়ে তিনি লক্ষ্য করলেন এই গ্রামে শিক্ষা নেই বললেই চলে, আর যা আছে তা কুশিক্ষা। এলাকায় একটি রাস্তার মাঝখানে ছোট একটি জলাধার যা দুই রাস্তাকে বিচ্ছিন্ন করেছে। রমেশ চাইলেই একা সেটা সংস্কার করে দিতে পারেন, কিন্তু তিনি চাইলেন গ্রামের সকলের সহযোগীতা ও অংশগ্রহণে কাজটি শেষ করতে। এজন্য তিনি কতকদিন খরচ করে এর বাড়ি ওর বাড়ি করে ঘুড়ে গোটাকয়েক সিকি ছাড়া কিছুই পাননি। এতে রমেশের বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। কিন্তু একদিন রমেশ বাজারের একটি দোকানে জটলা করা লোকের ভীড়ে যখন শুনতে পেলো কয়েকজন গ্রামের মোড়ল মিলেই জোট পাকাচ্ছে যে ঐ রাস্তা সংস্কারের জন্য কেউ যেন কানা কড়িও খরচ না করে। কারণ রমেশ শহরের বাবু হয়ে জুতা পরে ঘুরে বেড়ায় সেই তার গরজে তার খরচে ইহা আপনা থেকে মেরামত করে দিবে। তখন দুঃখে, কষ্টে তিনি এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তা করেন।
গ্রামের মানুষগুলোকে লেখক এভাবে বর্ননা করেছেন,
এদের দান করলে এরা বোকা মনে করে, ভালো করলে গরজ ঠাওরায়, এখানে ক্ষমা করাও মহাপাপ; ভাবে ভয়ে পিছিয়ে গেল।
এমতাবস্থায় তার নিকটজন এবং ব্রাহ্মণসমাজের চাটুকারীতা, পরস্পরের প্রতি হিংসা এবং শত্রুতা দেখে রমেশ এক সময় শহরে ফিরে যাওয়ার জন্য তার জ্যাঠাইমা বিশ্বেস্বরীর কাছে বিদায় নিতে যান। বিশ্বেস্বরী রমেশের রাগ ও অভিমানের অর্থ বুঝেন। তিনি বলেন, বাবা কার উপরে অভিমান করে তুমি এ গ্রাম ত্যাগ করবে। যে কাজ শুরু করেছো এই কাজ শেষ করবার দায়িত্ব তোমারই। আমি জানি এতে অনেক দুঃখ আসবে। কিন্তু এই অশিক্ষিত ঘুণেধরা সমাজের পরিবর্তন যদি তোমরা নাই করিবে তবে এই সমাজ পরিবর্তন হবে কিভাবে। বিশ্বেস্বরীর রমেশের দিকে ভালবেসেই নির্দেশ দেন,
বাবা শুধু আলো জ্বেলে দে রে, আলো জ্বেলে দে।
জ্যাঠাইমার কথা শুনে রমেশের ভাবোদয় ঘটে। এসে একা একা ভাবতে থাকে,
বাস্তবিক রাগ করি কাহার উপর। যাহারা এতটাই স্বার্থপর যে যথার্ত মঙ্গল কোথায় তাহা চোখ মেলিয়াও দেখিতে জানে না, শিক্ষার অভাবে যাহারা এমনই অন্ধ যে, কোনমতে প্রতিবেশীর বলক্ষয় করাকেই নিজেদের সঞ্চয়ের শ্রেষ্ঠ উপায় মনে করে, তাহাদের উপর অভিমান করা ভ্রম ছাড়া আর কিছুই হইতে পারে না।
অতঃপর রমেশ পূর্ণদ্যোমে তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকে।
কুঁয়াপুর সহ আশেপাশের সব জায়গায় রমেশের সুনাম ছড়িয়ে পরতে থাকে। অবস্থাদৃষ্টে পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে রমেশ হিন্দুদের দেবতা এবং মুসলমানদের পীর। কিন্তু সমাজে ধর্মের ক্ষেত্রে দেখা যায় হিন্দুরা উচ্চ বংশীয় এবং জমিদার, ব্রাহ্মণ হলেও হিন্দুদেরই জাতভেদ প্রকট। হিন্দুদের মধ্যেই চারটা দল। যদিও মুসলমানেদের মধ্যে এমন দলাদলি কিংবা জাতভেদ লক্ষ্য করা যায় না। লেখক এখানে মুসলমানদের ধর্মকে ‘সজীব’ বলেছেন। আর তাইতো রমেশের কাছে যখন একদিন মুসলমান পাড়ার লোকেরা দলবদ্ধভাবে এসে তাদের সন্তানদের পড়ালেখার জন্য সেখানে একটি মাদ্রাসা নির্মাণের প্রস্তাব করেন তখন রমেশ সেখানে অর্থ দিয়ে সহায়তা করে সেই মাদ্রাসা শিক্ষার সুচনা করেন। তিনি মাঝে মাঝে সেই শিক্ষালয়ে গিয়ে মুসলমানের সন্তানদের পড়ানো শুরু করেন। রমেশ লক্ষ্য করেন জাতভেদ ও উচু জাত নিচু জাত নিয়ে হিন্দুদের মাঝে যে আত্মমর্যাদার লড়াই সেটা মুসলমানদের মাঝে নেই। এখানে সবাই সমান। তারা একেকজনের সুখে- দুঃখে অন্যজন এগিয়ে আসছেন। যা তিনি শিক্ষিত ও উচুজাত দাবী করা হিন্দু ব্রাহ্মণদের মাঝেও দেখেননি। তিনি মুসলমানদের সাথে একাকার হয়ে মিশতে থাকেন। ফলাফলে তাকে একঘড়ে করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং সামাজিকভাবে কোণঠাসা করবার চক্রান্ত গোপনে চলতে থাকলো। উল্লেখ্য যে, এই চক্রান্তের মূল হোতা রমেশের জ্যাঠাতো ভাই বেণী মাধব, পরাণ হাওলাদার, গোবিন্দ গাঙ্গুলী এবং যদু মুখুয্যের মেয়ে রমা। যিনি কুলীন ব্রাহ্মণ ও ক্ষমতাবান জমিদার হলেও রমেশের বাবার সাথে পূর্ব শত্রুতার হেতু বেণী মাধবের প্ররোচনায় তার কাছের মানুষ রমেশের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে থাকেন।
এ চক্রান্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে চলতে থাকলেও কোনমতেই রমেশকে শায়েস্তা করতে পারছিল না। সেবার গ্রামে টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হওয়ায় গ্রামের প্রধান ধান ক্ষেত পানিতে ডুবে যায়। এসব ধানক্ষেত জমিদার রমা মুখু্য্য ও বেণী মাধবের কাছে বর্গা নিয়ে স্থানীয় চাষিরা চাষাবাদ করতো। যদিও সেখানে ছোট কর্তা জমিদার রমেশেরও সমান অংশীদার রয়েছে। ধানক্ষেতের দুই ধারে দুইটি বাঁধ। যার একটি সরকারী এবং পাকা পোক্ত করা অন্যটি বেণী মাধব ও রমা মুখুয্য মিলে দিয়েছেন এবং এর ভিতরে তারা বছরে শ'দুয়েক টাকার মৎস্য চাষাবাদ করেন। গ্রামের সমস্ত চাষা সারাদিন বেণী ঘোষালের পায়ের কাছে কান্নাকাটি করে যখন বাঁধ কেটে দেওয়ার অনুমতি না পেয়ে ব্যর্থ হল। তখন তারা এসে হাজির হল জনদরদী জমিদার রমেশের কাছে। রমেশ চাষাদের কথা শুনলেন এবং দেখলেন মাত্র শ'দুয়েক টাকার মাছের জন্য প্রজাদের সারা বছরের ধান নষ্ট হবে এটা কিভাবে হয়? তিনি তার জ্যাঠাতো ভাই বেণী মাধবের কাছে গেলেন। তিনি তাকে বুঝালেন আমাদের তিন জন মিলে মাত্র দু'শো টাকার ক্ষতি মেনে নিতে পারবো কিন্তু এই প্রজাগুলোর ফসল নষ্ট হলে তারা চরম অর্থকষ্টে ভুগবে। তাদের সন্তানরা না খেয়ে মারা যাবে। তাই তিনি যেন বাধটি কেটে দেওয়ার অনুমতি দেন। কিন্তু বেণী ঘোষাল তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন
ধার-কর্য করে খাবে, নইলে আর ব্যাটাদের ছোটলোক বলচে কেন?
যেহেতু ঐ জলার সম্পত্তি বেণী মাধব, রমা ও রমেশের সম্পত্তি তাই রমেশ অনেক আশা নিয়ে তার প্রিয়তমা রমার কাছে যায় বাঁধ কাটার অনুমতি প্রার্থনার জন্য, কারণ রমেশ মনে করে রমা যদি অনুমতি দেয় তবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ঐ বাঁধ বেণী মাধবের অনুমতি ছাড়াও কাটা যাবে। কিন্তু রমেশ বাঁধ কাটার প্রস্তাব রমার কাছে দিলে রমা জানায়,
না অত টাকা লোকসান আমি করতে পারব না।
রমেশ তাকে পুনরায় অনুনয় করলে রমা ক্ষতিপূরণ দাবী করেন। এতে রমেশ ভয়ানক ক্ষেপে যান এবং তিনি বলেন,
মানুষ খাঁটি কীনা, চেনা যায় শুধু টাকার সম্পর্কে।
অর্থ্যাৎ, রমেশের ভাষ্যমতে কারো সাথে আপনার সম্পর্কের মূল্য কতটুকু তা তখনই ধরা পরে যখন তার সাথে আর্থিক লেনদেন থাকবে, তখন বুঝা যায়। এবং রমেশ রমাকে জানায় সে চাইলেই বেণী মাধব ও রমাকে ক্ষতিপুরণ দিতে পারে কিন্তু সে দিবেনা। কারণ রমারা মানুষের উপর জুলুম করছে। তাই সে রমাকে জানায়, আজ রাতেই সে বাঁধ কাটবে। রমার যদি সামর্থ্য থাকে তবে সে যেন আটকায়। এতে রমা প্রচন্ড অপমানিত হন এবং প্রতিশোধ নেওয়ার আশায় তার প্রজা পাশের গ্রামের মুসলমান আকবর ও তার লাঠিয়াল ছেলেদের নিয়ে বাঁধ পাহাড়ায় বসান। যথারীতি রমেশ ও তার হিন্দুস্থানি চাকর মিলে আকবর ও তার ছেলেদের পরাস্ত করে জলার বাঁধ কেটে দেয়। ফলে অত্র অঞ্চলের চাষারা আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেলেও বেণী মাধব ও রমার রোষানল থেকে রমেশ ও তার হিন্দুস্থানী চাকর রক্ষা পায়না। তার নামে থানায় আর্থিক ক্ষতি ও প্রাণনাশের হুমকী, মারামারি আকবরের মাথা ফাটানো সহ বেশ কয়েকটি মিথ্যা মামলা করেন। রমেশের হিন্দুস্থানী চাকরকে ডাকাতির কেসে জেলে দেন। এদিকে ভজুর মেয়ের বিয়ে আটকানোর ভয় দেখিয়ে ভজুকে দিয়ে রমেশের নামে একটা মিথ্যা মামলা করেন। যেখানে রমা কোর্টে গিয়ে সাক্ষ্য দেন। সেখানে রমা আপাতদৃষ্টিতে কোন মিথ্যা কথা না বললেও তিনি সত্য গোপন করেছেন, ফলে রমেশের ছয় মাস সশ্রম কারাদণ্ড হয়। যদিও এসবের পিছনের মূল চাবিকাঠি নাড়াচাড়া করছিলেন বেণী মাধব ঘোষাল। কিন্তু রমেশের মনে শুধু একটি কথা বারংবার করাঘাত করতেছিল যে রমা এরকমটি কিভাবে করতে পারলো৷ কারণ রমেশের বিশ্বাস ছিল এ সমাজে আর যাই যেটা করুক রমা কখনো খারাপ কিছু করবে না। তখন রমার প্রতি অভিমান ও দুঃখে রমেশ একটিবারও জামিনের জন্য উকিল নিয়োগ করলেন না। সে মনে করল, বাইরের এই নোংরা সমাজের চেয়ে জেলখানা অনেক ভাল জায়গা।
রমেশ জেলে গেল আর হিন্দু জমিদারদের ন্যায় বিচার ও মানবিকতা বিবেচনা করে সকলে তাদের মনে রমেশকে দেবতা ও পীরের আসন স্থায়ীভাবে অলংকরণ করে নিলেন। মুসলমানরা এই পীর তুল্য জমিদার রমেশকে জেলে পাঠানোর শাস্তিস্বরূপ বেণী ঘোষকে শায়েস্তা করবার পরিকল্পনা করেন। কথাটি লোকমুখে বেণী ঘোষালের কানে গেলে সে নিজ গ্রামে পুলিশ ডেকে সেই সকল গোপনে বৈঠককারী দলকে ধরিয়ে দেওয়ার ফন্দি করবন। কিন্তু রমেশের বাল্য বন্ধু ও প্রেয়সী রমা সেটা টের পেয়ে ঐ সকল মুসলমানদেরকে সাবধান থাকতে বলেন। রমেশের অনুপস্থিতিতে বেণী ঘোষাল রমেশের জায়গা জমি দখল করে নেওয়ার প্রস্তাব দিলে রমা তা প্রত্যাখ্যান করে। মুসলমানদের হেনস্তা করা এবং জমি দখলের হীন উদ্দেশ্য ভেস্তে যাওয়ায়, বেণী ঘোষাল ক্ষোভে চারিদিকে রমার নামে রটনা শুরু করে দেন, রমেশের সাথে রমার সম্পর্ক নিয়ে নানান রঙমাখা কথা, রমার মিথ্যা সাক্ষ্যর জন্য আজ রমেশের জেল হয়েছে- এসব বলে বেড়াতে থাকেন। কিন্তু রমেশের প্রিয় প্রজা মুসলমানরা আসল অপরাধীকে চিনতে পারেন এবং রাতের অন্ধকারে একদিন বেণী ঘোষালের মাথা ফাটিয়ে দেন। এদিকে আস্তে আস্তে রমেশকে মিথ্যা মামলায় ফাসানোর মনকষ্টে পীড়িত হয়ে রমা শয্যা গ্রহণ করেন। বেণী ঘোষাল সেই সুযোগে রমার নামে যতো রকমের মিথ্যা ও অপমানকর কথাবার্তা প্রচার করে তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাকে একঘরে করে রাখেন। এমনকি তার ভাইয়ের উপনয়নেও কেউ উপস্থিত হলেন না। অন্যদিকে মুসলমানদের পুনরায় আক্রমণের ভয়ে রমেশের কারাশ্রমের পর বেরুবার দিনে সেখানে সর্বাগ্রে দন্ডায়মান হয়ে দুই হাত প্রসারিত করে আলিংগন করে বললেন,
রমেশ ভাই রে, নাড়ীর টান যে এমন টান, এবার টের পেয়েছি। যদু মুখুয্যের মেয়ে যে আচায্য হারামজাদাকে দিয়ে এভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে এতো দুঃখ দেবে, সে কথা জেনেও যে আমি তখন জানতে চাইনি, ভগবান তার শাস্তি আমাকে ভালমতই দিয়েছেন। জেলের মধ্যে তুই বরং ছিলি ভাল রমেশ, বাইরে এই ছটা মাস আমি যে তূষের আগুনে জ্বলে-পুড়ে গেছি।
এই কথা সেই কথা বলে বেণী মাধব রমেশের মনে রমা সম্পর্কে বিষ ঢুকাচ্ছিলো যাতে করে জেল থেকে ফিরে রমেশ রমার সাথে খারাপ আচরণ করে। আর রমা ইহলোক ত্যাগ করলে রমার সম্পত্তি সে দখল করবে। উপন্যাসে এখানেই পুরুষ শাসিত সমাজে নারী জমিদারের পরাজয় ঘটে। সারা জীবন রমা মুখু্য্য যে বেণী ঘোষালের কথা শুনে তার কাছের মানুষ রমেশের সাথে খারাপ আচরণ করলো, বেণীর কথায় মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে রমেশকে জেল খাটালো, আজ সেই পুরুষে পুরুষে মিলন ঘটলো কিন্তু নারীকে তার চরিত্রের দোষ দিয়ে সমাজ থেকে একঘরে করে রাখলো। রমেশ ফিরে আসায় প্রজাদের মনে যখন আনন্দ উল্লাস শুরু হয়েছে ঠিক এমন দিনে রমার দাসীর কাছে রমেশ জানতে পারে রমা তাকে একটিবার দেখা করতে ডেকেছে। রমেশ সার্থক জমিদার হিসাবে সগৌরবে যখন রমার কাছে যায় তখন রমা ও তার জ্যাঠাইমার কাশীবাসের খবর শুনতে পেয়ে রমেশ যেন স্তম্ভিত হয়ে পরে। তার মুখ থেকে কোন কথা বেড়ায় না। এমতাবস্থায় রমা রমেশের পায়ের কাছে পরে তার দুইটি কথা রাখার দাবী জানায়, একটি তার ছোটভাই যতীনকে রমেশ যেন তার কাছে রেখে রমেশের মতো মানুষ করে তোলে অন্যটি তার বিষয় সম্পত্তি যটোটুকু সে মালিক সেটুকু রমেশের নামে লিখে দিতে চায়। এই শুনে রমেশের চিত্তের সমস্ত কঠোরতা নিমিষেই বিগলিত হয়ে গেল। সে তৎক্ষনাৎ কোন উত্তর না দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলো।
নিরবতা কেটে রমা বললো,
আমার কথা নিয়ে বড়দার সঙ্গে তুমি কোনদিন ঝগড়া করো না।
রমেশ না বুঝে যখন প্রশ্ন করলো এর মানে কী? তখন রমা আবারো নীরবে বললো,
মানে যদি কখনো শুনতে পাও, সেদিন শুধু এই একটি কথা মনে করো, আমি কেমন করে নিঃশব্দে সহ্য করে চলে গেছি- একটি কথাও প্রতিবাদ করিনি।
এভাবে পুরুষ শাসিত সমাজে একজন নারীর হেরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে লেখক উপন্যাসের যবনিকা টানেন। তবে উপন্যাসে তিনি পুরুষ হয়েও নারীর চোখে সমাজের যে অত্যাচার অনাচারের বর্ণনা ফুটে তুলেছেন তা অসাধারণ।
পরিশেষে বলা যায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শুধু নারীর স্নেহশীলতা ও মানবিক হৃদয়াবেগের রূপকার নন, সামাজিক তথা জাতীয় অনাচার ও সংকটেরও সার্থক রূপকার। তিনি এ সংকটকে শুধু বর্ণনাদানই করে ক্ষান্ত হননি, সংকট নিরসন চেষ্টার উপায় নির্দেশ করে গেছেন।
উপন্যাসটি সাধু ভাষায় রচিত এবং বর্তমান বাস্তবতা হলো সেই পল্লী সমাজ এখন আর ঠিক সেভাবে নেই। তাতে এসেছে কিছু পরিবর্তন। উপন্যাসটি পড়লে যে কারো ভালো লাগবে তাতে সন্দেহ নেই।
শব্দশিল্প প্রকাশনীর প্রকাশিত ১১০ পৃষ্ঠার উপন্যাসটির প্রকাশক মোঃ শরিফুর রহমান। প্রকাশকাল ২০১১ এবং উপন্যাসটির গায়ের মূল্য ১২০ টাকা।
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম